তেতাল্লিশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
কিছু কিছু দিন থাকে নিদারুণ অস্বস্তির,কিছু কিছু রাত কাটে নিরর্থক জাগরণে।বিরজার এখনো মনে আছে, একরাশ ধুলো উড়িয়ে কুমুর গাড়ি মেঠোপথ পেরিয়ে যেতেই কেমন যেন এক বিষন্ন একাকীত্ব অথবা গভীর অপমানবোধ ঘিরে ধরেছিল তাঁকে জগৎ সংসারের সবকিছু ছাপিয়ে।
বাড়ি ফিরে এসেও সে বোধ তাঁকে ছাড়লো না। স্বাভাবিকভাবেই সন্ধ্যার রান্নায় স্বাদ ভালো হলো না,রুটি পুড়ে গেল,দুধে বেশি জল।দাদারা খেতে বসে অবাক হলেও মেজবৌদিদি তার বিরক্তি চেপে রাখেনি। চিরদিনের মুখরা বিরজার কিন্তু মুখে সেদিন রাও কাটেনি। বরং উনুন পাশের অন্ধকারে একা একা চোখের জল ফেলতে ফেলতে জীবনভ’র সেই একবারই ব্যাতিক্রমী মনে ভাবনা এসেছিল,ধ্বংস হয়ে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক সব।এ কেমন বিচার ভগবানের,জীবন জুড়ে কোথাও কোন ছায়া কেন তাঁর জন্য রইলো না!কেন কেউ আপন হলো না!কেন?কেন?কেন? এবং থাকবে নাই যদি কিছু, এতো দীর্ঘ সুস্থ জীবন কেন দিলে ঠাকুর!
এতদিন অন্তত এটুকু আত্মশ্লাঘা ছিল,বিশু অভাগা হলেও পুরুষ তো!সে অন্ততপক্ষে তাঁকে ভালোবাসতো!সে দর্পও তো চূর্ণ হলো!গাটা কেমন রি-রি করে উঠেছিলো তীব্র বিবমিষায়।কুমুর মতো সাধারণীরও যেটুকু অর্জন,তার কণামাত্রও কেন…
এসব আবোলতাবোল ভাবনার মাঝেই দেহ এবং মনের তাপমুক্তির আশায় আরও একবার স্নান করার ইচ্ছেয় পুকুরপাড়ে এসে,ঘাটের পৈঠায় বসেছিলেন। বিরক্তি ভরে ভেবেছিলেন মনে,কুমুর সর্বনাশ করার পরেও সাধ মেটেনি বিশুর!ব্যাধবা হয়ে ফিরে আসার পরে তাঁর কাছেও তো এসেছিল শয়তানটা! ভাগ্যিস তাঁরও দুর্মতি হয়নি কুমুর মতো!
তাহলে!তাহলে কি জবাব দিতেন সেই তাঁকে!জানেন না ঠিক,জ্যাঠাইমার কথামতো এ জীবনের পরেও যদি কোন জীবন সত্যিই থাকে,যদি আবার দেখা হয় তাঁর সাথে, তিনি কি সেই নবানুরাগে আবার তাকাবেন!পত্নীগর্বে গর্বিত নব্যযুবার সেই সদাহাস্যময় মুখখানি যেন চাঁদের ঐশী আলোয় পুকুরের জলের মধ্যে হাওয়ার খেলায় অযুত খন্ডে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যেতে লাগলো চোখের আলোয়।
🍂
রাত তখন ঢলে পড়ছে আরও গভীর রাতের দিকে,বাদুড়-চামচিকি-কালপেঁচাদের মতো রাতচরাদের শিকার পর্ব শেষ হয়ে এলো,টগরের কুঁড়িগুলি ফোটার অপেক্ষায় শুভ প্রহর গুনছে,বিরজার মনেও কেমন যেন নৈর্ব্যক্তিক স্বস্তি…
আপনার ছোট্ট ঘরটিতে ফিরে,তোরঙ্গ খুলে, সেই তাঁর ফেলে যাওয়া বইগুলি বুকে চেপে ধরতেই স্বামীসঙ্গ প্রত্যাশী রমণীর সর্বাঙ্গে অপার্থিব যে আসঙ্গ সুখতৃপ্তি নেমে এলো,বাস্তব রমনেও সে পূর্ণতা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ…
বাইরে তখন ভাদ্র শেষের হঠাৎ আসা ঝরোঝরো ধারায় দাহশান্তির আশ্বাস,তন্দ্রা থেকে গভীরতর নিদ্রায় প্রায় অতলে মিলিয়ে যেতে যেতে যৌবনের উপান্তে পৌঁছনো নারীর মনগহনে আরও কতো কি যে ভেসে চলেছিলো,সে হদিশ কেউ পেলোনা।
শুধু রাত ফুরিয়ে ভোরের আলো যখন পূবগগনে মুঠো মুঠো আবীর ছড়াচ্ছিল, সূচীস্নিগ্ধ প্রভাতী হাওয়া শারদীয়া আগমনীর খবর আনছিল,গ্রামের শেষপ্রান্তে এক হতদরিদ্র পোড়ো কুটীরে কোন এক সর্বহারা মানুষের যন্ত্রনারও বুঝি ছুটি হয়ে গিয়েছিল। কাঁদার কেউ ছিল না,সে পূণ্য তিনি করেননি,তবু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দ্যূতিপথে কোন মালিন্য হয়তো প্রকৃতি চায়নি। তাই হয়তো প্রাণপাখি জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করার মুহুর্তেই কে যেন দূর থেকে চিৎকার করে উঠলো,
-’’সামালো,সামালো…”
পরে পরে সেই আর্তরব এঘর ওঘর ছাপিয়ে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঁধ ভেঙে এলাকায় জল ঢুকছে হু হু করে,কোন সতর্কবার্তা ছাড়াই। সবাই আপন সংসার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মেজবৌদিদি যতই গিন্নী সাজার চেষ্টা করুন না কেন,এসব বিপদ সামলাবার শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি অসহায় হয়ে দৌড়ে এসেছিলেন বিরজার কাছে।
বিরজা সচরাচর ভোরেই ওঠেন, কিন্তু আগের রাতের অস্থিরতার শেষে সেদিন তখনও তিনি ছিলেন ঘুমে অচেতন।প্রতিবেশিনী মেজকীর ডাকে অবচেতন থেকে চেতনে ফিরে পরিস্থিতি বুঝতে খানিক সময় নিয়েই কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছিলেন প্রৌঢ়া তারা।যদিও তাঁদের দেশে এমন আকষ্মিক বান আসেনা বাঁধ ভাঙ্গা ছাড়া,তবু যে ক’য়বার এমন বিপদ হয়েছে,জ্যাঠাইমার কাছে শিখেছিলেন,আগে গরু বাছুর নিয়ে বাঁধে উঠে জায়গা দখল করতে হয়। ওদের নিরাপদে রেখে তারপরে ত্রিপল ও বাঁশ দিয়ে কাঠামো ও আচ্ছাদন তৈরি করে অস্থায়ী আবাসনের পরিকল্পনা করা হয়।
সেইমতো সেবারেও পাড়াশুদ্ধ সবাই যে যার মতো আশ্রয় ও খুঁটিনাটি গার্হস্থ্য সরঞ্জাম সাজিয়ে যখন খানিক থিতু হ’লো, সূর্য প্রায় অস্তাচলে।সাতসকালেই বিশুর দেহান্তর হলেও অন্তিম সংস্কার নাকি তখনও হয়নি। কিভাবে কি করা যায়,পাড়ার বয়স্করা সেই আলোচনা করছিলেন।
মেজদাদা ও বাচ্ছাগুলিকে কিছু চিড়ে মুড়ি খাইয়ে কাকে কোথায় পাঠানো যায়, সেই আলোচনা করতে করতেই বিরজা শুনেছিলেন সেসব কথা, এবং নিজের কাছেই অদ্ভুত লাগছিল,তাঁর তেমন কোন ভাবান্তর হচ্ছিল না। অন্ততপক্ষে সে তো বাল্যবন্ধু ছিল তাঁদের,তবুও…
সত্যিই, মানুষের কর্মফল তাকে যে কতখানি প্রিয় বা অপ্রিয়, প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে,তা জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতেই মানুষ টের পায়।সেসব থেকে শিক্ষা নিতে পারে যে মানুষ, সেই ক্রমে ক্রমে পূর্ণাঙ্গ ব্যাক্তিত্ব হয়ে ওঠে,সমাজ সংসার তাকে মানে, মহাপুরুষ ভাবে,আর কিছু নয়।এসব ভাবতে ভাবতেই বৃদ্ধা চোখ বুজলেন, মানুষ, সংসার,খাট বিছানা, ওষুধ বই সব ছাপিয়ে চোখের সামনে তখন তাঁর ভাসছে জল,জল…অথৈ জল;যে জলের অথবা আরও বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে ‘বানের’ ভয়াবহতা আরও দুই বছর পরে এসে তাঁদের পারিবারিক অর্থনীতিকে সম্পুর্ন ভাবে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল সমসাময়িক আরও অনেকের দুর্দশার মতো। যেখান থেকে উঠে দাঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল সমাজকে।
0 Comments