জ্বলদর্চি

নকশা সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ /রাজীব শ্রাবণ


নকশা সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ

রাজীব শ্রাবণ 


যাঁদের অকাল মৃত্যুতে ঊনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে  কালীপ্রসন্ন সিংহের কথা বলতে গেলেই এসে যায় তাঁর অমর সৃষ্টি নকশা সাহিত্যর কথা।

 বাঙলা সাহিত্য এবং বাঙালি জাতির জন্য যে সাধনা ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গিয়েছেন,  ইতিহাসে সেটার তুলনা মেলা ভার।
কালীপ্রসন্ন জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত দেওয়ান বংশের একমাত্র পুত্র ছিলেন। অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মধ্যেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। শৈশবেই তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটেছিল এবং নিতান্ত কাঁচা বয়সেই তিনি বিপুল বিত্ত-সম্ভারের মালিক হয়েছিলেন। 

 সেযুগের বাবুতন্ত্রের কলকাতায়— তখনকার প্রথা অনুযায়ী— তাঁর পক্ষে অধঃপতনের পথ অতিশয় সুগম ছিল। অথচ সেটা কিন্তু ঘটেনি। তখন একদিকে পুতুলনাচ, বাঈনাচ এবং গণিকা-চর্চার বনেদী বাবুয়ানা, এবং অন্যদিকে মদ্যপান ও চলনে-বলনে-লেখনে বিকৃতি ইংরেজিয়ানা— গ্রীক পুরাণের ইউলিসিসের মত এই শিলা এবং ক্যারিবডিসের মধ্যে দিয়ে নিজের আশ্চর্য শক্তির সাহায্যে কালীপ্রসন্ন একজন খাঁটি মানুষ হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেযুগে রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের আদর্শ একমাত্র কালীপ্রসন্নের মধ্যেই সার্থকভাবে উদ্ভাসিত হয়েছিল বলা চলে। কালীপ্রসন্নের মধ্যে বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি ঊনবিংশ শতকের বাংলার পূর্ণ প্রগতিশীলতার প্রতিনিধি ছিলেন। জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর যে কি অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল, সেটার উজ্জ্বলতম অভিজ্ঞান হল তাঁর বিপুলতম কীর্তি— মহর্ষি বেদব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাভারতের বঙ্গানুবাদ। বিদ্যাসাগর থেকে আরম্ভ করে তখনকার সমস্ত শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতই সেই বিরাট কাজে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন চাইলে শুধুমাত্র এই মহাভারতের বঙ্গানুবাদের জন্যই বাঙালির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু শুধুমাত্র ঐতিহ্যের চর্চার মধ্যে দিয়েই তিনি তাঁর কর্তব্যকে শেষ করে দেননি। তাঁর উপরে রামমোহনের প্রভাবের ফলে সমকালীন সমাজের যা কিছু কুপ্রথা— যা কিছু গ্লানি— যত কিছু ভণ্ডামি— সেসবের বিরুদ্ধেও তিনি সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন। আর তাঁর সেই বিদ্রোহের সবথেকে কৌতুককর নিদর্শন ছিল— ‘টিকি মিউজিয়াম’। সেযুগের তথাকথিত ভট্টাচার্য পণ্ডিতদের ধর্মপ্রাণতা যে কি পরিমাণে অন্তঃসারবর্জিত ছিল, সেকথা প্রমাণ করবার জন্য অর্থমূল্যের বিনিময়ে তিনি তাঁদের মাথা থেকে টিকিটি কেটে নিয়ে নিজের সংগ্রহে রেখে একটি আস্ত সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন। এমন মর্মঘাতী ব্যঙ্গের দৃষ্টান্ত বাংলার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণদের সেই ‘শিখামেধ’ যজ্ঞের পিছনে কালীপ্রসন্নের যে মনোভঙ্গি নিহিত ছিল— তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ সেটারই অকুণ্ঠ অভিব্যক্তি ছিল।
বাংলার ইতিহাসে কালীপ্রসন্নের সৎকীর্তি এবং সহৃদয়বত্তার তালিকা অফুরন্ত বলে দেখা যায়। মাত্র তেরো বছর বয়সে যিনি ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’–র প্রতিষ্ঠা করে সুসাহিত্য সৃষ্টি এবং সমাজ-সংস্কারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন; বঙ্গদেশে প্রগতিশীল নাট্যধারার প্রবর্তনের জন্যে যিনি ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ গড়ে তুলেছিলেন এবং সেইসঙ্গে নাটক রচনাও করেছিলেন; ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের কবিকে প্রথম গণসংবর্ধনা জানিয়ে যিনি তাঁর হাতে কৃতজ্ঞ বাঙালির মানপত্র এবং প্রীতির পানপাত্র তুলে দিয়েছিলেন; সেযুগের কুখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ মামলায় জড়িত রেভারেণ্ড জেমস লঙের জরিমানার হাজার টাকা যিনি সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতির প্রতিনিধি হিসেবে মিটিয়ে দিয়েছিলেন; নীলকর সাহেবদের শয়তানি চক্রান্তে জর্জরিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক লোকান্তরিত হরিশ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারকে যাঁর উদার অর্থসাহায্যই বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল— সেই কালীপ্রসন্ন সিংহের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাঙালি কিন্তু আজও তেমন কোন যথোচিত কর্তব্য পালন করেনি। এছাড়াও সংবাদপত্র সেবায়, দানে-দাক্ষিণ্যে, দেশপ্রেমে, শিক্ষার আনুকূল্যে— এমনকি কলকাতায় প্রথম বিশুদ্ধ পানীয় জলের প্রবর্তনে— এককথায় সমসাময়িক জীবনের সমস্ত প্রগতিশীল ভূমিকাতেই ঊনিশ শতকের বাঙালি শুধুমাত্র কালীপ্রসন্নকেই দেখতে পেয়েছিল। এহেন বিরাট মানুষটির অপূর্ব জীবন-সাধনার পরিচয় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সাহিত্য-সাধক চরিতমালা’ গ্রন্থটিতে সবিস্তারে পাওয়া যায়।
বাঙালি সত্যিই আত্মবিস্মৃত জাতি। সেটা না হলে বছরে অন্ততঃ একবার হলেও তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মরণোৎসবের আয়োজন করে নিজেরাই চরিতার্থ হওয়ার সুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র কালীপ্রসন্ন সিংহকে ভুলে যাওয়াটাকে বাঙালির চরম দুর্ভাগ্য শুধু নয়, পরমতম লজ্জার বললেও ভুল কিছুই বলা হয় না।
কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ এক অনন্ত সমাজচিত্র। যদিও শুধু চিত্র বললে সঠিক হয় না— কালীপ্রসন্নের এই গ্রন্থটি আসলে ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজের একটি আস্ত চিত্রশালা বা ‘পিকচার গ্যালারি’। সেযুগের— চড়ক-পার্বণের রঙ্গ, বারোয়ারীর নামে সমকালীন সমাজের দুর্নীতি; মরা ফেরা, ছেলে ধরা, মিউটিনি, সাতপেয়ে গোরু, আর দরিয়াই ঘোড়ার হুজুগের ব্যঙ্গ-প্রসঙ্গ, বিচিত্র বুজরুকির নমুনা, হঠাৎ অবতার পদ্মলোচন দত্তের শ্লেষতিক্ত উপাখ্যান, মাহেশের স্নানযাত্রার বর্ণনা, রামলীলার হট্ট উৎসব এবং নব প্রবর্তিত রেলওয়ের অতি বাস্তব চিত্র— হুতোমের নকশা থেকে এগুলির কোনোটাই বর্জিত হয়নি। এই গ্রন্থটি শুধু একটি বিশুদ্ধ সমাজচিত্র নয়— সংস্কারব্রতীর প্রতি উপদেশও নয়— রসসৃষ্টির দিক থেকেও কালীপ্রসন্নের এই নকশার একটি অসামান্য ঐতিহাসিক মর্যাদা রয়েছে। সব সমালোচকদের মতেই এই গ্রন্থটি আসলে যেকোন উপন্যাসের থেকেও বেশি সুখপাঠ্য।
তবে কালীপ্রসন্নের নকশা অবশ্য এই পর্যায়ের প্রথম কোন গ্রন্থ নয়। কালীপ্রসন্নের আগেই ‘সমাচার-চন্দ্রিকা’ পত্রিকার বিশ্রুতনামা সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন সমাজ-জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভ্রান্তি-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রথম কলম ধরেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ‘বাবুর উপাখ্যান’ দিয়ে তিনি তাঁর এইধরণের লেখনী আরম্ভ করেছিলেন, এবং এরপরে যথাক্রমে— ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নববাবুবিলাস’ এবং ‘নববিবিবিলাস’ গ্রন্থগুলির মধ্যে দিয়ে সেই লেখনীর পরিণতি ঘটেছিল। ঊনিশ শতকের কলকাতার সমাজক্ষেত্রে— বিশেষতঃ নব্যতন্ত্রীয়দের ভেতরে তখন যে সমস্ত অসঙ্গতি ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল, ভবানীচরণের আক্রমণের লক্ষ্য সেদিকেই ছিল। সমালোচকদের মতে— তাঁর কলমে ধার ছিল এবং আক্রমণের মধ্যে সত্যতাও ছিল। কিন্তু তবুও একইসাথে একথাও ভোলা সম্ভব নয় যে, ভবানীচরণ সেযুগের রক্ষণশীল মনোভাবের প্রধানতম প্রবক্তা ছিলেন। তিনি তাঁর সমসাময়িক অধিকাংশ প্রগতিশীল আন্দোলনেরই বিরোধিতা করেছিলেন, এবং সেসবের মধ্যে রামমোহন রায়ের সতীদাহ নিবারণ প্রসঙ্গে তাঁর ভূমিকা সবথেকে বেশি লজ্জাকর ছিল। সমসাময়িক ভট্টপল্লীর মনোভাব এবং শোভাবাজার রাজবাড়ির দৃষ্টিকোণই তাঁর রচনার মধ্যে বিশেষভাবে প্রকটিত হয়ে উঠেছিল। তাই সদিচ্ছা সত্ত্বেও ভবানীচরণের ব্যঙ্গচিত্র একদেশদর্শী হয়ে গিয়েছিল। সমালোচকরা তাঁর রুচিরও তেমন প্রশংসা করতে পারেননি; তাঁদের মতে— সেদিক থেকে তিনি ‘রসরাজের’ গুড় গুড়ে ভট্টাচার্য এবং ঈশ্বর গুপ্তের সমধর্মী ছিলেন। তৎকালীন সমাজের কুরুচিকে আঘাত করতে গিয়ে ভবানীচরণ নিজেই যে কতটা অশ্লীল হয়ে উঠেছিলেন— তাঁর লেখা ‘নববাবুবিলাস’ এবং বিশেষ করে ‘নববিবিবিলাস’ গ্রন্থে সেটার পরিচয় পাওয়া যায়।
ঊনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে সমাজচিত্র রচনায় ভবানীচরণের পরবর্তী স্মরণীয় প্রতিনিধি ছিলেন— ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ বা প্যারীচাঁদ মিত্র। তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটি প্রথম বাঙলা সামাজিক উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করেছে। উক্ত গ্রন্থটিতে টেকচাঁদ— ‘আলাল’ বেচারাম বাবু এবং তস্য ‘দুলাল’— কাহিনীর নায়ক (অথবা ভিলেন) মতিলাল, বালীর বেণীবাবু, স্কুল মাস্টার বাঞ্ছারাম, এবং সর্বোপরি স্বনামধন্য ঠকচাচার অপূর্ব চরিত্র-চিত্রণ করেছিলেন। ভাষার দিক থেকেও তাঁর কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য, সমালোচকদের মতে তাঁর প্রায় লোকায়ত সহজ-রীতির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের গভীর মধুর রচনা পদ্ধতির মিলনের ফলেই পরবর্তী সময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা-শৈলীর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সমাজচিত্র রচনা করবার থেকেও উপন্যাস রচনা করবার দিকেই প্যারীচাঁদের ঝোঁক বেশি ছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়। আর সেই উপন্যাস যে ‘রমন্যাস’ নয়— আদর্শবাদী প্রচারণার প্রতি নিবন্ধ দৃষ্টি প্যারীচাঁদ তাঁর সেই উদ্দেশ্যকে কখনো গোপন করেননি। সেদিক থেকে ভবানীচরণ যেমন প্রাচীন দলের মুখপাত্র ছিলেন, অন্যদিকে প্যারীচাঁদ তেমনি নব্য দলের বাণীবহ ছিলেন। সেযুগের প্রাচীনপন্থীদের অন্যতম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু— ব্রাহ্ম-সমাজের সুনীতি ও সুরুচির প্রধান আদর্শগুলিই তাঁর লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছিল বলে দেখা যায়। প্যারীচাঁদের আদর্শবাদিতার আরো সুস্পষ্ট পরিচয় তাঁর— ‘অভেদী’ কিংবা ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ —গ্রন্থ দুটির মধ্যে পাওয়া যায়। তাই আত্যন্তিক আদর্শবাদে চিহ্নিত প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটিকে সমালোচকরা কখনোই সম্পূর্ণভাবে সমাজচিত্রের সমপর্যায়ে ফেলেননি; তাঁদের মতে এই গ্রন্থটির উপরে ঊনিশ শতকের বাংলার ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র স্থূল হস্তাবলেপ লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ প্যারীচাঁদের আলালের গুরুত্ব এবং মহিমার ক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা।
🍂
প্যারীচাঁদের আলাল প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পরে বাংলা সাহিত্য জগতে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’–র আবির্ভাব ঘটেছিল। আর সেই আবির্ভাব যে রীতিমত চাঞ্চল্যকর হয়েছিল, সেবিষয়ে কারো বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ নেই। এর কারণ হল যে, হুতোমের এই নকশার মধ্যে কাল্পনিকতার কোন জায়গা ছিল না বললেই চলে। এই গ্রন্থটিতে দুঃসাহসী কালীপ্রসন্ন তাঁর সমকালীন বাংলার বিভিন্ন কুপ্রথা, মূঢ়তা, ভণ্ডামি এবং ইতরামীর একেবারে ফোটোগ্রাফিক ছবি যেন তাঁর এক্সরে লেন্সে ধরে ফেলেছিলেন। গ্রন্থটির কোথাও বাস্তব নামধাম বজায় রেখে, তো কোথাও আবার সামান্যমাত্র আবরণ রেখে তিনি সেযুগের অনেক তথাকথিত বিখ্যাত ব্যক্তির খাঁটি স্বরূপটি পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একদা দীনবন্ধু মিত্র সম্পর্কে যা কিছু বলেছিলেন, কালীপ্রসন্ন সম্বন্ধেও তাঁর সেই উক্তিকে সমানভাবে প্রযোজ্য করা চলে—
“তিনি তুলি ধরে সামাজিক বৃক্ষে সমারূঢ় বানরের ল্যাজ সুদ্ধ এঁকে দিয়েছিলেন।”
সেযুগের বাংলায় মধুচক্রে যে লোষ্ট্রপাত ঘটেছিল, সেবিষয়ে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। এরফলে তৎকালীন সমাজে যাঁদের গাত্রদাহ আরম্ভ হয়েছিল, তাঁদের পক্ষ থেকেও কালীপ্রসন্নের গ্রন্থটির প্রত্যুত্তরের দেওয়ার চেষ্টার কোন অভাব হয়নি। ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় তো উতোর গেয়ে লিখেছিলেন— ‘আপনার মুখ আপনি দেখ।’ কিন্তু হুতোমের সত্য ও স্পষ্টভাষণে শেষপর্যন্ত তাঁরই দল ভারী হয়ে উঠেছিল। সেই কারণেই— হুতোমপন্থী ও ‘সমাজ কুচিত্র’ গ্রন্থের লেখক ‘নিশাচর’, হুতোমকে নিজের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানিয়ে ভোলানাথকে নিম্নলিখিত কথাগুলি বলে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন—
“বাজারে হুতোম প্যাঁচা বেরুলো, বদমায়েশদের তাক্ লেগে গ্যালো, ছেলেরা চমকে উঠলো, আমরা জেগে উঠলুম্, চিড়িয়াখানায় নানাপ্রকার স্বর শোনা যেতে লাগলো। ‘আপনার মুখ আপনি দেখ’ এগিয়ে এলো। আমরা তারে চেনো চেনো কোরে ধরে ফেল্লেম, সেটা পাখী নয়, সুতরাং উড়তে পাল্লে না, আপনার ফাঁদে আপনিই ধরা পড়লো।” (সমাজ কুচিত্র, আমাদের গৌরচন্দ্রিমা)
কিন্তু সবথেকে কৌতুকের ব্যাপার হল যে, শেষপর্যন্ত এই ভোলানাথকেই কালীপ্রসন্নের অসীম অনুকম্পার দারস্থ হতে হয়েছিল। ‘আপনার মুখ আপনি দেখ’ গ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করবার জন্য ভোলানাথকে কালীপ্রসন্নের কাছেই কাতর নিবেদন জানিয়ে পত্র লিখতে হয়েছিল। অতীতে ‘শ্রীতালাহূল ব্ল্যাক-ইয়ার, প্রকাশক’—স্বাক্ষরিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় সেই চিঠিটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। সেই সংস্করণে ‘ব্ল্যাক-ইয়ার’ (অথবা হুতোম?) এপ্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন—
“ফলে ‘আপনার মুখ আপনি দেখ’ গ্রন্থকার হুতোমের বমন অপহরণ করে বামনের চন্দ্র গ্রহণের ন্যায় হুতোমের নক্শার উত্তর দিতে অগ্রসর হন ও বই ছাপিয়ে ঐ বই হুতোমের উত্তর বলে কতকগুলি ভদ্রলোকের চক্ষে ধূলি দিয়ে ব্যাচেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বহুদিন ঐ ব্যবসা চললো না। ... এমন কি, ঐ গ্রন্থকার খোদ হুতোমকেই তাঁরে সাহায্য কত্তে ও কিঞ্চিৎ ভিক্ষা দিতে প্রার্থনা করেন।”
হুতোমকে লেখা ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের চিঠির শেষে একটি অধ্যাত্মভাবমূলক কবিতা পাওয়া যায়। হুতোম কোথাও নিজের নাম বা ভোলানাথের নাম প্রকাশ না করলেও, সেই কবিতার অন্তরালে তাঁদের দু’জনের নামই সংকেতে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ভিক্ষাপাত্রের দ্বারা যে সত্যিটি নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়, সেটা হল যে— হুতোমের জয়যাত্রার সামনে কোন প্রতিপক্ষই সেদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন নি। এর কারণ হল যে, অকৃত্রিম দেশপ্রেম আর সত্যের শক্তিই কালীপ্রসন্নের অমোঘ যুদ্ধাস্ত্র ছিল।
বঙ্কিমচন্দ্র টেকচাঁদের রচনার প্রশংসা করেছিলেন এবং তাঁকে অভিনন্দনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু হুতোম তাঁর কাছ থেকে কোন প্রীতি কটাক্ষ লাভ করতে পারেননি। বালাই বাহুল্য যে, হুতোমের ভাষা ও বক্তব্য বঙ্কিমের কখনো ভালো লাগেনি। তবে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমের রাজকীয় উপেক্ষা সত্ত্বেও হুতোমের নকশা কিন্তু তাঁর নিজস্ব মর্যাদায় স্বমহিম থেকে গিয়েছে।
হুতোম তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় নিজের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন—
“এই নকশায় একটি কথা অলীক বা অমূলক ব্যবহার করা হয় নাই।”
এই গ্রন্থটির ভেতরে হুতোমের সমকালীন ব্যক্তিবিশেষ তাঁদের নিজস্ব প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেও সেবিষয়ে লেখকের বক্তব্য কিন্তু নির্বিশেষ ছিল—
“আমি কারেও লক্ষ্য করি নাই অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি, এমন কি স্বয়ং নক্শার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।”
এককথায় এই গ্রন্থটি তৎকালীন কলকাতার সমাজ এবং ব্যক্তি চরিত্রের একটি সামগ্রিক চিত্র। দীনবন্ধু মিত্রের মত একটি ‘দর্পণ’ সমাজের হাতে তুলে দেওয়াটা কালীপ্রসন্নের মনোগত অভিলাষ হলেও শেষপর্যন্ত সেযুগের নীলকরদের বর্বর প্রতিহিংসার কথা চিন্তা করেই তাঁকে সেবিষয়ে নিবৃত্ত হতে হয়েছিল—
“দর্পণে আপনার কদর্য মুখ দেখে কোন বুদ্ধিমানই আরসিখানি ভেঙে ফেলেন না বরং যাতে ক্রমে ভালো দেখায় তারই তদ্বির করে থাকেন, কিন্তু নীলদর্পণের হ্যাঙ্গাম দেখেশুনে—ভয়ানক জানোয়ারদের মুখের কাছে ভরসা বেঁধে আরসি ধত্তে আর সাহস হয় না—”
তাই তাঁকে— ‘সং সেজে রং কত্তে’ —হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সেই ‘রং’–এর উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত সার্থক হয়েছিল। হুতোমের ঠোঁটের ঘায়ে সেযুগের সামাজিক বানরেরা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের ‘আজব শহর কলকেতা’র কোন বিকৃতি বা কোন গ্লানি তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারেনি।
হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থটি রচনা করতে গিয়ে রুচির দিক থেকে হুতোম নিজের অসাধারণ সংযত মনের পরিচয় দিয়েছিলেন। সমালোচকদের মতে, সমগ্র গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র ‘মাহেশের স্নানযাত্রা’ প্রবন্ধের সামান্য কিছু অংশ ছাড়া বাকিটা নির্মল কৌতুকে উদ্ভাসিত। অথচ কালীপ্রসন্ন কিন্তু ইচ্ছা করলেই ভবানীচরণের মত প্যারডির ছলে প্রচুর কুরুচির সরসতা করতে পারতেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বলতে হয় যে, বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু হুতোমের প্রতি সুবিচার করেননি।
হুতোমের নকশায় সেযুগের সমস্ত স্তরের মানুষেরই ছবি থাকলেও কালীপ্রসন্ন মুখ্যতঃ তখনকার ‘হঠাৎ বাবুদের’ আঘাত করেছিলেন। সেযুগে নানারকম জাল-জুচ্চুরি এবং ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিয়ে যাঁরা রাতারাতি বড় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন, কলকাতা শহরের গ্লানি-মন্থনের কাজে সেই তাঁরাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। হুতোমের গ্রন্থে উল্লেখিত বীরকৃষ্ণ দাঁ এবং পদ্মলোচন দত্তের দল একথার সার্থক উদাহরণ। অপসঞ্চিত অর্থের বাষ্পে ফেঁপে-ওঠা বেলুনের মত সেযুগের সেই সমাজশত্রুর দলকে হুতোম বিদ্রূপের কশাঘাতে জর্জরিত করে তুলেছিলেন। তাঁর হাতে ‘হঠাৎ অবতার’ পদ্মলোচনের বিশ্লেষণ এরকম হয়েছিল—
“হঠাৎ টাকা হলে মেজাজ যে রকম গরম হয়, এক দম গাঁজাতেও হয় না। ... কিছুদিনের মধ্যে পদ্মলোচন কলিকাতা শহরের একজন প্রধান হিন্দু হয়ে পড়েন—তিনি হাই তুললে হাজার তুড়ি পড়ে—তিনি হাঁচলে জীব! জীব! জীব! শব্দে ঘর কেঁপে ওঠে! ওরে! ওরে! হুজুর ও ‘যো হুকুমের’ হল্লা পড়ে গ্যালো, ক্রমে শহরের বড় দলে খবর হল যে কলকেতার ন্যাচরাল হিস্ট্রীর দলে একটি নম্বরে বাড়লো!”
গ্রন্থটিতে এইধরণের ছবির সঙ্গে লেখক তৎকালীন বাংলার দুর্গতির জন্য অকৃত্রিম দীর্ঘশ্বাসও ফেলেছিলেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল যে— সেযুগের বাঙালি ধনী সম্প্রদায়ের হাত ধরে দেশ এবং জাতির সর্বতোমুখী উৎকর্ষ সাধিত হবে। কিন্তু ইংরেজিতে যেটাকে— “ill begotten money’ —বলে, সেটা তখন সমস্ত দেশকে আরো বেশি করে সর্বনাশের দিকেই এগিয়ে দিয়েছিল। এপ্রসঙ্গে হুতোম তাঁর নকশায় লিখেছিলেন—
“যারা প্রভূত ধনের অধিপতি হয়ে স্বজাতি সমাজ ও বঙ্গভূমির মঙ্গলের জন্যে কায়মনে যত্ন নেবে, না সেই মহাপুরুষেরাই সমস্ত ভয়ানক দোষ ও মহাপাপের আকর হয়ে বসে রইলেন, এর বাড়া আর আক্ষেপের বিষয় কি আছে।”
কালীপ্রসন্নের এই সদিচ্ছাই হুতোম প্যাঁচার নকশার মূল অনুপ্রেরণা ছিল। শুধু আক্রমণের তীক্ষ্ণতাই নয়, গ্রন্থটির পত্রে পত্রে প্রসঙ্গে প্রসঙ্গে কালীপ্রসন্নের অশ্রুসিক্ত দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়েছিল। সেযুগের সমাজকে তিনি যতটা আঘাত করেছিলেন, সেটার থেকে বেশি নিজে আহত হয়েছিলেন। সমালোচকদের মতে, কোন শ্রেষ্ঠ শ্লেষশিল্পীর বা স্যাটায়ারিস্টের এটাই হল আদর্শ। যিনি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হন, শুধুমাত্র তাঁরই জাতি এবং সমাজকে ব্যঙ্গ করবার অধিকার থাকে। যেখানে প্রীতি নেই কিংবা সহানুভূতি নেই— হৃদয়হীনতার সেই আঘাতের মধ্যে দিয়ে কোন উদ্দেশ্যই সাধিত হতে পারে না। সেই ধরণের নির্মমতায় কোন জাতিরই কল্যাণ হয় না, তাতে মানুষ আত্মশুদ্ধির জন্য অনুপ্রাণিত হয় না,— বরং হিংস্র ক্ষোভে উত্যক্ত হয়ে ওঠে। সহানুভূতির অশ্রু রেখাই হুতোম প্যাঁচার নকশার ধ্রুবপদ।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে কালীপ্রসন্নের সমবেদনার উজ্জ্বলতম চিত্র হল তাঁর ‘রেলওয়ে’ প্রবন্ধটি। সেযুগের যাঁরা সাধারণ দরিদ্র মানুষ ছিলেন, যাঁরা তখনকার রেলের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী ছিলেন, তাঁদের যে ছবি কালীপ্রসন্ন নিজের লেখায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন— সেটার ভেতর দিয়ে এমন এক মর্মভেদী কারুণ্য প্রকটিত হয়েছিল যে, শেষপর্যন্ত সেটি কৌতুকের সমস্ত আবরণকে বারে বারে ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিভাবে তখন এই মানুষগুলি পদে পদে বঞ্চিত হয়েছিলেন, কেমন করে সেকালের অসাধু রেলকর্মচারীর দল তাঁদের উপরে উৎপীড়ন চালিয়েছিলেন, জমাদার আর চাপরাসীদের বেত কি নির্মমভাবে তাঁদের রক্তাক্ত করে দিয়েছিল এবং সর্বশেষে তৃতীয় শ্রেণীর গাড়িতে তাঁরা কিভাবে স্থানলাভ করেছিলেন— কালীপ্রসন্নের কলমে এই বর্ণনাগুলির দ্বিতীয় কোন তুলনা বাংলা সাহিত্যে আজও পাওয়া যায় না।
“যে সকল হতভাগ্য ইংরেজ ব্ল্যাকহোলের যন্ত্রণা হতে জীবিত বেরিয়েছিলেন, তাঁরা এই কোম্পানীর থার্ড ক্লাস দেখলে একদিন এদের এজেন্ট, ও লোকোমোটিব সুপারিন্টেন্ডেন্টকে সাহস করে বলতে পাত্তেন যে, তাঁদের থার্ড ক্লাস যাত্রীদের ক্লেশ ব্ল্যাকহোলবদ্ধ সাহেবদের যন্ত্রণা হতে বড় কম নয়।”
নিজের ব্যক্তিজীবনে কালীপ্রসন্ন নির্ভীক দেশপ্রেমের যে পরিচয় দিয়েছিলেন— হুতোম প্যাঁচার নকশাতেও সে প্রমাণ পাওয়া যায়। তৎকালীন কলকাতার সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস মর্ডান্ট ওয়েলস সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের যোগ্য প্রতিনিধি ছিলেন, কোন একসময়ে তিনি আদালতে প্রকাশ্যে বলেছিলেন—
“বাঙালীরা মিথ্যাবাদী ও বব্বলের (বর্বরের?) জাত।”
তখন তাঁর সেই স্পর্ধার প্রতিবাদে তৎকালীন বাংলার নেতারা রাজা রাধাকান্ত দেবের নাট মন্দিরে যে বিরাট সভার আয়োজন করেছিলেন, সেই সভায় কালীপ্রসন্ন জ্বলন্ত ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর নকশাতেও সেই কাহিনী পাওয়া যায়। এরপরে সেই সভা থেকেই একটি প্রতিবাদ-লিপি তৈরি করে ইংল্যাণ্ডে সেক্রেটারী-অব-স্টেটের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন বাংলায় থাকা ইংরেজ পদলেহী একদল ব্যক্তি সেই সভার বিরুদ্ধে আরেকটি আন্দোলন চালিয়েছিলেন বলে তাঁদের ব্যঙ্গ করে হুতোম নিজের নকশায় লিখেছিলেন—
“ওয়েলসের বিপক্ষে বাঙালীরা সভা করবেন শুনে তাঁরা বড়ই দুঃখিত হলেন—খানা খাবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সময় মনে পড়ে গ্যালো, যাতে ঐ রকম সভা না হয়, কায়মনে তারই চেষ্টা কত্তে লাগলেন।”
কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রতিবাদসভায় যে জনমত প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে—
“দশ লক্ষ লোকে সই করে এক দরখাস্ত কাষ্ঠ সাহেবের (সার চার্লস উড) কাছে প্রদান কল্লেন, সেই অবধি ওয়েলস ব্রেক হলেন।”
অর্থাৎ— এরপরে স্যার চার্লস উডের নির্দেশে গভর্নর জেনারেলের ধমকে ওয়েলস ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলেন।
গ্রন্থটিতে ‘মিউটিনি’ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে হুতোম বাঙালির ভীরুতাকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিলেন। ‘পাদরি লং ও নীলদর্পণ’ প্রবন্ধে নীলকরদের অত্যাচারের প্রতি তাঁর অন্তর্জালা প্রকাশিত হয়েছিল। সেযুগের বহু বিচিত্র কাহিনী ও টুকরো টুকরো ঘটনাকে আশ্রয় করে কালীপ্রসন্ন তাঁর নকশা গ্রন্থটিতে সেযুগের বাঙালির জাতীয় জীবনের যে স্বরূপটি উদ্‌ঘাটিত করেছিলেন, সেসবের তুলনা আজও দুর্লভ। তাই সমাজ-সচেতন সাহিত্য-সৃষ্টি হিসেবে হুতোমের নকশার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। গ্রন্থটির রসের দিকও কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। বরং রঙ্গে, ব্যঙ্গে, পর্যবেক্ষণে এবং চিত্ররচনায় হুতোমের মৌলিকতা অসাধারণ বলেই দেখতে পাওয়া যায়।
আঙ্গিকের দিক থেকে গ্রন্থটির চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল এর ভাষা। সমালোচকদের মতে, একেবারে সর্বজনবোধ্য চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ হিসাবে বাংলা গদ্যে এটিই প্রথমতম। এর আগে প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থে চলিত রীতির একটা ধাঁচ থাকলেও, মোটামুটি সরলীকৃত সাধুভাষা সেটার ভিত্তি ছিল। কালীপ্রসন্ন কিন্তু ভাষার প্রয়োগের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে সংস্কারমুক্ত হয়েই কাজ করেছিলেন। অসীম দুঃসাহসের সঙ্গে তিনি যেমন তাঁর নকশার বিষয়বস্তুগুলি বেছে নিয়েছিলেন, তেমনি গ্রন্থটির উপযোগী বাগরীতিও তিনি স্বহস্তেই গঠন করেছিলেন। তাঁর নকশার সঙ্গে এই ভাষার মণিকাঞ্চন সংযোগ ঘটেছিল। তবে চলতি ভাষার নিরঙ্কুশ ব্যবহারের ফলে তাঁর লেখায় কিছু কিছু অসংযম প্রকাশ পেয়েছিল এবং অশালীন শব্দের অবাঞ্ছিত প্রয়োগও ঘটেছেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে একথাও মনে রাখতে হবে যে, চলতি ভাষা— প্রকৃতজনের মুখের কথাই যে আগামী দিনের সাহিত্যের বাহন, বীরবলের ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকার পাতায় এই বাণী ঘোষিত হওয়ার ঢের আগেই কালীপ্রসন্ন সিংহ বাংলা সাহিত্যে সেটার সূচনা করে দিয়েছিলেন। সমালোচকদের মতে তাঁকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক গদ্যরীতির পথিকৃৎ বলা চলে। হুতোম প্যাঁচার নকশায় তাঁর প্রথম প্রয়াসের সমস্ত অসম্পূর্ণতাকে অতিক্রম করে— তাঁর সৎসাহস ও শক্তিমত্তা নিজের গৌরবে দীপ্ত হয়ে উঠেছিল বলে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে, কালীপ্রসন্নের এই সংকেতকে বঙ্কিমচন্দ্র গ্রহণ করতে পারেননি। যদি পারতেন, তাহলে অনেক আগেই তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীর ছোঁয়ায় বাংলা গদ্য সাহিত্যে নবযৌবনের জোয়ার চলে আসত।
পরিশেষে বলা সবকিছু মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে, বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে কালীপ্রসন্ন সিংহ অমর; আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ তাঁর মৃত্যুহীন কৃতিত্ব।

Post a Comment

0 Comments