জ্বলদর্চি

দেবতা /পুলককান্তি কর

চিত্র- অর্ণব মিত্র 

দেবতা 
পুলককান্তি কর 

-কী গো, এত দেরী হল আজ? তিসির ঘুম ভাঙেনি নাকি?
-না, না ওর দোষ নেই। আমারই ঘুম ভাঙেনি।
-কেন, অ্যালার্ম দিতে ভুলে গেছিলে?
-না, না অ্যালার্ম বেজেছে তো! আমি কখন ঘুমের ঘোরে বন্ধ করে দিয়েছি খেয়াল হয় নি। যখন চোখ খুললো, অলরেডি পনেরো মিনিট লেট। কোনও রকম দৌড়ে দৌড়ে এসেছি।
-সেই, আমি ভাবলাম কী হল, শরীর টরীর খারাপ হল নাকি। আজ ওদের ক্যুইজ ট্যুইজ, তোমার তো দেরী হবার কথা নয়।
-টুবাই কই? ও ভেতরে ঢুকে গ্যাছে তো?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, কখন! আমি তো আজ বরং পাঁচ সাত মিনিট আগে ইন করেছি। ওকে ভেতরে দিয়ে তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম।
-সরি অনীশ দা। চলুন বরং একটু চা খাই; আজ তাড়াহুড়ো তে চা খেয়ে আসতে পারিনি।
-সেই ভালো, চলো। নইলে তো তোমার আবার মাথা ধরবে। এক কাজ করবে? একটুখানি গেলে একটা ছোট কেবিন টাইপের দোকান আছে, ওখানে যাবে? তাহলে বসে চা খাওয়া যায়! 
-কদ্দুর?
-না, না। খুব দূর নয়। এই তো বাইকে পাঁচ-সাত মিনিট। তাছাড়া আজ তো থাকতে হবে। স্কুল তো তাড়াতাড়ি ছুটি হবে বোধ হয়।
-তাই আবার হয় নাকি? যারা পুল কারে আসে, তারা কী করে আগে যাবে? এভাবে বিনা নোটিশে স্কুল আগে বন্ধ হয় না। 
-ভারী বুদ্ধি তো তোমার! জজ ব্যারিস্টার হলেই ভালো করতে!
-আগামী জন্মে হবে অনীশ দা। এখন চলুন। একটু চা খেয়ে আসি।
  অনীশ তার বাইকটা স্টার্ট দিয়ে একটু সামনে ঝুঁকে বসল, যাতে আরাম করে বসতে পারে অনুমিতি। তবুও যেন গা বাঁচিয়ে আলতো করে বসল সে। অনীশ বলল, ‘কী হল, ধরো আমাকে! ব্রেক কষলে পড়ে যাবে যে!’ 
-না, না! পেছনের রড ধরেছি তো।
-তুমি না ফিজিক্সের মেয়ে! সাইড করে বসে এক হাত দিয়ে রড আর অন্য হাত কোলে রাখলে – ব্রেক মারলে পড়ে যাবে না? ওই টর্ক না কী বলে যে! 
-কিছু হবে না, আপনি চলুন। বাইকে তো আর রেস করবেন না যে গতির বৈষম্য হবে!
-বাঃ! দারুন বললে তো! গতির বৈষম্য! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনীশ। জীবনে যারা একসাথে   চলছে, তাদের গতির সমতা কী সত্যি থাকে? না কি রেস করতে গেলেই বিষমতা! একটু পরেই কমলা কেবিনের সামনে বাইকটা দাঁড় করিয়ে বলল, ‘নামো! দেখো, এখানে তোমার পছন্দ হয় কিনা’। 
  বেশ ভালোই জায়গাটা। পুরোনো দিনের টেবিল, উপরে মার্বেলের টপ। কালো কালো ছোট চেয়ার, সেই পুরোনো আমলের। একটু গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই বসতে হয়। দুটো বাটার টোষ্ট, আর চায়ের অর্ডার করলো অনীশ।
-সঙ্গে একটা করে ডবল ডিমের অমলেটও বলি?
-না, আমি খাবো না। আপনি খান।
-কেন খাবে না কেন?
🍂
-সকালে ডিম ভালো লাগে না খেতে। তাছাড়া আজ বৃহস্পতিবার তো। নিরামিষ।
-তুমি মানো এসব?
-আমি মানি কিনা সেটা বড় কথা নয়। শ্বশুরবাড়ীর নিয়ম এটা।
-এটা তো শ্বশুরবাড়ী নয়! এখানে কী অসুবিধা? নিজে যখন মানো না, তাহলে খেতেই পারো। এই যে ভাই... বেয়ারাকে ডাকতে গেল অনীশ।
-না, না, ডাকবেন না প্লীজ! আমি নিয়ম মেনে চলতে চাই।
-কে এমন মাথার দিব্যি দিয়েছে অনু। তুমি না শিক্ষিত? এম.এস.সি পাশ! ঠিক আছে, শ্বশুরবাড়ীতে অশান্তি হবে বলে মেনে নিচ্ছ, এখানে বাইরে মানার দরকার কি!
-আমি বিশ্বাস ভাঙতে চাইনা অনীশ দা। তাছাড়া সকাল সকাল অমলেট এমনিতেও খেতে ইচ্ছে করে না আমার।
-তুমি ভীষণ গোঁয়ার অনু। কবে থেকে বলছি তোমার ফোন নাম্বারটা দাও। কী এমন হত যদি আমাকে নাম্বারটা দিতে? আমি কি তোমাকে সবসময় কল করতাম? এই তোমার শরীর ঠিক আছে কিনা, অসুখ টসুক হল কিনা, রাস্তায় বিপদে পড়লে কিনা? মানুষ ক্ষেত্রবিশেষে তো ফোন করতেই পারে। তাতে কি তোমার বর গোঁসা করবে?
-গোঁসা করবে কেন? ও ভালো মানুষ। আমার ফোন ছুঁয়েও দ্যাখে না। নিজের জগৎ নিয়েই মেতে থাকে। 
-তবে? ও কি সন্দেহবাতিক?
- না, না। তাও না।
-তাহলে তোমার ফোন নাম্বারটা দিতে আপত্তিটা কি? তুমি কি তোমার বান্ধবীদের দাওনি? টুম্পা, অর্ক – এদের মা’র কাছে নেই তোমার নাম্বার?
-আছে। স্কুলটুল কামাই করলে ওদের থেকেই তো পড়ার খবর নিতে হয়।
-সেটা তো আমিও দিতে পারি।
-ব্যাপারটা তো বিষয়টুকু জানার। ওর থেকে নিই বা আপনার থেকে, তফাৎটা কোথায়! মুচকি হাসল অনু।
-তফাৎ কী জানো না! তুমি তো জানো, তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। এই অছিলায় নাহয় একটু কথাই বলতে! তবে কি ধরে নেবো আমার সাথে তোমার কথা বলতে ভালো লাগে না?
-এভাবে বলছেন কেন!
-কী ভাবে বলবো?
-বেকার ঝগড়া করছেন কেন সকাল থেকে? মুড ভালো নেই বুঝি! বউদির সাথে কথা হয়েছে কাল?
-হ্যাঁ। কথা তো রোজই হয়।
-কবে আসবে বৌদি?
-এই তো যেমন আসে। আজ চোদ্দ তারিখ। ওই সাতাশ-আঠাশ করে আসবে। তিন চারদিন থাকবে।
-বউদিকে বলুন না চাকরী ছেড়ে দিতে।
-তোমার কি আমাকে সেরকম পুরুষ মনে হয়? তুমি তো জানো, আমি কারোর উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিই না।
-আসলে টুবাইটা তো মাকে পায় না। এসময়ে বাচ্চাদের মা’কে খুব দরকার হয়। 
-সে আর কি করা যাবে! ওর ওখানে তো ভালো স্কুলটুল নেই। ফলে কলকাতাতেই বাচ্চাকে থাকতে হবে, এবং আমার কাছে।
-বউদি তো স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে এদিকে আসতে পারে। দেয় কি?
-জানিনা ওসব। এ নিয়ে আমি তেমন কিছু বলিনা, বলতে চাইওনা।
-বউদি নিজে থেকে কিছু বলে না এই নিয়ে?
-না তেমন কিছু শুনিনি। হয়তো ওখানে থাকতে ভালোবাসে বোধ হয়।
-কিছু মনে করবেন না। একটা পার্সনাল কথা জিজ্ঞেস করব?
-বলো না। তোমাকে কোন কথা আমি বলি না?
-না, মানে টুবাই আসার আগে এসব আপনারা ভাবেন নি! মানে বউদি তো তখনও চাকরীটা করতো।
-আমি বলেছিলাম। ও বললো, কেন চাকরী করা মেয়েদের কি বাচ্চা হয় না?
-বাচ্চা হবার পর উনি কী করলেন?
-ওই বছর খানেক ছুটিছাটা ম্যানেজ করল। পরে ওর মাকে নিয়ে ওর কাছে রেখেছিল বছর তিনেক। সেসময় টুবাই ওর কাছেই থাকতো। আমি মাসে একবার দুবার যেতাম। পাঁচ বছর থেকে আমার কাছেই পাকাপাকি।
-অসুবিধা হয় না আপনার?
-আগে একটু আধটু হত। এখন অভ্যাস হয়ে গ্যাছে। সকালে ওকে স্কুল দিয়েই আমি চা খেয়ে আমার শপ এ চলে যাই। মাঝে বেরিয়ে এসে ওকে নিয়ে বাড়ী। ওখানে মা-বাপি দুপুরটা দ্যাখে। আয়াও আছে। বিকেলে শপ থেকে বাড়ী গিয়ে একটু ওকে রাস্তায় বেড়িয়ে আনি। আবার শপে ফিরি। রাত ন’টার পরে গিয়ে ওর পড়াটড়া একটু দেখি। বাপিই বেশীটা দ্যাখে।
-রাতে কি টুবাই দাদু-দিদার কাছে শোয়, না কি আপনার কাছে?
-যেদিন যেমন ইচ্ছা হয়।
-ও মায়ের কথা বলে না?
-না, খুব বেশী না। মা এলেই তো বরং শাসন।! ছাড়ো এসব। চা খাও। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!
-আপনি কি কষ্ট পান খুব, এ নিয়ে?
-না, না। এখন অভ্যাস হয়ে গ্যাছে সব। তাছাড়া টুবাই এর সাথে আমার বেশ ভালোই সময় কাটে। দ্যাখো, এভাবে তুমি আসল কথা এড়িয়ে গেলে!
-কী কথা?
-এই যে, ফোন নাম্বার দেওয়া নিয়ে বলছিলাম।
-ছাড়ুন না অনীশ দা। ও নিয়ে কী করবেন আপনি? এই তো দেখা হয় রোজ।
-এই যে সোমবার আসো নি তুমি, কতক্ষন ওয়েট করলাম! তুমি তো অন্তত আমাকে জানিয়েও দিতে পারো – আজ আসবে না। জানাবেই বা কী করে? আমার নাম্বারও তো নেই তোমার কাছে। ওটা তো রাখতে পারো।
-আপনি ভারী বোকা তো! মুচকি হাসলো অনুমিতি।
-কেন বোকা কেন? এর মধ্যে বোকা কথাটাই বা কী?
অনু কিছু না বলে মিটিমিটি হাসতে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। 
-কী হল,উত্তর দিচ্ছো না যে বড়!
-না, কিছু না। 
-আরে বলোই না, বোকামিটা কী? ওঃ আচ্ছা! আমার নাম সেভ করবে কী করে, এইতো? এ নিয়ে জানোতো হোয়াটস অ্যাপে একটা মজার জোকস্‌ এসেছিল। একটি বউ তার কনট্যাক্ট লিস্টে সব টুম্পার মা, টুবাই এর মা, পম্পার মা এভাবেই নাম সেভ করে রেখেছিল, একদিন ওর বর আবিষ্কার করল ওগুলো সব ওর বয়ফ্রেন্ডদের নম্বর। ব্যাপারটা অনেক মজা করে লিখেছিল – আমি বলতে পারলাম না ভালো। মজার গলায় বলল অনীশ। ‘কী ই গো! আবার হাসছো! ঠিক বললাম না বুঝি? তবে?
-দূর বাবা, এ তো সহজ ব্যাপার। আমি আপনাকে কল করলে আপনি আমার নম্বরটা সেভ করে নেবেন না! খিল খিল করে উঠল অনুমিতি।
-বাবা, কী হল তাতে! আমি তো তোমায় প্রমিস করলাম অনু –অকারনে কল করব না তোমায় –  তুমি বিশ্বাস করলে না?
-থাক না অনীশদা, কেন জোরাজুরি করছেন?
-জোরাজুরি করছি? তুমি জানো না, আমি কাউকে কোনও বিষয়ে জোর করি না? ঠিক আছে, আর বলব না কখনও। একটু বিষন্ন শোনালো অনীশের গলা।
-রাগ করলেন নাকি? আমি সত্যি সত্যি এভাবে বলতে চাইনি আপনাকে। প্লীজ, কিছু মনে করবেন না।
-কী মনে করবো বলো! আমার তোমার প্রতি মনোভাব তো তোমার অজানা নয়। তুমি এটা জানো বলেই আমায় কষ্ট দাও।
হঠাৎ করে ভারী হয়ে গেল আশপাশ। দুজনে বাটার টোষ্ট শেষ করল বেশ মন দিয়ে। অনুমিতি বলল, আর এক কাপ করে চা খেলে হয়। বেশ ভালো চা করে এখানে।
-আর তাছাড়া ঘন্টা তিনেক তো কাটাতে হবে আরও।
-আপনি চাইলে শপে চলে যান না! হয়ে গেলে টুবাই কে নিয়ে নেবো আমি। আপনি তখন এসে নিয়ে নেবেন।
-কখন শেষ হবে জানাবে কী করে? ট্যালিপ্যাথি জানো নাকি?
হেসে ফেললো অনুমিতি। মুখে বলল, ওকালতিটা আপনিও ভালো করতেন। কম্পিউটার না পড়ে ওকালতি শিখলে ভালো হত। ওতেও আপনার নামযশ হত বেশ।
-কী করলে যে তোমায় ইমপ্রেস করা যেত অনু, তাই ত ভেবে পাই না! 
একটু চুপ থেকে অনুমিতি বলল, আমাকে ইমপ্রেস করার প্রশ্ন উঠছে কেন? একটু গম্ভীর শোনালো ওর গলা।
-তুমি কি সত্যি বোঝ না?
-কী বুঝি না?
-না বোঝার ভান করো না অনু। তুমি দিব্যি জানো, কী বলতে চাইছি আমি।
-না বুঝছি না আমি। আপনি বলুন পরিষ্কার করে।
-এই, মানে.... চুপ করে রইল অনীশ। বেশ খানিকক্ষণ পরে একটু গলা খাঁকরে নিয়ে বলল, কিছু মনে করো না অনু; সত্যি করে বলো তো, আমার প্রতি তোমার কোনও ফিলিংস নেই?
-ফিলিংস থাকবে না কেন? আপনার প্রতি আমার বেশ ভালো ফিলিংস ই আছে। একটু তরল গলায় বলল অনু।
-আবার মজা করছো তুমি। এটা সিরিয়াস বিষয় অনু। আমার জানা দরকার এটা। তুমি কী আমায় একটুও ভালোবাসো না?
কিছু জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল অনু।
-কী হল? আবার ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করল অনীশ। ‘বলো। হ্যাঁ না - যাইহোক কিছু বল, আমি কিছু মনে করবো না’। 
-না। বেশ দৃঢ় শোনাল অনু’র গলা।
-কেন? বেশ থতমত খেয়ে গেল অনীশ। কেন অনু? আমি কি তোমার ভালোবাসার যোগ্য নই?
-যোগ্য অযোগ্যের প্রশ্ন আসছে কেন? আপনার যোগ্যতা থাকলেই ভালোবাসতে হবে, তেমন কোনও মাথার দিব্যি আছে কি?
-এত কঠোর করে কেন বলছো অনু?
-আপনি তো তাই শুনতে চাইছেন। আপনার হঠাৎ করে কেন মনে হল আমি আপনাকে  ভালোবাসতে পারি? এই আপনার সাথে কথা বলি, একসাথে চা খাই বলে? সেই হিন্দি সিনেমায় ডায়লগ আছে না – এক লড়কা-লড়কী কাভি দোস্ত নেহি বন সকতা – আপনিও কী সেই দলের? আপনাকে তো কখনও আমি এভাবে ভাবতেও পারিনা!
-এভাবে মানে কীভাবে? প্রেমিক হিসাবে নাকি লড়কা লড়কীর না দোস্তির সমর্থক হিসেবে? কপট রসিকতা করল অনীশ। এই রসিকতায় একটু মুচকি হাসল অনুমিতিও। অনীশ আবার বলল, আসলে তুমি পুরুষ হলে বুঝতে! কোথায় যেন আমার মনে হয়, তুমি আমায় ভালোবাসো, ভালোবাসতে বাধ্য।
-কেন বাধ্য কেন? বাধ্যতার কী দেখলেন আপনি? আমি কী কখনও বলেছি - আমি অসুখী, দুঃখী বা ভালোবাসার ভিখারী?
-না, না সরি! ওভাবে কথাটা বলতে চাইনি আমি। বাধ্য মানে, তোমার অ্যাঙ্গেল থেকে বলছি না, আমি যেটা বলতে চাইছি – তোমার যা অ্যাটিটিউড, তাতে আমার মনে হয় আমাকে তুমি ভালোবাসোই।
-এমনটা কেন মনে হয় অনীশ’দা? দেখুন আপনি ভালো মানুষ, সফ্‌ট, ক্রিয়েটিভ। আপনাকে আমি পছন্দ করি। কেন এসব ভেবে সম্পর্কটাকে স্টিফ করে দিচ্ছেন?
-অনু, তুমি কি তোমার জীবনে সুখী?
-আপনার কী মনে হয়, আমি অসুখী? আমি কী কখনও আমার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ী নিয়ে আপনাকে খারাপ কিছ বলেছি?
-বলোনি মানেই কি তুমি আনন্দে আছো? আমার তো মনে হয় – কোথায় যেন বন্দী হওয়া পাখি তুমি। কে যেন তোমার দম বন্ধ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
-এভাবে আমি ভাবতেই চাইনা অনীশ’দা। আমার মেয়েটা ছোট। ওকে বড় করতে হবে। আমার স্বামীও খারাপ মানুষ নন। একটু উদাসীন – কিন্তু এই নয় যে আমায় অযত্ন করেন বা কষ্ট দেন। আমি এই জগতেই ঠিক আছি অনীশ’দা। আমি অন্য কিছু মনেও আনতে চাই না। আপনার যদি অন্যরকম কিছু মনে হয়, তবে আমার সাথে নাই বা মিশলেন!
-একথা বলো না অনু। তুমি তো জানো সারাদিনের এটুকুই আমার জীবনে আলোর জায়গা। সকালে একবার দিতে আসা আর নিতে আসার সময়টুকুই বাঁচিয়ে রাখে আমায় সারাদিন। তুমি আর এটা থেকে আমায় বঞ্চিত করো না।
-কিন্তু আপনি মিছিমিছি কষ্ট পাবেন।
-তোমায় ধন্যবাদ অনু,  অ্যাটলিস্ট কষ্টটা যে হবে – এটা তুমি বোঝ। যে ভালোবাসে না, প্রত্যাখানের কষ্ট তো তার বোঝার কথা নয়, বুঝবেও না কোনওদিন। নীতি-অনীতির কথামালা দিয়ে এর বিচার হয় না কখনও।
-প্রত্যাখ্যান বলে ভাবছেন কেন? শব্দটা বড় নিষ্ঠুর। 
-প্রত্যাখ্যান ছাড়া কী ই বা বলব বলো? তুমি তো আমায় নিরাশই করছো!
-নিরাশ কোথায় করলাম? আমি তো এই নিয়ে কিছু বললেই চাইনি; আপনি জোর করলেন তাই বললাম। আমি এসব নিয়ে ভাবার জায়গাতেই নেই অনীশ’দা। 
-তুমি তো অনেক কবিতা পড়েছো। কবি হেল্ডারলিনের এর নাম জানো? 
-হ্যাঁ। বিখ্যাত জার্মান কবি। ওঁর লেখা কবিতার অনুবাদও পড়েছি বুদ্ধদেব বসুর লেখায়।
-ওই কবিতাটা পড়েছো – ওই যে, ‘একবার বেঁচেছি দেবতা হয়ে, আর তাই যথেষ্ট আমার’?
-হ্যাঁ।
-মানে বুঝেছ কি?
-হ্যাঁ – মানে – আচ্ছা আপনিই বলুন।  
-দ্যাখো, কবির সাথে দিওতমা নামের যে মেয়েটির সম্পর্ক ছিল, সেই মেয়েটি ছিলো চার সন্তানের মা। ওদের বাড়ীতেই ছেলে মেয়েদের পড়াতে যেতেন কবি। এই নিয়ে জয়’দা একটা লেখাও লিখেছেন কিছুদিন আগে। তো সেই ভদ্রমহিলা খুব একটা সুখী ছিলেন না মনে হয় পারিবারিক জীবনে। বেশ কিছুদিন পরে যখন কবির চাকরী যায় ওই বাড়ী থেকে, কবি তখন পাগল হয়ে যান এবং এই অবস্থায় আরও প্রায় ৩৬ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা এই বিখ্যাত কবিতাটিতে তিনি বলেছেন – দ্যাখো, তোমার কাছে আমি কিছুক্ষনের জন্যও দেবতা হতে পেরেছিলাম এই আমার যথেষ্ট। এর বেশী কিছু আকাঙ্খা আমার নেই।
-এ তো এই পংক্তিতেই বলা আছে। বোঝাই যাচ্ছে। আপনি নতুন কী বোঝাতে চাচ্ছেন, সেটা বলুন। 
-দ্যাখো, আমি যে তোমায় ভালোবাসি, তাতে কি আমি তোমার থেকে কিছু চাই? 
-কেন টেলিফোন নাম্বার চেয়েছেন! মজা করল অনু।
-সিরিয়াস কথা বলছি কিন্তু! দ্যাখো, আমি জানি তুমি বিবাহিতা, সংসারের দায় তুমি অস্বীকার করতে পারোনা, আমিও চাই না তুমি তাই করো। আমি তোমার সাথে সিনেমা যেতে চাই না, একান্তে নিভৃতে তোমাকে অন্য কোনও ভাবে পেতেও চাই না, তোমার সাথে দাম্পত্যও চাই না আমি। শুধু মনে মনে তুমি আমায় যদি একটু ভালোবাসো, একটু বোঝ – তাহলে কি খুব অন্যায় হয়ে যাবে অনু? এইটুকু দেবতা হবার যোগ্যতা কি আমার নেই? স্যরি, আবার যোগ্যতা শব্দটা বললাম। আসলে বলতে  চাই দেবতা হবার ইচ্ছেটুকু কি আমার হতে পারে না অনু? একটু দম নিল অনীশ। কিছুক্ষণ পরে বলল – আমাকে খুব খারাপ লোক মনে হচ্ছে, তাই না অনু? খুব ঘেন্না হচ্ছে আমার উপর?
-ঘেন্না হবে কেন? আমার সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না।
-কেন মনে হচ্ছে না?
-হলে কি আপনি খুশী হতেন? 
-না – মানে – হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। অন্যদের তো তাই হত। অবশ্য তুমি অন্যদের থেকে আলাদা বলেই তো আমার ভালো লাগে। দ্যাখো, সারাদিনের কাজের ফাঁকে যখন একটু অন্যমনস্ক হবার অবসর পাবো – তখন তো মনে হবে কেউ আমায় ভাবছে, বা অকারণ নিঃসঙ্গতায় মনে হবে কেউ তো আছে, যে আমার নিজস্ব এক চেতনায় থাকে – যার কথা কেউ নাই বা জানলো – শুধু তুমি আর আম জানি। আমার মতো সামান্য এক মানুষ যাকে কেউ অসামান্যতার মর্যাদা দিয়েছে নিজের মনে! 
-সে তো অন্য সম্পর্কেও থাকা যায়। বন্ধু হয়েও তো এই চাহিদা মিটতে পারে।
-না অনু। বন্ধুরা কখনও মনের দেবতা হয় না কোনওভাবে। ঠিক আছে, এই নিয়ে কোনও চাপ নিওনা তুমি। আমি এই নিয়ে আর কিছু বলবো না তোমাকে। দোহাই তোমায়, যেটুকু আছে সেটুকু বন্ধ করে দিও না তুমি। হঠাৎ করে অনুমিতির হাতের উপর আলতো করে হাত রাখল অনীশ। সেই হাত চট্‌ করে সরিয়ে নিল না অনু। শুধু বলল, - চলুন। ওদের স্কুলে ক্রিশমাসের জন্য যে সব জিনিস দেওয়ার আছে, আজ বরং ওগুলো কিনে নিই। দেখেছেন তো নোটিশটা?
-হ্যাঁ। তাই চলো। তুমি থাকলে কিনতে সুবিধে হবে। টাকা মিটিয়ে বাইকে স্টার্ট দিল অনীশ। চাকা ঘুরতে শুরু করল। একই গতিতে তারা পৌছতে পারবে গন্তব্যে? দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হেলমেটের মধ্যেই আবর্ত্তন করতে লাগল অনুক্ষণ।

Post a Comment

0 Comments