'ঈশ্বর' আজও প্রাসঙ্গিক
প্রসূন কাঞ্জিলাল
ফোর্ট উইলিয়াম কর্মকালে বিদ্যাসাগর ইতিহাস লেখার দায়িত্ব পেয়ে বুঝলেন ইংরেজ আমাদের ইতিহাস জানে না। সংস্কৃত ও ফার্সী ভাষা দরবারি, সাধারণ মানুষের জীবন বর্ণনা নেই। ওঁর শিক্ষক অশোক এর শিলার পাঠোদ্ধার করেন। তিনিই নাম দেন ব্রাহ্মী লিপি। বিদ্যাসাগর শ্রমজীবী ইতিহাস জানতে আধুনিক ভারতে পালি চর্চা গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তাঁর অনুসারী রবীন্দ্রনাথ, স্যার আশুতোষ এর প্রচেষ্টায় পালি ভাষা নানা বিশ্ববিদ্যালযে পাঠ্য হয়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় উদ্ভাসিত হয়েছে যে সাঁওতালেরা অরণ্য ধ্বংসের প্রতিবাদ করায় তাঁদের উপর বৃটিশ বর্বর অত্যাচার করে। বিদ্যাসাগর, ডে ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল জব্বারৈর কাছে জেনেই সাঁওতাল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর মাধ্যমেই নন্দন কানন বাড়ি কিনে সাঁওতালদের সহমর্মী হয়ে তাঁদের আস্থা অর্জন করেন। অম্লান দত্তের মতে, বিদ্যাসাগর বিশ্বে সর্বজনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পুরোধা এবং নন্দনকানন তার অনন্য নজীর ও পীঠস্থান।
ওড়িশায় অনেকে বলেন, বিদ্যাসাগরের ছাত্র ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরী ও বিজয়চন্দ্র মজুমদার দক্ষিণ এশিয়ায় নৃতত্ত্ব চর্চার পথিকৃৎ। নৃতত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরের অবদান অনেক।
বিদ্যাসাগর এক চিরকালীন অস্তিত্ব। যাঁর জীবন দর্শন, জীবনযাত্রা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, কর্মনিষ্ঠা, মানবাধিকার, মানবিকতা,সুদৃঢ মেরুদন্ড ও নারী শিক্ষার প্রসারে যে কর্মকাণ্ড তা আদতে চলার পথের নীতিশিক্ষার পাঠ স্বরূপ।
মানবাধিকার কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, জীবন ও সভ্যতার সমস্ত দিগন্তেই এর উপস্থিতি। এর মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার মত নাগরিক অধিকার। 'আইনের চোখে সমতা'-র মত রাজনৈতিক অধিকার। আবার সমান কাজের জন্য সমান বেতন কিংবা সম্পত্তি অর্জনের মত অর্থনৈতিক অধিকার গুলিও মানবাধিকারের অঙ্গীভূত। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখার ও অনুশীলনের সাংস্কৃতিক অধিকার গুলিও মানব অধিকারের বৃহৎ আঙ্গিকের অঙ্গীভূত। সম্মতি ভিত্তিক বিবাহ প্রথা কিংবা শিক্ষার অধিকারের মত সামাজিক অধিকার গুলিও মানবাধিকারের ধারার সঙ্গে বিশেষভাবে সংযুক্ত।বিদ্যাসাগরের জীবনব্যাপী সমস্ত প্রয়াসের মধ্যে এই বিভিন্ন ধারার অধিকার গুলি রক্ষার জন্য নিরন্তর প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যাসাগরের কর্মধারায় মানবাধিকার রক্ষার লড়াই এর বিভিন্ন দিক সুস্পষ্ট ভাবেই পরিলক্ষিত।এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব। ঔপনিবেশিক পরি-কাঠামোয় বিদেশীদের দ্বারা অবদমিত, নিয়ন্ত্রিত ও নিপীড়িত ভারতীয় তথা বাঙালী জাতির প্রতিনিধি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, স্বভাবতই প্রতি- পদক্ষেপই তাকে বইতে হয়েছে পরাধীনতার গ্লানি ও হৃত-মানবাধিকারের যন্ত্রনা। সেখানে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে চর্চা ও রক্ষার বিষয়টি আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। ঔপনিবেশিক শোষণ ও সংশ্লিষ্ট নানা কারনে সমাজের অধিকাংশই ছিল দারিদ্র পীড়িত ও শিক্ষার আলোক বঞ্চিত। স্বভাবতই নানা সংস্কার-কুসংস্কারের মায়াজাল তাদের আবদ্ধ রেখেছিল। মধ্যযুগীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের না ছিল কোন অধিকার কিংবা কোন স্বাধীনতা। পুরুষদের বহুবিবাহ, কৌলীন্য প্রথা, পণপ্রথা ও বিধবাদের ওপর নানাবিধ নিপীড়ন ছিল স্বাভাবিক চিত্র। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতির এক বৃহৎ অংশ ছিল শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত। শিক্ষার যে সংকীর্ণ সুযোগটুকু ছিল তাও সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে। সাধারণের মধ্যে ছিল না কোন শিক্ষা তেমনি কোনও সচেতনতাও ছিল না, এই প্রেক্ষাপটেই বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতা।
বিদ্যাসাগর তদানীন্তন পাশ্চাত্ত্য দার্শনিক ধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বেন্থাম, মিল বা অগাষ্ট কোঁতের দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে তাঁর নিবিড় পরিচয় ছিল। তবে তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার পশ্চাতে দর্শনের প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করাও কাম্য নয়। কার্যত এদেশীয় সমাজ, ধর্ম, নীতি কিংবা দর্শনের প্রভাবেই তাঁর চিন্তাধারার মূর্ত রূপ পেয়েছিল। মানুষের সার্বিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করাই বিদ্যাসাগরের যাবতীয় কর্মের প্রেরণা ছিল। ভারতবর্ষীয় সমাজে চিরাচরিত রীতিনীতি, তাঁর পারিপার্শ্বিক ও পারিবারিক আবহ ইত্যাদি ও তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার পিছনে সক্রিয় ছিল। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও উৎপীড়িত নারীদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি, সমানাধিকারের জন্য বহু বিবাহ ও বাল্যবিবাহ রদ, বিধবা বিবাহ প্রচলন, স্ত্রী শিক্ষা তথা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য তাঁর নিরলস প্রয়াস অতুলনীয়।
তিনি নির্দিষ্টভাবে জোর দেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর, তার মতে একমাত্র শিক্ষাই পারে এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অবদানের নানা দিক, যেমন সমাজ সংস্কার, নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবাবিবাহ প্রচলন ইত্যাদি নানান বিষয়ে আলোচনা হলেও বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অবদান ও দৃষ্টিভঙ্গি স্বল্পালোচিত কিন্তু আজও বড়োই প্রাসঙ্গিক। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর ছিলেন পরাধীন ভারতের প্রথম ভারতীয় বিদ্যালয় পরিদর্শক।সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ ব্যতিরেকে ১৮৫৫ সালের ১লা মে,মাসিক ২০০ টাকা বেতনের বিনিময়ে বিদ্যাসাগরের উপর দক্ষিণবঙ্গের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের ভার ন্যাস্ত করা হয়। এছাড়া বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সংগঠিত করার সাথে সাথে হুগলি নদীয়া, বর্ধমান ও মেদনীপুর এই চার জেলার আদর্শ বিদ্যালয় পরিদর্শনের কাজেও নিযুক্ত হন। সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্ব নেওয়ার অব্যহতির পরেই
বিদ্যাসাগরকে উপ-পরিদর্শকের পদে নিয়োগ করা হয়। চারটি জেলার প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা ভাবে ও অন্যান্য বিষয় অতিরিক্ত আরও ১০০ টাকা করে মাসিক ভাতা পান বিদ্যাসাগর।
এই কাজে তাকে বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যেতে হত। একবার এক বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে শ্রেণীকক্ষে ঢুকে তো তার চক্ষু চড়কগাছ! কী কারণ ? একটা লম্বা বেত রাখা শিক্ষকমহাশয়ের টেবিলে! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শাসনের নামে ছাত্রদের প্রহার করাকে ভীষণ অপছন্দ করতেন। তাই শ্রেণীকক্ষের টেবিলে বেতটি দেখে তিনি মনে মনে বড়ই বিরক্ত হলেন। এরপর তিনি শিক্ষককে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই বেতটি দিয়ে কী কাজ হয় ?’
শিক্ষক মহাশয় কঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘শুধুমাত্র ছাত্রদের ম্যাপ দ্যাখানোর জন্যই বেতটি এনেছি।’
বিদ্যাসাগর শিক্ষকের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি, রথ দেখা কলা বেচা–দুই কাজই হবে। বেতটা দিয়ে ম্যাপ দেখানোও যাবে, আবার ছাত্রদের প্ৰহার করাও যাবে। ঠিক বলেছি তো?’ বিদ্যাসাগরের কথা শুনে ঐ শিক্ষক লজ্জা পেয়ে যান। কারণ সত্য প্ৰকাশ পেয়ে গেছে। সেদিন থেকে ঐ শিক্ষক মহাশয় বেত পরিত্যাগ করেন। বর্তমান শিক্ষানীতিতে বারংবার যে বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে, তা হোলো শিক্ষার্থীদের আনন্দদায়ক পরিবেশে শিক্ষা দান। আর এই বিষয়টিতে আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগেই বিদ্যাসাগর মহাশয় আলোকপাত করে গেছেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোলো, প্রকৃত শিক্ষক গঠন অর্থাৎ একজন শিক্ষককে শুধু মাত্র বিদ্বান হলেই হয় না, নানান শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলেই তবেই তিনি প্রকৃত শিক্ষক হয়ে ওঠেন এবং সেই আমলেই বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদ্যালয় গঠন করেন এবং চূড়ান্ত আধুনিক মানসিকতার ছাপ রেখে যান ইতিহাসে। ১৮৫৫ সালে ১৭ই জুলাই সংস্কৃত কলেজের অধীনে শিক্ষকদের শিক্ষনকার্য শেখানোর জন্য "নর্মাল স্কুল" প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর বন্ধু ও অন্যতম শিক্ষাবিদ শ্রী অক্ষয়কুমার দত্তকে ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত করেন।
ঈশ্বর চন্দ্র প্রকৃত পক্ষে এক পীড়িত জাতির বলিষ্ঠ পথ প্রদর্শক ছিলেন। আজও বর্ণপরিচয় যেমন প্রাসঙ্গিক, প্রাসঙ্গিক তাঁর জীবন দর্শন। তিনি আজও মানব কল্যাণের মধ্য দিয়ে জাতি জাগরণের দিশারি।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব রবীন্দ্রনাথের কাছে মনে হয়েছিল যেন এক অতি আশ্চর্য ঘটনা। তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ ভাষণে তিনি লেখেন -- “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না। কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়— মানব-ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপনে কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন।”
রবীন্দ্রনাথের মতে বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বাংলায় ‘একক’, তাঁর স্বজাতি সহোদর কেউ ছিল না। অথচ মানব-ইতিহাসে সম্পূর্ণ একাকীত্ব বিরল, সে কালের বাঙালি সমাজে নিশ্চয়ই একটি দয়ার ঐতিহ্য, উদার মনোভাবের ধারা ছিল, যা ইউরোপ থেকে আমদানি করা লিবারালিজ়ম-এর চেয়ে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবীর তাঁর পুত্রের ওপর সুপ্রভাবের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “ভগবতী দেবীর অকুণ্ঠিত দয়া তাঁহার গ্রাম, পল্লী, প্রতিবেশীকে নিয়ত অভিষিক্ত করিয়া রাখিত।” সমালোচকরা হয়তো মনে করতে পারেন যে, জননী সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা খানিকটা ‘পরিমাণ বহির্ভূত’ হয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের দৃঢ় প্রত্যয় যে, জননীর ও পুত্রের চরিত্রে প্রভেদ নেই, তাঁরা ‘পরস্পরের পুনরাবৃত্তি’। অভিমন্যু যেমন জননী-জঠরে যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন, বিদ্যাসাগর তেমনই ‘বিধিলিখিত সেই মহাশাস্ত্র মাতৃগর্ভবাসকালেই অধ্যয়ন’ করে এসেছিলেন।
সৎকর্ম ও কীর্তির মধ্যে তফাত আছে। বাংলা ভাষাই তাঁর প্রধান কীর্তি। এই অভিমত আমার নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সুচিন্তিত মূল্যায়ন— “বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।” তিনি আমাদের মাতৃভাষা সরল, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে পরিবেশন করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষও বটে । ১৮৪১-এ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত, ১৮৫১-য় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, আর তার পরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠাতা। সংস্কৃত কলেজে তিনি ইংরেজি শিক্ষা আবশ্যিক করেছিলেন, মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে তৈরি করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার সমন্বয়। বিদ্যাসাগর দেখতে চেয়েছিলেন প্রাথমিক ও মেয়েদের শিক্ষার প্রসার। ব্রিটিশ রাজের কার্পণ্যের ফলে তাঁর সেই স্বপ্ন সে ভাবে পূরণ হতে পারেনি। সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ মনোপলি তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন। তাহলে আবার আসি বর্তমান শিক্ষানীতির প্রসঙ্গে - এই নীতিতে প্রথম ও প্রধান শর্তই ' Education for all' অর্থাৎ সবার জন্য শিক্ষা। আর বিদ্যাসাগর প্রায় সার্ধ শতাব্দী পূর্বেই জাতির উত্তরণের জন্য সকলের জন্য খুলে দিয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষার দ্বার। তাঁর দূরদর্শীতাই তাঁর চির প্রাসঙ্গিকতার মূল আধার।
এবার আসি তাঁর আরেক মানবতার অনন্য রূপের পরিচয় নিয়ে - চিকিৎসক বিদ্যাসাগর মহাশয়।তার চিকিৎসা পদ্ধতির মূল অস্ত্র ছিল তাঁর নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর অন্তরের ভালোবাসা।
বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক নাকি ঐশ্বরিক বিবরণ পাওয়া যায় তার কারমাটার বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন "সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় প্রায় শয্যাগত বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া, মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন, হা করাইয়া পথ্য দিতেন উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন।"
ভুবন কৃষ্ণ মিত্র লিখছেন এভাবে হোমিওপ্যাথি মতে ওষুধ তৈরি করে তিনি বহু রোগীকে না জানিয়ে এই ওষুধ সেবন করান এবং বিনা ব্যয় বহু লোকের রোগের উপশম ঘটান। যেকোনো যুক্তিনিষ্ঠ মন অপ্রাকৃত কিছু দেখলে অনুসন্ধানে ব্যস্ত হবেই। বিদ্যাসাগর ও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। পরবর্তীকালে তার বানানো এই ঔষধটি 'Blatta Orientalis' নামসহ মেটেরিয়া মেডিকা বইটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সমাজ সংস্কারক এবং জ্ঞানের সাগর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গবেষণার ইতিহাসে এই কৃতিত্বের কথা হয়তো এখানের বহু হোমিওপ্যাথি গবেষকেরাই আজও জানেন না।
🍂
আরও পড়ুন 👇
পাঁচ দশক আগে অতি বামেরা তাঁর মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ করেছিল। তিনি নাকি ইংরেজ রাজত্বের বিরোধিতা করেননি। অশোক সেন দেখিয়েছিলেন যে, উনিশ শতকে ‘লয়ালটি’ ও ‘অপোজ়িশন’-এর মাঝখানের রেখা ছিল খুবই সূক্ষ্ম। বিদ্যাসাগর ইংরেজদের কাছে কখনও মাথা নত করেননি, নিজের ও বাঙালির আত্মমর্যাদার বিষয়ে তিনি সর্বদা সচেতন ছিলেন। প্রমাণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একটি উদাহরণের উল্লেখ করেন। 'এক বার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার-সাহেব তাঁর ‘বুটবেষ্টিত দুই পা টেবিলের উপর ঊর্ধ্বগামী’ করে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সভ্যতার অভিমান দেখিয়েছিলেন। কিছু দিন পরে যখন এই সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তখন ঈশ্বরচন্দ্র চটিজুতা সমেত তাঁর ‘সর্বজনবন্দনীয় চরণযুগল’ টেবিলের উপর প্রসারিত করে অহঙ্কৃত ইংরেজের সঙ্গে আলাপ করেন।'
কালের কালিমা আর কলুষতা যখন বিষবাষ্প হয়ে সমাজকে মৃতপ্রায় করে তোলে তখনই শান্তি ও সংস্কারের পতাকা নিয়ে আগমন করেন মহামানব, মানবহিতৈষী। চরম বিরোধিতার মধ্যে নিজেকে সংযুক্ত রাখেন শান্তি ও সংস্কারের সাথে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিজয়ীর মালা গলে শোভা পায় তারই। এমনই এক কুসংস্কারের কালিমা ও কলুষতায় লিপ্ত ছিল উনিশ শতকের ভারতীয় সমাজ।সেই কালিমা ও কুসংস্কারকে শান্তি ও মানবতাময় করতে নিবেদিত প্রাণ হয়ে আগমন করেছিলেন মানবহিতৈষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)।
তিনি শিক্ষা জীবনে একজন কৃতী ছিলেন। পেয়েছিলেন শিক্ষাবৃত্তি ও পারিতোষিক। যেহেতু কৃতি শিক্ষার্থী সেহেতু তার মনে সমসাময়িক বিষয়ের নানা অসঙ্গতি দারুণ পীড়া দিত। তাই তিনি ব্যথিত চিত্তে এসব নিয়ে ভাবতেন আর পরিত্রাণ খুঁজতেন। শিক্ষা জীবনে তার অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল হিন্দু আইন। এই হিন্দু আইন সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ অধ্যয়ন করে তিনি ল কমিটির তত্ত্বাবধানে একটি পরীক্ষা দিলে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হলে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে কমিটি তার জন্য যে সনদ প্রদান করে সেখানেই প্রথম 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি যুক্ত ও ভূষিত হয়। এর অর্থ যে তিনি হিন্দু আইনের উপর যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বিদ্যাসাগর হিসেবে দ্বিতীয় যে স্বীকৃতি তিনি পান তা ছিলো ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কলকাতা সরকারী সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য।
হিন্দু আইনসহ উপর্যুক্ত বিষয়াবলীতে যাঁর পাণ্ডিত্য তাঁর নিশ্চয়ই জানা যে, কোন কোন আইনের অপব্যবহারের ফলে এরকম কালিমা ও কলুষতা বিরাজ করছে সমাজে। আদৌ কি সে আইনের কোনও পরিবর্তন বা সংস্কার সাধন সম্ভব কিনা? সেটা তিনি পরিপূর্ণ রূপে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এতদসঙ্গে এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, পশ্চাদপদতা কেন পিছু ছাড়ছে না এ উপমহাদেশের মানুষের। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা গভীর কুসংস্কার এবং আধুনিকতা থেকে পিছিয়ে তা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এসবের মধ্যে তৎকালীন হিন্দু সমাজের ভিতরে যে প্রথম ও প্রধান সমস্যা ছিলো তা হোলো বিধবাদের পুনর্বাসন এবং সমাজের মূল স্রোতের সাথে বিধবাদের একীভূত করণের জন্য বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করণ। নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ছিলই না। বাল্য বিবাহের কুফলে সমাজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কৌলিন্য প্রথার ফলে মানুষকে মানুষ মনে হতো না। তথাকথিত উঁচু শ্রেণির বহুবিবাহ ইত্যাদি ছিল সমাজের প্রগতির অন্তরায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুপযোগী পাঠ্যক্রম ছিলো অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।
সেই যুগে একজন যোদ্ধার মতো তিনি আলোকবর্তিকা নিয়ে শিক্ষার সংস্কারে হাত দিলেন। ইউরোপীয় ভাবধারার নানা বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিষয় তিনি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করলেন। সংস্কৃতকে তিনি বাংলায় পড়িয়ে সহজবোধ্য করলেন। এ জন্য নিজেই কিছু গ্রন্থ লিখেছিলেন। কেননা সময়োপযোগী শিক্ষা ছাড়া জাতি কখনোই উন্নতি করতে পারে না। বিশেষ জোর দিলেন নারীশিক্ষার প্রতি। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কতিপয় মানুষের সাহায্যে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। লর্ড হার্ডিঞ্জের সহায়তায় গ্রামে অনেকগুলো স্কুল স্থাপন করেছিলেন তার মধ্যে ৩৩টি স্কুল স্থায়ী হয়। বেশ কয়েকটি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই যে শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি যে সংস্কার এনেছিলেন তা উপমহাদেশের হিন্দুদের বিশেষ এগিয়ে নিয়েছে। আর নারী সমাজকে দিয়েছিলো শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে নেয়া বিশেষ মর্যাদা।
শিক্ষার ক্ষেত্রে তার আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিলো সংস্কৃত কলেজে সব ধরনের শিক্ষার্থীর পাঠগ্রহণের সুযোগ। যে কলেজের পাঠ গ্রহণের উপর তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের ছিলো দেবত্ব আরোপ। সেখানেই পাঠের সুযোগ লাভে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী নিজেরা একেকজন পরিণত হয়েছিলেন মানবহিতৈষী বা মানব দেবতায়।
এই যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে তার এত অবদান, এত ত্যাগ, পরিশ্রম তা কি শুধু সেই সময়ের জন্য প্রযোজ্য? এর থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? এখনো পথে প্রান্তরে কত নিরক্ষর পথশিশু ফলে ঝরে পড়ে কত মেধাবী ভবিষ্যৎ। তাদেরকে যদি মূল শিক্ষার স্রোতের সাথে একীভূত করা না যায় তাহলে কাঙ্ক্ষিত সমাজ পাবো না উপহার।
আজকের এই কৃত্রিমতা ও লোক দেখানো আভিজাত্যর যুগে বিদ্যাসাগর কতটা প্রাসঙ্গিক, তা বলাই বহুল্য এবং অন্তহীন আলোচনার রসদ। বর্ণপরিচয়ে তাঁর ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ উপদেশ আজকের ও আগামীর সকল ছেলেমেয়েদের নীতি পাঠ হয়ে থাকবেন।কোনো যুগেই তিনি অপ্রাসঙ্গিক নন। আলোচনা শেষ হোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা দিয়ে, তিনি বিদ্যাসাগরের অনন্য কঠিন চরিত্র গুণের সম্পর্কে বলেছেন - “যে গুণে তিনি পল্লী-আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালীজীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে — করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।”
'ঈশ্বর'কে তাই আমাদের বিনম্র আভূমি প্রণাম ।
1 Comments
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন...
ReplyDelete" বস্তুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এত বড় ও আমরা এত ছোট, তিনি এত সোজা ও আমরা এত বাঁকা, যে তাঁহার নাম গ্রহণ আমাদের পক্ষে বিষম আস্পর্ধার কথা বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। বাঙালী জাতির প্রাচীন ইতিহাস কেমন ছিল, ঠিক স্পষ্ট জানিবার উপায় নাই। লক্ষ্মণ সেন ঘটিত প্রাচীন কিংবদন্তী অনৈতিহাসিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যাইতে পারে; কিন্তু পলাশীর লড়াই-এর কিছুদিন পূর্ব হইতে আজ পর্যন্ত বাঙালী-চরিত্র ইতিহাসে যে স্থান লাভ করিয়া আসিয়াছে, বিদ্যাসাগরের চরিত্র তাহা অপেক্ষা এত উচ্চে অবস্থিত যে, তাঁহাকে বাঙালী বলিয়া পরিচয় দিতেই অনেক সময় কুণ্ঠিত হইতে হয়। বাগ্ সংযত, কর্মনিষ্ঠ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও আমাদের মতো বাক্সর্বস্ব সাধারণ বাঙালী, উভয়ের মধ্যে এত ব্যবধান যে, স্বজাতীয় পরিচয়ে তাঁহার গুণকীর্তন দ্বারা প্রকারান্তরে আত্মগৌরব জ্ঞাপন করিতে গেলে বোধহয় আমাদের পাপের মাত্রা আরও বাড়িয়া যাইতে পারে।"