দূর দেশের লোক গল্প -- ২০৮
কুমির রাজার বউ
লাওস (এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
এক দিন এক চাষি বেরিয়েছে তার গমের খেত পাহারা দিতে। নদীর গায়েই জমি। বেশ উর্বরা। ফলনও ভালই হয়েছে এ বছর। দানা পুরুষ্টু হয়ে উঠেছে গাছে গাছে। ক’দিন বাদে পাক ধরবে।
সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। হাতে একটা টেকসই গুলতি। গাছে ফসল এলেই, শুরু হয় উৎপাত। খরগোশ, শূকর এসে জোটে। ভীষণ ফসল নষ্ট করে। হাতে গুলতি থাকলে, ভারি উপকার হয়। আড়ালে থেকে গুলতি ছোঁড়। ঢাঁই করে গিয়ে লাগবে। অমনি এক লাফে, দে ছুট।
খেতে পৌঁছে, চাষির তো চোখ কপালে উঠে গেল। সাত-আটটা কুমির শুয়ে আছে খেতে। হায়-হায় করে উঠল লোকটা। হাতের গুলতি কোন কাজে আসবে না এখন। যা দানবের মতো চেহারা এক-এক জনের!
এগিয়ে গিয়ে ধমক লাগাল—আরে হতচ্ছাড়ার দল। এ কী সর্বনাশ করেছিস আমার। ভাগ বলছি এখান থেকে।
সে কথায় কী আর কাজ হয়? কুমিরগুলো ভারি বিরক্ত হয়েছে। তারা একটা করে লম্বা হাই তুলল, আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে। তা দেখে চাষির তো প্রাণ যায় অবস্থা। এই বুঝি গিলে ফেলল। দু’পা পিছিয়ে এলো লোকটা।
কুমিরগুলো করল কী, একবার করে ওলট-পালট খেয়ে, আবার শুয়ে পড়ল। আরও কতকগুলো গাছ মাড়িয়ে গেল তাতে। ঘরে বউ আছে। তার কথা মনে পড়ে গেল চাষির।
হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি এসে হাজির। বউ তো সব শুনে, রেগে কাঁই—কোন আক্কেলে সব ছেড়েছুড়ে ঘরে ফিরে এলে তুমি। আবার যাও। হতভাগাগুলোকে নদীতে ফেরত পাঠিয়ে, তবে আসবে।
চাষি ফিরে এসেছে। এবার গলা চড়িয়ে বলল—এখানে কেন? নিজের জায়গায় ফিরে যাও এক্ষুনি।
হাতের সামনে ছোট বড় পাথর যা পেল, তাই ছুঁড়তে লাগল। কুমিরগুলো গ্রাহ্যই করল না তাকে। বরং বিশাল হাঁ করে চেয়ে দেখল চাষির দিকে। সে কী হাঁ। আর দাঁত তো নয়, এক একটা মূলো।
চাষি কিন্তু ভয় পেয়ে গেছে। কাতর গলায় বলল—দোহাই তোমাদের। আমাকে রেহাই দাও দয়া করে। এভাবে আমার ফসল নষ্ট কোর না। তোমাদের নিজের জায়গায় ফিরে যাও।
একটা কুমির বলল—ঠিক আছে, আমরা চলে যাব। তার বদলে, একটা উপহার দিতে হবে তোমাকে। কথা দিয়ে যাবো, কোনদিন তোমার ফসল নষ্ট করব না আমরা। অন্য কেউও না করে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখব।
চাষি তো আহ্লাদে অষ্ট আশি খানা। খেত পাহারা দেবার দায় নেমে যাবে মাথা থেকে। এর চেয়ে ভালো, আর কী হতে পারে। খুশির গলায় বলল—বলো, কী উপহার চাই? কথা দিচ্ছি। খেলাপ হবে না। যা চাইবে, দেবো।
--আমাদের রাজামশাই তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। সেজন্যই তো এখানে এসে, তোমার অপেক্ষা করছি আমরা।
চাষি বলে দিল—ঠিক আছে, তাই হবে। এদিকে মনে মনে ভাবছে, এখন তো বিদায় করি শয়তানগুলোকে। পরে ঝামেলা করলে, দেখা যাবে। জলের জীব, ডাঙ্গায় আর কত কেরামতি দেখাবে?
আনন্দে ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে চাষি। বউ তো শুনে চেঁচিয়ে উঠেছে—কোন আক্কেলে এমন কথা দিয়ে এলে তুমি? আরে, একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। তাকে একটা কুমিরে সাথে বিয়ে দেবে তুমি?
চাষি বলল—এত ভাবনার কী আছে? এক-দু’দিনের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি আমি। তুমি দেখতে থাকো।
--সে তো দিলে? এদিকে যে কথা দিয়ে এসেছ? তার কী হবে?
--বলে দেব, মেয়ে তো বিয়ে করে চলে গিয়েছে।
দু’-এক দিন খোঁজখবর করে, একটি ছেলেকে জোগাড় করে ফেলেছে চাষি। চাষির মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দরী, গুণেও মেয়েটি লক্ষ্মী। ছেলে পেতে ভাবনা করতে হয় না। কিন্তু কপালে না থাকলে যা হয়। বিয়ের দিনই একেবারে আচমকা ছেলেটা মারা গেল। মেয়েকে সরিয়ে ফেলার সুযোগই পাওয়া গেল না।
আবার একটি ছেলে জোগাড় করা হয়েছে। সে ছেলের বিয়ের আগের দিন বুকে যন্ত্রণা। আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে মারা গেল সেও।
দেখে শুনে মেয়েটা ভারি বিরক্ত। বলল—আমার জন্য দু’-দুটো ছেলের জীবন গেল। এবার থামো তোমরা। কথার খেলাপ করা ঠিক নয়। ঐ কুমির রাজাকেই বিয়ে করব আমি।
তার মা কাঁদতে লাগল হাপুস নয়নে। বাবা বলল—তা কী করে হয়, মা। আমাদের একমাত্র মেয়ে তুই। আর ও তো একটা দৈত্য। কী করে তোকে তার হাতে তুলে দেব?
চাষি নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই রাজি নয়। জেদ করে বসে রইল—কিছুতেই এ বিয়ে হবে না। এই আমি বলে দিলাম।
মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে, এক দৌড়। সোজা নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির। চেঁচিয়ে বলল—শুনছো তোমরা? তোমাদের রাজাকে বলে দাও। কথার খেলাপ আমরা করি না। বিয়ের জোগাড় করতে বল।
একটা দিনও যেতে পেল না। পরদিনই একদল কুমির চাষির বাড়ি এসে হাজির। নতুন শাড়ি এনেছে পরাবার জন্য। হেনাও এনেছে। মেয়ের হাতে নকশা কাটা হোল।
খানিক বাদে এলো একদল বাজিয়ে। গোটা পাড়া বেজে উঠল সানাইয়ের সুরে। তাদের সাথে এসেছে প্রচুর মণ্ডা মিঠাই। গোটা গ্রাম সাত দিন পেট পুরে খেয়েও ফূরোতে পারবে না।
আর এসেছে গয়নাগাটি। থালায় থালায় সোনা, হীরে, মোতির নানান অলঙ্কার। গরীব চাষির কুঁড়েঘর আলো হয়ে উঠল, গয়নাগাটির ঝলকানিতে।
চাষি আর তার বউয়ের চোখের জল বাধা মানছে না। হায় হায়, এ কী করলাম। মেয়েটাকে বিক্রি করে দিলাম আমরা?
কতক্ষণ বাদে কুমির রাজা এসে পৌঁছালো। সে কী রাজবেশ তার শরীরে। ঝলমলে সিল্কের চোগা-চাপকান। মাথার পাগড়িখানায় চোখ পড়লে, আর ফেরানো যায় না।
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। হীরে জহরতের ঝালর দেওয়া পালকি। তাতে চেপে রাজার বাড়ি চলল চাষির মেয়ে।
নদীর পাড়ে এসে পৌঁছেছে। পালকি থকে নেমে, যেই জলে পা ডুবিয়েছে, মেয়ের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। জল সরে যাচ্ছে দু’দিকে। মাঝখানে রাস্তা তৈরি। বাজনদার আর বরযাত্রীদের পিছু পিছু, কুমির রাজার সাথে, মেয়েটিও রাজার প্রাসাদে পৌঁছে গেল।
এক মাস কেটে গেল। দু’মাসও কেটে গেল দেখতে দেখতে। কিন্তু মেয়ের কোনও খবর পায় না চাষি। ভীষণ কষ্টে দিন কাটে দুজনের।
অস্থির হয়ে উঠেছে বাবা মা। একদিন চাষি বলল—না রে, বউ। একবার চলেই যাই মেয়েকে দেখতে।
হঠাৎই একটা ইট-এর কথা মনে পড়ে গেল বউটার। আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বিয়েবাড়ি সেরে বউ নিয়ে যাবার সময়, একখানা ইট দিয়ে গিয়েছিল কুমির রাজা। যখন ইচ্ছে হবে, এটা গিয়ে নদীর জলে ছোঁয়াবে। আমার প্রাসাদ পযন্ত রাস্তা পেয়ে যাবে।
ইট মুঠোয় নিয়ে নদীর পাড়ে এসেছে চাষি। অবাক কাণ্ড, ইট ছোঁয়াতেই নদীর জল দু’ভাগ। কোন অসুবিধা হোল না। একেবারে প্রাসাদের দেউড়িতে এসে হাজির হয়েছে চাষি। বলল—আমাকে চিনতে পারছো না? এই রাজার রানি তো আমারই মেয়ে।
হয়েছে কী, সেসময় কুমীর রাজা বাইরে থেকে ফেরেনি। জানালায় দাঁড়িয়ে, রাজার জন্য অপেক্ষা করছিল চাষির মেয়ে। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছে গলায়।
ভারি সুখে আছে মেয়েটি। হেসে খেলে আনন্দে দিন কেটে যায় তার। আসল ব্যাপার হোল, যাকে বিয়ে করেছে মেয়েটি, আদতে সে কুমির নয়। ছিল এক দেশের রাজকুমার। তার বাবা একবার একটা কুমির শিকার করেছিল। কুমিরের মা অভিশাপ দিয়েছিল রাজাকে—আজ থেকে তোমার নিজের ছেলেও কুমির হয়েই থাকবে এই নদীতে। যতক্ষণ রাজার বাড়ির বাইরে থাকবে, ততক্ষন সে কুমির। প্রাসাদে ফিরে এলে, সে তখন সুপুরুষ রাজকুমার। যেমনটি সে ছিল।
তাই স্বামী নিয়ে সুখের শেষ নাই মেয়েটির। রাজার ফিরে আসবার সময় হলে, অধীর আগ্রহে জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটি। আজ হঠাৎ, বাইরে থেকে বাবার গলা কানে এল তার। চমকে উঠে নিজের বাবাকেই দেখতে পেয়ে গেল সে।
আনন্দে মন নেচে উঠেছে। বলল—বাবা, একটু অপেক্ষা করো তূমি। রাজা বাইরে গেছে। সে ফিরবার সময় হয়ে গেছে তার। দুজনে গিয়ে নিয়ে আসব তোমাকে।
বাবা বলল—ঠিক আছে, মা। তুই ভালো আছিস, এটা দেখেই বুক ভরে গিয়েছে আমার। আর কোন দুশ্চিন্তা নাই মনে।
কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, স্বয়ং রাজা এসে হাজির। চাষি চিনবে কী করে। বরং রাজাকে দেখে, ভ্যাবাচেকাই খেয়ে গেছে। এই ভয়াণক কুমিরের দেশে এ কে? স্বর্গের দেবতার মত সুন্দর চেহারা। দেখেই মনে হয় ভারি ক্ষমতাবান কেউ।
হাঁটু গেড়ে রাজার সামনে বসে পড়েছে চাষি—দোহাই আপনার। আমার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে চলে এসেছে এখানের কুমির রাজা। আমি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি তাকে উদ্ধার করে দাও ভেতর থেকে। এইটুকু দয়া করো আমাকে।
রাজার তখন মুখভরা হাসি—আমিই কুমির রাজা। আমিই বিয়ে করে এনেছি তোমার মেয়েকে। আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি।
চাষির তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রাজার মুখে হাসি। নিজের অভিশপ্ত জীবনের কথা এক এক করে বলে গেল চাষিকে। ততক্ষণে দুজনে প্রাসাদে ঢুকে পড়েছে। কথা সরছে না চাষির মুখে। এমন প্রাসাদ সে কল্পনাও করতে পারে না। তার মেয়ে এখানে এসেছে রানি হয়ে? নিজের চোখে মেয়েকে এখানে দেখেও, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
মেয়ে সুখে আছে দেখে, চাষি নিজেও বেশ খুশি। বলল—তোর মাও একবার নিজের চোখে দেখবে না তোকে? একবার বাড়ি চল, মা।
মায়ের কথায় মেয়ের মন উচাটন হোল। একবার যেতে সাধ হোল। স্বামীকে বলল—আমি একা যাবো না। তুমিও চলো।
রাজা বলল—তুমি জানো, জলের বাইরে গেলে, আমার এই শরীর থাকবে না। কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর কুমিরের চেহারাতেই যেতে হবে। না রানি, আমি সেই চেহারায় যেতে চাই না।
মেয়ে বলল—তাহলে, কিন্তু আমিও যাবো না।
শেষমেশ রাজাই একটা উপায় বের করল। রাজার বাড়ির পাশেই আর একটা বাড়ি তৈরি করা হোল। চাষি গ্রামে ফিরে গেল বউকে আনতে। মেয়ের সুখের কথা শুনে, বউ না করল না। গ্রামের কুঁড়েঘর ছেড়ে, চাষি চলে এলো বউকে নিয়ে। চার জনে মিলে বেশ সুখেই দিন কেটে যায় তাদের।
0 Comments