জ্বলদর্চি

নীলার কিছু কথা কবিতায়...পর্ব ৩/কমলিকা ভট্টাচার্য

গুচ্ছ কবিতা
চিত্র -লেখিকা

নীলার কিছু কথা কবিতায়...
পর্ব ৩
কমলিকা ভট্টাচার্য 

নীলার দিন

সকাল বেলায় জানলা খুলতেই,
দ্বাররক্ষী দুটো নারকোল গাছ জানায় পেন্নাম রাণীমা।
পদ্মফুলের দিঘী বলে শুভসকাল,
লেজ নাড়িয়ে দুটো ময়না দম্পতি ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে শুরু করে মিষ্টি গল্প।

রাতের লেগে থাকা আদর মাখা চাদর,
আলসেমির কোমল পরশে আরও কিছুক্ষণ মিশতে চায় মন,
ঘরের দেওয়াল ঘড়ি ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় জাগরণ।
চায়ের কাপে উষ্ণতার ভাপ,
সকালের আলো ছুঁয়ে যায় ঠোঁটের কোণ,
তার মাঝে শব্দের খেলা, চুপিসারে উঁকি মারে।

কখন চিনির কৌটোর পাশে, মিষ্টি স্বপ্নের লুকোচুরি,
আলু-পেঁয়াজের ঝুড়িতে তাদের গোপন হাসির ফোয়ারা।
বেলনের চাপে শব্দের ছোট্ট চিৎকার,
বলি চুপ কর, আর জ্বালাস না আমায়,
হাতের চুড়ি থেকে মৃদু জল,
গরম চাটুর মাঝে পড়ে, 
চড় চড় করে গায় যন্ত্রণার গান।

এই শব্দেরা আমার মনের নীরবতার ভাষা,
পাতায় দাগ কেটে কবিতা হয়ে ওঠে,
নীলার দিনের ছন্দ মেখে।


জলবিন্দু


আজ একটা জলবিন্দুকে  
বিলীন হতে দেখলাম,  
গরম চাটুর উপর যন্ত্রণায়  
ছটফট করতে করতে  
তারপর কোথায় যেন উবে গেল।  
একটা দাগ থেকে গেল,  
একটি শেষ চিহ্ন যেন—  
শোধ করে দেওয়া  
পৃথিবীর অগণিত ঋণ।  

আমাকে জাপটে ধরলো ভয়,  
সময় বড় কম,  
এই জীবনের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলি,  
তোমার ভালোবাসায় সিক্ত আমি,  
অথচ পুড়ছি বিরহের অগ্নিকুণ্ডে।  
শাওয়ারের জল মাথা বেয়ে নামে,  
হাঁপিয়ে উঠি যন্ত্রণায়,  
যেন কোনো শান্তি নেই  
এই দগ্ধ হৃদয়ের গহ্বরে।  

যদি ঐ জলবিন্দুর মত উবে যেতে পারতাম,  
বিলীন হতাম অধরায়,  
হয়তো মিশে যেতাম  
অসীমের অনন্ত প্রবাহে।  
আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি—  
ঐ তো কিছু কবিতা,  
সেগুলো তোমার নামে করে যাব,  
কিন্তু তাতেই কি আমি ঋণমুক্ত হব?  
জীবনের এই ভাঙা ভাঙা স্বপ্নগুলি,  
তোমার সাথে কাটানো সেই অমূল্য সময়—  
সেগুলো কি শুধুই অজানা ঋণ,  
না কি আমার আত্মার নীরব নৈবেদ্য?  
জলবিন্দুর মতো ক্ষুদ্র আমি,  
তোমার বিরহে ভাসমান,  
শুধু চাই, একদিন বিলীন হতে,একদিন মিশে যেতে  
তোমার আকাশের নীল সমুদ্রে,  
যেখানে আর কোনো দহন থাকবে না,  
থাকবে শুধু এক প্রশান্তির  
অবিচল ঢেউ।


এসেছে মাহেন্দ্রক্ষণ

সকাল হয়েছে, ওঠো, দেখো, এসেছে তোমার ময়না,
আজ সে ধরেছে কবিতা শোনার বায়না।
সারাদিনের জমিয়ে রাখা কথা, নয় শুধুই কান্না,
কবিতার সুরে বলো তাকে, ছেড়ে থাকতে মন যে আর চায় না।

শব্দগুলো আজ বাজবে তার চুড়ির তালে,
আজ শুধু সে তোমার জন্য সাজবে নিরালে।
কপালে সোহাগের রং মিহি ধারায় গড়াবে,
উষ্ণতার ছোঁয়ায় ঘামের ফোঁটাও মিষ্টি মিষ্টি লাগবে।

তোমার দুচোখে লাগুক শিশির ভেজা সকালের সুখ,
আলোর দ্যুতি মিশে প্রেমের ঝলকে ঝলমলে হোক মুখ।
সতেজ হাওয়ায় উড়ে যাক মনে জমা যত ভুল
সেরে উঠুক মনের অসুখ, ফেরাতে ঠোঁটে হাসির ফুল।

জাগো কবি, ঝরে গেছে রাত,
সকালের আলোয় এসেছে তোমার ময়না,
শুনতে তোমার কথা তার আর সবুর হয় না,
আলোকিত ঘরে এসেছে মাহেন্দ্রক্ষণ, বেশিক্ষণ কিন্তু রয় না,
কাটাও দ্বিধার জাল, কোরো না আর দেরি,
দাও তাকে তোমার কবিতার গয়না,
সে যে কবিতায় গাঁথা তোমার হৃদয়বীণা।


মন পাখি

রোজ চোখ বন্ধ করলেই দেখি
দুটো পাখি কোথা যেন উড়ে যায়,
কখনো হাওয়ায় গা ভাসায়,
কখনো ডানা ঝাপটায়,
কখনো উড়ে গিয়ে বসে গাছের ডালে,
ওদের চোখে দেখি স্বপ্নগুলো জ্বলজ্বলে।

ভালোবাসা লুকোনো ডানার নীচে,
ঠোঁট ছুঁয়ে যায় একে অপরকে আড়ালে।
ওরা কি সত্যিই পাখি,
নাকি দুটো মন,
সুদূরে বসে কেউ কবিতায় লিখছে কোড,
রিমোট হাতে উড়াচ্ছে উড়াল পথ।

চোখ খুলে দেখি, দলছুট দুটি পাখি,
হারিয়ে যায় কোন নদীর তীর ছাড়িয়ে,
কবিতার সীমা পেরিয়ে,
কোন এক তরুচ্ছায়ায়,
নাকি এক আত্মায় মিলে যায়।

হোক না লেখা সেই মন পাখির প্রেমকথা,
হোক না আরেকটা উপন্যাস,
না হয় লিখি আরেকটা অমর গাঁথা,
যেখানে প্রেমের গল্পে বাঁধা থাকবে
ওদের অজানা পথের দুঃখগাথা।

Post a Comment

0 Comments