ইতিহাসের প্যারিসে অলিম্পিক্সের উৎসব
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
“ইজ পারি বার্নিং?” প্যারিসের হোটেল থেকে বেরিয়েই প্রশ্ন শুনে চমকে ফিরে তাকাই লিমুজিন ক্যাব চালিকা-কাম-গাইড ডরোথির দিকে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। প্যারিসের ইতিহাস দেখতে বেরিয়েছিলাম দেড় দশক আগে। আজ তেত্রিশ তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিয়াডের আসর বসেছে এই শহরে। তৈরি করল অভিনব উদ্বোধনী ইতিহাস শান্তির প্রতীক অলিম্পিক শিখা সহ স্যেন নদীতে ভাসমান মার্চ পাস্ট করে। ঠিক একশো বছর আগে এমনই অলিম্পিয়াডের আসর বসেছিল প্যারিসে আর তখনও ছিল চমক, অলিম্পিক্সের ইতিহাসে তৈরি হয়েছিল প্রথম অলিম্পিক্স ‘ভিলেজ’। ইতিহাসের শহর সুযোগ পেলেই ইতিহাস সৃষ্টিতে মেতে ওঠে। 
স্যেন নদী
খ্রিস্টপূর্ব আড়াইশো বছর আগে এই স্যেন নদীর আশেপাশে বসতি গড়েছিল পারিসি নামে সেলটিক উপ-জনজাতি, তাদের নামেই শহরের নামকরণ। তখন নদীর জল ছিল পানযোগ্য। এখন হরেক ব্যাকটিরায় এত দূষিত যে সাঁতারের কিছু প্রতিযোগিতা করা সম্ভব হোল না। আশা আছে এমাসের ৮ ও ৯ তারিখে ম্যারাথন সাঁতার প্রতিযোগিতা করা সম্ভব হবে, প্রশাসন জোর কদমে চেষ্টা চালাচ্ছে ব্যাকটেরিয়া-মুক্ত করার। দুশো বছর পর রোমানরা পারিসিদের তাড়িয়ে দিয়ে নতুন নাম দেয় লুটেসা কিন্তু তারা চলে যেতেই প্যারিস নাম ফিরে আসে। স্যেন নদীতে তরী ভাসালে দুপাশে ছড়িয়ে আছে প্যারিস শহর গড়ে ওঠার ইতিহাস। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্সের এই খেলার আয়োজন হয়েছে সেইসব ঐতিহাসিক স্থানেই যাতে শহরের ইতিহাসের সাথে মিলেমিশে যায় খেলার উৎসবের ইতিহাস।
আইফেল টাওয়ার
ফরাসি দেশকে চেনায় আইফেল টাওয়ার, বিশ্বজোড়া এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের খ্যাতি। স্যেন নদীর তীরে ১৮৮৯ সালে গুভাস্তে আইফেল নির্মিত ৩৩০ মিটার উচ্চতার এই সুপ্রসিদ্ধ স্থানে আয়োজন করা হয়েছে বিচ ভলিবল খেলার প্রতিযোগিতা। আইফেলের সামনের সবুজ গালিচার বাগান শ্যাম্প দ্য মার্স, রোমান দেবতা মার্স বা মঙ্গলের নামে উৎসর্গীকৃত, যেখানে খেলা হবে জুডো এবং কুস্তি। আড়াইশো খৃস্টাব্দের সেন্ট ডেভিস স্মরণে তৈরি হয়েছিল পাহাড়ের উপর মন্টমার্ত্রে গ্রাম। ১৮৭১ সালে ফরাসি-প্রুস যুদ্ধের মৃত ফরাসি সৈন্যদের স্মরণে উনিশ শতকে নির্মাণ হয়েছিল শ্বেতগম্বুজযুক্ত স্যাক্র-কোউর মনোমুগ্ধকর ব্যাসিলিকার বাড়ি। পিকাসো এবং ডালি সমেত অনেক শিল্পীর বাস ছিল এই পাহাড়ের গ্রামে। এখান থেকে প্যারিস শহরের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ্য। পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল পথে গাড়ি নেমে গেল শহরে। পথে দেখা যায় ১৮৮৯ সালের নাচ-গানের বিনোদন ক্ষেত্র বিখ্যাত মুলা রুজ, আজও সমান আনন্দ দিয়ে চলেছে। শহরের রাস্তা চওড়া আর সবুজ গাছ দুপাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি এবং দেহ শীতল রাখছে। এত সবুজ মনে হয় যেন আগুনের রঙ বদলে গেছে। এই রাস্তা দিয়েই চলবে সাইক্লিং প্রতিযোগিতা।
🍂
প্রশস্ত রাস্তার পাশে পায়ে-চলা চওড়া পথ, সেখানে ক্যাফের দোকানের চেয়ার বাইরে রেখে চলছে জমিয়ে আড্ডা। এরকমই এক বিখ্যাত রাস্তা শ্যাম্প এলিসিস। এরই পূর্ব প্রান্তে কনকর্ড স্কোয়্যার, বিখ্যাত জনপ্রিয় জনসমাবেশের জায়গা। কিং লুই পঞ্চদশের অশ্বারোহিত মূর্তি শোভাবর্দ্ধন করছে। আর পশ্চিমে বিখ্যাত আর্ক দ্য ট্রিউম্ফ, ফরাসি বিপ্লব এবং নেপোলিয়ন যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভ। ১৭৭২ সালে তৈরি কনকর্ড স্কোয়্যার ছিল ফরাসি বিপ্লবীদের গিলোটিন করার স্থান। বিপ্লবের শেষে ষোড়শ লুই ও রানিকে এখানেই গিলোটিনে হত্যা করা হয়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এই স্থান নতুন করে সাজানো হয়। এই জায়গাতেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এবারের অলিম্পিক্সে নতুন সংযোজন ব্রেকিং ইভেন্ট অর্থাৎ ব্রেক-ডান্স। বাস্কেটবল খেলার আয়োজন করা হয়েছে এখানেই। শ্যাম্প এলিসিস আর স্যেন নদীর মাঝে গ্রাঁ প্যালেস, কাঁচের ছাদ বা ‘গ্লাস রুফটপ’এর জন্য জগদ্বিখ্যাত। এখানেই হবে ফেন্সিং ইভেন্ট।
রিভোলি স্ট্রীট দিয়ে যাওয়ার সময় ডরোথি ইতিহাসের সারণী বেয়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের যুগে নিয়ে চলে গেল। প্যারিস শহরের বুক চিরে এই রাস্তা নেপোলিয়নেরই তৈরি। ১৭৯৭ সালে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে রিভোলি যুদ্ধে জয়লাভের স্মারক এই রাস্তা। জোয়ান অব আর্কের মূর্তি এবং ভেনডোম স্তম্ভ শোভিত এই জায়গা। নারী হয়ে পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আর্কের চিতাভস্ম স্যেন নদীতে ভাসানো হয়েছিল। ইতিহাস বলে রাজনৈতিক কারণে ভেনডোম স্তম্ভ ১৮৭১ সালে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে আবার তৈরি করা হয়। লুভ্র মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে চলে গেলাম সেন্ট লুই আইল্যান্ড। লুভ্রে কোন ইভেন্ট নেই কিন্তু যারা খেলায় যোগ দিতে আসবেন তারা কি ভাবে লুভ্রের মোহময়ী আকর্ষণ এড়াবেন? আসতেই হবে মোনালিসা শোভিত বিশ্বখ্যাত এই মিউজিয়ামে। একদা ফ্রান্সের দ্বাদশ শতকের দ্বিতীয় ফিলিপ অগাস্টাসের প্রাসাদ-দুর্গ পরিবর্তিত হয় জন-প্রদর্শশালায় আঠারো শতকে। বিশ্বখ্যাত ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পীদের সংগ্রহ ছাড়াও রয়েছে নবপ্রস্তর যুগ থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গ্রিক মিশর রোমান ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার প্রাচীন নানাবিধ প্রত্নসামগ্রী। বর্তমানে নব-আধুনিকতায় সজ্জিত সেন্ট লুই দ্বীপ ইওরোপে মধ্যযুগে নানা ঘটনাবলীতে ইতিহাস প্রসিদ্ধ। ফরাসি বিপ্লবের সময় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় স্যেন নদীর মাঝে এই প্রাকৃতিক দ্বীপ। এখান থেকে চলে গেলাম স্যেন নদীর অন্য দ্বীপে নতরদাম গির্জা দর্শনে। মাতা মেরীকে উৎসর্গীকৃত মধ্যযুগীয় এই ক্যাথেড্রাল গির্জা গোথিক স্থাপত্যের উৎকর্ষ উদাহরণ।
লুভ্ রে ভিঞ্চির ছবি
১৯৬৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দ্য গোলের রক্ষণশীল সমাজ শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। বিক্ষোভে যোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ৩-রা মে এই নতরদামের পাশ দিয়েই হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্রের দল বিক্ষোভ দেখায়, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। পরদিন ব্যারিকেডে ছেয়ে যায় প্যারিস। শ্রমিকেরা অধিকার ও মজুরির দাবীতে আন্দোলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলন এত বিস্তার লাভ করে যে জাঁ-পল সার্ত্র পর্যন্ত প্রভাবিত হয়ে সমর্থন করে। আকৃষ্ট হয় মিশেল ফুকো, জাঁ-ল্যুক গোদার, ত্র্যুফো, লুই মাল ইত্যাদি প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। আন্দোলনের তীব্রতায় সেবছর কান চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করে দেওয়া হয়। মে মাসের শেষে দ্য গোল ফ্রান্স ছেড়ে পশ্চিম জার্মানি পালিয়ে যান। পাঁচ বছর আগে অগ্নিকাণ্ডের পর এই গির্জা বন্ধ, কোনো ইভেন্টও নেই এর কাছাকাছি। 
লুভ্ রে ভাস্কর্য
প্যান্থিয়ন এবং লুক্সেমবার্গ উদ্যান ঘোরার সময় নেপোলিয়নের আরও অনেক কাহিনী শুনতে শুনতে অবশেষে এসে পৌঁছলাম নেপোলিয়নের স্মৃতিস্তম্ভের কাছে। জায়গাটার নাম লে ইনভ্যালিড্স অর্থাৎ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত সেনাব্যক্তিদের থাকা ও উপাসনা করার জায়গা। সতেরো শতকে নির্মিত আহত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের জন্য বাড়ি হাসপাতাল সেনা-মিউজিয়াম প্রার্থনাস্থল ইত্যাদি নিয়ে একটা বিশাল কমপ্লেক্স। ১০৭ মিটার উচ্চতার গম্বুজাকৃতি গির্জা এবং তার ভেতরের অলংকৃত দেওয়াল বিশেষ দ্রষ্টব্য। নেপোলিয়ন স্তম্ভ ১৮৪০এ শুরু হয়ে ১৮৬১ তে সম্পূর্ণ হয়। ভেতরে বহু অলঙ্কৃত চিত্রের মধ্যে ১৮০৪ সালে অভিষেকের চিত্রখানি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বর্তমান অলিম্পিক্সের ম্যারাথন দৌড়ের শেষ সীমা রাখা হয়েছে এখানে। সাইক্লিং রাস্তা ছাড়াও আর্চারি বা তীরন্দাজ ইভেন্ট হচ্ছে এখানেই।
লে ইনভ্যালিডস
প্রতিবারের মত এই অলিম্পিক্স শেষ হলেই শুরু হবে প্যারালিম্পিক্স, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ অলিম্পিক্স। যে দেশ অশক্ত ব্যক্তিদের জন্য এত আগে থেকে চিন্তা করে তাদের বিশেষ ব্যবস্থা করে সেখানে প্যারালিমপিক্সের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ থাকেনা। প্যারিসে সব স্থাপত্য ইমারতেই রয়েছে হুইলচেয়ার চলাচলের সুব্যবস্থা এবং দৃষ্টিহীন ও শ্রবণহীন ব্যক্তিদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা। ফলে সব ধরনের লোকেদের জন্যেই প্যারালিম্পিক্স উপযুক্ত হবে।
অতিমারির জন্য বত্রিশতম টোকিয়ো অলিম্পিক্স শুরু হয় এক বছর পরে, দর্শকহীন ছিল মাঠ কিন্তু খেলোয়াড়দের মধ্যে উৎসাহ কম ছিল না। টিভিতে দেখেছে লক্ষ লক্ষ লোক। প্যারিস অলিম্পিক্স শুরু হয়েছে ফ্রান্সে অস্থায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে। বানচাল করার হুমকিও ছিল। কিন্তু ২০৬ দেশের ১১০৪০ প্রতিযোগী ৩২৯ ইভেন্টে অংশগ্রহণ করছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ খেলার আসরে, এ বড় কম কথা নয়। ডরোথির সঙ্গে এখন দেখা হলে ওঁর প্রশ্নের উত্তর দিতাম, “পারি ইজ সিজলিং ইন অলিম্পিক্স ফিভার”।
0 Comments