প্রসূন কাঞ্জিলাল
মহালয়া স্মরণের অনুষ্ঠান। মহালয়া কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের অনুষ্ঠান। অতীতকে, ঐতিহ্যকে ধন্যবাদ নয়, আন্তরিক প্রণতি জানাবার অনুষ্ঠান। তাইবা কেন, এ হলো বিশ্বের সব কিছুর সঙ্গে— ‘আব্রহ্মা স্তম্ভপস্তিম্'— সব কিছুকে আপন করে নেওয়ার এক সর্বাত্মক প্রয়াস। এ বিশ্বের সব কিছুই ঈশ্বরের দান। তার ওপর সকলের রয়েছে সমান অধিকার। সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয় কাউকে— এই বোধে আত্মস্থ হওয়াই মহালয়ার দীক্ষা। ভোগে নয়, সুখ ত্যাগে, সুখ যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু গ্রহণে। উপনিষদের এই শিক্ষারই অপরূপ প্রতিফলন মহালয়ার শ্রাদ্ধে-তর্পণে।
কেন মহালয়া, কী এর তাৎপর্য তার গভীরে যাওয়ার আগে বরং শোনা যাক একটি পৌরাণিক কাহিনী ---
অঙ্গরাজ কর্ণ অধিরথ সুতপুত্র তিনি। কুম্ভীপুত্র হয়েও নিয়তির খেলাতে নিজের অজ্ঞাতেই কৌরবরাজ দুর্যোধনের পরম সুহৃদ তিনি। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের অন্যতম মহানায়কও কর্ণ। এসবই তাঁর এক একটি পরিচয়। এর বাইরেও রয়েছে তার আরও একটি পরিচয়। তিনি দাতা। তাঁর মতো দাতা খুব কমই দেখা গেছে ভূ-ভারতে। তাঁর কাছে কিছু চেয়ে বিমুখ হয়নি কখনও কেউ। সোনা-দানা, মণিমাণিক্য যে যা চেয়েছে তাই দিয়েছেন তিনি। এমনকী নিজের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুরক্ষা অভেদ্য কবচকুণ্ডলও তিনি হাসিমুখে দান করেছেন অবলীলায়।
বস্তুত মহাবীর কর্ণের চেয়ে দাতা কর্ণই বড়ো হয়ে ওঠেন সকলের কাছে। দানের জন্যই তিনি এক মহোত্তম মানুষ।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিহত হন কর্ণ। পরিণামে স্থান পান স্বর্গে। তিনি যে পরিমাণ সম্পদ তিনি দান করেছিলেন, পরলোকে তার সহস্রগুণ ফিরে আসে তার কাছে। স্বর্ণ সম্পদের বিপুল বৈভবের নিচে তিনি যেন চাপা পড়ে যান। তবুও দুঃখী তিনি। একটি অপ্রাপ্তির তীব্র জ্বালা তাঁকে অস্থির করে তোলে। সব পাচ্ছেন তিনি কিন্তু পাচ্ছেন না খাদ্য পাচ্ছেন না পানীয়। আর সেই না পাওয়ার যন্ত্রণা বাড়িয়ে তোলে তার কষ্টকে লক্ষ কোটি গুণ। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর কর্ণ যান যমরাজের কাছে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বলেন, এ কেমন বিচার! অফুরন্ত স্বর্ণরত্ন তিনি পাচ্ছেন, কিন্তু সেসব তো খাদ্য নয়। ক্ষুধার অন্ন নয়। তৃষ্ণার পানীয় নয়। তারই অভাবে যে তিনি বড়ো কাতর। এসব সোনাদানায় কাজ নেই তাঁর। এসব তো খাওয়া যায় না। সকলের আগে তো দরকার খাদ্যের। খাদ্য বা অন্নই তো জীবন। সেই খাদ্য কোথায় ?
কর্ণের এই জিজ্ঞাসার মুখে যমরাজ কিছুটা অসহায়। বিব্রত কণ্ঠেই বলেন, এর আমি কী করব? ইহলোকে মানুষ যা দান করে, পরলোকে এসে তাই কয়েক সহস্রগুণ ফিরে পায়। বলা যায়, ইহলোকে দানের মূল্যেই মানুষ কেনে পরলোকের সুখ। নরলোকে যে যা দান করে, পরলোকে তাই-ই পায়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কর্ণ কুণ্ঠিত ভাবেই বলেন, আমি তো মর্ত্যে দানে কোনও ত্রুটি রাখিনি। বলা উচিত নয়, তবু বলছি, আমার তো দানবীর বলে একটা খ্যাতি ছিল। তাহলে কেন বঞ্চিত থাকব খাদ্য-পানীয় থেকে. ?
যমরাজ বলেন, সত্য তোমার কথা। সঙ্গত তোমার জিজ্ঞাসা। —তাহলে ?
— দেখ, আমি আগেই বলেছি, মানুষ যা যা দান করে পরলোকে তাই পায়। তুমি যে অজস্র সম্পদ দান করেছ তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই এখানে এসেও পাচ্ছ তাই। কিন্তু তুমি কোনওদিন কাউকে অন্নদান করনি। দাওনি কোনও তৃষ্ণার্তকে জল। সে কারণে এখানে বঞ্চিত তুমি সেসব থেকে।
–কিন্তু আমি যে ক্ষুধায় অস্থির। এর একটা বিহিত করুন আপনি। ফিরিয়ে নিন সম্পদ, পরিবর্তে দিন একটু খাদ্য। একটু জল।
যমরাজ বলেন, আমি নিরুপায়। ঈশ্বরের বিধান বদলের কোনও ক্ষমতা আমার নেই।
–না জেনে অপরাধ করেছি। অন্নজল দান যে এত মহোত্তম দান, এটা জানা ছিল না। সেই অনিচ্ছাকৃত অপরাধ ক্ষমা করুন। একটা কিছু প্রতিবিধান করুন।
কর্ণের কাতর প্রার্থনায় করুণা হয় যমরাজের। বলেন, বেশ একটা সুযোগ তোমাকে দিচ্ছি। ফিরে যাও তুমি মর্ত্যলোকে। একটি পক্ষকালের জন্য। যথেচ্ছ দান করো অন্নজল। নিশ্চিত করো তোমার এখনকার জীবনের প্রকৃত সুখ। যাও, তবে এক পক্ষকাল, মাত্র পনেরো দিনের জন্য।
পনেরো দিনের জন্য কর্ণ ফিরে আসেন মর্ত্যে। পনেরো দিন ধরে দান করেন অন্ন। তৃষ্ণার্তকে দেন জল। পরিণামে স্বর্গে ফিরে পান অন্ন। পান তৃষ্ণার জল।
আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পনেরো দিন কর্ণের ছিল দ্বিতীয় দফার মর্ত্যবাস। আর এই পনেরোটি দিনই হিন্দুশাস্ত্রে চিহ্নিত পিতৃপক্ষ হিসেবে। কর্ণ স্বর্গে ফিরে আসেন যে অমাবস্যা তিথিতে— সেটিই অভিহিত মহালয় বা মহালয়া নামে।
হিন্দু শাস্ত্রে, পিতৃপক্ষের পনেরো দিন প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তিলতর্পণ এবং শ্রাদ্ধ করার বিধি। ওই সময় দরিদ্রদের আহার দান করালে শুধু নিজের নয় পরলোকে পিতৃপুরুষদেরও অন্নজলের অভাব থাকে না।
গরুড় পুরাণে আছে, পুত্রছাড়া মুক্তি নেই। পিতৃপক্ষের পুত্রের দেওয়া অন্নজলেই তৃপ্ত হওয়া যায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণেরও নির্দেশ, পিতৃপক্ষে পিতৃপুরুষকে অন্নজল দিতে হবে। পিতৃপক্ষের তর্পণ আর মহালয়ার শ্রাদ্ধই দেয় মানুষকে সুস্বাস্থ্য, জ্ঞান এবং সম্পদ। তাই মহালয়া তর্পণে রত হল সকলে। শাস্ত্রের বচন, পিতৃপক্ষ বা মহালয়াপক্ষে পিতৃপুরুষরা নেমে আসেন মর্ত্যে – দর্শন করেন উত্তরপুরুষদের। তর্পণ শ্রাদ্ধে নিজেরা তৃপ্ত হন। আশীর্বাদ করেন উত্তরপুরুষদের। দীপান্বিতা অমাবস্যায় তারা ফিরে যান পিতৃলোকে। সঙ্গে আকাশ প্রদীপ জ্বালানো। তাদের পথ দেখানোর জন্য।
দান বীর কর্ণের কাহিনীর শিক্ষা আমাদের সমৃদ্ধ করুক মহালয়ার দিবসে এই কামনা করি ।
বাতাসে পুজোর গন্ধ কিন্তু এসেই গিয়েছে। ফুরফুরে মন, বাইরে বেশ আগমনী সুগন্ধ, আর সাতসকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে রেডিওতে বেজে উঠবে 'মহিষাসুরমর্দিনী'-র অনন্য সুর।
আবার অন্যদিকে মহালয়ার দিন মানেই সকাল থেকেই ভরে ওঠে ফেসবুকের নিউজফিড, হোয়্যাটসঅ্যাপে ঘন ঘন মেসেজ। আপনিও পাঠাবেন বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়দের। সেসব মেসেজে দেদার অনেকেই লিখেও চলেছেন
‘শুভ মহালয়া’
কিন্তু এ কথা কি বলা যায় ? মহালয়া কি আদৌ ‘শুভ’ ? কাউকে ‘শুভ মহালয়া’ উইশ করা করা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত ?
এনিয়ে কিন্তু বিতর্ক রয়েছে। আগে জেনে নেওয়া যাক এই বিশেষ দিন সম্পর্কে কী বলছে শাস্ত্র :-----
হিন্দু বিশ্বাস মতে, এই সময় প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষের বিদেহী আত্মারা ফিরে আসেন এই মর্ত্যলোকে। তৈরি হয় এক মহা আলয়। সেই প্রয়াত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার দিনটিই হল মহালয়া।যব-তিল-জল দিয়ে তর্পণ করে তাঁদের পরিতৃপ্ত করা হয়। এই তর্পণ যেমন প্রয়াত বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের জন্য, তেমনই সমগ্র জীবজগতের জন্যও। শুনতে অবাক লাগলেও, মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও সরাসরি যোগ ই নেই।
মহালয়াকে ‘শুভ’ বলার মধ্যে ভুল কিছু নেই। বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা জানানোই যায়। শুভেচ্ছা জানানোয় আবার নিয়ম, অনিয়ম কীসের?
0 Comments