আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সাঁইত্রিশতম পর্ব
স্মৃতি বড়ো মারাত্মক,স্মৃতি বড়ো বেদনা সংবেদী।তাই হয়তো জীবনভ’র কিছু কথা মনে রয়েই যায় মানুষের।সে চা’ক বা না চা’ক, অসুস্থতা,বিয়োগ ব্যথা উজিয়েও সেসব কথা ভেসে ওঠে অকস্মাৎ। এই যেমন এতোদিনের ভুলে যাওয়া সেই বিশেষ দিনের ছবি অনুপুঙ্খ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন করছে আজ তাঁর রোগাতুর মন।
ইদানিং যেমন তিনি তেমন কিছুই পারতেন না, বয়সকালে তো তাতো হবার ছিল না। কাজকর্ম, রান্না বান্না সব একা হাতে সামলিয়েও সেলাই ফোঁড়াই,বইপড়ার জন্য অফুরন্ত সময় থাকতো তাঁর হাতে।
সেই দিনও তো সবাইকে খেতে দিয়ে রান্না ঘরে এসে দেখলেন,কুচোকয়লাগুলি রেখে উঠেছে, ধোঁয়ার লেশমাত্র নেই।পিতলের হাঁড়ি ধোওয়ার ছিল,সে হাঁড়িতে খানিক তেজপাতা ফেলে ঘী ঢেলে তেতে উঠলে দেশ থেকে আনা সুগন্ধি গোপালভোগ চাল ভেজে দুধ ঢাললেন।দুধ উথলোতে না উথলোতেই বৌদিদির ডাক,
-’ও ঠাকুরঝি!বলি ও তারা!কি করছো আবার রান্নাঘরে!খেতে এসো,খিদে পেয়েছে যে,বেলা গড়িয়ে যায়…’
-’যাই গো যাই।ভাত বাড়ছি। তোমাকে পাত তুলতে হবেনা, আমি যাচ্ছি।’
ততক্ষণে বৌদিদি ছেলেদের এঁটো পাত তুলে নিকিয়ে নিয়েছেন,কুয়ো তলায় থালা নামিয়েও নিয়েছেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
-’সত্যি বৌদিদি!তোমায় নিয়ে আর পারিনা!’ রান্নাঘরের দরজার দাঁড়ানো মাতৃময়ীর দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি।প্রশ্রয়ের হাসি হেসে অগ্রজা অনুজাকে বললেন,
-’আবার পায়েস বসালে বুঝি!ওফ্! তুমি পারোও বাবা!’
-’না।না।তেমন কিছু নয়।ঐ একটু…চলো চলো খেতে চলো,মরা আঁচে ফুটুক ততক্ষণ…’
এরপরে যথারীতি খাওয়া দাওয়া সেরে সবাইকে পান দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের ব্যবস্থা করে যখন ছেলেটির ঘরে এলেন বিরজা,উঠোনময় ম ম করছে পরমান্ন ঘ্রাণ।
ছেলেটি কি যেন ভাবছিল, লক্ষ করেনি তাঁর উপস্থিতি।
তিনিই কাছে গিয়ে ডেকেছিলেন,
-’কি গো ছেলে!কি ভাবছো!’
চমকে উঠলো যেন। তারপরে খানিক উদাসী গলায় বললে,
-’নাঃ! কিছু না।কি ভাববো আর’
মুখে বললে বটে, কিন্তু ব্যবহারে কেমন যেন উন্মন ভাব।হয়তো লজ্জা পেয়েছে তাঁকে দেখে।তাই বললেন,
-’কেমন খেলে,বললে না তো?’
-’ভালই তো’
-’শুধুই ভালো!’
-’না না।আপনি তো খুব কেয়ারিং, রান্নাও করেন খুব ভালো। আপনার কথা মনে থাকবে আমার!’
নিজের প্রশংসা করে না শুনতে চায়! খুশি হয়ে বললেন,
-’পায়েস করেছি। রাত্রে খাওয়াব।’
-রাতে তো থাকব না আমি!’
-’সে কি!কোথায় যাবে?না মানে কোন বন্ধু…’
-’না।না।একটা কাজ আছে।’
বলেই চমকে উঠেছিল। তারপরেই নিজেকে সামলে বলেছিল,
-’না।মানে অনেক দিন তো…’
গোপন কিছু বলে ফেলার মতো বিপন্নতা ছিল গলায়,বিরজাকে যা বড়ো আতুর করেছিল। খুব কাছে গিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে জানতে চেয়েছিলেন,
-’কি হয়েছে তোমার?আমায় বলতে পারো।’
কপাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়েছিল, আবেগহীন গলায় বলেছিল,
-’কিচ্ছু হয়নি পিসিমা।আপনি বৃথাই চিন্তা করছেন। সকাল থেকে অনেক খাটুনি হয়েছে, বিশ্রাম নিন।’
ছোট্ট থেকেও বড়ো অভিমানী বিরজা,ভালোবাসতে ভালোবাসেন,প্রত্ত্যুত্তরে ভালোবাসাই চান।না পেলে অপমানিত বোধে সরে আসেন।
প্রকৃত অর্থেই মাতৃহীন ছেলেটিকে ভালোবেসেছিলেন।তার কাছে এমন হৃদয়হীন আচরণ কাম্য ছিল না।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে বৌদিদির কাছে শুয়ে পড়েছিলেন। কান্নাভেজা ব্যথার বিষন্নতায় মিশেছিল ক্লান্তি, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
ঘুম ভেঙেছিল সন্ধ্যার মুখে, সবাই প্রস্তুত হচ্ছিল বিসর্জন দেখতে যাবে বলে।মনটা ভালো ছিল না, যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না।তবু সবার জোরাজুরিতে যেতেই হয়েছিল রাস্তার মোড়ে।
বরণের পরে সেখানে তখন চলছিল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি,সামনের বনেদী বাড়িটির প্রতিমার।
সামনে ব্যান্ড পার্টি,ঢাকীর দল। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন কর্তা। সবাই উৎসুক।
শুরু হয়েছিল যাত্রা, ঠেলাঠেলি ভিড়। হঠাৎ তাঁরই মধ্যে দুম-দুম শব্দ, মর্মভেদী আর্তনাদ!...
কি হলো!কি হলো কলরবের মধ্যেই খোকা একহাতে বৌমা, একহাতে বৌদিদিকে ধরে তাঁর কাছে এসে বললেন,
-’তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাও পিসিমা এদের নিয়ে। আমি বাবাকে নিয়ে ফিরছি।’
-’কি হয়েছে খোকা?’
-’পরে বলছি।এখন যাও।’
বলেই হারিয়ে গেল ভীড়ে। তিনিও বৌমাকে আগলে বৌদিদিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন,ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখলেন,সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ালো বেশ কয়েকটি পুলিশের গাড়ি, কোতোয়ালী থানা তো ঢিলছোঁড়া দূরত্বে,হেঁটে দৌড়েও অনেক পুলিশ…
খানিক পরে,বড়োদাদা ও বেহাইমশাইকে নিয়ে খোকা ঘরে ঢুকতে জানতে পারলেন,শোভাযাত্রার ভীড়ে মিশে থাকা দুটি ছেলে নাকি নিরাময়ের কর্তাকে গুলি করে পালিয়েছে।ঐ বনেদী বাড়িটির নাম ছিল নিরাময়, তাদের একটি ঔষধ দোকানও ছিল,সেটির নামেই ঐ পরিচিতি।
গ্রামের মানুষ তাঁরা,রাত নামলেই অন্ধকারে অভ্যস্ত। কিন্তু শহরের মধ্যের অন্ধকার যে কি ভয়ানক, সেই সন্ধ্যায় টের পেয়েছিলেন তাঁরা। মুহুর্মুহু পুলিসের ছোটাছুটি,পথে আটক মানুষজনের দিশেহারা দৌড়াদৌড়ি, লোডসেডিং, দরজা জানালা বন্ধ করে মিজমিজে হ্যারিকেনের আলোয় পরস্পরের সঙ্গে ফিসফিস,পুলিসের মাইকিং…’শহরবাসী সকলে বাড়িতে থাকুন, অচেনা কাউকে আশ্রয় দেবেন না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও প্রশাসনকে সাহায্য করুন’
ভীষণ ভীষণ ভয়ে সবাই যেন সন্ত্রস্ত।ক্ষিদে-তেষ্টা ভোলার যোগাড়।
ইতিমধ্যে রাত আরও গভীর হয়,পরিবেশ পরিস্থিতিতে সবাই খানিক ধাতস্থ হয়।
বিরজারই প্রথম মনে পড়ে,বৌমাকে অন্তত কিছু খাওয়ানো প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, খাবার তৈরি করতে গেলে তো উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে যেতে হবে,ওদিকের পাঁচিল নীচু, যদি কেউ ইতিমধ্যে…
বড়ো দাদা এবং খোকা দুজনেই বারণ করলে, শেষে বিরজা মুড়ি ও নারকেল নাড়ু বের করলেন, সঙ্গে ছোলা বাদাম ভাজা।তখনই মনে পড়লো, রান্নাঘরে পড়ে থাকা পায়েসের কথা…
ওঃ!কি করে যে ভুলে গেলেন!ঘরে নিয়ে আসাও হয়নি,শিকেতে তুলে রাখাও হয়নি…
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো ছেলেটির কথা,ওর জন্যই তো…
কিন্তু মায়ের মন তো,সব ভুলে বেরিয়ে গেলেন উঠোনে,
-’এমা! আমরা সবাই এখানে, বৌমার ভাইটা…খোকা, তুই দরজা ধরে দাঁড়া, আমি আসছি’
বলেই বেরিয়ে গেলেন।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন,উনুন পাশে পড়ে থাকা পায়েসের হাঁড়ি প্রায় খালি,ঢাকা খোলা…বিড়াল তো এভাবে…লন্ঠনের দম বাড়িয়ে দেখেন,প্রায় নিভে যাওয়া উনুনের পাশে একটা হাতে লেখা আধপোড়া কাগজ,তুলে নিয়ে পড়লেন,
পিসিমা,
আমার জন্য পায়েস বানিয়েছিলেন,পেটভরে খেয়ে গেলাম। জানিনা,আর কখনও দেখা হবে কিনা, কিন্তু যে অচেনা মাতৃস্নেহামৃতের আস্বাদন এই ক’য়দিন আপনার কাছে পেলাম, সারাজীবন তার মনে থাকবে। সামনে বড়ো ভীষণ লড়াই,অসম সংগ্রাম।আশীর্বাদ করবেন যেন জয়ী হই, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।’
পড়লেন, আবার পড়লেন।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো…কি যেন অতুল আগ্রহে তার ঘরের দিকে ছুটে গেলেন,ঘরে সে নেই! নেই!
0 Comments