দূর দেশের লোক গল্প ২০৫—মঙ্গোলিয়া (এশিয়া)
উট আর ইঁদুর
চিন্ময় দাশ
[এশিয়ার একটি দেশ মঙ্গোলিয়া। সেদেশের বৌদ্ধ মঠগুলিতে চান্দ্র ক্যালেণ্ডার মেনে চলা হয়। সে ক্যালেণ্ডারে ১২টি জীবজন্তুর নামে ১২টি বছরের নামকরণ করা আছে। সেগুলি আবার ক্রমান্বয়ে পুরুষ এবং স্ত্রী হিসাবে সাজানো। এছাড়া, জগতের ৬টি জিনিষকে প্রতিনিধিত্ব করে বছরগুলি। যেমন—বৃক্ষ, আগুন, মাটি, লোহা, জল এবং বায়ু। পৃথক পৃথক রঙও নির্দিষ্ট আছে তাদের—সবুজ, লাল, ধূসর, কালো, নীল এবং সাদা।
১২টি বছর এক একটি জীবের নামে চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু এতো জীব থাকতে, কীভাবে মাত্র ১২টি জীবকে বেছে নেওয়া হয়েছে? তাই নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে মঙ্গোলিয়া এলাকায়। সেই গল্পই আজ এখানে শুনব আমরা। ]
অনেক কাল আগের কথা। তখন ১২ মাসের বছর চালু করেছেন বিধাতা। দিন, মাস, বছরের আলাদা আলাদা হিসাব চালু হয়েছে।
একদিন বিধাতার মনে হোল, যুগ চালু করবেন। তাতে লম্বা সময়ের হিসাব রাখতে বাড়তি সুবিধা হবে। তার সাথে, হিসাব করবার ভালো মতন একটা ছকও তৈরি হবে।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। একটা সভা ডেকে দিলেন বিধাতা। মনের ভাবনা হোল, যা করতে চলেছেন, সবাইকে জানিয়েই করবেন।
বনের যত জীব, সবাই এসে হাজির হয়েছে। বিধাতা বললেন—শোন, সবাই। দিন, মাস আর বছরের পঞ্জিকা তৈরি করে দিয়েছি। জানো সবাই তোমরা। একটা নতুন হিসেব যোগ করব তাতে।
--কী হিসাব, ঠাকুর? কী হিসাব? সবারই কৌতুহল। সবাই চঞ্চল।
বিধাতা বললেন— দিন থেকে মাস-বছর পর্যন্ত হিসাব তো তোমাদের বলে দিয়েছি। এবার ১২ বছরের একটা যুগ চালু করব ভেবেছি।
--কেন, ঠাকুর? নতুন একটা যুগ চালু হলে, লাভটা কী?
--লাভ হোল, হিসেবের সুবিধা। চালু হোক, তখন ভালো করে বুঝতে পারবে।
বিধাতা বুঝিয়ে বললেন—অনেক লম্বা সময়ের হিসেবও করতে হয় আমাকে। এই যে যুগ চালু করছি, তাতে হিসেবের সুবিধে হবে। যাকগে, পরে বুঝতে পারবে সবাই। এখন যা বলছি, মন দিয়ে শোন।
আবার নতুন কিছু বলবেন বিধাতা। সবাই কান পেতে রইল।
🍂
আরও পড়ুন 👇
বিধাতা বললেন—একটা যুগে থাকবে ১২টা বছর। যেমন একটা বছরে আছে ১২টা মাস। আমি ভেবেছি, সেই ১২ বছরের সব ক’টার আলাদা আলাদা নামও দেবো একটা করে। তাতে বছরটা বোঝাতে সুবিধা হবে।
--কী নাম দেবেন, ঠাকুর? অনেকেই জানতে চাইল।
শুনে, বিধাতার মুখে হাসি—ঠিক করেছি, নাম দেব তোমাদের নামেই।
সবাই খুশি। বনের জীব তারা। তাদের নামে বছরের নাম হবে। বেশ গর্বের কথা। সিংহ হোল বনের রাজা। সে বলল—কিন্তু ঠাকুর, বনে তো অনেকেই আছি আমরা। তোমার হাতে বছর তো মাত্র ১২টা। কাকে ছেড়ে, কার নাম রাখবে?
বিধাতা হাসি মুখ করে বললেন—সে জন্যই তো তোমাদের ডেকেছি। যাতে কারও মনে কষ্ট না হয়। যাতে কেউ অভিযোগ করতে না পারে। যাইহোক, একটা উপায় বের করেছি। সেইটা শোন সবাই মন দিয়ে।
--আজ এখন সবাই নিজের নিজের ডেরায় ফিরে যাও। সকালে আবার এখানে এসে হাজির হবে। যে ১২ জন প্রথমে এসে পৌঁছাবে, ১২ বছরের নাম হবে তাদের নামেই।
বাহ, বেশ ভালো উপায়। সবাই খুশি। সবাই ফিরে চলল মুখে হাসি নিয়ে।
পরের দিন। বিধাতা এসে গেছেন সূজ্জিমামা ভালোমতন উঠবার আগেই। খানিক বাদেই বিভিন্ন জনের মুখ দেখা যেতে লাগল।
আসলে সবাই তো আর এক জায়গায় থাকে না। সবার ডেরা এখান থেকে সমান দূরত্বে নয়। তাছাড়া, সবার হাঁটা-চলার গতিও সমান নয়। চাইলেই পৌঁছে যাওয়া যায় না।
বিধাতা গুণে দেখছেন ১২ জন কখন এসে হাজির হয়। সেই ১২ জনের নামে ১২টা বছরের নাম রাখবেন তিনি।
প্রথম এলো হনুমান। তাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। তারপরে এলো বুনোমোষ।। হনুমানের পরে দাঁড় করালেন তাকে। এইভাবে পর পর বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ভেড়া, মোরগ, কুকুর আর শুকর এসে হাজির হয়েছে।
এক এক করে ১১ জন এসে গিয়েছে। এবার কেউ একজন পৌঁছোলে, কাজ শেষ হয়।
তখনই এক উটকো ঝামেলা। এবার দেখা গেল, একজন নয়, দু’জন এসে হাজির। একটা উট, আর একটা ইঁদুর। এসেছেও তারা একেবারে এক সাথে। কেউ আগে নয়, কেউ পিছে নয়। যেন হাত ধরাধরি করে এসে পৌঁছলো দুটিতে।
মহা মুশকিলে পড়লেন বিধাতা। কাকে নিয়ে, কাকে বাদ দেবেন। দুটিই তারা তাঁর নিজের হাতে গড়া জীব। কেউ ভালো বা কেউ মন্দ—এমনটা নয়। সব জীবই তাঁর কাছে সমান। দুজনেই এরা যুগের নাম হিসাবে সমান যোগ্য।
অনেক ভাবলেন। মাথাও চুলকালেন অনেক। শেষে একটা উপায় এলো মাথায়। বললেন—শোন, একটা যুগের নাম বাকি আছে আর। কিন্তু এরা দুজনে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু একটা নামের জন্য, দুজনকে তো আর নেওয়া যাবে না। একজনকেই নিতে হবে।
সবাই সায় দিল বিধাতার কথায়। কিন্তু কারও মাথায় ঢুকছে না, কাকে ছেড়ে কাকে নেওয়া হবে।
এক্টুখানি থেমে, বিধাতা বললেন—তোমাদের দুজনের মধ্যে কাকে নেওয়া হবে, তার একটা উপায় ভেবেছি। আকাশে সূর্য ওঠা দেখার প্রতিযোগিতা হবে। দুজনে তোমরা যেখানে খুশি যাও। যেখান থেকে খুশি দ্যাখো। কী ভাবে, বা কোথা থেকে দেখবে, সেটা তোমাদের ব্যাপার। কাল সকালে যে প্রথম দেখবে সূর্য উঠেছে, সে সোজা এখানে এসে আমাকে জানাবে। তাকেই নেওয়া হবে শেষ নামের জন্য।
সবাই ফিরে গেল যে যার ডেরায়।
উট ভাবল, সূর্যের ওঠা প্রথম দেখা যাবে কোনও উঁচু যায়গা থেকেই। এখানে চার দিকেই ছোটবড় পাহাড়। কিন্তু চেহারা বড় হলে কী হবে, পাহাড়ে চড়া উটের পক্ষে সোজা কাজ নয়। ছোট মতো একটা টিলা বেছে রাখল মনে মনে। ভোর না হতেই, টিলার মাথায় গিয়ে হাজির হয়ে যাব।
এদিকে, ইঁদুর বেচারা সারা দিন সারা রাত ভেবে ভেবে হয়রান। এইটুকু মাথা তার। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না, কোথায় গেলে সূর্য ওঠা আগে দেখা যাবে। সে করেছে কী, রাতের অন্ধকার থাকতেই, উটের ডেরায় গিয়ে হাজির হয়ে গেছে। দেখা যাক, উটদাদা কী করে।
এইটুকুন চেহারা ইঁদুরের। একটু আড়াল খুঁজে নিয়ে, ঘাপটি মেরে বসে রইল।
সবে ভোর হয়েছে। উট বের হোল তার ডেরা থেকে। ইঁদুর চলল তার পিছু পিছু। উট তার ফন্দি মতো, সেই টিলায় গিয়ে উঠে পড়ল। সূর্য উঠবে পূর্বদিক থেকে। সেদিকেই মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল উট।
ইঁদুরও হাজির হয়ে গেছে টিলায়। চেহারায় পুঁচকে হলে কী হবে, তার মগজ ভালোই কাজ করে। সে করল ঠিক তার একেবারে উল্টোটা। উট দাঁড়িয়েছে পূর্বদিকে মুখ করে। ইঁদুর করল কী, উটের পিছনে গিয়ে, বসে পড়ল। অবাক কাণ্ড। পূর্বদিকে নয়, পশ্চিম দিকে ছিল বড়সড় এক পাহাড়। সেদিকেই মুখ করে বসে রইল ইঁদুর।
দেখতে দেখতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এল। ভোর হয়ে আসছে। আলো হয়ে যাচ্ছে চার দিক। উট অপেক্ষা করে আছে, এবার মাথা তুলবে সূর্য।
আর, পশ্চিমে মুখ করে বসা ইঁদুর? সে বসেছে অনেক চিন্তা ভাবনা করে। পাহাড়ি এলাকায় সকালের প্রথম রোদ এসে পড়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায়। সূর্য তখন দেখাই যায় না। সেই হিসাব কষেই, পশ্চিমে মুখ করে বসে আছে সে।
বেশি সময় লাগল না। রোদ এসে পড়ল উঁচু পাহাড়ের মাথায়। কাঁচা সোনার মতো রঙ সে আলোয়। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল ইঁদুর—রোদ উঠে গেছে। রোদ উঠে গেছে। আমি দেখে নিয়েছি।
উট বেচারা চমকে উঠেছে। পিছন ফিরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ইঁদুরের নাচন-কোদনের দিকে। চেয়ে দেখল, সত্যিই রোদ পড়েছে পাহাড়ের গায়ে।
পূব দিকে তখনও সূর্যের দেখা নাই। পিলপিল করে দৌ লাগাল ইঁদুর। বিধাতাকে বলল—ঠাকুর, সুজ্জ উঠে গিয়েছে। নিজের চোখে রোদ দেখে এলাম আমি।
খানিক বাদেই উট এসে পৌঁছালো। এত্তোবড় চেহারা তার। গলাখানা ইয়া লম্বা। বিধাতা দেখলেন, মাথাখানা ঝুলে পড়েছে বেচারার। মুখ ভার। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। রা-টিও কাড়ল না মুখে।
সবাই বুঝে গেল, ইঁদুর জিতেছে। বিধাতাও বুঝে গেলেন। প্রত্যেক যুগের শেষ মাসের নাম ইঁদুরের নামেই করে দিলেন বিধাতা। দবাই আনন্দে হই হই করতে লেগেছে।
সবার চেয়ে ছোট জীব ছিল ইঁদুর। উট সবার বড়। তাকে হারিয়েও, মনে ফূর্তি নাই ইঁদুরের। তা দেখে, বিধাতা বললেন—কীরে, মুখ ভার কেন তোর?
ইঁদুর বলেই ফেলল—উটের মতো বড় জীবের সাথে লড়ে জিতে গেছি, তার কোন পুরষ্কার দেবেন না আমাকে?
খুব এক চোট হাসলেন বিধাতা। শেষে বললেন—ঠিক আছে দেব। ছোট্ট শরীর তোর। আজ থেকে শরীরের চেয়ে তোর লেজ হয়ে যাবে বড়। আর, বড় শরীরের উটের লেজ ছোটই থেকে যাবে।
সবাই মজা করতে করতে ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের ডেরায়। উট করল কী, মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। পিঠ রগড়াতে লাগল জোরে জোরে। তাতে মনের জ্বালা যদি একটুও দূর করা যায়—এই ভেবে।
সেই অভ্যাস আজও রয়ে গেছে উটের। মাঝে মাঝেই মাটিতে পিঠ ঘসে নেয় তারা। আর, ইঁদুরের লেজটা যে বেশ লম্বা, সে তো সবাই দেখতে পাই।
0 Comments