বাচিকশিল্পী ঊর্মিমালা বসু-র সাক্ষাৎকার নিলেন আগমনী কর মিশ্র
বেতার, দূরদর্শন, মঞ্চ সব জায়গায় যাঁর দৃপ্ত পদচারণ,একটি আলোকবৃত্ত সবসময় যাঁকে ঘিরে থেকেছে, তবু যিনি একজন সুখী গৃহিনী এবং সার্থক জননী। সৃষ্টিশীল মনের দৃঢ় বিশ্বাসে যিনি বলতে পারেন " যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।"সেই অসম্ভব ইতিবাচক মানুষটি হলেন কন্ঠশিল্পের অনন্য কারিগর ঊর্মিমালা বসু। জ্বলদর্চির পাঠকদের জন্য তিনি মন খুলে কথা বললেন।
আগমনী কর মিশ্র : কেমন আছেন?
ঊর্মিমালা বসু : ভালো আছি। গরমটা তো ভীষণ।তবে আজ একটু বৃষ্টি হলো।কিছুটা হলেও স্বস্তি। সবমিলিয়ে ভালো আছি।
আগমনী : আপনার ছোট থেকে বেড়ে ওঠা নিয়ে একটু জানতে ইচ্ছে করছে।
ঊর্মিমালা : আমার ছোটবেলা আর পাঁচজনের মতোই কেটেছে। আমাদের বাড়িটা একটু দলছুট বাড়ি ছিলো। বাড়িতে একটা ব্রাহ্ম পরিবেশ ছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের পরিবারের একজন সদস্য বলে জানতাম। চার ভাইবোনের মধ্যে ভয়ানক একটা ভাব ছিলো।বাবা মায়ের একটা ব্যালান্সড ভালোবাসা ছিলো। ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে পড়াশুনো করার ফলে নাচ গান থেকে ব্যবহার সবকিছুই ভীষণ সহজাত ছিলো। সম্পূর্ণ মানুষ করার চেষ্টা যেমন স্কুলের আবহে ছিলো তেমনই মায়ের মধ্যেও ছিলো।
আগমনী : সকলেরই ছোট বেলার একটা স্বপ্ন থাকে। আপনার সেরকম কিছু স্বপ্ন ছিলো ?
ঊর্মিমালা : স্বপ্ন তো অনেক থাকে। প্রথমে তো স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবো। কিন্তু অঙ্কে খারাপ, তাই কোন চান্সই ছিলো না। (হাসি) শিক্ষকতা ভালো লাগতো,তবে এই ধরনের শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত হবো কখনো ভাবিনি।
আগমনী : কন্ঠশিল্পের জগতে কি হঠাৎ করে আসা ?
ঊর্মিমালা : হঠাৎ করে আসা ঠিক নয়,হঠাৎ করে জগন্নাথ বসু আমার জীবনে এসেছিলেন। তারপর ইচ্ছেটা জাগে। একসঙ্গে থাকা,একসঙ্গে কাজ করা।
আগমনী : বেতার জগতে কীভাবে এলেন ?
ঊর্মিমালা : বেতারে কিন্তু আমি ছোট থেকেই ছিলাম। আমি সংস্কৃত নাটক করতাম। লেডি ব্রাবোনের অধ্যক্ষা তথা রবীন্দ্র ভারতীর ভাইস চান্সেলর ডঃ রমা চৌধুরীর প্রাচ্য বানী বলে একটি সংগঠন ছিলো। সেই প্রাচ্য বানী থেকে আমি সারা ভারতবর্ষে সংস্কৃত নাটক মঞ্চাভিনয় করেছি। সেই সমস্ত অনেক সংস্কৃত রেডিও নাটক করেছি। তারপর যুববানীতে কাজ। পরে অডিশান দিয়ে নাটক,এফ,এম-এ কাজ। বিবিধ ভারতীতে কাজ। আমরা তো আসলে রেডিও সন্তান। তাই রেডিও কখন যেন আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
আগমনী : শ্রুতিনাটকের যে এত জনপ্রিয়তা তার অন্যতম কারিগর তো আপনি। কিন্তু এর শুরুটা কেমন করে এলো খুব জানতে ইচ্ছে করে ।
ঊর্মিমালা : শুরু করেছিল জগন্নাথ-শাঁওলিরা। তখন রবীন্দ্রনাথের উপর কাজ করেছে।পরে যখন শ্রুতিনাটক নিয়ে কাজ করে তখন থেকে আমি আছি। প্রথম নাটকটা জগন্নাথের সঙ্গে আমি করিনি,কিন্তু তারপরে যখন থেকে জগন্নাথের সঙ্গে কাজ করেছি তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি।
আগমনী : আপনি তো প্রচুর অডিও স্টোরি করছেন এবং নিয়মিত করছেন। মুগ্ধ শ্রোতারা যদি এই জগতে আসতে চান তাহলে তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন ?
ঊর্মিমালা : দেখো,এখন আগ্রহ যত বেশি অনুশীলন তত বেশি নয়। এখন সমাজমাধ্যমে যে কেউ যা কিছু পোস্ট করতে পারে। পারুক না পারুক রোজ একটা করে পোস্ট করা যায়। কিন্তু কেউ হয়তো শোনেন না। তাই কেউ যদি এই দিকে আসে তাহলে তাকে অনেক ধৈর্য্য ধরতে হবে,অনুশীলন করতে হবে,সৎ হতে হবে।
আগমনী : আপনি তো চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। এই সময়ে কি দর্শকরা আপনাকে দেখতে পাবেন ?
ঊর্মিমালা : হ্যাঁ, 'অনু' 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' এরকম কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি।
কিছুদিন পরে আসবে শিবপ্রসাদ-নন্দিতার একটি সিনেমা। সেখানে একটি চরিত্রে আমি আছি।
আগমনী : আমরা জানি আপনি ভীষণ ভালো লেখেন। আগামীতে পাঠকরা আপনার কোন বই পাবেন ?
ঊর্মিমালা : আমার না লিখতে খুব ভালো লাগে কিন্তু আমি খুব কুঁড়ে মানুষ তো। তারপর এত কথা বলতে হয় যে লেখার সময়টা থাকে না।
আগমনী : না না, আমরা কিন্তু আপনার লেখা পড়তে চাই। বিশেষ করে একটি শক্তিশালী কলম যেখানে মুখ বাড়িয়ে থাকে।
ঊর্মিমালা : (হাসি) আচ্ছা, সব কাজেই তো শুভকামনার খুব দরকার হয়।এমন শুভকামনা থাকলে কাজও হয়ে যায়। ভবিষ্যতে দেখা যাক হয় কিনা।
আগমনী : 'যুগলেষু' হয়ে গেছে। এবং ভীষণ জনপ্রিয় । তা এই 'যুগলেষু' নিয়ে আগামীতে কোন পরিকল্পনা আছে ?
ঊর্মিমালা : যুগলেষু তো ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্যোগে হয়েছিল। এই ব্যাপারটা ভাববে ওরাই।
আগমনী : একজন নারী হয়ে কাজের জগত আর সংসার কীভাবে সামলান ?
ঊর্মিমালা : কী জানো আগমনী, যে কাজটা তুমি ভালোবাসবে তার জন্য কখনোই তোমার সময়ের অভাব হবে না। যেটা তোমার ভাল্লাগে না দেখবে সেটা কক্ষনো করতে ইচ্ছে করবে না। মানে করলেও সেই নিমপাতা গেলার মতো অবস্থা হয়। আমার মনে হয় যেটা আমাকে করতেই হবে সেখানে অশান্তি না করে,অসন্তুষ্টি না রেখে চুপচাপ করে ফেললেই সময়ও বাঁচে,মানসিক শান্তিও থাকে আর যা করতে চাইছি তা করাও যায়। আসলে যা করতে চাই আমরা ইচ্ছে করলে সব করতে পারি। তার জন্য কোন বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
আগমনী : আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কী ?
ঊর্মিমালা : আমার বিয়ে। এজন্যই টার্নিং পয়েন্ট, বিয়ের পর আমার জীবনে যা যা ঘটেছে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সবকিছু একদম অন্যরকম ঘটতে শুরু করে।
আগমনী : মহিলা হওয়ায় কি বাচিকশিল্পের জগতে কোন সুবিধে হয়েছে ?
ঊর্মিমালা : এটা বলে কারা বল ? মেয়েদের মধ্য যে সবচেয়ে উচ্চতায় উঠতে পেরেছে ,যার নাম সবচেয়ে বেশি হয়েছে তার সম্বন্ধেই তো বলা হয়। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এসব কথা বলে। আর একটা কথা মনে রেখো, প্রশংসা সবাই করে না। কিছু মানুষ থাকবেই যারা সমালোচনা করবে। হাজার ভালো করলেও তারা থামিয়ে দেওয়ার জন্য বলবে। দাবিতে রাখার জন্য বলবে। এসব কথায় একেবারেই কান দিতে নেই। এগুলো তো মন ছোট করা কথা।ব্যর্থ মানুষের কথা এসব।
আগমনী : আপনি কন্ঠের মাধ্যমে প্রতিটি চরিত্রকে আলাদা আলাদা করে ফুটিয়ে তোলেন। এটা কীভাবে সম্ভব হয় ?
ঊর্মিমালা : এটাই তো শিক্ষা। তুমি তো এগুলো জানো। শুধুমাত্র পড়ে গেলেই কিন্তু চরিত্র হয়ে ওঠা যায় না। চরিত্র হয়ে উঠতে গেলে নিজের যাপন এবং অনুশীলন তেমনটাই হওয়া দরকার। প্রতিদিন চরিত্রটি নিয়ে ভাবা উচিত। শ্রোতার মনের মধ্যে একটা সঠিক ছবি তৈরি না হলে চরিত্রটি সার্থক হয়ে ওঠে না।
আগমনী : প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত মানুষ তাঁদের পাশে কাউকে পেয়েছেন,যারা তাঁদের জন্য প্রেরণার কাজ করেছেন। আপনি কি তেমন কাউকে আপনার পাশে পেয়েছেন?
ঊর্মিমালা : পাশে কিন্তু একজনকে পেতেই হয়। সেটা হল নিজেকে। আমার পাশে সবসময়ই আমাকে পেয়েছি। যখন আমি ধাক্কা খেয়েছি, চলতে পারছি না,নানাভাবে আমাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে সবসময়ই নিজেকেই বলেছি 'ওঠো,চলো। তোমাকে বেরোতেই হবে এসব থেকে।' কেউ কাউকে কিচ্ছু করে দেয় না। মনে হয় করে দিয়েছে কিন্তু কিছুই না। এটা একটা শিক্ষা। প্রতিটি মানুষের পাশে তারা নিজেরা থাকুক তাহলেই হবে।
আগমনী : জ্বলদর্চি পত্রিকার জন্য আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন। আমরা কৃতজ্ঞ। পত্রিকার জন্য যদি কিছু বলেন।
ঊর্মিমালা : আমি সামান্য মানুষ। আমাকে এই পত্রিকায় স্থান দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চিত হোক। সুন্দর বাক্যে বাংলা লেখা পাঠকরা যেন পড়তে পারেন। বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক। সকলের জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
আগমনী : জ্বলদর্চি পত্রিকার সম্পাদক ও সকল পাঠকের তরফ থেকে অজস্র ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন। ভালো থাকবেন।
ঊর্মিমালা : সকলকে আমার তরফ থেকে শুভেচ্ছা। ভালো থেকো।
🍂
0 Comments