নির্মল বর্মন
কথাসাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায় আনন্দিত চিত্তে ''যাযাবর'' ছদ্মনামে বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনা করে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিলেন। তিনি সারাজীবনে মাত্র আট খানা গ্রন্থ রচনা করে পাঠক সমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। অবশেষে পাঠকের কাছে গ্ৰন্থগুলো বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
কথাসাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায় ১৯০৮ সালে জানুয়ারি মাসে ঢাকা শহরের পাশাপাশি গ্ৰামে জন্মগ্ৰহন করেন। এবং ২২ শ অক্টোবর ২০০২ এ দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা করেন। ছাত্র অবস্থাতেই গান রচনা করে ছাত্রদের মন জয় করতে পেরেছিলেন। সেই গানগুলো সুরসাধক হিমাংশু দত্ত সুর দিয়েছিলেন। বিখ্যাত গায়ক শচীন দেব বর্মন ও উমা বসু বিনয় মুখোপাধ্যায় রচিত গান গুলো গেয়ে ছিলেন। এবং গানের সুর বাংলার সারস্বত সমাজ সাড়া ও আপ্লুত হয়েছিলেন । দৈনিক 'যুগান্তর' পত্রিকায় 'শ্রীপথচারী' ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক হয়েছিল। 'যাযাবর' ছদ্মনামে সাহিত্যচর্চা করতেন। ক্রিকেট খেলা ও দেখার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল , সেই সূত্রে বাংলা ভাষায় "খেলার রাজা ক্রিকেট " ও "মজার খেলা ক্রিকেট" দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
১৯৫০ এ "দৃষ্টিপাত' গ্রন্থের জন্য দিল্লী ইউনিভার্সিটি "নরসিংহ দাস" পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার "বিদ্যাসাগর" পুরস্কার প্রদান করেন।
কথাসাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গ্রন্থ ' ''দৃষ্টিপাত'' (প্রকাশকাল১৯৪৬-এ,১৩৫৩, আশ্বিন)।
সাহিত্যিকের অন্যান্য উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থগুলি :-
''জনান্তিক'' (১৯৫১), ''ঝিলম নদীর তীর'' (১৯৫৫), ''লঘুকরণ'' (১৯৬৪), ''হ্রস্ব ও দীর্ঘ'' (১৯৭৩), ''যখন বৃষ্টি নামল'' (১৯৮৫), ''যাযাবর অমনিবাস'' (১৯৮৩)।
যাযাবরের প্রথম গ্রন্থ ''দৃষ্টিপাত'' সংকলন মূলতঃ পত্রাবলি। জনপ্রিয় মাসিক বসুমতী পত্রিকাতে খণ্ডাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। "দৃষ্টিপাত" এর রচনাকারের সুতীক্ষ্ণ মননশীলতা, স্থিতধী-শক্তি, নিরীক্ষণ-শক্তি , উইট ও স্যাটায়ারের প্রয়োগকৌশল পাঠককে চিত্তাকর্ষক করেছিল।
🍂
আরও পড়ুন 👇
দৃষ্টান্ত:- ''বিবাহ সে পরিপূর্ণতার লাইফ ইনসিওরেন্স নয়, গ্যারান্টি তো নয়ই, সে শুধু মীনস, সে এন্ড নয়।... আগে প্রেম ও পরে বিবাহকে যাঁরা সমস্ত দাম্পত্য সমস্যার সমাধান জ্ঞান করবেন, তাঁরা এখন ঠেকে শিখেছেন যে কোর্টশিপ করে বিয়েও ফুল প্রুফ নয়, যেমন নয় ইন্টারভিউ দিয়ে কর্মচারী নিয়োগ।''
বস্তুতঃ ১৮৫৭ এর বিষয " ব্রিটিশের দিল্লি অভিযান যেমন 'দৃষ্টিপাত''--তেমনি১৯৪৭ এ ''ঝিলম নদীর তীর''-এর বিষয় "কাশ্মীর থেকে হানাদার বিতাড়নে ভারতীয় সেনার অভিযান"।
সুতরাং যাযাবরের ইতিহাস নিষ্ঠতা এবং ইতিহাসকে প্রয়োগযোগ্য করার শিল্পসামর্থ্য প্রকাশিতব্য । 'ঝিলম নদীর তীর' এর তথ্যচিত্রগুলি যেমন জীবন্তচিত্র তেমনি তার পরিবেশন পরিকল্পনায় নৈপুণ্যের সুনিপুণ চমৎকারিত্ব।
ফলতঃ "রাজনৈতিক ও সামরিক অভিযান এর থিম 'রোমাঞ্চকর এবং রুদ্ধশ্বাস' গতিতে লেখক "ঝিলম নদীর তীর''গ্রন্থ বর্ণনা করে পাঠক মহলে তাকে লাগিয়ে দিয়েছেন। আসলে বিদেশী খতরনাকদের প্রতি ঘৃণা ও ভারতীয় বাহিনীর দেশপ্রেমের বলিষ্ঠ কাজকর্ম প্রস্ফুটিত।
যাযাবর ছদ্মনামী ব্যক্তিত্বের '''জনান্তিক'' আসলে একমাত্র বহুল প্রচারিত উপন্যাস। উপন্যাসের নায়িকা মলি সেন এর ট্র্যাজেডি মূলতঃ এই উপন্যাসের উপজীব্য। বস্তুতঃ নায়িকা মলি সেন এর প্রেমে আসক্তি, ভালোবাসার আশা ও হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি থাকলেও নায়িকা মলি নিজের স্বামীকে জয় করতে পারলেন না, কিন্তু অন্যকে আকর্ষণীয় করে ট্র্যাজেডির নায়িকায় রূপান্তরিত হলেন এবং দাঁড়িয়ে পাঠক সমাবেশ জয় করলেন। মহানগরী ও এ ওয়ান সিটির এক ক্লাবে যাযাবর যোগ দিয়েছিলেন, এবং শুভানুধ্যায়ী সুহৃদ ও অনুরাগী পাঠককুলের হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ক্লাবে নানাধরনের শ্রেণি নানা পেশার রহস্যময় মানুষ সমবেত হয়েছিল এবং আনুষঙ্গিক আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। সুতরাং কথাসাহিত্যিকের বর্ণননৈপুণ্য অসাধারণ ও আকর্ষণীয় বটে।
কথাসাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায় ওরফে যাযাবর-এর দুটি গল্প গ্ৰন্থ ''হ্রস্ব ও দীর্ঘ'' (সাতটি গল্পের সংকলন) এবং ''যখন বৃষ্টি নামল'' (আটটি গল্পের সংকলন)। যাযাবরের গল্পগুলি খানিকটা "মুজতবা আলি"-র ''চাচা কাহিনী''-র মতো আন্তরিক রমণীয়তা ও অম্লমধুর ভাষা রোমহর্ষক দিক ভাবনা থেকে পাঠককুলের হৃদয় ও মনন উভয়ই সমান আকর্ষণীয়।
দৃষ্টান্ত :- ''সরীসৃপ'' ছোটগল্প বিরাট জনপ্রিয়। গল্পকথকের লেখনীতে ফুটে উঠেছে -- "বিলাত প্রবাসী বাঙালি ছুটি কাটাতে জলপথে ব্রিটেন থেকে ফ্রান্সে যাচ্ছে। সে সময় জাহাজের ডেকে আলাপ হয় এক মিশুকে ইংরেজের সঙ্গে, যিনি পরাধীন ভারতবর্ষের শাসককূলের একজন" । সুতরাং লেখকের কর্মজীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ফসল এই গল্পটি।
নানারকমের রসের আধিক্য পরিবেশনে, উপস্থাপন নৈপুণ্যের প্রেক্ষিতে, "চাবুকমারা সমাপ্তি" ও সাবলীল সরল গদ্যের অসাধারণ প্রয়োগ কৌশলে তাঁর গল্পগুলি ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধে বিভোর।
কথাসাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায় এর ''লঘুকরণ'' প্রবন্ধ সংকলনে মূলত: ''রামগরুড়ের ছানা'', ''খাপছাড়া'', ''স্ত্রীযু রাজকূলেস্ চ'', ''তির্যক অফি'' ইত্যাদি সুস্বাদু রম্য রচনা স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। তাছাড়া প্রবন্ধগুলির মূল থিমের সঙ্গে ছোটগল্পের কালজয়ী সুখপাঠ্যের - অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণধর্মী নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশভাবনা প্রকাশিতব্য। তাসত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দর্শকদরবার কতখানি যাযাবর কে হৃদয়ঙ্গম করে রেখেছেন, তাই ভাববার সময় এসেছে। হুজুগে বাঙ্গালী পাঠকদের কাছে আজ বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক বিনয় মুখোপাধ্যায়, যাযাবর ছদ্মনামে পরিবর্তীত হয়েছেন।
0 Comments