জ্বলদর্চি

স্বপন যদি মধুর এমন /মুক্তি দাশ

চিত্র- সৈয়দ স্নেহাংশু

স্বপন যদি মধুর এমন
মুক্তি দাশ 

লোকটা সরাসরি এসে বলল, “তোর খুব খিদে পেয়েছে, না রে? মুখখানা একেবারে শুকিয়ে গেছে, আহা রে! আয় দিকিনি আমার সাথে। একটা জায়গা নে’ যাব, যাবি? পেটপুরে ভালোমন্দ খেতে পাবি কিন্তু।”

খাওয়ার কথা শুনেই কালুয়ার ইন্দ্রিয়গুলো সংগে সংগে বেহালার তারের মতো টান টান হয়ে উঠল। খিদেটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। গোল-গোল চোখ তুলে কালুয়া জিজ্ঞেস করল, “কুথায়?”

“চ’ না আমার সাথে, গেলেই দেখতে পাবি!”

আবছা অন্ধকারে লোকটার মুখ ভাল করে ঠাহর না হলেও কালুয়া লোকটাকে বিলক্ষণ চিনতে পারল। একদম তার বাপ-বাপ মুখ। মায়ের মুখে শুনেছে, তার বাপ তাদের ছেড়েছুড়ে অন্য কোথাও নতুন করে ঘর বেঁধেছে। বাপ আর এখন নাকি তাদের কেউ না। কোনোদিন ফিরে আসবেও না। এজন্যে বাপের প্রতি তার একটা চাপা ক্ষোভ আর অভিমান থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু কই, রাগ হয়নি তো কখনো! কেন কে জানে!

অন্যসময় হলে কালুয়া কিছুতেই যেত না এই লোকটার সংগে, যতোই আদর করে ডাকুক! মুখের ওপর সটান ‘না’ বলে দিত। আজ আর পারল না। বড্ড খিদে পেয়েছে যে! খিদে বড় বালাই।

আলো-ঝলমলে সঙ্গীতমুখর একটা বিয়েবাড়ির সামনে গভীর রাতে বাপের হাত ধরে কালুয়া এসে দাঁড়াল। ও, এই ব্যাপার! শেষরাতে বিয়েবাড়িতে খাবার-দাবার যা বেঁচেছিল, পাশের বস্তির গরীবগুর্বো হা-ভাতে মানুষদের বসিয়ে তা-ই খাওয়ানো হচ্ছে। সেই দলে কালুয়া আর তার বাপও।

খেয়েদেয়ে ভরা পেটে হেলতে দুলতে একা একাই কিন্তু বাড়ি ফিরল কালুয়া। মানে, ফিরতে হলো। অন্ধকারে সাপের মতো শুয়ে থাকা কালোপিচের রাস্তা থেকে ম্যাজিকের মতো কোথায় যে ভ্যানিশ হয়ে গেল তার বাপটা!

শেষরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে কালুয়া ধড়মড় করে চাটাই-পাতা বিছানার ওপর উঠে বসল। পেটে চিনচিনে ব্যথা। খিদেয় জ্বলছে পেট। আরেহ্! এত  খাওয়া-দাওয়ার পরেও খিদেটা তো কই যায়নি! ধন্দে পড়ে গেল কালুয়া। আদৌ কি কালরাতে সে বিয়ে বাড়িতে গেছিল? আদৌ কি তার বাপের সংগে মোলাকাৎ হয়েছিল? নাকি…

ততক্ষণে কালুয়ার মায়েরও ঘুম ভেঙে গেছে। একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে কালুয়া ঘুমঘুম গলায় বলল, "আমার বাপটা বড্ড ভাল ছিল, না রে মা?"

তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠে মা বলল, "খবরদার! ওই মিনসেটার নাম মুখেও নিবি নে বলে দিলাম!"

ঘোর-লাগা গলায় কালুয়া বলে চলেছে "স্বপ্নে আজ বাপটাকে দেখলাম, জানিস! আমাকে নিয়ে একটা বে’-বাড়িতে গেল। কতো কি যে খেলাম সেখানে!  মাংস, পোলাও, বিরিয়ানি…"

🍂

"চোপ! একদম চোপ!" 

মুখে হাতচাপা দিয়ে মা ওকে চুপ করিয়ে দিল। তারপর জোর করে ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ল। ছেঁড়া শাড়ির ভেতর হাত ঢুকিয়ে নিজের শুকনো পেটে হাত বুলোতে বুলোতে কেমন ঘোর লাগা গলায় বলল, "স্বপ্নটা তুই একা একাই দেখে নিলি রে বাপ! একবার তোর মায়ের কথাটা মনেও পড়ল না!"

কালুয়া বুঝতে পারল না,  মায়ের এত আক্ষেপ কিসের জন্যে? স্বপ্নে এতদিন পরেও তার ‘মিনসে’র সাথে দেখা হলো না বলে? নাকি, বিয়েবাড়িতে ভালোমন্দ এঁটোকাঁটা জুটলো না বলে? ভাবতে ভাবতে মাকে জড়িয়ে ধরে একসময় ফের ঘুমিয়ে পড়ল কালুয়া।
______________________

Post a Comment

0 Comments