জ্বলদর্চি

কাব্যগ্রন্থ আলোচনা --( রাত্রির তপস্যা --সর্বজয়া নন্দ আচার্য) আলোচক--তনুশ্রী ভট্টাচার্য

কাব্যগ্রন্থ আলোচনা --
( রাত্রির তপস্যা --সর্বজয়া নন্দ আচার্য)

 আলোচক--তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

ঈশা ব্যসমিদং সর্ব যৎ কিঞ্চিৎ জগত্যাং জগৎ
তেন তক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধ: কস্য স্বিদ্ধনম্ ।।


 ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনের নিবিড়  অনুশীলনে   ঈশোপনিষদের এই  মন্ত্রের  মূল নির্যাসে পৌঁছে যেতে পারেন  যে কেউ। এই গতিশীল বিশ্বে সব কিছুই অনিত্য এবং পরমার্থের দ্বারা আচ্ছাদিত। ত্যাগ ও তপস্যার মাধ্যমে সেই পরমার্থের অন্বেষণ  এবং আত্মোপলব্ধি   পার্থিব মানুষের কামনার ধন। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনেই ঘটে মানুষের মুক্তি ও সিদ্ধি। তার জন্য চাই তপস্যা---- আন্তরিক নিষ্ঠায় , চাই শুদ্ধ জীবনাচারণ। চাই নিবেদন।চাই সমর্পণ। করপুটে অঞ্জলি ও অর্ঘ্য নিবেদন। সে তপস্যা কোনো বহিরঙ্গে নয়, নয় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক, নয় কোনো বেদীমূলে বা আসনে উপবিষ্ট হয়ে। সে তপস্যা অন্তরে। অন্তরের অন্তঃস্থলে। সে তপস্যায় মগ্ন থাকতে হয় নিয়ত ।সময়ের কোনো বিভাজক তাকে থামিয়ে দিতে পারে না। এমনই  নিরন্তর তপস্যার সুর ধ্বনিত হয়েছে কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দের সাম্প্রতিক কাব্য গ্রন্থ  রাত্রির তপস্যায়।
কবিতাগুলি ভক্তিরসের কবিতা, অধ্যাত্ম দর্শনের কবিতা। এক জীবনদর্শনের  কবিতা। একজন সাধিকার সাধন ভজন  সহজিয়া পথে চলে এবং ছুঁতে চায় সেই  পরমপিতার আশ্রয়।  ঈশ্বরগত প্রাণের আকুলতা ব্যকুলতা কবিতাগুলির ছত্রে ছত্রে। বড় আবেগী মরমী কবিতাগুলি । নিখাদ তপস্যালব্ধ এক বীক্ষণ ,এক অনুভূতি পাঠককে জারিত করবে।কথামৃতস্বরূপ কবিতাগুলিতে মানবিক গুণাবলীর জয়গান করা হয়েছে। কন্টকময় জীবনযন্ত্রণা থেকে দুদন্ড শান্তি পাওয়ার আশায় কবিতাগুলি পড়তে বসলে পাঠক হতাশ হবেন না--বলাই যায়। হং আর স:-- মিলে গেলে আমাদের প্রাপ্তির ভান্ডার পূর্ণ হয়। সেই আদি পরমা প্রকৃতির শক্তি তে কবি আত্মদর্শন করতে চান। "অন্তিম শয্যা হোক উন্মুক্ত ধরিত্রীর বুকে"/পড়ুক শেষের নি:শ্বাস দুর্নিবার বাতাসের গায়---" কবির উচ্চারণে কোনো ফাঁকি নেই। ভক্তিরসের সঙ্গে মিলেছে করুণ রস। কোনো কোনো কবিতা মনে পড়িয়ে দেয় ইংরেজ কবি ক্রিশ্চিনা জর্জিনা রসেটির  ভক্তিরসের কবিতাগুলি।তাঁর কবিতার মতো এখানেও  শান্ত নীরব ত্যাগ ও  পরমপিতার চরণে আশ্রয় পাওয়ার একটা আকুতি আছে ইংরেজীতে যাকে বলা হয় calm resignation.। শত ব্যর্থতাতেও নেই বেদনা হতাশা অপ্রাপ্তিবোধ। বরং তা অতিক্রম করে উত্তরণের পথ বাতলে দেয় কবিতাগুলি।  বিশ্বকবির গীতাঞ্জলির কথা মনে পড়ে  "তপের নিধি " উপশিরোনামে গ্রন্থিত কবিতাগুলি পড়তে পড়তে। ---নেই  উপচার -নৈবেদ্য
/আছে ক্ষুদ্র হৃদয়ের বেদী/ নিশীথের নিস্তব্ধতার মাঝে/
ঋত্বিকের একাগ্রতা যদি /শাশ্বত আনন্দের খোঁজে/
করে মুহূর্তের আরাধনা/ তবে সেই দেয় পরিতৃপ্তি /সেই হয় শ্রেষ্ঠ সাধনা।
আজ যখন উদগ্র জাগতিক কামনা  বাসনায় ,ভোগের চূড়ান্ত লিপ্সায় মানুষ বেপথু তখন এই স্নিগ্ধ রসের কবিতাগুলিতে প্রীতি সৌহার্দ্য সহৃদয় হৃদয় সংবেদী সমাজের  বার্তা আছে । কোনো কথার মারপ্যাঁচ নেই। ভাব ভক্তি নিবেদন ও করুণরসে জারিত কবিতাগুলি তে যেন মানকুমারী বসু,গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী প্রিয়ংবদা দেবী  বা  কামিনী রায়ের কবিতার জীবনদর্শনের ছাপ পাওয়া যায়। রাতের প্রহরে,তপস্যার বাটে ও তপের নিধি তিনপর্বে  বিন্যস্ত কবিতাগুলিতে ভাবগত ঐক্য অক্ষুণ্ণ।
হয়তো আধুনিক কবিতার গঠন বয়ান বা ভাষ্যে কবিতাগুলি  শ্রেণীবদ্ধ হতে কিছু সীমারেখা থেকে দূরবর্তী অবস্থানে আছে তবুও বলব কবিতাগুলি পড়ার পরে  এক টলটলে সরোবরে অবগাহন স্নানের শান্তি লাভ করবেন পাঠক। ভক্তিরসমধুর কবিতাগুলো  জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এক অক্ষয় সঞ্চয়ের  সন্ধান দেয়। পার্থিব নয়,পরমার্থিক সঞ্চয়।  এখানেই কবিতাগুলির সার্থকতা। প্রকাশক জ্বলদর্চি র এই প্রয়াস পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠুক।।

Post a Comment

0 Comments