জ্বলদর্চি

পথের সাথী /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

সোনাঝুরি

পথের সাথী  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য 

পাওয়াই লেকে মুম্বাই শহরের সুসজ্জিত বিল্ডিং হৃদকমলের পাঁচতলার  দক্ষিণের ব্যালকনিতে দুপুরের ভাত ঘুমের পর বিকেলে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে স্মিতা। ওর প্রসারিত দৃষ্টির সীমানা জুড়ে চারদিক ঘিরে আছে রুক্ষ কঠিন তামাটে পাহাড়। তার সৃষ্টি ছাড়া উঁচু মাথার ওপর ধূসর গোধূলির আকাশের বিষণ্ণ একাধিপত্য। ছন্নছাড়া মেঘেরা একবুক বৃষ্টির সাথে এখন আর দলবেঁধে জাঁকিয়ে আসেনা। বিকেলের  রাঙা রোদ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এলোমেলো ছলকে পরছে । পাওয়াই লেকের শ্যাওলা সবুজ জলে টকটকে লাল সৃর্যের গোলা একটু পরে টুপ করে ডুবে যাবে । যাবার বেলায় আকাশ কে বলবে এ রাতের শেষে আবার  দেখা হবে !

 ডিসেম্বর মাসের প্রায় শেষ।এখানে শীতের বালাই নেই। সময়ের সাথে পা মিলিয়ে তাতা থৈ থৈ তালে আসবে নতুন বছর। সোনালী সূর্য পুবের আকাশে  নব চেতনায় আত্মপ্রকাশ করবে। মানব মনের অশেষ চাওয়ার মত স্মিতার মনেও গুনগুনিয়ে ওঠে আশা জাগানোর ছন্দ। বেঁচে থাকার অমৃতের সন্ধানে মরিয়া হয়ে ওঠে প্রাণের স্পন্দন। 
  পাহাড়ি পথে।

 নানা কাজের অজুহাতে দিনের আলো রাতের কালোতে মিলে যায় । নিজের চিরন্তন চেনা গন্ডির সুখ ছেড়ে এখানে দিনগুলোয় স্বাধীনতার স্বাদ অন্যরকম। আজ বেশ লম্বা অবকাশ পেয়ে ও বহুদিন পর  পাহাড়ের পায়ের কাছে বৈকালিক ভ্রমণে দূরের ঐ  আলো আঁধারিতে ঘেরা রহস্যময় পথে এগিয়ে চলেছে।

ক্যাম্পাসের কালোপীচঢালা আঁকাবাঁকা পথগুলোর ডাকে ওর মন বিহ্বল। শেষ বিকেলের আকাশ থেকে কমলা রাঙা আলোয় সোনাঝুরির সোনালী  রঙের ফুলের মোরাম বিছানো পথের দুপাশে। উদাসী বসন্তের দক্ষিণ সমীরণের আমেজে উন্মত্ত আলোড়নে মাথা ঝাঁকায় পথপাশে প্রহরারত পাম মেহগিনি ইউক্যালিপ্টাসেরা। ঘোলাটে আকাশ নিমেষ হারা চোখে অপলকে তাকায়। 
পাওয়াই লেক।

ওপাশের রাস্তায় সদা চঞ্চল শহরের তিরিশ পয়ত্রিশ তলা বিলাসী অট্টলিকারসারি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব গ্রাস করেছে বিশাল দেহী দৈত্যাকায় বিল্ডিংগুলো।  টকটকে লাল সৃর্য পাওয়াইয়ের জলে অনেক আগেই ঝাঁপ দেওয়ায় স্লেট রঙের কালচে মেঘ ছাই মাখা নিস্তেজ আকাশ কে ঢেকে ফেলেছে । দূরের পাহাড়ের উঁচু নিচু ঢালগুলো কে আড়াল করে রেখেছে প্রকৃতির ওপর বুলডেজার চালিয়ে অহংকারী মানুষের সর্বনাশা ক্ষুধা। আধুনিক নগরের আকাশছোঁয়া আবাস স্থল গড়ে তুলছে ভাবীকালের ঐতিহ্যের স্মারক পায়রার খোঁপের মত শান্তির নীড়। অজস্র হলুদ আলোর প্লাবনে ক্লান্ত সন্ধ্যার বিদায়ীতে রাতের আকাশ জেগে ওঠে । বিলাসীনীর পায়ের তলে অগুনিত বস্তির নীল সবুজ পলিথিন কাগজে মোড়া টালির ছাদের ছোটোবড়ো অসংখ্য চালাঘর। মুম্বাইয়ের টানা বর্ষণের অবিরত অজস্র ধারায় বৃষ্টিকে শাসনে রাখে ঐ নীল পলিথিনের সিটগুলো। যেন ধনীর পায়ের তলে অল্প দামে বিকিয়ে যাওয়া বিদ্রুপের মত জীবনের কলোরোল।  
🍂
 
  স্মিতা ফুটপাত ধরেই হাঁটছিলো ,একপাশে বয়স হয়ে যাওয়া হলদেটে গায়ে সাদা ছোপের ভুলু সামনের দুটো পা টান করে চোখ বুজে বিশ্রামে রত। ওর কালো চোখের দুপাশ দিয়ে বয়সের ক্লান্তির জল গড়ায়। ওদের বারোমাস নিবাস রাস্তাতেই। তবে টানা বর্ষায় গ্যারেজের শেডের তলে, কিম্বা স্টাফ হোস্টেলের লম্বা করিডরে অবারিত দ্বার। ভুলু প্রতিদিন সিঁড়িবেয়ে  লাঞ্চ টাইমে পাঁচতলার বারান্দায় উঠে স্মিতার দরজায় দাঁড়িয়ে খুব চেনা সুরে আওয়াজ দেয়।
 মাছ মাংসের রান্নার গন্ধ ওর খুব প্রিয় আর ভালবাসে ব্রিটানিয়া মেরি বিস্কিটস। স্মিতা যত্ন করে মাছ বা মাংসের টুকরো কিম্বা ডিম দিয়ে ভাত মেখে ওর নির্দিষ্ট প্লেটে ঢেলে দিয়ে প্রায়ই লক্ষ্য করে খাবার সময় ভুলুর পুরো শরীর টা বেশ উত্তজনায় থরথরিয়ে কাঁপে। খাওয়া শেষ হলে একটা দানাও লেগে থাকেনা পাত্রের কিনারায়।

 স্মিতার নতুন পাটভাঙা শাড়ির গন্ধ আর পায়ের আওয়াজে ,শুয়ে থাকা ভুলু সচকিত হয়ে চেয়ে গা ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ! অভিভাবকের দৃষ্টিতে তাকায় ভাব টা যেন এখন এই ভর সাঁঝের বেলায় অচেনা পথে তুমি একাকী কেন ? ভাবে বুঝি এমন অসময়ে যাচ্ছে কোথায়?                
   
  নবীন বসন্তের আবির্ভাবে পশ্চিম সায়রের কিনারা থেকে মিঠে বাতাস বইছে। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসে বুনোফুলের সুগন্ধ। ইউক্যলিপটাস অমলতাস মেহগিনি শাল পিয়াল সেগুনে ছেঁয়ে আছে এদিকের হিলসাইডের সবুজের গলিপথ। দিনের শেষ ম্লান আলোয় বৈচিত্রহীন নিরাশায় ভরা মন স্তম্ভিত। 
 ছাই রঙা ধূসর পৃথিবী কে মনে হয় দীনহীন ভারী রিক্ত। অসীম শূন্যতা গ্রাস করেছে চারদিকে। অজস্র  ভাবনারা মাথার ওপর ঘূণ পোকার মত ঘুরপাক খায়। 
বেখেয়ালে হেঁটে বহুদূরের অচেনা পথে চলে এসেছে।    
  দিগন্তের প্রান্ত রেখায় ঘরে ফেরা পাখির পাখায় প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে ব্যাকুলতা। আকাশ ছোঁয়া গাছেদের গায়ে প্রাণের পরশে সাড়া জাগে। 

লেকের ধার বরাবর সোজা রাস্তায় এগিয়ে বিশাল হসপিটালের সীমানা ছাড়িয়ে নির্জন বনের ধারে এক রাস্তায় যেখানে মর্গ আছে,আর কয়েক পা এগোলেই তো  টিমটিমে বাতি জ্বলা লাশ কাটা লাল ঘরটা। সেই ছোটবেলায় শোনা নিশিপাওয়া ভুতুড়ে গল্পের মত ভয়ে বিবর্ণ ও। স্মিতা ফেরার পথ খুঁজে পায় না ,শুধু দিকবিদ্গি জ্ঞানশূন্য হয়ে উদভ্রান্তের মত চলে ? পেছন ফিরে লম্বা পা ফেলে দে ছুট। অন্ধকারে পথ সব অচেনা লাগছে ।  

সর্পিল কালো ঝাঁ চকচকে পথ বুঝি তার আপন ঐশ্বর্যের মোহজালে এমনি করেই পথিক কে জড়িয়ে ধরে আঙুলের ইশারায়। অনভ্যস্ত পায়ের পাতা দুটো ও অবসন্ন বোধ করছে।  গোলোকধাঁধায় পরে  নিরুপায় হয়ে পথচারী কে জিজ্ঞেস করে,গুলমোহর বাসস্টপ আর কত দূরে ? মাঝারি বয়সের লোকটি  ক্ষয়ে যাওয়া লাল দাঁত বারকরে বিদঘুটে হেসে বলে একদম সোজা গিয়ে ডাইনে মুড়ে আবার বাঁয়ে চলে দেড়  কি,মি,। হে-হে এ যে উল্টো পথ অটোরিক্স ও পাওয়া যাবে না। ''

  অবশেষে দাঁড়িয়ে না থেকে ভয় ভাবনা চুলোয় দিয়ে ক্লান্তি মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে নিস্তব্ধ পথে আবার চলার শুরু । পথের পাশে নজর পরতেই আবছা অন্ধকারে দেখে হলদেটে লেজ নেড়ে মুখ দিয়ে ভোঁ,ভোঁ হাল্কা আওয়াজ বার করে ভুলু দাঁড়িয়ে। হায়রে এতক্ষণ নিজের চিন্তায় মশগুল থাকায় ও খেয়ালই করেনি যে ভুলু সঙ্গ নিয়েছে। বলছে , ভাবছো কেন ? আমি আছি তো ! পথ দেখাবো।
  নিরুদ্দেশের পথ

বলতে বাধা নেই ,সেইক্ষণে এক অপার্থিব আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলো স্মিতা । অবলা  ভুলু একমাত্র ভরসা। ওকে অনুসরণ করে গুলমোহর পেরিয়ে অবশেষে প্রায় আধঘন্টা বাদে ওর ফ্ল্যাটের পাঁচ তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। একটু জিরিয়ে দরজার তালা খুলে পিছন ফিরে দেখে ভুলু নেই।  প্ৰভুভক্ত ভুলু দায়িত্ব নিয়ে ওকে যথা স্থানে পৌঁছে দিয়ে নিশব্দে নীচে নেমে গিয়েছে। একটা বিস্কুট, বা একটু যত্নের ডাক সামান্য আদরের ও তোয়াক্কা করেনি। কোনো প্রত্যাশা নেই  বরং  নীরবে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে মনিব কে বিপদ মুক্ত করেছে। 
স্মিতা অবাক! এমন ও হয়? কি অসাধারন ধী শক্তি ।কী খাঁটি ভালোবাসা ! এত দূলর্ভ প্রভুভক্তি এত মায়া একটা স্ট্রিটডগের! এত সহজে রাস্তা খুঁজে পাবে কে ভেবেছিল।

   জানলার ধারে চুপ করে বসে ভুলুর কথাই মনে পড়ছিল। তখন ই সুরঞ্জনার ফোন বেজে উঠল। বিশাল এক্সিডেন্ট হয়েছে মেন রাস্তায় প্রচুর যান জটে ফেঁসেছি , ফিরতে দেরী হবে। বাইকের আরোহী ইয়ং ছেলেটি গুরতর আহত। রেস্কিউ এম্বুলেন্সে এখনো ও পৌঁছয় নি। প্রাইভেট মারুতিকারটি ব্রেক ফেল করে তাল তুবড়ে চাপা দিয়েছে পথ চলতি এক কুকুর কে। 
ইট কাঠের জঙ্গল মুম্বাই।

স্মিতার বুকটা হাপড়ের মত লাফায় ,ধক করে ওঠে ,ভাবে কুকুর? আমাদের ভুলু নয়তো ? ও তক্ষুনি ছুটে মেনরাস্তার দিকে দৌড়োয়। যা ভেবেছে ঠিক তাই। জমাট লাল রক্তের মাঝে চিরতরে শুয়ে আছে ভুলুই।  ওর রক্তাক্ত নিথরদেহ।  এই রাস্তা দিয়েই তো ভুলুর সাথে দশ মিনিট আগেই ফিরলাম। আর এর মধ্যেই ?  স্মিতা নির্বাক স্তদ্ধ হয়ে মূক বধির কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে প্লাবন বয়ে যায়। জীবন এত অনিত্য ! একটু আগেই যে ভুলুর যত্নে  গৃহকোণে ফিরলো।

বিশ্বাস হয় না,সেই ভুলুই নিমেষে একাকী চলেছে কোন পরপারে,মহাপ্রস্থানের পথে ?  তা হলে পৃথিবী থেকে বিদায় বেলায় ভুলু বুঝি ঋণশোধ করে গেল? আধুনিক সভ্যতায় মানুষ কত দ্রুত পরিবর্তনের স্রোতে ভাসছে। কিন্তু রাস্তার ভুলুদের কোনো পরিবর্তন নেই। ওদের বিবেক বুদ্ধি ,প্রভুভক্তি অতুলনীয়। সেইকবে ?  মহাভারতের যুগে স্বর্গেরপথে অসহায় নিঃসঙ্গ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে চলেছিল ভুলুরই পূর্বসূরি । ওদের  প্রভুভক্তির সেই ট্রাডিশন আজো সমানে চলেছে।

Post a Comment

0 Comments