আর জি কর ও সাহেব আলি
সৌমেন রায়
চিত্র – সুকন্যা চক্রবর্তী
আর জি কর হসপিটালের মহিলা ইন্টার্ন ডক্টর এর উপর পাশবিক অত্যাচার এবং হত্যার কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে । কি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে মেয়েটি। বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয় আমাদের। সেই লোকগুলি কি আদৌ মানুষ ? আদৌ মানবাধিকার তাদের আছে ? মেয়েটির বাবা-মা কি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তা চিন্তারও অতীত ! স্বাধীনতার সমসাময়িক সময়ে মনে প্রশ্ন জাগে যে সব মহাপ্রাণ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন তারা কি ভুল করলেন? আমরা যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছি সে আত্মবলিদানের? নাকি কষ্টে পাওয়া স্বাধীনতা কিছু লম্পটের হাতে তুলে দিচ্ছি ক্ষুদ্র স্বার্থে?
ঘৃন্য ঘটনাটির পরবর্তী ঘটনাক্রম বিষয়ে সকলেই অবগত আছেন। আলাদা করে বিশেষ কিছু বলার নেই। তদন্তের আগেই পুলিশের আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা, সি বি আই নির্দেশ হওয়ার পর সংলগ্ন অঞ্চলে ভাঙাভাঙি এসব আমাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। অধ্যক্ষের বদলিতে টালবাহানা, সকালে বদলি বিকেলে অন্যত্র বহাল এসবই ঘুঘুর বাসার ইঙ্গিত দেয়। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অপরাধীর ফাঁসি চেয়েছেন। সাংবিধানিক প্রধান পদে থেকে এমন একটি কথা তিনি কেন বললেন তাও চিন্তার। সুষ্ঠুভাবে তদন্ত হলেই যেখানে সমাধান হতে পারে সেখানে আগ বাড়িয়ে ফাঁসির কথা বলার প্রয়োজনীয়তা কি? তিনিও কি ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস হারাচ্ছেন? কিম্বা আবেগের বশে তিনি হয়ত সাময়িকভাবে প্রশাসনিক পদটি ভুলে আমাদেরই মতো প্রান্তজনের ভাষা বলেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন এই বিষয়গুলি নিয়ে নয়। এগুলি তো আলোচনা চলছেই। সে চলুক। প্রশ্ন আমাদের সমাজে এত অন্যায় কেন? নারীদের উপর এত নৃশংস অত্যাচার কেন? আমাদের সমাজ ছোট থেকে শুনিয়ে আসছে যে নারী মায়ের মত। অপরিচিত নারীকে মা, বোনের মতো দেখাই তো সমাজ আমাদের শিখিয়েছে। আমাদের দেব-দেবীদের মধ্যে সম্ভবত দেবীরাই প্রধান। সেখানেও তো একজন নারী মা হিসেবে পূজিতা। কোথাও রক্ষাকারী, কোথাও বিনাশকারী কোথাও বিদ্যা, ধন প্রদায়িনী। তাও আমাদের দেশে নারীদের উপর এত অত্যাচার কেন? যেখানে এত দেবী নেই , যৌনতা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি রকমের লুকোছাপা নেই সেখানেও হয়তো অপরাধ হয়। কিন্তু এত নৃশংস অপরাধ কি হয়? মনে হয় না। (গুগলের তথ্য দেখে বিভ্রান্ত না হওয়াই ভালো। পরিসংখ্যান শুধুমাত্র নথিভুক্ত অপরাধের কথা বলে) তাহলে কি আমাদের ছোট থেকেই নীতি শিক্ষা, মায়ের মত দেখতে শেখানো এর মধ্যেই কোন বাধ্যবাধকতা আছে? আমাদের মধ্যে কি স্বাভাবিকভাবেই এর বীজ বিদ্যমান? আমাদের মনের অন্তঃস্থলে কি নারী মায়ের জাতি বলে বিশ্বাসটুকু নেই। তাই কি আমাদের ছোট থেকেই ধরে ধরে পাখি পড়ার মতো শেখাতে হয় মেয়েদের মা বলে মনে করবি রে! বোন বলে মনে করবি রে! কিন্তু হায় শেকড়ের অভাবে মনে করা আর হয়ে ওঠেনা!
ঘটনার পর চারিদিকে একটা রব উঠছে যে স্কুলে আমাদের নীতি শিক্ষা দেওয়া উচিত। পরিবারের মধ্যেই এমন শিক্ষা দেওয়া উচিত যা শিশুর নীতিবোধ শক্তিশালী করবে। ছোট থেকেই সে ন্যায়-অন্যায় বোধ গড়ে তুলতে পারবে। নীতিশিক্ষা দেওয়া উচিত সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যি কি পারিবারিক শিক্ষা, বিদ্যালয়ে নীতিশিক্ষা দিয়ে এসব অন্যায় বন্ধ করা যাবে? সেই সূক্ষ্ম শিক্ষার কি ক্ষমতা আছে বৃহত্তর সমাজের অযুত অন্যায়, অর্থের প্রলোভন, ক্ষমতার দম্ভ এসবের ভার সহ্য করার? যে শিক্ষা শ্রেণীকক্ষে, বাবা-মার কাছে পাওয়া যায়, পরিবারের মধ্যে পাওয়া যায় তা কি বৃহত্তর সমাজের বিরাট, ব্যাপক, বিস্তীর্ণ অন্যায়ের ভূমিতে গিয়ে সত্যিই অঙ্কুরিত হতে পারবে? হয়ত পারে কখনো কখনো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে হয় ব্যর্থ হয়। সন্দেহ হচ্ছে ? পুনের ডাক্তার দম্পতির কথা ভাবুন। তাদের সতেরো বছরের সন্তান মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে হত্যা করলো দুই নিরপরাধকে। ছেলে যাতে ধরা না পড়ে সেজন্য তারা সত্তর হাজার টাকার বিনিময়ে অন্য একজন ডাক্তারের কাছ থেকে ছেলের নকল ব্লাড রিপোর্ট সংগ্রহ করলেন। আপনার কি মনে হয় এই তিনজন ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্ট কেউই ছোটবেলায় নীতি শিক্ষা পাননি? আমাদের সমাজে নৈতিকতা আসলে দুর্বলের অবলম্বন।
সাহেব আলি‘র কথা বলে শেষ করব। কারণ বিষয়টি এতটাই মর্মস্পর্শী, হৃদয়বিদারক যে দুটো কথা লিখতেও মন অবশ হয়ে আসছে। একদিন ক্লাস সিক্সের সাহেব আলির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলো ক্লাসের মধ্যে । আজ এতদিন পরে সে অভিযোগটি কি সেটি সঠিকভাবে মনে নেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন বাবা তুই অন্যায়টা করেছিস? দেখ যদি করে থাকিস তাহলে এটা তো খুবই খারাপ কথা। ওই ছেলেটি তো দুঃখ পেয়েছে, আরো সকলে কেমন চুপ হয়ে গেছে দেখ। তুই তো ভালো ছেলে। তুই কি এমন করেছিস? সাহেব বলল না স্যার আমি এমনটা করিনি। মাথায় হাত রেখে শিক্ষক বলেছিলেন ঠিক আছে সাহেব আমি তোকে বিশ্বাস করছি। ধরে নিচ্ছি তুই করিসনি। তবে যদি করে থাকিস তাহলে সংশোধন করে নিস । আর কখনো করিস না বাবা । যার উপর অন্যায় হয়েছিল তাকেও কোনভাবে শান্ত করেছিলেন। কিভাবে ঠিক মনে করতে পারছেন না । একদিন পর করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ সাহেব পিছন থেকে ছুটে এলো। শিক্ষক শুধালেন কিরে? মাথা নিচু করে দাঁড়ালো সাহেব। বলল স্যার আগের দিন আমি মিথ্যা কথা বলেছিলাম। অন্যায়টা আমিই করেছি। সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি । বলেছিলেন তোর বন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস। ক্ষমাও চেয়েছিল। সাহেব আলি পড়াশোনাতে মোটেও ভালো ছিল না। বছর তিন চারের মধ্যে পড়া ছেড়ে কাঠের কাজে যোগ দিয়েছিল। কাজে যোগ দেওয়ার বছর দুই পরে দেখা করতে এসে আর একবার বক্ষলগ্ন হওয়ার আবদার করেছিল শিক্ষকের কাছে। ভালোবেসে, বিশ্বাস করে তার মধ্যে যে মিথ্যে বলার জন্য অনুশোচনা জাগানো গেছিল সেটি কি বৃহত্তর সমাজে গিয়ে বেঁচে থাকবে? বাস্তবের খর রৌদ্র, ঝড়, দারিদ্র ,প্রলোভন, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, অন্যায়ের ধারাপাত তাকে কি সরল থাকতে দেবে? সন্দেহ জাগে। আমরাই যেন ক্রমশ আমাদের শত্রু হয়ে উঠছি। সততা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা ধীরে ধীরে যেন ‘বোকাদের’ অভিধানে ঢুকে পড়ছে।
3 Comments
বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম প্রথম আত্মহত্যা বলে পরিবারের কাছে ফোন গিয়েছিল হসপিটাল থেকে।অসাবধানতা বশত ওটি পুলিশ লেখা আছে।এই ত্রুটির জন্য দুঃখিত।
ReplyDeleteপ্রায় সকল মা তাঁর কন্যা সন্তানকে ঘিরে যে ধরনের উৎকণ্ঠায় থাকেন, পুত্র সন্তান থাকলে তাকে নিয়েও কি একই রকম দুশ্চিন্তায় থাকেন? মেয়েকে যেভাবে নিজের উপর সতর্ক থাকার পাঠ দেন সেভাবে কি কখনো তার ছেলেকে মেয়েদের প্রতি আচরনের বিশেষ কোন পাঠ দেন?
ReplyDeleteনা,সেভাবে দেন না।আমাদের সমাজে যৌনতা নিয়ে লুকোছাপা চলে।সেই কারণেই হয়ত মায়েরা বলেন না।শেখানো উচিত।
Deleteএই ভিন্ন দৃষ্টিকোনটি তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।