জ্বলদর্চি

নিজেকেই হতে হবে নিজের শিক্ষক/ ঋত্বিক ত্রিপাঠী


নিজেকেই হতে হবে নিজের শিক্ষক 


ঋত্বিক ত্রিপাঠী

আজ হিংসা-খুন-ধর্ষণের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে আন্দোলন করছে। এই প্রতিবাদী সত্তা প্রমাণ করে আজও মানুষের ভিতরের মানুষ জেগে আছে। এই ভিতরের মানুষটাই আসলে নিজের শিক্ষক। সে লড়াই জানে। হারতে শেখেনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ এভাবেই ঘুরে দাঁড়ায়। ইতিহাস তাই বলছে।

সাধারণ ধারণা যিনি সিলেবাস অনুযায়ী প্রশ্ন উত্তর তুলে ধরেন তিনি শিক্ষক। তা কিন্তু না। শিক্ষক তিনি— যিনি এগিয়ে ভাবেন ও এগিয়ে যেতে ভাবনা দেন। শেখান — সততা নিয়ে বাঁচতে। অন্যায়কে অন্যায় বলতে শেখান। স্রোতের বাইরে বেরিয়ে নতুন কিছু বলেন। সেই বিচারে একজন বন্ধু কিংবা একজন অভিভাবক কিংবা অপরিচিত একজন মানুষও হয়ে উঠতে পারেন জীবনের শিক্ষক। 

প্রতিবছর শিক্ষক দিবস আসে। আয়োজন বড় হয়ে দেখা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় উৎসবের মেজাজ। পেশায় শিক্ষক মানেই প্রকৃত শিক্ষক নাও হতে পারেন। কিন্তু তাঁরা অবশ্যই শিক্ষাজীবী। কিংবা বয়সে বড় বলেই তিনি যা বলছেন, সঠিক বলছেন— তাও নয়। বিজ্ঞানের অধ্যাপকের হাতের আঙুলে থাকতেই পারে মিথ্যা যুক্তির মন্ত্রপূত গ্রহরত্ন। শ্রেণিকক্ষে 'একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান' বলে যাঁরা রোজ ক্লাশ নেন, মাসের এক তারিখে বেতন নেন, তাঁদের অধিকাংশজনই কিন্তু নিজের সন্তানের বিয়ের বিজ্ঞাপনে জাত-গোত্র-রাশি ব্যবহার করেন, গর্বের সঙ্গে। কারণ তাঁরা জানেন ক্লাসরুমের ব্যাকরণ ও ব্যক্তিজীবন এক না হলেও চলে, শিক্ষক তকমা খর্ব হয় না তাতে।

 প্রথাবদ্ধ সিলেবাসে আছে স্থিতিজাড়্য, গোঁয়ার স্বভাব। অধিকাংশ শিক্ষক সিলেবাসের বাইরে যাওয়াকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন। হাতেগোনা দু'চার জন যদিও বা চান মনেমনে, বাস্তব প্রয়োগে সাহস পান না। সৃজনশীলতার গুরুত্ব না থাকায় নিছক মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে তথ্যে সমৃদ্ধ তোতাপাখি-শিক্ষকরা ব্যক্তিচরিত্রেও আর পৃথক নন— যেন সবাই এক সংখ্যায় চিহ্নিত। নেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। তাই শিক্ষক-শিক্ষিকার অনন্য ব্যক্তিত্বে তেমনটা আর অনুপ্রাণিত হয় না আজকের ছাত্রছাত্রী। এই ছাত্রছাত্রীরাই একদিন শিক্ষক-শিক্ষিকা হন, চাকুরীজীবী হন। সমাজে প্রকৃত শিক্ষকের অভাবটা থেকেই যায়।

পরিবারের প্রবীণ সদস্যগণ অনেক সময়ই কুসংস্কারাছন্ন, জাতপাতে বিশ্বাসী। এঁদের অন্ধ অনুকরণ না করে নিজেকেই হতে হবে যুক্তিনিষ্ঠ। চাই, আত্মজিজ্ঞাসা। কেমন করে বাঁচব! উত্তর: নিজের মতো বাঁচব। নিরপেক্ষ হব। স্বাধীনচেতা হব। তাতে তো দুঃখ আসবে। আসবেই তো! তার জন্য চাই দুঃখের সাধনা। 

প্রথানুগ শিক্ষা ও ভাবনার বাইরে যাঁরা বেরুতে পেরেছেন তারাই হয়েছেন কালজয়ী। আর তাঁদের ওপর ভর করেই এগিয়েছে সভ্যতা। প্রকৃত শিক্ষক তাঁরাই। সেই বিচারে একজন সৎ কৃষক, নির্লোভ শিশু, গ্রামের বিজ্ঞানমনস্ক যুবক প্রকৃত শিক্ষক। "সত্যিকারের শিক্ষক তাঁরাই, যাঁরা আমাদের ভাবতে সাহায্য করেন।"— এই অমোঘ বক্তব্য ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের। যাঁরা জন্মদিবস উপলক্ষে আমাদের জাতীয় শিক্ষক দিবস। স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল— শিক্ষকই পারেন শিক্ষার মাধ্যমে সমাজকে শুদ্ধ করতে। অবশ্য এর জন্য শিক্ষকের চাই অনুশীলন— প্রকৃত শিক্ষক হয়ে ওঠার লক্ষ্যে।

সেই কতকাল আগে নিকোলাস কোপারনিকাসের (১৪৭৩-১৫৪৩) মতবাদে বিশ্বাসী হলেন গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২)। তিনিও বললেন পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু বিনিময়ে পেলেন অপমান, দণ্ডাদেশ, বন্দিদশা। চৈতন্যদেব প্রতিষ্ঠা করলেন সর্বধর্মসমন্বয়ে মানবপ্রেম। রামমোহন রায়ের আন্দোলনে বন্ধ হল সতীদাহপ্রথা। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ বন্ধ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এঁরা বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে ভাবতে পেরেছিলেন, ভাবাতে পেরেছিলেন। বিনিময়ে সমকালে পেয়েছেন অপমান, কিন্তু কর্মে ছিলেন স্থির। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যুতে শোকাহত হচ্ছেন, হাজারো অপমানে বিদ্ধ হচ্ছেন অথচ সৃজনে মগ্ন। তাঁর ছিল দুঃখকে শোষণ করার ক্ষমতা। আসলে জীবন তো তাই, বেশিরভাগটাই না-পাওয়া, অল্প যা কিছু পাওয়া তার জন্যেও প্রয়োজন কঠিন পরিশ্রম। অথচ, আমরা সামান্য না-পাওয়াকেই বড় করে তুলি। কিন্তু অধিকাংশ কালজয়ী মানুষ জীবন শুরু করেছেন শূন্য থেকেই। তাঁরাই তো আমাদের পথপ্রদর্শক, শিক্ষক।

কিশোর বয়সেই হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। প্রবল আর্থিক সংকট। নিজের আয়ুও অল্প, মাত্র ২৬ বছর । কিন্তু তিনি ছিলেন প্রবল আত্মবিশ্বাসী। জন কিটস। আজও পৃথিবীখ্যাত রোমান্টিক কবি। পৃথিবীর অন্যতম মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড। মৃত্যুর আগের ১৫ বছর ক্যান্সারের কষ্ট যন্ত্রণা এড়াতে বারবার অস্ত্রোপচারের ঝক্কি নিয়েছেন। অথচ তাঁর গবেষণার ছেদ পড়েনি। আমরা জানতে পারলাম মনের চেতন অবচেতনের রহস্য। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং স্কুলজীবনে ছিলেন পেছনের দিক থেকে প্রথম। অথচ তিনিই আবিষ্কার করেন বিশ্ব সৃষ্টির 'বিগ ব্যাং থিওরি'। ২১ বছর বয়স থেকে দুরারোগ্য মটর নিউরন রোগে আক্রান্ত স্টিফেনের বক্তব্য, “জীবন যেমনই কঠিন হোক না কেন অবশ্যই এমন কিছু আছে যা তুমি করতে পারবে এবং সে কাজে তুমি সফল হবে।”

পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ছাত্র মণি ভৌমিকের জন্ম অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার তমলুকে। নুন- লঙ্কা পান্তাভাদের জীবন তাঁর। ১৯৪২-এর মন্বন্তরে তাও জোটেনি। গরু চরিয়ে তারপর স্কুল। যখন পায়ে প্রথম চটি উঠল, তখন তাঁর বয়স ষোলো। এক্সিমার লেজার আবিষ্কর্তা। এক ডজন লেজারের পেটেন্ট হওয়ায় তিনি বর্তমান চরম বিত্তশালী।

সবসময় সফল ব্যক্তির কাজই যে অনুপ্রেরণা দেয় তা তো নয়। আপাত হারের মধ্যেও আমরা পাই দৃঢ়তা, শক্তি-উৎস। পাই জয়ের সুষমা। মণিপুর থেকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে দীর্ঘ ১৬ বছর অনশন করেও সফলতা পাননি ইরম শর্মিলা চালু। তবে সময়ই বলবে তাঁর আত্মত্যাগের গুরুত্ব। কারণ, ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সবসময় সঠিক কথা বলে না। তাই প্রকৃত শিক্ষক তাঁরাই, যাঁরা সময়ের থেকে এগিয়ে ভাবেন, ভাবিয়ে তোলেন।

পরিবেশ ও পরিস্থিতি, জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা শিখি বেশিরভাগটাই। তাই স্মৃতিকে সংরক্ষণ করি, সাবধানী হই। অবশ্য রবি ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়েই জাগিয়ে তুলি সত্তা। তাই 'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ'—এই বোধে ভবিষ্যতে পা বাড়াই। এই হল আমাদের পাঠ গ্রহণ ও পাঠ দানের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ।

নিছক আয়োজন কিংবা উৎসব নয়, শিক্ষক দিবস হয়ে উঠুক আত্ম-আবিষ্কারের দিন। নিজেকেই হতে হবে নিজের শিক্ষক।

🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব সুন্দর

    ReplyDelete
  2. অসামান্য বিশ্লেষণ। আসুন সবাই চেষ্টা করি।
    আন্দোলন দেখে সত্যি ভরসা জাগছে।এত প্রলোভন,ভয়, আগ্রাসী অন্তর্জালের মধ্যেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোমল মনটি হারিয়ে যায়নি।

    ReplyDelete