প্রসূন কাঞ্জিলাল
সময়টা ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাস।প্রাক্-গ্রীষ্মের দাবদাহের আভাসের সাথে সাথেই কলকাতায় বেড়ে চলেছে প্লেগের প্রকোপ।ঠিক তার বছর দুয়েক আগেই করাচিতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।তারপর পুণে ও মুম্বাই ঘুরে,সে মহামারী তার করাল থাবা বিস্তার করে তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গদেশেও।
ওয়ালডেমার হপকিন্সের তৈরী প্লেগের ভ্যাকসিন তখন কলকাতায় এসে পৌঁছালেও,'টিকাকরণ জরুরি নয়'- ব্রিটিশ সরকারের এই ঘোষণার ফলস্বরূপ জনমানসে এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল।কোথাও বা ভ্যাকসিন পৌঁছায়নি সরকারের গাফিলতি ও অপরিনামদর্শিতার ফলে,আবার কোথাও বা এই ঘোষণার উপর বিশ্বাস করে জনগণ ভ্যাকসিনের গ্রহনের প্রতি উৎসাহী হয়নি।কিছু ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসও প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে মানুষকে করে রেখেছিল বিজ্ঞানচেতনাহীন।
ঠিক এই টালমাটাল সময়েই,উত্তর কলকাতায় ঘুরে ঘুরে প্লেগাক্রান্ত রোগীদের সেবা করে চলেছেন এক আইরিশ মহিলা।অপরদিকে জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক পদে নিযুক্ত এক চিকিৎসকও,কলকাতার অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে রোগী খুঁজে বেড়াচ্ছেন।রোগীদের চিকিৎসা করছেন।পথ্য কিনতে অপারগ রোগীকে নিজ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন;এই মহামারীর বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করছেন জনমানসে।এরপর সেই বিদেশিনী ও সেই চিকিৎসকের আলাপ হয়;কলকাতায় প্লেগের সংক্রমণ কমাতে ও মৃত্যুর হার হ্রাস করতে তারা একত্রে কাজ করেন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে,সেই আইরিশ মহীয়সী হলেন,- মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল,যিনি ভগিনী নিবেদিতা নামেই আপামর বাঙালি জাতির কাছে সুপরিচিতা।কলকাতায় প্লেগ সংক্রমণের ঠিক এক বছর পূর্বেই (১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী),স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন,এবং স্বামীজির 'শিবজ্ঞানে জীবসেবার' মন্ত্রকেই করে তোলেন জীবনের ব্রত।
এবং সেই জনদরদী চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর।
দেবাশীষ ঘোষের লেখা 'আনন্দ তুমি স্বামী'- উপন্যাসে প্লেগজজর্রিত কলকাতার রাস্তায় ভগিনী নিবেদিতা ও ডাঃ রাধাগোবিন্দ করের প্রথম আলাপের এক সুন্দর বর্ণন রয়েছে।
তবে রাধাগোবিন্দ কর শুধুই কোনও উপন্যাসের চরিত্র নন,তিনি নিযস্য একজন রক্তমাংসের মানুষ।যদিও তার জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় যে,তা গল্প-উপন্যাসের চেয়ে কোনো অংশেই কম ঘটনাবহুল নয়।
রাধাগোবিন্দ করের জন্ম হাওড়া জেলার বেতড়ের বিখ্যাত কর বাড়িতে।জানা যায় যে সেই বাড়ি তৈরী হয়েছিল ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে।কর পরিবারের ইতিহাস সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ।
কর বংশের প্রথম পুরুষ ভূমিঞ্জয় কর থেকে শুরু করে বিংশতিতম পুরুষ পর্যন্ত সকলেই বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করেছিলেন।বেতড়ের বাড়ি তৈরীর কাজে প্রথম হাত দেন কর বংশের একবিংশতিতম পুরুষ শ্রীযুক্ত জয়রাম কর এবং পরে সে ভদ্রাসনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র কর মহাশয়।
এই বাড়িতেই ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ শে আগস্ট রাধাগোবিন্দ কর জন্মগ্রহণ করেন।
তবে যে দালানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন,সেটির এখন ভগ্নপ্রায় দশা।
সেই সময়কার করবাড়ির কোনও চিত্র পাওয়া যায়নি।তবে,রাধাগোবিন্দ করের এক বংশধর শ্রী সৌমিত্র কর মহাশয় তৎকালীন করবাড়ির ছবিকে তাঁর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন।'মাই হোম ইন গ্রীন ডেজ'- নামক সেই চিত্র থেকে বেতড়ের করবাড়ির সেই সময়কালে কীরূপ ছিল তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে তাঁর বংশের উত্তর পুরুষদের থেকে জানা যায়,একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে রাধাগোবিন্দের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলায়।কিন্তু সেই তথ্য ভুল।তাঁর পিতা দুর্গাদাস কর ঢাকায় মিডফোর্ড হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা করেন,ফলে এই ধারণা তৈরী হয় যে,রাধাগোবিন্দের জন্মও ঢাকায়।
বস্তুতঃপক্ষে তাঁর বাল্যকালও কাটে বেতড়েই।তিনি এখান থেকেই কলকাতার তদানীন্তন হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা করেছেন।বাড়ির ঘোড়ার গাড়ি করেই হাওড়ার গঙ্গার ঘাটে পৌঁছাতেন,তারপর নৌকা করে নদী পার হয়ে কলকাতা।সেখান থেকে আবার স্কুলের পথ।
তখনও রবীন্দ্র সেতুর আদি রূপ 'পন্টুন ব্রিজ' তৈরী হয়নি,তাই নৌকাই ছিল ভরসা।
রাধাগোবিন্দ যখন ডাক্তারি পড়া শুরু করেন,তখন তাঁর পঠনপাঠনের সুবিধার জন্য উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে দুর্গাদাস কর একটি বাড়ি তৈরী করেন।বর্তমানে কর বংশের সদস্যরা যদিও সেই বাড়ি সম্পর্কে কিছু তথ্য সেভাবে জানাতে পারেননি।
ডাঃ রাধাগোবিন্দ করের পিতা দুর্গাদাস করও ছিলেন এক কৃতী পুরুষ।তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভার্নাকুলার বিভাগে অধ্যাপনা করতেন।চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর বাংলা ভাষায় বইও তিনি রচনা করেছিলেন।দেশীয় ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চায় গুরুত্ব আরোপের প্রেরণা রাধাগোবিন্দ তাঁর পিতার থেকেই পেয়েছিলেন,একথা বলাইবাহুল্য।তাঁর সমগ্র জীবনে তাঁর পিতার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
পরে হিন্দু স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে,কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসেন তিনি।তাঁর ইচ্ছা ছিল বিদেশে পাড়ি দেওয়ার।পিতার নির্দেশ অমান্য না করতে পেরেই তাঁর ডাক্তারি পড়ায় হাতেখড়ি।তবে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর থিয়েটারের প্রতি টানও ছিল দুর্দম।এটিও যদিও উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া।তাঁর পিতা দুর্গাদাস করের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র।এই মানুষটির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন রাধাগোবিন্দও,যা তাকে ছাত্রাবস্থায়ই থিয়েটারের জগতে টেনে নিয়ে যায়।
পার্থ করের লেখা থেকে জানা যায় যে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে 'বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার' তৈরী করেন রাধাগোবিন্দ।সঙ্গে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ,অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি ও নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
গোটা উত্তর কলকাতায় তখন থিয়েটারের আবহ।রাধাগোবিন্দও ডাক্তারি পড়ার সুবিধার জন্য বেতড়ের পরিবর্তে কলকাতার বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতেন।
এই সময়েই রাধাগোবিন্দও থিয়েটারে সক্রিয় হয়ে উঠেন।১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্রের 'লীলাবতী'-তে ক্ষীরোদবাসিনীর ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন।এছাড়াও,বহু নাটকে স্ত্রী চরিত্রে তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন।
করবাড়ির বর্তমান বংশধরদের কাছ থেকে জানা যায় যে,রাধাগোবিন্দ কোনও দিনলিপি লিখে যাননি।ফলতঃ,তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনাপ্রবাহই রয়ে গিয়েছে অজানা।তবে তাঁর সম্পর্কে বহু তথ্য আমরা পাই একাধিক মানুষের স্মৃতিচারণায়,বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও গবেষণাধর্মী লেখাগুলিতে।যেমন- 'বলাকা' পত্রিকায় (সংখ্যা ২৮,২০০৯) প্রকাশিত সুবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়,১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দে একবার বিনা অপরাধে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন তিনি।শ্যামাপূজার রাতে আতসবাজি পোড়ানো উপলক্ষে এক পুলিশ কনস্টেবলের সঙ্গে তাঁর প্রতিবেশীদের বচসা ও হাতাহাতি হয়।দুর্ভাগ্যক্রমে,সেই সময়ে রাধাগোবিন্দ সেই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।তাই তিনিও গ্রেফতার হন।এছাড়া তাঁর প্রথমা পত্নীর অকালপ্রয়াণও সেইসময়কালে তাকে করে তুলেছিল বিচলিত।এইসকল বিক্ষিপ্ত ঘটনা ও পড়াশোনার বদলে থিয়েটারের প্রতি টান তাঁর ডাক্তারি পড়ায় বাধা সৃষ্টি করে।কলকাতা থেকে স্কটল্যান্ডে পাড়ি দেন তিনি।সেখানে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে।তাঁর বিদেশযাত্রায় তাঁর সাথী ছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ডাক্তার আশুতোষ মিত্র।১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে রাধাগোবিন্দ পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন এবং এখানেই নিজের ডাক্তারি পড়া শেষ করেন।
অন্যদিকে নজর ফেরানো যাক রাধাগোবিন্দের ডাক্তারি পাঠরত অবস্থায় কলকাতার চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন ছিল সেইদিকে।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরী হয়েছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ।নিজেদের স্বার্থেই ব্রিটিশ সরকার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরীতে উৎসাহী ছিল।প্রচলিত দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্রিটিশ শাসকদের তেমন ভরসা ছিল না।তাছাড়া ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করা ছিল উপনিবেশ স্থাপনেরই একটি অংশ।
ইউরোপীয় চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই সময়ে যেসকল বাঙালি ডাক্তারগণ শিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মধুসূদন গুপ্ত।তিনি প্রথম বাঙালি ডাক্তার হিসাবে অস্ত্রোপচার করার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।কিন্তু রাধাগোবিন্দের সেই খ্যাতি ছিল না।কিন্তু তবুও,সারাজীবন ধরে তিনি চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁর যে অবদান রেখে গিয়েছেন,তাতে মধুসূদন গুপ্তের পরেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি ডাক্তার হিসাবে অভিহিত করলে অত্যুক্তি করা হবে না।এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে,যেমন - চিকিৎসাবিদ্যা চর্যাচাকালীন যাতে মাতৃভাষাতেই বাঙালি চিকিৎসকরা শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেন,সেই কাজে নিজেকে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করেন রাধাগোবিন্দ।
শঙ্করকুমার নাথের লেখা বই কলকাতা ‘মেডিক্যাল কলেজের গোড়ার কথা ও পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত’ থেকে জানা যায়, যখন ইউরোপীয় চিকিৎসকেরা দেশীয় চিকিৎসক ‘ক্যাডার’ গড়ে তুলতে চাইছিলেন, তখন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা। হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করা গুটিকয়েক ছাত্র ইংরেজি জানতেন। তা ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞান তো দূরের কথা, বাংলায় লেখা সাধারণ বিজ্ঞানেরও ভাল কোনও বই ছিল না। সহপাঠীদের দেখেও এই অসুবিধের কথা নিজে অনুভব করেছিলেন রাধাগোবিন্দ। তাই ডাক্তারি পাশ করার আগেই বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লেখার কাজে হাত দেন। তাঁর প্রথম বই ‘ভিষগবন্ধু’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭১ সালে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি একাধিক বই লেখেন। উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল ‘সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব’, ‘রোগী পরিচর্য্যা’, ‘ভিষক সুহৃদ’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগের চিত্রাবলী ও সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব’, ‘সংক্ষিপ্ত শিশু ও বাল চিকিৎসা’, ‘সংক্ষিপ্ত ভৈষজতত্ত্ব’, ‘কর সংহিতা’ ও ‘কবিরাজ ডাক্তার সংবাদ’। সব ক’টি বই লেখা হয়েছিল বাংলায় এবং সাধারণ মানুষের পড়ার উপযোগী করে। ইংরেজি জানা ডাক্তারি ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁর বই পড়তেন। থিয়েটারের মতোই বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লেখার ক্ষেত্রেও রাধাগোবিন্দের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বাবা। দুর্গাদাস কর নিজে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও বাঙালি মানসে ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থার আগ্রাসী রাজ্যবিস্তারকে মেনে নেননি। চিকিৎসা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা ছিল আরও প্রবল। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বহু ইংরেজি শব্দকে বাংলায় অনুবাদ করা ছিল শক্ত। দুর্গাদাস লক্ষ করেছিলেন, ভারতের নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থার ন্যারেটিভে ইউরোপীয় চিকিৎসা শিক্ষা শুধু মাত্র থাবাই বসায়নি, এক রকম তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেও উঠে পড়ে লেগেছিল। দুর্গাদাস এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধাচরণ করতে কলম ধরেছিলেন। ১৮৬৮ সালে ‘ভাষজ্য রত্নাবলী’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন তিনি। বইয়ে ছিল একাধিক গাছগাছড়ার ছবি। পল্লিগ্রামের ছোটখাটো চিকিৎসকেরা ‘ভাষজ্য রত্নাবলী’ পড়ে চিকিৎসা করতেন। রাধাগোবিন্দ নিজে বই লেখার পাশাপাশি পরবর্তী কালে বাবার লেখা বইয়ের সম্পাদনাও করেন এবং বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লেখা যে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের রোগীদের সমস্যার সমাধান নয়, তা ছাত্রাবস্থাতেই বুঝতে পেরেছিলেন রাধাগোবিন্দ। তাঁর এই উপলব্ধির আভাস পাওয়া যায় ‘ভিষগবন্ধু’ বইয়ের মুখবন্ধে। তিনি লিখেছিলেন,
‘‘যাহারা চিকিৎসা বিদ্যালয় হইতে সুশিক্ষিত ও কৃতকার্য হইয়া চিকিৎসা কার্যে প্রবৃত্ত হয়েন তাঁহারা যতই বুদ্ধিমান ও বিদ্বান হউন না কেন, তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই বহুদর্শিতার অভাবে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করিতে সহজে সক্ষম হন না।’’
সেই সময়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে উঠলেও যে বহু রোগীই আসলে ঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতেন, এ কথা জানতেন রাধাগোবিন্দ। ইউরোপীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় শিক্ষিত ডাক্তারদের মধ্যে ইউরোপীয় ডাক্তারেরা ভারতীয় রোগীদের অবজ্ঞাই করতেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য ও উপনিবেশে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা। দেশের মানুষদের চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরনো আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও সদ্য শেখা ইউরোপীয় চিকিৎসা— এই দুই টানাপড়েনে পড়তেন বাঙালি চিকিৎসকেরাও। রাধাগোবিন্দ কর বুঝেছিলেন যে দেশের মানুষের চিকিৎসার জন্যে তাই শুধু নির্দেশিকা, পুস্তিকা বা বই প্রকাশ যথেষ্ট নয়। বরং প্রয়োজন গোটা একটি পৃথক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের। সেই কলেজ বা হাসপাতালটিকে হতে হবে ব্রিটিশ নিয়মাবলির ফাঁস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই উদ্দেশ্য সাধনে রাধাগোবিন্দের ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছিল তাঁর চিকিৎসা জীবনের প্রথম থেকেই। ১৬১ নম্বর পুরনো বৈঠকখানা বাজারের এক বাড়িতে তিনি কলকাতার তৎকালীন সেরা কয়েক জন বাঙালি চিকিৎসককে সঙ্গে নিয়ে একটি সমিতি স্থাপন করেন। সমিতির সদস্য ছিলেন মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিপিন মিত্র, কুমুদ ভট্টাচার্য প্রমুখ। এই সমিতিতেই এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল তৈরির প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৮৮৬ সালে শুরু হয় স্কুল। নাম হয় ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন’। প্রথমে দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষাদান চলত। ১৮৮৭ সালে অ্যালোপ্যাথি বিভাগ শুরু হয়। নাম বদলে হয় ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল’। পরে বৈঠকখানা বাজার থেকে স্কুলবাড়ি স্থানান্তরিত হয় বৌবাজার স্ট্রিটে। ১৮৯০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকার স্কুলে শব ব্যবচ্ছেদের অনুমতি দেয়। প্রথম দিকে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুলে সমস্ত বিভাগেই পড়ানো হত বাংলায় লেখা বই। রাধাগোবিন্দ করের লেখা বইগুলি তো ছিলই, সেই সঙ্গে মধুসূদন গুপ্তের লেখা বইও ছিল পাঠ্যক্রমে। ক্রমে রাধাগোবিন্দ করের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হতে থাকে। ২৯৮, আপার সার্কুলার রোডের ঠিকানায় স্কুলবাড়ি স্থানান্তরিত করা হয়। সেই সময়ে মেডিক্যাল স্কুল সংলগ্ন হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ছিল মাত্র ১৪! এর পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘে জমি কেনে। যুবরাজ অ্যালবার্ট ভিক্টরের ভারত ভ্রমণের তহবিল থেকে আঠেরো হাজার টাকা সাহায্য মেলে। স্কুলের নিজস্ব বাড়ি তৈরি হয়। তবে তখনও সামান্য শয্যাসংখ্যার জন্য স্কুলে হাসপাতালের ব্যবস্থা পুরোদমে শুরু করা যায়নি। ১৮৯৯ সালে স্কুল সংলগ্ন হাসপাতালও তৈরি হয়। জন উডবার্ন হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। তাঁর নামানুসারে হাসপাতালের নাম রাখা হয় ‘অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল’। হাসপাতালে ডিসপেন্সারি গড়ে তোলার টাকা দেন বাবু মানিকলাল শীল। রাধাগোবিন্দ করের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপনের কয়েক বছর পরেই আরও একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়— ‘কলেজ অব ফিজ়িশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স অব বেঙ্গল’। ১৮৯৫ সালে তৈরি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৯০৪ সালে রাধাগোবিন্দ করের তৈরি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই যৌথ প্রতিষ্ঠানটিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ হয় ১৯১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই ভাবেই বহু উত্থান-পতন পেরিয়ে রাধাগোবিন্দ করের ছোট্ট চারাগাছটি মহীরুহ হয়ে ওঠে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল একাধিক ঠিকানা বদল ও নাম বদলের পরে রাধাগোবিন্দের নামে নামাঙ্কিত হয়। মেডিক্যাল এডুকেশন সোসাইটি অব বেঙ্গলের সাধারণ সভায় গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী নাম রাখা হয় ‘আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল’। যদিও নিজের নামাঙ্কিত হাসপাতাল রাধাগোবিন্দ কর দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু রাধাগোবিন্দ করকে তাঁর সবচেয়ে বড় সম্মান সম্ভবত দিয়েছিলেন বাংলারই আরও এক প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক— বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৪৮ সালের ১২ই মে নাম পাল্টে আর জি কর হয়। ১৯৪৮ সালে কলকাতার জনৈক ধনী ব্যক্তি বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজের তহবিলে দুই লক্ষ টাকা দান করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। শর্ত ছিল— তাঁরই পরিবারের কোনও সদস্যের নামে রাখতে হবে কলেজের নাম। কলেজের আর্থিক সঙ্কটের কথা চিন্তা করে এই প্রস্তাবে সায় ছিল কলেজ কমিটির। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তিনি ব্যাপারটি নিজের উদ্যোগে আটকেছিলেন এবং রাধাগোবিন্দ করের নামেই কলেজের নাম রাখা হয়।দেশের মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থার পথ সুগম করতে রাধাগোবিন্দ করের লড়াই প্রথমে বাঙালি সমাজের সমর্থন পায়নি। এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও (বিদ্যাসাগর) তাঁকে নিরুৎসাহ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বক্তব্য ছিল— সাধারণ স্কুল স্থাপন করা আর মেডিক্যাল স্কুল স্থাপন করার মধ্যে বিস্তর ফারাক। রাধাগোবিন্দ অবশ্য হাল ছাড়েননি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কারিগরি দিক, বই লেখা ও রোগী দেখার কাজে যেমন তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন, তেমনই স্কুল স্থাপনের অর্থ সংগ্রহের জন্যও চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। চিকিৎসক রীতম জোয়ারদারের লেখা প্রবন্ধ ‘ডক্টর রাধাগোবিন্দ কর: আ ফিলানথ্রপিস্ট অ্যান্ড পায়োনিয়ার ইন মেডিক্যাল এডুকেশন’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, হাসপাতাল তৈরির অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাক্তার বন্ধু শৈলেন গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাড়ি, ধনী পরিবারের বিয়েবাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন রাধাগোবিন্দ। শত অপমান সহ্য করেও নিরহঙ্কার মানুষটি হাসপাতাল তৈরির স্বপ্ন সার্থক করার জন্য নির্দ্বিধায় অর্থ সাহায্য চাইতেন। শুধু তাই নয়, চিকিৎসক হিসেবে স্বোপার্জিত অর্থের সমস্তটাই দান করে গিয়েছেন মেডিক্যাল স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনে। অরুণকুমার চক্রবর্তীর ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে বাঙালি’ বইটি থেকে জানা যায়, মৃত্যুর সময়ে রাধাগোবিন্দ করের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল বেলগাছিয়ায় গড়ে তোলা একটি বাড়ি। সেই বাড়িটিও উইল করে দান করে যান মেডিক্যাল কলেজকে। উইলের শর্ত ছিল, তাঁর মৃত্যুর পরে জীবিতাবস্থায় বাড়িটির মালিকানা ভোগ করবেন তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী। তার পরে বাবা দুর্গাদাসের নামে স্থাপিত হবে ‘দুর্গাদাস আরোগ্য নিকেতন’।
প্লেগের মতো মারণরোগের মোকাবিলায় নিজের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়া, মাতৃভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই লেখা ও সম্পাদনা, শত বাধা পেরিয়ে এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপন— এ সমস্তই ছিল রাধাগোবিন্দ করের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ববোধের পরিচায়ক। তিনি অসম্ভব ভাল সংস্কৃত জানতেন। সেই জ্ঞান কাজে লেগেছিল দেশীয় প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি পাঠে। কাজে লেগেছিল বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালসের হয়ে ওষুধ তৈরিতেও। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মজীবনী ‘লাইফ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সেস অব আ বেঙ্গল কেমিস্ট’ থেকে জানা যায়, দেশের প্রথম ফামার্সিউটিক্যাল সংস্থা তৈরির সময়ে রাধাগোবিন্দ করের অকুণ্ঠ অর্থকরী সাহায্য ও উৎপাদনগত পরামর্শের কথা। তিনি বুঝেছিলেন, দেশের মানুষের চিকিৎসায় খামতি ঢাকতে হাসপাতাল গড়ে তোলা, চিকিৎসক তৈরি করা, মেডিক্যাল স্কুল স্থাপন ও বই লেখাই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি রোগীকে যাতে চড়া দাম দিয়ে বিদেশি ওষুধ কিনতে না হয়, সে দিকেও ছিল তাঁর কড়া নজর। তাই দেশীয় পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরির কাজেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন রাধাগোবিন্দ। তাঁর সমস্ত কীর্তির কথা মাথায় রেখে তাই এ কথা বলাই যায় যে, রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন উনিশ শতকের বাংলায় প্রকৃত রেনেসাঁ পুরুষ।
দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলার এই প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক, লেখক, সমাজসংস্কারক ও থিয়েটার ব্যক্তিত্বকে আত্মবিস্মৃত বাঙালি মনে রাখেনি। রাধাগোবিন্দ করের বর্তমান বংশধরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হাওড়ার সাঁতরাগাছি অঞ্চলের বাইরে বেশির ভাগ মানুষই জানতেন না রাধাগোবিন্দের জন্মভিটে কোথায়! বছর তিনেক আগে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের দুই চিকিৎসক রাধাগোবিন্দের জন্মভিটের খোঁজে বেতড়ের বাড়িতে এসে পৌঁছন এক দিন। সেই ঘটনার পরেই ধীরে ধীরে ফের আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বর্তমান চিকিৎসকেরা রাধাগোবিন্দ করকে নিয়ে উৎসাহ দেখাতে শুরু করেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও তৎপরতা দেখা যায়। উনিশ শতকের শেষ ভাগে রাধাগোবিন্দ বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল ও হাসপাতাল গড়ার কাজ শুরু করলেও ১৯১৬ সালের ৫ই জুলাই দিনটাকেই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ধরা হয়। তখন ‘বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ’ নামে পরিচিত ছিল অধুনা আর জি কর হাসপাতাল। সেই হিসেবে ২০১৬ সালটি ছিল রাধাগোবিন্দ করের কীর্তির একশো বছর পূর্তি। শতবর্ষে রাধাগোবিন্দ করকে শ্রদ্ধা জানাতে বেতড়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন সমাজের একাধিক সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের পক্ষ থেকে রাধাগোবিন্দ করকে স্মরণ করে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করা হয়।
১৯১৮ সালের ১৯শে ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাধাগোবিন্দ কর। এই কর্মবীর,জনদরদী চিকিৎসকের মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে একশো বছরেরও বেশি। জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরেও তিনি তাঁর প্রাপ্য যথার্থ সম্মান পেয়েছেন, এ প্রমাণ কিন্তু মেলে না ।।
তথ্যসূত্র
১. ৩০শে মার্চ ২০১৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শঙ্করকুমার নাথ ও পার্থ কর লিখিত প্রবন্ধ।
২. ‘বলাকা’ পত্রিকা, বর্ষ ১৮, সংখ্যা ২৮, ২০০৯)।
৩. আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃক প্রকাশিত শতবার্ষিকী সংখ্যা।
৪. চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালি, অরুণকুমার চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৮)।
৫. আনন্দ তুমি স্বামী, দেবাশিস ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৭)।
৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই জুলাই ২০১৫ সাল।
৭. বিশেষ সহায়তা - মৌমিতা ভৌমিক।
৮. আন্তর্জাল ও অন্যান্য।
1 Comments
ধন্যবাদ
ReplyDelete