বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩৭
লজ্জাবতী
ভাস্করব্রত পতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও ইটালিতে মহিলা অধিকার রক্ষায় উজ্জ্বল হলুদ লজ্জাবতীর ফুলকে সূর্যের সাথে তুলনা করে চিহ্নিত করা হয়েছিল উন্নতি ও জয়ের প্রতিক হিসেবে। ইউনাইটেড নেশনসের উদ্যোগে ১৯৭৭ এর ৮ ই মার্চ থেকে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ইটালিতে এই দিনকে বলে Festa Della Donna। এই দিন পুরুষেরা এক গুচ্ছ Mimosa ফুলের তৈরি bouquet উপহার দেয় তাঁর মহিলা শিক্ষিকা, প্রেমিকা, আত্মীয়া, স্ত্রী, বান্ধবীদের। আর মেয়েরা তা উপহার দেন অন্য মেয়েদের।
সংস্কৃতে লজ্জালু, স্পর্শলতা, হিন্দিতে লাজবন্তী, লাজল, ওড়িয়ায় লাজকুলি লতা, মারাঠিতে লাজালু, গুজরাটিতে রিসামণি, তামিলে লাজিরো, তেলুগুতে অট্টপট্টি এবং ইংরেজিতে Sensitive Plant এবং Touch Me Not Plant বলে। বৈদিকমতে 'সমঙ্গা' হল লজ্জাবতী লতা। 'সমঙ্গা'কে বলে 'বরাহক্রান্তা'। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের গ্রন্থ 'পর্যায় মুক্তাবলী'তে পাওয়া যায় এই নাম। যার প্রধান শিকড়ের পাশে বরাহের লোমের মতো অসংখ্য সূক্ষ্ম ঘন শিকড় জন্মায়। এই 'ক্রান্ত' শব্দের অর্থ' 'লক্ষণ'। এই ধরনের সামঞ্জস্য থাকায় এহেন নামকরণ।
চাদরের মতো বিছানো লজ্জাবতী
লজ্জাবতীকে অন্যান্য যেসব নামে ডাকা হয় তা হল -- সমঙ্গা, রক্তপাদী, শমীপত্রা, সঙ্কোচিনী, প্রসারিণী, সপ্তপর্ণী, খদিরী, স্পর্শলতা, গণ্ডমাণিকা, লজ্জা, বশিনী, লজ্জিরী, অন্ত্ররোধিনী, রক্তমূলা, তাম্রমূলা, স্বগুপ্তা, মহৌষধি, গজাল, স্পৃক্কা, খদির পত্রিকা, অঞ্জবিকারিকা, মহাভীতা, নমস্কারী এবং স্পর্শ'লজ্জা। এটি Fabaceae (Leguminosae) পরিবার বা শাখাগোত্রের Mimosoideae উপপরিবার বা উপগোত্রের এবং Mimosaceae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। গ্রিক শব্দ Mimos কথার অর্থ হল নকল। অর্থাৎ কোনও এক বিষয়ের প্রতিক্রিয়া জানানোর ভান করে। তা থেকেই এসেছে Mimosa। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Mimosa pudica Linn। যদিও লজ্জাবতীর আরও অনেক প্রজাতির সন্ধান মেলে।
সারা বিশ্বে প্রায় ৪০০ প্রজাতির লজ্জাবতী লতার সন্ধান রয়েছে। তেমনই কয়েকটি প্রজাতির নাম হল --
Mimosa pudica L.
Mimosa rubicaulis Lam. (বড় লজ্জাবতী)
Mimosa texana (Gray) Small
Mimosa aculeaticarpa Ortega
Mimosa aculeaticarpa var. biuncifera Ortega
Mimosa arenosa (Willd.) Poir.
Mimosa asperata L.
Mimosa borealis Gray
Mimosa casta L.
Mimosa cupica Gray
Mimosa ceratonia L.
Mimosa diplotricha C.Wright ex Sauvalle
Mimosa distachya Cav.
Mimosa dysocarpa Benth.
Mimosa emoryana Benth.
Mimosa grahamii Gray
Mimosa hostilis
Mimosa hystricina (Small ex Britt. et Rose) B.L.Turner
Mimosa latidens (Small) B.L. Turner
Mimosa laxiflora Benth.
Mimosa malacophylla Gray
Mimosa microphylla Dry.
Mimosa nuttallii (DC.) B.L. Turner
Mimosa pellita Kunth ex Willd.
Mimosa pigra L.
Mimosa quadrivalvis L.
Mimosa quadrivalvis var. hystricina (Small) Barneby
Mimosa roemeriana Scheele
Mimosa rupertiana B.L. Turner
Mimosa scabrella Benth.
Mimosa schomburgkii Benth.
Mimosa somnians
Mimosa strigillosa Torr. et Gray
Mimosa tenuiflora (Willd.) Poir. (Mimosa hostilis)
Mimosa turneri Barneby
সবুজের আস্তরণ লজ্জাবতীর
এদের পাতার বোঁটা এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা, পাতাগুলি ঠিক বিপরীতভাবে সুন্দর করে সাজানো থাকে। কিন্তু কোনও ভাবে পাতাগুলি বাইরের কিছুর ছোঁয়া পেলেই বিপরীত দিকের পাতাটি নেমে এসে জুড়ে গিয়ে মুসড়ে পড়ে। গুটিয়ে যায়। তখন মনে হয় পাতাগুলি যেন করজোড়ে কিছু প্রার্থনা করছে। পাতার এরূপ আচরণের জন্য লজ্জাবতীর অপর নাম 'পত্রাঞ্জলি'। ঢাকা এলাকায় এক ধাঁধার মাধ্যমে লজ্জাবতী লতার এই বিশেষ চরিত্রটি নিয়ে বলা হয় -- 'হাত দিলে বন্ধ করে, সূর্যোদয়ে খোলে / ঘোমটা দেওয়া স্বভাব তার, মুখ নাহি তোলে'।
তখনও লজ্জায় রাঙা হয়নি
আসলে একটু ছোঁয়া পেলেই নুইয়ে পড়ে এই গুল্মজাতীয় লতাটি। গানের ভাষায় 'ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না আমাকে... '। প্রচুর লজ্জা এবং শরমে পরিপূর্ণ। যেন ঠিক 'লাজে রাঙা হল কনে বউ গো'! এহেন আচরণের জন্যই নামকরণ করা হয়েছে লজ্জাবতী। আদি নিবাস মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে হলেও বর্তমানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বহুল পরিমাণে জন্মাতে দেখা যায়। সবুজ চাদরের মতো বিছানো থাকে মাটিতে।
লজ্জাবতী লতার মধ্যে অ্যাসিটাইল কোলিন নামে এক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তার দরুন এই গাছে স্পর্শ করলেই এই রাসায়নিক পদার্থটি এক কোষ থেকে অন্য কোষে যায়। যার ফলে একটা তড়িৎ শক্তি প্রবাহিত হয় গাছের মধ্যে। আসলে এই গাছের পাতার গোড়ার অংশ কিছুটা ফোলা। এই অংশের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য কোষ, যা পরিপূর্ণ থাকে জল এবং খনিজ পদার্থের মাধ্যমে। অ্যাসিটাইল কোলিনের প্রভাবে ঐ ফোলা অংশ থেকে খনিজ লবন এবং জল নির্গত হয়ে আসে। তখন কোষগুলি চুপসে যায়। এসময় ঐ কোষে জলের চাপ কম থাকায় লজ্জাবতীর পাতার ডাঁটাগুলো সোজা হয়ে থাকতে পারে না। নুইয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে সব পাতাগুলোও বুজে যায়। লজ্জাবতীর এই ধরনের প্রতি ক্রিয়াশীল চলনকে উদ্ভিদ বিদ্যার পরিভাষায় বলে সিসমোন্যাস্টিক চলন (Seismonastic Movement)। বহুকাল আগে কোনও এক কবি 'লজ্জাবতী' নামে এক কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতায় ছিল --
'নিশীথ ঘুমায় যবে
স্তব্ধতার সুখ কোলে,
কামিনী কানন বালা
মুখখানি ধীরে খোলে;
লজ্জাবতী চুপে চুপে
ভালবেসে হেসে চায়,
কে জানে বোঝে কি চাঁদ?
নীলাকাশে ভেসে যায়!
তটিনী ঘুমের ঘোরে
গায় তারে উপহাসি,
কোথা কোন দূর হতে
বেজে কার ওঠে বাঁশি!
শিয়রে তারকা দুটি
হেসে ঢলে পড়ে যায়,
মরমে মরম ঢাকি
সরমে সে ঝরে যায়'!
হালকা বেগুনি লাল রঙের ফুল ফোটে গাছে। ফুল তুলোর মতো নরম। পত্রবৃন্ত ও লতার সংযোগস্থল থেকে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা পুষ্পদণ্ড বের হয়। সারা বছরই ফুল ও ফল হতে দেখা যায়। তবে জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ফুল ও ফল বেশি হয়। এদের শুঁটিতে ৩ - ৪ টি করে বীজ থাকে। সেই বীজে থাকে কাঁটা। সাধারণত নদীর বাঁধে, রেললাইনের পাশে, রাস্তার পাশে লজ্জাবতী লতার মূল বাসস্থান।
লজ্জাবতী লতার মধ্যে পাওয়া যায় অ্যালকালয়েড মাইমোসিন সহ বিভিন্ন স্টেরয়েড, ক্রোশেটিন ডাইমিথাইল ইথার ট্যানিন, ফ্যাটি অ্যাসিড, মিউসিলেজ, মোম ইত্যাদি। লজ্জাবতী লতাগাছ যেখানে থাকে, সাপ সেখানে প্রবেশ করেনা। এটি মাটিতে লতিয়ে লতিয়ে বাড়তে থাকে। লজ্জাবতীর গায়ে অসম্ভব বাঁকা বাঁকা কাঁটা রয়েছে। সেগুলি নীচের দিকে মুখ। তাই হয়তো খোঁচা খাওয়ার ভয়ে সাপ ঢোকেনা।
লজ্জাবতীর ফুল
মালাবার অঞ্চলে সাধারণ মানুষ অর্শরোগের নিরাময়ে লজ্জাবতী গাছের মূল ও পাতা ব্যবহার করে। চরকে উল্লিখিত 'সমঙ্গা' হল আসলে লজ্জাবতী লতা। এ তথ্যটি মেলে ওয়াট সাহেবের "ইকনোমিক্ প্রডাক্টস্ অব্ ইন্ডিয়া" নামক একটি বইতে। এখানে লজ্জাবতীর লৌকিক নাম দেওয়া হয়েছে লজ্জালু। এছাড়াও আরও একটি নাম হল -- 'অঞ্জলিকারিকা'। সুশ্রুত সংহিতার টীকাকার ডল্বন লিখেছেন, - 'সমঙ্গা অঞ্জলিকারিকা লজ্জালু ইতি লোকে'।
লজ্জাবতী লতা অর্শ রোগের পক্ষে খুব উপযোগী। এছাড়াও আমাশয়, হাত পা জ্বালা করা, যোনি ক্ষত নিরাময়ে, রক্ত পিত্ত উপশমে, দাঁতের মাড়ির ক্ষত, বগলে দুর্গন্ধ, কানের পুঁজ, রমণে অতৃপ্তি, দুষ্ট ক্ষত, মিথুন দণ্ডের শিথিলতা কাটাতে, আঁধারযোনি ক্ষত, মল কাঠিন্য, কানের পুঁজ ইত্যাদি থেকে রেহাই পেতে লজ্জাবতী লতার গুরুত্ব অপরিসীম।
'লাজুক পাতার মতো লজ্জাবতী
তোমাকে ছুঁয়ে দিতে চায় অনুমতি।
স্বপ্নের আবির থেকে ইচ্ছের
সাত রং মেখে
তোমার আকাশে হবো প্রজাপতি'।
-- (হাবিব & ন্যান্সি)
0 Comments