শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৬ / সালেহা খাতুন
১৮৭৩ – এ প্রতিষ্ঠিত কলেজে পড়াতে এলো ১৯৭৩ - এ জন্মানো মেয়ে। বয়স তখন সাতাশ বছর নমাস। বিংশ শতাব্দীতে নিজেকে মানুষ গড়ার কারিগর রূপে যোগ্য করে নির্মাণ করে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করলো এককালের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিপ্লবের আঁতুড়ঘর মেদিনীপুর কলেজে। যে কলেজের পাঁচজন ছাত্র দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। বিনয়-বাদল-দীনেশ এই ত্রয়ীর দীনেশ গুপ্ত এই কলেজের ছাত্র। রয়েছেন শহীদ প্রদ্যোত কুমার ভট্টাচার্য, শহীদ মৃগেন্দ্র নাথ দত্ত, শহীদ ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, শহীদ নির্মল জীবন ঘোষ, শহীদ অনাথবন্ধু পাঁজা, শহীদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ।
১৯০৮ - এ মেদিনীপুর কলেজে ক্ষুদিরাম বসু ভর্তি হন কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের সজাগ দৃষ্টি এড়াতে কয়েকমাসের মধ্যে মেদিনীপুর কলেজ ছেড়ে চলে যান। ১৯২১ – এ মেদিনীপুর কলেজ-কলেজিয়েট মাঠে মহাত্মা গান্ধী আসেন। ১৯২৪ – এ কাজী নজরুল ইসলাম মেদিনীপুর কলেজে আসেন। ১৯৩০- এর সময় থেকেই মেদিনীপুর কলেজের ছাত্র এবং শিক্ষকরা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার এর অন্যতম সদস্য কলেজের ছাত্র দীনেশ গুপ্ত কলেজের বহু ছাত্রকে একাজে উৎসাহিত করেন এবং শিক্ষকরাও যুক্ত হন। ১৯৩১ – এর ৭ জুলাই রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানে তিনি ছিলেন। ১৯৩২-এ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে হত্যা করেন কলেজের ছাত্র প্রদ্যোত কুমার ভট্টাচার্য। ১৯৩৩ -এ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বার্জকে খুন করেন কলেজের ছাত্র মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু মেদিনীপুর কলেজের ছাত্র। বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি তৈরি হয় তাঁর নেতৃত্বে। ছাত্র শিক্ষকরা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৩৬-এ গভর্মেন্ট কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময় শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা প্রায় পাঁচমাস বিনা বেতনে কাজ করে কলেজকে রক্ষা করেন। ১৯৩৭-এ ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে আর ১৯৩৮ থেকে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
১৯৩৯ – এ রবীন্দ্রনাথ মেদিনীপুরে আসেন বিদ্যাসাগর হল প্রতিষ্ঠা করতে। মেদিনীপুর কলেজের ছাত্রদের তিনি আশীর্বাণী দেন-
উদয়াস্ত
তুমি বাঁধো নূতন বাসা
আমার ভাঙবে ভিৎ।
তুমি খুঁজো লড়াই, আমার
মিটেছে হারজিৎ।
তুমি বাঁধো সেতারে তার
থামচি সাথে এসে।
চক্ররেখা পূর্ণ হলো
আরম্ভে আর শেষে।
১৯৪০ থেকে কলেজ নতুন দিশায় চলতে থাকে। ১৯৪২ - এর আন্দোলনের সময় কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল বি ডি ব্যানার্জি পুলিশকে কলেজে ঢুকতে দিতেন না। কলেজের বাউন্ডারি পেরিয়ে পুলিশ যখন কলেজে ঢুকতে যায় তখন প্রিন্সিপাল বজ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “Don’t touch my wall don’t touch.” পুলিশ ফিরে যেতে বাধ্য হয় ।
বি ডি ব্যানার্জি ১৯৪৩- এ প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্র-শরৎ-বঙ্কিম পরিষদ। ১৯৪৬- এ কলেজে আসেন কবি অমিয় চক্রবর্তী। ১৯৪৭ – এর উনিশে জানুয়ারি রথীন্দ্রনাথ চিঠি লিখে বার্তা পাঠান এই পরিষদের জন্য। এবছরই নয় মে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় আসেন রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনে। এই পরিষদ ১৯৫০ -এ অসুস্থ নজরুল ইসলামকে তিনশো আঠাশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা দান করে। ১৯৫২ তে কলেজে আসেন বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯৫৬ তে আসেন কালিদাস নাগ এবং অনুরূপা দেবী আসেন ১৯৫৯ -এ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন ১৯৬৮ তে। ১৯৭১ -এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মেদিনীপুর কলেজ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধে ওখানকার ছাত্র শিক্ষকদের নানাভাবে সহায়তা করে। বহুকাল ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা এই কলেজ ১৯৮৫ সালের জুন মাস থেকে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়।
দীনেশ গুপ্তের সিগনেচার কলেজের রেজিস্টারে
এমন ঐতিহ্যশালী কলেজে পড়াতে এসে কেমন একটা থ্রিল অনুভব করতে থাকি। ব্যক্তিগত সমস্যা তখন কেমন নিজে থেকেই ম্লান হয়ে যায। পড়াতে এসেছি বঙ্গভাষা ও সাহিত্য। ইতিহাস না জানলে চলে না। মেদিনীপুর কলেজে বাংলা বিদ্যাচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস কিছুটা জানতেই হবে। ঠিক কবে থেকে এখানে বাংলার পঠনপাঠন শুরু হলো সে ইতিবৃত্তে কিছুটা ঘুরপাক খাওয়া যাক। ১৯১৬ তে কলেজে ভার্নাকুলার কম্পোজিশন রূপে উর্দু এবং বাংলা পড়ানো হতো। ১৯২৪ নাগাদ কলেজ যখন সরকারের অধীনে আসে তখন ভার্নাকুলার কম্বিনেশন রূপে আই এস সি তে বাংলা উর্দু সংস্কৃত এবং পারসী ভাষা পড়ানো হতো। আর ইংরেজি তো ছিলই। ১৯৪০-৪১ জেনেরাল সাবজেক্ট রূপে বাংলা পড়ানো শুরু হয়। ১৯৫৬ তে গভর্মেন্ট স্পনসর্ড কলেজ রূপে ঘোষিত হওয়ায় বাংলায় দুজন শিক্ষক নিয়োগ হয়। অধ্যক্ষ পি এন ঘোষের সময়কালে ১৯৬৩ থেকে মেদিনীপুর কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ানো শুরু হয়। আর আমি দু’হাজার এক সালে কলেজে জয়েন করার বারো বছর পর ২০১৩ থেকে কলেজে বাংলায় এম. এ. পড়ানো হচ্ছে। ২০১৯ থেকে পি এইচ ডি অর্থাৎ গবেষণাও শুরু হয়েছে। মেদিনীপুর কলেজ জুড়ে গেছে জীবনের সঙ্গে । কবিতায় বলি-
তোমার প্রাঙ্গণে এসে
নিষেধের প্রহরা হয়েছে বিলীন।
তোমার প্রাঙ্গণে সদা বাজে
সম্মুজ্বল ভবিষ্যতের বীণ।
তোমার প্রাঙ্গণে দেখি
কর্মে মানুষে দৃঢ়তার বন্ধন,
তোমার প্রাঙ্গণে রাজার রাজার
নিত্যনতুন নানান আয়োজন।
তোমার প্রাঙ্গণে ঘন্টা বাজে
কোলাহল জেগে ওঠে
তোমার প্রাঙ্গণে এগিয়ে চলি
সময়ের বাঁধন কেটে।
0 Comments