জ্বলদর্চি

অন্য পারে/পুলক কান্তি কর

চিত্র- মণিদীপা দাস 

অন্য পারে

পুলক কান্তি কর


 মোবাইলের স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়েই শর্বরী বলল, ‘কী হল? কথা কানে ঢুকলো?’

-সেটা বুঝতে হলে শুধু কথা বলাতেই মনটা নিয়োগ করতে হবে। মোবাইলে খেলতে খেলতে কথোপকথন চালালে এরকমই সংশয় তৈরী হবে। বেশ রাগত গলায় বলল সৈকত।

-কেন খেলছি তো হাতে! কান-ফান তো খোলা রেখেছি। এই জন্যই বলি মাল্টিটাস্কিং হও।

-তোমার কোনটা খোলা কোনটা বন্ধ এতখানি অনুমান করে উত্তর দিতে পারবো না। আমার সাথে কথা বলতে হলে বা কোনওরকম আদান প্রদান করতে হলে পুরোপুরি আমার দিকেই অ্যাটেনশান দেবে। কোনও কিছুতে সাড়া দিতে হলে পঞ্চইন্দ্রিয়ের যে কোনওটা দিয়েই আমি দিতে পারি।

-শোনো সৈকত, জীবনটা বড় ছোট। একসঙ্গে অনেক কাজ করতে শেখো। সেই পুরোনো দিনের লোকের মতো এটা শেষ হলে ওটা করব, এই ভাবতে ভাবতে দেখবে জীবন শেষ! 

-আমি এত জিনিয়াস নই বুলু। আমার এক এক করে কাজ করলে জীবনে অপূর্ণ কিছু থাকবে না। সুতরাং আমার সাথে যদি কোনও আলাপ আলোচনা তুমি প্রয়োজনীয় বলে মনে করো তবে মাল্টিটাস্কের মধ্যে ওকে রেখোনা, আমি তাল মেলাতে পারি না।

-এখন বাক্য ছুটছে মুখ দিয়ে, একটু আগে হ্যাঁ-না কিছু একটা বললেই তো আমি বুঝে যেতাম। ভগবান মুখটা দিয়েছে, একটু ব্যবহার করো না! এত মাথা ঝাঁকিয়ে, ঘাড় দুলিয়ে কথাবার্তা বলার দরকারটাই বা কী?

-ওটা আসলে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র।

-মানে?

-মানে একসঙ্গে দুজনে মুখ চালালে এত শব্দ ক্ষয় হবে, তখন সংসারে মুশকিল হয়ে যাবে। জানো না, শব্দ হল ব্রহ্ম?

-লেকচার ছাড়ো। আজ রাতের শোতে ফিল্মটা দেখতে যাবে কিনা তাই বলো?

-তোমাকে তো বহুবার বলেছি বুলু, এসব ফিল্ম দেখতে আমার ভালো লাগে না। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার বন্ধু বান্ধবের সাথে চলে যাও না! 

-তোমাকে বিয়ে করেছি কি বন্ধু-বান্ধবের সাথে সিনেমা যাওয়ার জন্য?

-এটা তো জানতাম না, বিয়ে করার আরেক অর্থ সাথে করে সিনেমা নিয়ে যাওয়া!

-শুধু সিনেমা কেন? সব যাওয়া আসাই বরের সঙ্গে, এমন কী জাহান্নামও!  

-এমন জানলে আগে দু’হাজারবার ভাবতাম বুলু।

-কোনও একটা ‘হ্যাঁ’ সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি দু-হাজার বার ভাবতে হয় তবে তেমন ভাবনা না ভাবাই ভালো! আর একান্ত যদি অঢেল সময় থাকে, এখন সিনেমা যেতে হ্যাঁ বলার আগে দুহাজার বার ভেবে নাও, আমি নেটে টিকিট বুক করে নিচ্ছি। কিছুটা মজার ছলে বলল শর্বরী। 

-‘হ্যাঁ’ বাচক মানে? দুহাজার বার প্রতিটি ভাবনায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ‘না’ ই হত বুলু।

-আমি যেটা ‘না’ মনে করি সৈকত, সেটা একবারও ‘না’ মনে হলে আমার কাছে সেটা ‘না’ ই। যতবারই ভাবিনা কেন, ওটা জীবনে ‘হ্যাঁ’ হবে না। তোমার আর আমার জীবনে এটাই বেসিক পার্থক্য। সারাজীবন খালি দুলে গেলে।

-দুলেছি বা দুলি বলেই তোমার সাথে ঘর করতে পারি বুলু। নইলে কবেই সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতাম।

-যাওনা কেন? কে তোমায় মাথার দিব্যি দিয়ে বেঁধে রেখেছে?

-বিবেক! আমার বিবেক এটাই বলে, বিয়ে যখন করেছি তখন আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, যাতে এই সম্পর্ক আজীবন টানা যায়।

-জীবন একটাই সৈকত। এ জীবন দ্বিতীয়বার তুমি আর পাবে না। তোমার এতই যদি সম্পর্কটা বোঝা মনে হয়, টেনো না। কুইট কর, অন্য কোথাও চলে যাও। অন্য কোনও সম্পর্কেও জড়াতে পারো, আমি অন্তত আপত্তি করব না। শুধু একটাই অনুরোধ, লুকিয়ে কিছু করো না।

-মুখে বড় বড় ডায়লগ মেরো না বুলু। সত্যি সত্যি হলে কেঁদে কূল পাবে না। পৃথিবীটা এত মসৃণ না।

-কী বলতে চাইছ তুমি? তোমার সাথে দিন কাটানোটা সবচেয়ে মসৃণ?

-তাইতো মনে হয়। একচেটিয়া রাজ্যপাট তোমার এখানে। মুখের উপর কেউ কথা বলার নেই। শাশুড়ি ননদের গঞ্জনা নেই। ছেলেপুলের কিচিরমিচির নেই। যা চাইছো সেটাই হচ্ছে, আর কী চাই?

-আমি যা চাই তা হয়? এই যে সিনেমা দেখতে যেতে চাচ্ছি, তুমি নিয়ে যাচ্ছো কী?

-আল্টিমেট যে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে সে তুমিও জানো, আমিও জানি।

-তাহলে মিছিমিছি মুখ করছো কেন? সোনামুখ করে বেরিয়ে পড়লেই তো হয়! ফালতু নিজেদের মেজাজটা খারাপ হয় না!

-সেই চেষ্টা তো আমিও করছি বুলু। তবে কিনা এখনও টুকটাক মানুষ প্রজাতিটার রিপু টিপু বেঁচে আছে তো! তাই মাঝে মাঝে একটু আধটু দাঁত মুখ খুলে ওরা জানান দিতে চায়, ওদেরও কিছু ইচ্ছে আছে, ওদেরও কিছু সব ‘হাঁ’ তে ‘হাঁ’ না মেলাবার স্বাধীনতা আছে। ওরাও কখনও কখনও নিজের পরিসর চায়। তোমার এটাই একটা সমস্যা বলতে পারো বা অতৃপ্তি, আমি তোমার বশ্যতা স্বীকার করেও পুরোপুরি বশ্য হয়ে উঠতে পারিনি। তবে আমার বিশ্বাস, খুব শিগ্‌গিরি তোমার সে অতৃপ্তিও পূর্ণ হবে।

-কী, আমি তোমাকে বশ্য করে রেখেছি? যাও, আমার সাথে কোথাও যেতে হবে না তোমাকে! শর্বরী মোবাইলটা ছুঁড়ে গটমট করে উঠে চলে গেল শোবার ঘরে।

সৈকত এবার নিজেকে আর নিজের স্বাধীন মত প্রকাশের চিত্তটাকে মনে মনে জুতো পেটা করল খানিকক্ষণ। তির, ধনুক থেকে যখন বেরিয়েই গেছে, ক্ষতস্থানে মলমপট্টি যত তাড়াতাড়ি করানো যায়, তত ভালো। নইলে অকারণ শান্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন বিঘ্নিত হবে। অগ্যতা নিজেই টিকিটের জন্য নেট খুলে বসল সে! ধ্যাত্তেরি, সময় মতো নেটও আবার খোলে না!

  রাত্রে সিনেমা দেখে বাইরের থেকে খাবার টাবার কিনে এনে যখন শুতে গেল সৈকত, তখন  রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। এখন কিছুক্ষণ সিনেমার গল্প এবং পরিচালনার পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনা করতে আরও অন্তত আধঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখা দরকার নইলে শর্বরীর সাথে গল্প করার সময়ই নেই তার – এই অপরাধের অভিযোগটুকু অবশ্যম্ভাবী উঠবে; আর তখন সেই সব চাপান উতোরে একঘণ্টা সময় যাবে। তারচেয়ে অ্যালার্মটাকে সাড়ে ছ’টার জায়গায় সাতটা করে বরং পেপার পড়ার সময়টুকু কাঁচি চালিয়ে দিলে হবে। অন্তত সাড়ে পাঁচ ঘন্টা থেকে ছ-ঘণ্টা না ঘুমোলে আজকাল শরীর আর চলে না। অফিসে ঘুম পায়। এই নিয়ে কলিগদের তির্যক হাসি-মস্করা সহ্য হয় না তার।  

  শুতে এসে শর্বরী ওর অভ্যাসমতো একটা পা সৈকতের উরুর উপর চাপিয়ে জিজ্ঞাসা করল - ‘কী গো কেমন দেখলে?’ সৈকতের ইচ্ছে হল বলতে ‘অতি জঘন্য’, কিন্তু তখন অবধারিত ভাবে তার কারণ বিশ্লেষণের দায় বর্তাবে। অতএব সংক্ষেপে উত্তর দিল ‘ভালো’। সৈকতের আবার দোষ আছে। সে যদি এরপরে একটি বাক্য খরচ করে দিত, ‘তোমার কেমন লেগছে?’ - তবে ওই চর্চায় ওকে পরবর্তী আক্রমণ ফেস করতে হত না। শর্বরী ওর উত্তরেই নিজেকে ব্যাপৃত রাখত। কিন্তু কখনও কখনও এই সংক্রান্ত আলোচনাকে এতটাই বাহুল্য মনে করে সে, সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধি মাথায় এলেও তাকে  জিভের আন্দোলন ঘটিয়ে শব্দের রূপ দিতে বেজায় আলস্য আর কুণ্ঠার কাছে পরাজয় হয় তার। অগ্যতা, ‘শুধু ভালো? আমি তোমাকে চিনি না? ভাবছো, যাক্‌ বাবা, ভালো বলে রেহাই পাই? আমি কী এত খারাপ? আমার সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে না তোমার? অন্যের সাথে ফোনে তো দেখি দিব্যি গদগদ হয়ে কথা ফুরোয় না,’  ইত্যাদি ইত্যাদি...।

-মাঝরাত্রে চিৎকার চেঁচামিচি কার বা ভালো লাগে? সন্ধ্যার ঝাড় খাওয়া স্বাধীনচেতা চিত্ত আবার উঁকি দিল, ‘কী সবসময় এক কথা ব্যাজব্যাজ কর বুলু?’

-কী, আমার কথা ব্যাজব্যাজ মনে হচ্ছে? কার কথা ভালো লাগে, শুনি?

-আরে মাঝরাত্রে এই নিয়ে পড়লে কেন আবার? ফিল্মের ভালোমন্দকে নিজেদের মধ্যে টেনে আনছো কেন? তুমি জিজ্ঞাসা করলে, ‘ফিল্ম কেমন লেগেছে, আমি বললাম ‘ভালো’ - এরমধ্যে অন্যায়টা কী বললাম?

-এই ফিল্ম তোমার ভালো লেগেছে? তোমাকে চিনি না?

-যদি বুঝেই থাকো, তবে প্রশ্ন করছ কেন?

-বা রে! বুঝেছি বলে জিজ্ঞাসা করবো না?

-এসব বোকা বোকা কথা আমার সাথে কোরো না বুলু।

-এত চালাক চালাক কথা কোত্থেকে পাবো শুনি? স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে সবসময় শাস্ত্র কথা, তত্ত্বকথা আলোচনা করবে?

-আমি তো তা বলিনি। তুমি তোমার মতই কথা বল না! কে না বলছে? আমি যখন বলছি ‘ভালো মুভি’—এটা মেনে নাও। অত নিজস্ব অনুমান জুড়তে যাচ্ছ কেন?

-এই মুভি তোমার কোন অ্যাঙ্গেলে ভালো লাগলো সৈকত? তুমি এসব মারপিট একদম পছন্দ কর না।

-প্রথম কথা, পছন্দ করতাম না মানে এখন করিনা, তাতো নয়। এখন আমি এসব পছন্দ করতে চাই। আর দ্বিতীয় কথা, ফিল্মটা যে এমন সেটা তুমি সমালোচনায় পড়েছিলে। আগের মুভিটা দেখতে গিয়ে ট্রেলারও দেখেছো। তবে জোর করে নিয়ে গেলে কেন? 

  শর্বরী দ্বিতীয় যুক্তির পাশ মাড়ালো না। প্রথম পয়েন্টের কথাটা বেশ মতলবের। বলল, ‘পছন্দ করতে চাই’ মানে কি? তুমি কি বলতে চাও আমি তোমার পছন্দকেও বদলে দিতে চাইছি?

  সৈকতের স্বাধীন চিত্ত আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর স্বাভাবিক বুদ্ধি কাজ করতে শুরু করেছে আবার। সুতরাং এই বিতর্কিত কথার কোনও জবাব দেওয়া আপাতত সমীচিন মনে হল না তার। উল্টোদিক থেকে খোঁচা আসতেই লাগল, ‘কী হলো, উত্তর দিচ্ছ না যে?’ দু-একবার খোঁচা হজম করে অতঃপর সন্ধি করল সে –  ‘না না - বদল করবে কেন? আমার আজকাল দেখছি এসব বেশ ভালো লাগছে। ভগবানের সবকিছুর একটা কোটা আছে, বুঝলে কিনা! আগে এসব ভালো লাগতো না। আজকাল দিব্যি লাগছে। ওই যে হিরোটা লাফ মেরে মেরে একসাথে আটটা দশটাকে ক্যালাচ্ছে, বেশ মজা পেলাম ওতে বুলু! নিশ্চই তুমিও মজা পেয়েছ?’

-ধূর! তোমার পাল্লায় পড়ে আজকাল আর এসব দাঙ্গা ফ্যাসাদ ভালো লাগে না। হয় কমেডি না হলে অ্যাটলিষ্ট মিউজিক্যাল হলে ভালো লাগে।

-এও তো কমেডিময়। এমন স্টাইলের মারপিট, রজনীস্যারও হার মানবেন। আর মিউজিকও তো বেশ ঢিক্‌চাক্‌ ঢিক্‌চাক্‌। সৈকত বেশ দুলে দুলে মুখে আওয়াজ করতে লাগলো।

-এই মিউজিকে তুমি সুর করে করে দুলছো! ছিঃ ছিঃ। কী অধঃপতন তোমার!

-এটা অধঃপতন না উর্দ্ধারোহণ বুঝি না বুলু। শুধু বুঝি, জীবন হল বেঁচে থাকার অভ্যাস।

-মানে? 

-মানে কিছু না। ঘুমিয়ে পড়। সকালে অফিস আছে।

                              (২)

-সৈকত, তুমি তারাপদ রায়ের গল্প পড়েছ? হোয়াটসঅ্যাপ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করল শর্বরী।

-কিছু কিছু পড়েছি। 

-‘খেজুর গুড়ের সন্দেশ’ পড়েছ?

-মনে পড়ছে না। কোনটা বলো তো?

-ওই যে এক ভদ্রলোক মৃত্যুশয্যায়, ডাক্তার এসে জানিয়ে গেছেন - এখন শুধু কিছুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। হঠাৎ ভদ্রলোক মৃত্যুশয্যা থেকেই উপলব্ধি করলেন খেজুর গুড় থেকে সন্দেশ পাকাবার গন্ধ তাঁদের রান্নাঘর থেকেই আসছে। ভদ্রলোক তাঁর বেডের পাশে দাঁড়ানো মেয়েকে বললেন, দ্যাখ না, তোর মা তো সারাজীবন আমাকে ভালোমন্দ কিছুই খেতে দেয়নি। আজ যা তো, রান্নাঘর থেকে দুটো সন্দেশ নিয়ে আয়, মরার আগে দুটো খেয়ে যাই। মেয়েও মাকে ভালো চেনে। একটু দোনামোনা করে সে রান্নাঘরে গেল আর খানিক বাদে বিরস মুখে ফিরে এলো!

-কী হলো? সন্দেশ দিল না? সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করলো সৈকত!

-আরে শোনোই না! তা ভদ্রলোক বললেন, ‘কী রে শুধু হাতে ফিরে এলি? মেয়ে বললো, ‘মা দিল না, বললো, ওগুলো শ্মশান বন্ধুদের জন্য বানানো। তোমাকে পুড়িয়ে এসে ওরা দুটো করে খাবে; সেজন্য মা ওগুলো বানিয়ে রাখছে। ওসব তোমার জন্য নয়’।

সৈকত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

-দীর্ঘশ্বাস ফেললে কেন? আমি কি তোমায় খেতে দিই না?

-তা কেন?

-তবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোন দুঃখটা গোপন করছো?

-তুমি সবকিছুকে এত পার্সোনালাইজ করো কেন বুলু? হচ্ছিল তারাপদ রায়ের গল্পের কথা। তাকে নিজেদের সম্পর্কে ইম্‌পোজ না করলেই কি নয়?

-তুমিই তো বাধ্য করলে। গল্পটা শুনেই দীর্ঘশ্বাস পড়লো কেন তোমার? তোমাকে আমি খাওয়া রেস্ট্রিক্ট করি, নাকি খাওয়া নিয়ে কিচ্‌কিচ্‌ করি?

-মানুষের কি এই একটাই সমস্যা? 

-ওঃ। তাহলে তোমার দীর্ঘশ্বাসটা সমস্যা কেন্দ্রিকই। বলো, সমস্যাটা কী?

-আমার এখন এইমুহূর্তের সমস্যা তুমি! মানুষ কি এত মেপে শ্বাস নিতে পারে বুলু? বাড়ীতেও যদি গুনে গুনে শ্বাস নিতে হয়, পা ফেলতে হয় তবে তো বাঁচাটাই মুশকিল!

-আমারও আর ভাল্লাগে না বাপু! কবে যে তোমার থেকে মুক্তি পাবো?

-মুক্তির জন্য যদি ভগবানে ভরসা কর, তবে তো জীবন কেটে যাবে।

-মানে কি সৈকত? তুমি কি চাও আমি সুইসাইড করি?

-আমি মোটেও তা বলতে চাইনি। আমি বলতে চাইছি এত মুক্তি মুক্তি করো কেন? জানো না – স্বয়ং রবিঠাকুরই বলে গেছেন, ‘মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? মুক্তি কোথায় আছে? আপনি প্রভূ সৃষ্টিবাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে’! 

-সত্যি সৈকত, আই নিড সাম ব্রেক!

-ফ্রম? 

-ফ্রম এভরিথিং!

-সবকিছুর থেকে তো মুক্তি পাবে না বুলু! তুমি আমার থেকে মুক্তি পেতে পারো, যদি চাও!

-কীভাবে? জানোই তো, বাপের বাড়ী গিয়ে থাকতে পারবো না!

-তাহলে যাবার যখন জায়গাই নেই, মুক্তি মুক্তি চিল্লাছ কেন?

-তুমি সেটা জানো বলেই তো আমার উপর মানসিক অত্যাচার কর!

-কী বললে বুলু? আমি মানসিক নির্যাতন করি? আমি?

-হ্যাঁ। তুমিই।

-তুমি জানো না, ‘আমি এমনভাবে পথ চলি যাতে ঘাসের বুকেও আঁচড়টি না লাগে’?

-আমি তো ঘাসেরও অধম! তোমার ঘাসের প্রতি মায়া আছে, অথচ আমাকে আঁচড়াতে তোমার বাধে না!

-বুলু, সত্যি সত্যি তুমি যদি এটা বিশ্বাস করো, তবে তুমি দূরেই থাকো। কোনও পি.জি তে থাকতে পারো, ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে পারো। জোর করে আমার সাথে থেকো না।

-কী করে থাকবো? আগে যদি বুঝতাম, চাকরী বাকরীর চেষ্টা করতাম।

-সে তুমি ভেবো না। মাসে তোমার যা খরচ লাগে, আমি পাঠিয়ে দেবো। তুমি তোমার এ.টি.এম কার্ড দিয়ে টাকা তুলে নিও।

-তুমি কি শেষের কবিতার প্রাকটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন করে দেখাতে চাও সৈকত?

-কোনটার কথা বলছ? লাবণ্যকে ছেড়ে কেটিকে বিবাহ, নাকি লাবণ্যের সাথে দূরে থেকেও মাঝে মাঝে দেখা করার পরিকল্পনা?

-ওই দূরে দূরে থাকা।

-আমি কিছুই চাইছি না বুলু। আমি তোমার কোনও চাওয়াতেই কখনও বাধা দিই না। এতেও দেবো না। এখানে থেকে তোমার অকারণ নির্যাতিত হওয়ার দরকার নেই।

  কথাগুলো বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেল সৈকত। আজ কোথাও যেন তার কেটে গেছে সবকিছুর। রাতে খাবার টেবিলে বসে কোনও মতে রুটি তরকারি গিলে ফেলল সে। শর্বররীর মুখও থমথমে। পরষ্পরের মধ্যে বাক্যের আদান-প্রদান প্রায় বন্ধ। রাত্রে শুয়ে শুয়ে শর্বরী ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখে দিল, ‘ফিলিং ইগনোরড’। মুহুর্তে অসংখ্য কমেন্টস জমা পড়ে গেল। কেউ বাল্য বন্ধু, কেউ বা কলেজের। দু-চারজন এখনকার বন্ধুও আছে। ‘কার এত বুকের পাটা, তোর মতো জ্বালামুখীকে ইগনোর করে?’ বা ‘কটাক্ষে হানো তব পঞ্চম শর’; এমনকি ‘সৈকত দা বড় বেরসিক, তুই বলে ঘর করিস’ পর্যন্ত সংলাপ চলতে লাগলো ঘন্টাখানেক ধরে। পাশাপাশি শুয়ে থাকলে মোবাইলের খুটখুটানি বড় বিরক্ত করে। সর্বোপরি এমন একটা আলো বেরোয় মোবাইল থেকে, কারোর মন বিষিয়ে থাকলে তাকে আরো বেশী বিষিয়ে তুলতে ওর জুড়ি মেলা ভার। বালিশের তোয়ালেটা দিয়ে চোখ ঢেকে বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করল সৈকত। অবশেষে বলল, ‘রাত দেড়টা বাজে বুলু। সকালে অফিস যেতে হবে তো!

-তোমাকে অফিস যতে বারণ কে করেছে?

-ঘুমোতে পারলে তবে না অফিস যাবো! ততক্ষণ থেকে মোবাইলটা খুটখুট করছো, ঘুমোবো কী করে?

-কেন? আমার তো কী-প্যাড সাউন্ড অফ আছে। তোমার তো কোনও আওয়াজ পাওয়ার কথা নয়!

-আলোটা তো জ্বলছে মোবাইল এর!

-তাহলে খুটখুট করছি বললে কেন?

-খুটখুট করা মানে শুধু শব্দ করে করা বোঝায় না বুলু! মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করাটাকেও খুটখুট করা বলে। একটু বাংলা শেখো। এত ইংলিশ মিডিয়াম কপচালে মনের ইংলিশ ব্যাধি হয়।

-মানে?

-মানে আর কি? এখন বউরা ইংলিশ কালচারে নিজেকে এমন কেউ কেটা ভাবছে যে সামান্য কথার হেরফের বা ব্যবহারের হেরফের তাদের ইগোকে হার্ট করছে! আগেকার মহিলাদের কি এমন সমস্যা ছিল? কেউ কি পাবলিকলি বলতো, আমার বর আমার সাথে বেশী কথা বলে না? কোনও বউ কি আগে বলতো, ভাতটা বেড়ে দাও, বাসনটা মেজে দাও বা বিছানাটা পেতে দাও?

-ওঃ। বউ বলে তারা মানুষ নয়? তাদের তোমরা সবসময় দাসী-বাঁদী বলে ভাববে? 

-‘তোমরা’ মানে কি বুলু? আমি কি কখনও তেমন ভাবে তোমাকে ট্রিট করেছি?

-তাই তো বলছ! আমাদের বেশী ইগো, ইংলিশ ব্যামো – কত কথা!

-দেখ বুলু, আমি একটা সামাজিক সমস্যার কথা বলছি। একে পার্সোনালি নিচ্ছ কেন?

-প্রসঙ্গটা তো তুমিই তুললে সৈকত!

-কেন এলো বলো দেখি? এই রাত দেড়টাতেও তোমার হুঁশ নেই তোমার বর কাল সকালে উঠে অফিস যাবে। তার অফিসে তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। তারজন্য তার পরিমিত ঘুম দরকার। বউ যেহেতু মানুষ, তার এইটুকু বিবেক থাকবে না কি? 

 শর্বরী এর উত্তরে তেমন উত্তেজনা প্রকাশ করলো না, বা এর উত্তরে প্রতিযুক্তি খাড়া করার রাস্তায়ও গেল না। একটু চুপ থেকে বলল, সৈকত খানিকক্ষণ আগেই আমাদের আলাদা থাকার কথা হচ্ছিল না? আমি ঠিক করে ফেলেছি, আমি কিছুদিন আলাদা থাকবো!

-কোথায় যাবে মনস্থ করেছ? আমি কি কোনও ব্রোকার ট্রোকারকে বলব?

-না। ভাবছি কিছুদিন রাই এর ওখানে যাবো।

-রাই মানে তোমার শঙ্খদীপ? তোমার প্রাক্তন প্রেমিক?

-‘প্রাক্তন’ বলছ কেন? এখনও একনিষ্ঠ প্রেমিক।

-কোথায় থাকে এখন? 

-ওই তো থানের কাছে থাকে। মুম্বাই থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। 

-কী করে ওখানে?

-স্ট্রাগলিং সিঙ্গার।

-মানে?

-স্বপ্ন নিয়ে গেছিল প্লেব্যাক করবে। আপাততঃ মাচা করে বেড়ায়।

-তোমার সাথে যোগাযোগ আছে তার?

-তেমন নেই। হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকে কথা হয়। এখন দেখি আমার একটা পোষ্টে কমেন্ট করেছে। লিখেছে ‘চলে আয় আমার কাছে’।

-আহ্বাণটা কি অতল জলের? 

-যেভাবে নেবে।

-তুমি কিভাবে চাইছো?

-আপাততঃ তো যাই। কদিন থাকি। তারপর ভাববো, ডুববো কিনা!

-জানো তো বুলু, এরকম একটা অ্যাপ এসেছে। ওটা এরকমই একটা ডেটিং অ্যাপ। তুমি কোনও এক সম্পর্কে ক্লান্ত হয়ে যদি অন্য কোনও সম্পর্ক ট্রাই করতে চাও, তবে এই অ্যাপের মাধ্যমে কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারো।

-সম্পর্কটাও এখন ট্রাই করার জায়গায়? ভালোই বলেছো কথাটা।

-সবই ইংলিশ বুলু! ভালো। যাও ঘুরে এসো। কবে যাবে জানিও। আমি টিকিট করে দেবো। ওকে জিজ্ঞেস করো, ফ্লাইটে গেলে সুবিধা, না কি ট্রেনে?

-থানে তো এয়ারপোর্ট থেকে অনেকটা দূরে। ট্রেনে গেলেই সুবিধা হবে নিশ্চই।

-একঘণ্টার দূর আর এমনকি! তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করো, ও তোমাকে রিসিভ করতে আসবে কিনা। 

-যে তোমার থেকে অনিশ্চিত দিনের জন্য চলে যেতে চাইছে, তাকে কেউ রিসিভ করতে আসবে কিনা– এসব নিয়ে চিন্তা করছো কেন সৈকত? না কি দায়িত্বটা হস্তান্তর পর্যন্ত?

-সে যেভাবে ভাবো!

-আমি যে বেশ কিছুদিন চলে যেতে চাইছি, তোমার খারাপ লাগবে না?  

-সে কথা তো এখন ভাবার নয় বুলু! তুমি যখন নিজের জীবন নিয়ে কিছু ডিসিশান নিতে চাইছো, পিছুটান রেখো না! তুমিই তো বল জীবন একটাই?

-আমি বুঝতে পারছি, তোমার মনে মনে লাড্ডু ফুটছে। ব্যাচেলার জীবনের স্বপ্ন দ্যাখো না? এবার দ্যাখো, ব্যাচেলার জীবন কেমন লাগে! প্রতিটা মুহূর্তে বুঝবে!

-তুমি অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছ নাকি বুলু? দিলে দাও, যেভাবে তুমি সুখ পেতে চাও, পাও! আমি কিছু মনে করবো না।

-তুমিও কি এখানে কারোর সাথে কিছুদিন ট্রাই করবে না কি?

-পাগল? ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যেতে চায় বুলু?

-ওঃ আমি বেলতলা?

-তুমি বেলতলা হতে যাবে কেন? বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটা বেলতলা।

-বেশ তো! কিছুদিন মুক্তির স্বাদ পেয়ে দ্যাখো। দ্যাখো হয়তো বা বেলতলাতেই মধুরতা খুঁজে পাবে!

-হোপ সো! আজকের মতো ঘুমোতে যাও বুলু। আড়াইটা বাজে।

                                 (৩)

  শিবাজী ইন্টারন্যাশান্যাল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই শর্বরী দেখলো সামনেই রাই দাঁড়িয়ে আছে। আগেরকার মতো ছিপছিপে চেহারা আর নেই। আলগা একটা ফ্যাটের লেয়ার সারা দেহে; ভুঁড়িটা অল্পস্বল্প হলেও নজর কাড়ে। এখনও আগের মতো চাপদাড়ি। জিন্সের উপর পাঞ্জাবী। মুখের মধ্যে ওর ছেলেমানুষী চাউনিটা এখনও হারিয়ে যায়নি। ওকে দেখেই হাত তুলে ইশারা করল শর্বরী।

-বড়ি, তুই সেই একরমই আছিস রে!

-তুই কিন্তু অনেক মোটা হয়ে গেছিস রাই। এ তো পুরো অ্যালকোহলিক ফ্যাট। এখন কি রোজই ঢুকুঢুকু?

-তা একপ্রকার। তোর রাস্তায় কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

-না। ফ্লাইটও একদম রাইট টাইম। সৈকত এসে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে গেছিল। কোনও অসুবিধা হয়নি। 

-সৈকতদা এসেছিল? আজ অফিস নেই?

-অফিস ছিল। তবে ও আজ ছুটি নিয়েছে। বউ এর বিদায় বলে কথা!

-যাঃ, সৈকতদা খুব ভালো মানুষ।

-ওরকম দূর থেকে মনে হয়রে রাই! ঘর করতিস কিছুদিন, বুঝতিস কী ধরনের মানুষ ও!

-কেন রে! কোনওরকম খারাপ কিছু নাকি? সেরকম তো কিছু শুনিনি কখনও!

-আরে না না, ওরকমও খারাপ নয়!

-তবে কেমন খারাপ? পারভার্ট? আলুর দোষ?

-না রে বাবা! তেমন মানুষ ও নয়!

-তবে যে বললি?

-ও তুই বুঝবি না রাই।

-সৈকতদা কি তোকে কষ্ট দেয়?

  এর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না শর্বরী। শুধু হ্যাঁ বা না তে কি এর উত্তর হয়? ও বলল, ‘সৈকত শুধু আমাকেই কষ্ট দেয় রাই, ও পৃথিবীতে আর কাউকে কষ্ট দিতে পারে না।’

-এটাই তো ভালোবাসা রে!

-ভালোবাসা না ছাই। ঘর জ্বালানি পর ভুলানি।

রাই কোনও উত্তর করল না। শুধু মনে মনে বলল, তুই ভালোবাসার আর কী বুঝিস বড়ি, তুই তো শুধু মন পেতেই অভ্যস্ত! মুখে বলল, ‘চল, গাড়ীটা পার্কিং এ আছে’।

 গাড়ীতে বসে শর্বরী বলল, ‘রাই, আমার থাকার ব্যবস্থা কী করেছিস্‌?’

-কেন, আমার ফ্ল্যাটে।

-আমি তো তোকে আসার আগেই বলেছিলাম, তোর সাথে আমি এক ফ্ল্যাটে থাকবো না। তুই শুনলি না কেন?

-কেন, আমাকে বিশ্বাস নেই?

-বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নেই এখানে। প্রশ্নটা শোভন-অশোভনের।

-শোভনতা কার কাছে বড়ি? এই মুম্বাই শহরে কেউ কাউকে চেনে না। পাশের ফ্ল্যাটের লোকের মুখও আমি দেখিনি এতগুলো বছরে।

-সে যাই হোক, এক ফ্ল্যাটে আমি থাকবো না। আমাকে হোটেলে নিয়ে চল!

-তুই আমার ভরসায় এলি কি করে বড়ি?

-ভরসাতো এখনও পুরোমাত্রায় আছে রাই!

-তাহলে আর ভাবছিস কেন? দ্যাখ না কী হয়!

-মানে?

-মানে আমার দুখানা ফ্ল্যাট। বুঝিস তো আমাদের জীবনে কোনও পেনসন গ্র্যাচুয়িটি নেই। যখন টাকা থাকে, কিছু অ্যাসেট করে ফেলি ভবিষ্যতের ভরসায়। এই গলা যদ্দিন, তদ্দিনই আয়। আমি নিজে যে ফ্ল্যাটটায় থাকি, তার থেকে আটটা দশটা প্লট দূরে আমার আরেকটা ফ্ল্যাট কেনা আছে। তুই ওখানেই থাকবি। আমার পুরোনো বাঈকে বলা আছে, ও সাফসুতরো করে রাখবে। তুই যদ্দিন থাকবি, ও এসে ঘর ঝাড়ু পোছা করে যাবে।

-ও কি তোর রান্নাবান্নাও করে?

-দিনের বেলাটা করে। রাত্রে তো আমার ফেরার ঠিকঠিকানা থাকে না। ফলে খাওয়ার পাট রাত্রে নেই।

-কী খাস তবে রাত্রে?

-যেদিন যেখানে প্রোগ্রামে যাই, সেখানেই সাধারণত প্যাকেট ট্যাকেট দেয়। না দিলে রাস্তাঘাটে খেয়ে নিই।

-সব দিন তো আর প্রোগ্রাম থাকে না। সে সব রাতে কী হয়?

-ওই হরিমটর! যা জোটে তাই!

-একটু নিজেও তো করে নিতে পারিস, ভাতে ভাত বা এক তরকারী ভাত।

-পোষায় না রে।

-বেশ, যে কদিন আছি, রাত্রে আমি রান্না করে রাখব, তুই এসে খেয়ে যাস!

-তুই তো কবিতা টবিতা করতিস বড়ি, প্রমোদ বসুর ওই কবিতাটা মনে আছে ?  

                মেঘে রোদ্দুরে ভাসাবে তোমার ডানা

                আমি ঘুরে ঘুরে খাদ্য আনবো ঘরে।

                বৃষ্টিতে তুমি কাঁপবে দারুণ, তোমার

                আদর ঝরবে মন উচাটন স্বরে!

-হ্যাঁ। হঠাৎ?

-না, এ স্বপ্নটাই তো দেখেছিলাম একদিন। তুইতো কোনওদিন পাত্তাই দিলি না। হাসলো রাই।

-‘তুই কি পাত্তা পাওয়ার মতো ছিলি’? বলেই মনে মনে জিভ কাটলো শর্বরী। বলল ‘স্যরি এভাবে কথাটা বলতে চাইনি আমি। আমি ইন জেনারেল কথাটা বলেছি রাই। আমিতো কাউকেই এই হিসাবে পাত্তা দিইনি। আমার বাবা সোজা হিসাব। হৃদয়ের জন্য জীবনটা বাজী রাখা যায় না। কলেজের ছেলেরা কী এমন স্বপ্ন দেখাবে, যার টানে বাবা-মাকে দুঃখ দিয়ে একটা এতবড় রিস্ক নেবো? এটা আমার পরিষ্কার সিদ্ধান্ত ছিল রাই, আমি কখনও স্কুল কলেজ জীবনে প্রেম করবো না।‘ 

-কলেজ পাশ করেও তো করতে পারতিস? তখনও তো এই বান্দা আর অনেক ক’টা রাখাল হাজির ছিল তোর সামনে!

-এম.এ. পাশ করার পর দেখলাম বাবাই সম্বন্ধটা আনলো। গেজেটেড অফিসার। খবরটবর নিয়ে দেখা গেল স্বভাব চরিত্রও ভালো। রাজী হয়ে গেলাম। অন্য কিছু নিয়ে ভাবনার অবকাশও ছিল না।

-ভালোই করেছিস বড়ি। এই দ্যাখ না আমার এই চালচুলোহীন জীবন। যেই আসতো ওর কষ্টই হতো!

-তুই কি এইভাবেই বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবি নাকি?

-ইচ্ছে তো তেমনই। বাকীটা অদৃষ্ট।

-আরও কতটা যেতে হবে?

-বিশ মিনিট আরও।

-তোর আজকে প্রোগ্রাম নেই?

-এখন অফসিজিন। রিহার্সাল ছিল। তবে তুই আসবি বলে ক্যানসেল করেছি। আগামী চারদিন পুরো ফ্রী আমি। যা যা দেখতে চাস, লিষ্ট করে রাখ –  সব দেখিয়ে দেব।

-আমি তো মুম্বাই আগে কখনও আসিনি রে রাই। জানি না। তুইই বল, কি কি বেড়াবার জায়গা আছে এখানে?

-মুম্বাইতে প্রচুর বেড়ানোর জায়গা। এর মধ্যে বিখ্যাতগুলো হল - গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া, মেরিন ড্রাইভ, তাজহোটেল, হ্যাঙ্গিং গার্ডেন, জুহু চৌপাটি, হাজি আলির দরগা, এলিফ্যান্টা কেভ। এর মধ্যে তোর যেগুলো পছন্দ, সেগুলো যেতে পারি। তুই তো এখন আছিস ই।

-এখান থেকে লোনাভালা-খান্ডালা কতদূর?

-যাবি?

-শুনেছি নাকি সুন্দর জায়গা?

-চল, তোর অনারে আমারও যাওয়া হবে। প্রায় দশ বছর হল এসেছি, এখনও আমার দুটোর কোনওটাই যাওয়া হয়নি। এখানে মাড আইল্যান্ড বলেও একটা ভালো জায়গা আছে। সেখানেইও যাইনি কোনওদিন। আগে ছোটখাটোগুলো দেখে নে। ওগুলো পরে ঘুরিয়ে দেব।

-তোরপ প্লে-ব্যাক করার কী হলো?

-ওসব বলিস না। সুমনের ওই গানটা শুনেছিস তো, ‘একটা সুযোগ দাও একটু সুযোগ/একটা জীবন অন্যরকম হতে পারে,’ সেই সুযোগ পাওয়াটাই বড় ব্যাপার রে!

-তুই তো ভালো গাইতিস। দু-একবার ইউটিউবেও শুনেছি - এখনও ভালো গাস। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?

-এই ভারতে ভালো গান গায় এমন লোকের অভাব নেই রে! আমি সুযোগ পাচ্ছি না, সেজন্য যারা পাচ্ছে - তারা যে অযোগ্য এমনটা নয়। তাদের লাক্‌ ফেভার করেছে - সেজন্য তারা কারও নজরে আসতে পেরেছে। যারা নজরে আসতে পারে না, তাদের মধ্যেও অসংখ্য ভালো গায়ক আছে রে! একে ভাগ্য বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

-তুই নজরে পড়তে পারিস এমন কিছু করছিস না ?

-করি। কিছু জিঙ্গল গেয়েছি। অধিকাংশ সময় কি হয় জানিস? আমাদের মতো অনামাদের গান গাইয়ে ওই ট্র্যাকে অন্যের ভয়েস জুড়ে বাজারে ছেড়ে দেয় এরা। অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে কষ্ট করে গান করছি আমরা, নাম করছে অন্যলোক।

-আজকাল কি সর্বক্ষেত্রেই এরকম ঘাপলাবাজি? 

-বলতে পারিস। তবে আজকাল এসব নিয়ে ভাবিনা। তাতে গানের কোয়ালিটি ফল্‌ করে যায়। এখন আমার একটাই কাজ - ভালো গান করা এবং ফলের কথা চিন্তা না করা!

-বাব্বা। তুইতো কর্মযোগী হয়ে গেলি যে রে?

-কী আর করব? জীবনটাই তো দর্শন!

  খানিকক্ষণ চুপ করে রইল দুজনেই। একটু পরে রাই বলল, আজ রাতের খাওয়াটা হোটেলেই করি, কী বলিস?

-করলেই হয়।

-সেই ভালো। কাল সকাল থেকে ঘরেই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হবে। বাঈ এসে করে দিয়ে যাবে দু’বেলা।

-এই না কথা হল, রাত্রে আমি করব?

-সে যেদিন ইচ্ছে হয়  করিস। বেসিকটাতো ওই করে দিয়ে যাক। এখানে বেড়াতে এসেছিস। তুই কি দুবেলা রান্না করবি?

-ঢেঁকি তো যেখানে যাবে, ধানই ভাঙবে রাই!

-তুই কি বাড়ীতে রান্না করতিস নাকি? তোর রান্নার লোক ছিল বলেই তো বলেছিলি একবার!

-রান্নার লোক ছিল। তবে ভালোমন্দ রান্না আমিই করতাম। সৈকত  খেতে খুব ভালোবাসে। ভালো মাছ বা মাংস টাংস হলে - কাজের লোককে দিতে সাহস হয় না।

-ঠিক আছে। এখানেও তোর যেমন ইচ্ছে তেমনটা কর। কেউ বাধা দেবারও নেই, জোর করারও  নেই।

-রাই, তোদের ফ্ল্যাট থেকে বাজার কতদূর?

-এখানে কলকাতার মতো নয় রে! ঠেলায় করে বাজার আসে ফ্ল্যাটগুলোর নীচের কমন প্যাসেজে। মোটামুটি টাইম বাঁধা থাকে ওদের। নতুন লোকেরা সিকিউরিটিদের বলে রাখে, ওরা ইন্টারকমে খবর দিয়ে দেয়।

-মাছ টাছ পাওয়া যায় এখানে? 

-হ্যাঁ। তবে সামুদ্রিকই বেশী। এখানে একটা বিখ্যাত মাছ হল সুরমাইয়া। খুব টেষ্টি। আমাদের আড়-বোয়ালের মতো।

-বাঃ।

-দাঁড়া কালকে কিনে আনবো।

-ওটা রাঁধতে জানি না তো।

-ও নিয়ে ভাবিস না। আজকাল নেট খুললেও রান্নার টিপস পাওয়া যায়। তাছাড়া আমি এইটা একটু আধটু রাঁধতে জানি। তোকে বলে দেব। যাইহোক প্রায় এসে গেছি। এই চক্‌টা মনে রাখিস। বাঁ দিকে এই এভারেষ্ট ম্যানসনটাকে রেখে আমাদের যেতে হবে। তুইও যদি টুকটাক বেরোস, এটাকেই ল্যান্ডমার্ক করে রাখবি। এর সামনে দশটা প্লট পরে ডানদিকে টার্ন নিলেই আমাদের ফ্ল্যাট।

                               (৪)

  সকালে শর্বরীর ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের শব্দে। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে গল্প করে যখন রাই গেল, তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। রাই এর ফ্ল্যাটটা ও দেখে এসেছে কালই। হেঁটে দুই থেকে তিন মিনিটের রাস্তা। সতেরো তলার উপরে ওর ফ্ল্যাট। উপর থেকে নীচে তাকালে কেমন যেন মনে হয়! মাটি থেকে বড্ড দূর, বড্ড উঁচু! এজন্যই বোধ হয় এখানকার মানুষজন মাটির টান বোঝে না; সবসময় দৌড়োয়। এসব ফ্ল্যাটে থাকলে মনে হয় সব কিছু যেন অধরা, নিজেও যেন নিজের কব্জার বাইরে। হয়ত থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে যায়, কিন্তু আপাতত শর্বরীর ভালো লাগছে না মোটেই। বরং শর্বরীকে থাকার জন্য যে ফ্ল্যাটটা দিয়েছে রাই, ওটা আটতলায়, তাই বাঁচোয়া। দরজা খুলে দেখল, একজন মধ্যবয়সী স্থুলকায়া মহিলা দাঁড়িয়ে। জানা গেল, ওই মহিলাই বাঈ, কলকাতার ভাষায় কাজের মাসি। ওর নাম প্রমীলা। ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘দিদি চা খাবে তো’?

-হ্যাঁ।

-ক’ চামচ চিনি? নাকি লিকার খাও?

-হাফ চামচ চিনি দিও। আচ্ছা তুমি কি ওই দাদার বাড়ীতে যাবে এরপর?

-না। দাদা বলে দিয়েছে, যে ক’দিন তুমি এখানে থাকবে, এখানেই ওর দুপুরের রান্নাটা করতে। 

-তবে ঝাড়ু পোছা? ওর বাড়ীতে ঝাড়ু পোছা কখন করবে?

-তোমাদের বাড়ীতো কলকাতায়?

-হ্যাঁ।

-তা সেখানে রান্নার লোকই কি ঝাড়ু পোছা করে? আমাদের এখানে করে না। আলাদা ডিপার্টপেন্ট।

মনে মনে জিভ কাটলো শর্বরী। ভদ্রমহিলার বোধ হয় প্রেস্টিজে লেগে গেছে। তাই যথাসম্ভব নরম গলা করে বলল, ‘মানে রাই বলেছিল তো তুমি এখানে পরিষ্কার টরিষ্কার করে রাখবে – তাই ভাবলাম ওখানেও তুমি ঝাড়ু পোছা কর।

-ও তো দাদা নেহাত করে বলল বলে কালকে তোমারটা করে দিলাম। নইলে এর জন্য অন্য লোক।

-ঠিক আছে। দাদা সকালে চা খায় না?

-না, না। ও তো ঘুম থেকে ওঠে এগারোটার পর। তারপর উঠেই যন্ত্রপাতি নিয়ে গান করতে বসে যায়। অর্ধেক দিনই আমার সাথে ওর দেখা হয় না - মানে ও ঘুমিয়ে থাকে। আমার কাছে দরজার চাবি থাকে। ফলে আমি আমার মতো করে যাই আসি, অসুবিধে হয় না।

  ভদ্রমহিলা বেশ চটপটে। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই সব করে টরে চলে গেল। শর্বরী উপরের টেরেস থেকে দেখল - ওর নিজের স্কুটি আছে। সেইটা চালিয়েই সে বাড়ী বাড়ী কাজে যায়। বেশ ভালো লাগলো দেখে।

  দুপুরে যখন রাই এল, তখন প্রায় একটা বাজে। দেখে মনে হল, এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। শর্বরী বলল - ‘কী রে, কখন ঘুম থেকে উঠলি?’

-এই তো ঘন্টাখানেক। উঠে স্নান ট্নান করে এলাম।

-কেমন স্নান করেছিস রে? দেখে তো মনে হচ্ছে না!

-দেখে কী মনে হচ্ছে?

-মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে কোনরকম বেরিয়ে এসেছিস। মাথায় জল দিস নি?

-দিয়েছি তো!

-সত্যি! এতবড় ধেড়ে ছেলে, স্নানও করতে জানিস না!

-ছাড়! আজ কি কোথাও বেড়াতে যাবি? না কি বিশ্রাম?

-চল, কোথাও ঘুরে আসি।

-তাহলে খেয়ে টেয়ে নে। আজ জুহু বিচে যাবো। জানিস তো, ওই চত্বরে সব ফিল্মস্টারেরা থাকে!

-সে থাকুক। আমার ওদের বাসস্থান নিয়ে অত কৌতুহল নেই। চল, বরং সমুদ্র দেখে মনটাকে বড় করে আসি। 

  ঘুরে টুরে যখন ওরা বাড়ী ফিরল তখন রাত সাড়ে আটটা। এসেই রাই বলল – ‘তুই গিয়ে ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নে, আমি আসছি।‘ মিনিট পনেরো বাদে রাই এসে একেবারে আসর সাজিয়ে বসল। বরফ কুচি, চাট টাট জড়ো করতে বাইরে গেছিল সে। শর্বরী দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল,‘এসব কী রাই?’

-এই একটুখানি গলা ভেজাব। তুই নিবি?

-তুই জানিস না - এসব খাওয়া আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না।

-দ্যাখ বড়ি, এখন এমন অভ্যেস হয়ে গেছে, না খেয়ে আমি থাকতে পারি না। তুই নিশ্চিন্তে থাক-একচুলও বেচাল আমাকে দেখবি না, প্রমিস!

-খাস কেন রাই? কী লাভ এই নেশা নিয়ে?

-দূর বোকা! নেশা কি মদে থাকে? নেশা তো থাকে মনে। ‘শরাবী’ ফিল্মের গানটা মনে নেই? ‘নশা শরাব মে হোতা তো নাচতি বোতল।‘

-তাহলে খাস কেন? 

-এ তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না বড়ি! এটা একটা অনুঘটকের মতো। মনের নেশাটাকে কখনও বাড়ায়, কখনও ভোলায়।

🍂

-এই ‘কখনও’ শব্দটাই তো গোলমেলে। একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি?

-ইট ডিপেণ্ডস। মন যখন যে মুডে থাকতে চায়, নেশাও তখন তাকে অ্যাকসিলারেট করে।

-এই যে লোকে বলে - নেশা করে দুঃখ ভোলা যায়। সত্যি যায় কি?

-তাহলে কি ‘দেবদাস’ হত? বাস্তবে ‘আগুন দ্বিগুন জ্বলে ছাপোষ হাওয়ায়।’

-তাহলে তুই খাস কেন, রাই? জানিসই তো এত রোগ হয় এতে!

-কেন খাই? ঠিক জানিনা রে! হয়ত ভুলে থাকতে চাই সবকিছু, হয়তো ভুলতে চাই না পাওয়াগুলো বা হয়তো নিজেকেই।

-এই তো বললি, এতে সত্যি সত্যি ভোলা যায় না।

-আসলে বোধ হয় ভোলাটা বড় ব্যাপার নয়। ভুলতে চাওয়াটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।

-কী ভুলতে চেয়ে তুই মদ ধরেছিস রাই?

রাই খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘তোকে’। 

-বাজে কথা বলিস না। তুই আগেও খেতিস, কলেজে পড়তে পড়তেই তোরা মাঝে মাঝে পার্টি করতিস না?

-ওটা তো অকেশনাল। বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে খাওয়া। পাকাপাকি খাওয়া শুরু করলাম তোর বিয়ের দিনের পর থেকে।

-যাঃ।

-‘যাঃ’ না রে! তুই জানিস, তোর বিয়ের পর থেকে কতজন এরকম দেবদাস হয়ে গেছে?

-আর জেনে কাজ নেই। তুই এসব গোছা এখান থেকে। আমার কাছে এটা দেখাও দৃশ্যদূষণ!

-ভাবলাম কোথায় তুই আমাকে পেগ বানিয়ে না দিস-অন্তত সামনে বসে থাকবি, তা না করে বাগড়া দিচ্ছিস!

-কেন আমাকে কি সাকী বানানোর সখ ছিল? 

-তুই থাকলে কি আর মদের দরকার ছিল রে?

-আমি এসব জানতে চাইনা রাই, তুই মদ ছেড়ে দে।

-পারবো না রে!

-দিব্যি পারবি। আমার দিব্যি রইল।

-দিব্যি ফিব্যি দিস না বড়ি; আমি চেষ্টা করব। আস্তে আস্তে কমিয়ে দেব।

-আস্তে আস্তে এসব কমানো যায় না। একেবারেই ছেড়ে দিতে হয়। তুই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর ওই গল্পটা জানিস?

-কোন গল্পটা?

-একজন ভদ্রলোকের সাথে ওনার স্ত্রীর প্রায়দিনই ঝগড়া হত। ভদ্রলোক বলতেন, দ্যাখো এভাবে যদি তুমি আমার পেছনে লেগে থাকো, তবে সব ছেড়ে ছুড়ে আমি বিবাগী হয়ে যাবো। স্ত্রীও বলতেন -‘ওঃ। তোমার মুরোদ আমার জানা আছে’। একদিন ভদ্রলোক নদীতে স্নানে যাবেন বলে কাঁধে গামছা ফেলে রেডি, এমন সময় ঝগড়া লাগল। ভদ্রলোক বললেন, তোমাকে বহুবার বলেছি এরকম করলে কিন্তু আমি বাড়ী ছেড়ে যাবো।‘ স্ত্রী বললেন, ‘ভারী তো মুরোদ। শুধু মুখেই বক্তাপি’। ভদ্রলোক বললেন, ‘দ্যাখ খেপি - এই চললাম’। সেই যে বেরিয়ে গেলেন, আর ফিরলেন না। সুতরাং যেতে হলে একেবারেই যেতে হয়, ছাড়তে হলেও তাই।

-আসলে আমাদের লাইনে সবাই খায়। আমার পুরো দলটা খায়। আমি বা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি কী করে?

-তখন ভাববি, আমি তোকে বারণ করেছি, আর তুই আমাকে কথা দিয়েছিস।

-আমাকে এমন করে কেন বিপাকে ফেলছিস বড়ি? তুই আর কদিন থাকবি! সারাজীবন তোর বেড়া দিয়ে আমাকে বেঁধে যাবি কেন বল দেখি? 

-আমাকে ভোলার জন্য যদি তুই মদ শুরু করেছিস বলে লোককে বলে বেড়াস, তবে তাকে বন্ধ করার নৈতিক দায়ও কি আমার থাকতে পারে না?

-তোর সাথে কথায় পারা বড় মুশকিল বড়ি। নে, চেষ্টা করব। তবে তুই তোর দিব্যি উইথ ড্র করে নে। অবস্থা বিশেষে যদি আমি না খাই, আমার লিয়াঁজো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি আর কাজ পাবো না রে!

-যে কাজ মদের বিনিময়ে হয়, সে কাজ না করাই ভালো।

-হ্যাঁ রে, সৈকতদা কি মাঝে মধ্যেও খায় না?

-না। ওসব বিষয়ে ও একেবারে গুডবয়।

-বাই দা বাই, তুই আজ সৈকতদাকে ফোন করেছিস?

-না। কাল এসে পৌঁছানোর খবর দিয়েছিলাম।

-আজ করলি না?

-রাই, আমি এখানে এসেছি জাষ্ট বেড়ানোর জন্য এমনটা নয়। আমি আমার বিগত ছয় বছরের পর্বটাকে ভুলতে চাই। প্রতিদিন যদি ফোনে ফোনে কী রান্না হল, অফিস গেলে কিনা - এসব করতে থাকি, তবে ওই জগৎ থেকে বেরোতে পারবো না। আমি শুধু পুরোনো সম্পর্ক বা পুরোনো বিষয়গুলোকে রিজুভিনেট করবো বলে কিছুটা টাইম স্পেস পেতে আসিনি রাই। আমি নিজেকে আগামী দিনের অ্যাসপেক্টে কিছুটা যাচাইও করে নিতে চাই।

-বা, বা! তুই তো বিবাহযুক্ত সম্পর্কে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিস যে রে!

-কেন? তুই নতুন কোনও সম্পর্কে পড়তে চাইছিস নাকি?

-না।

-তবে তোর ভয় কিসের?

-এতদিন করিনি বা এখন করতে চাইছি না বলে কখনও যে চাইতাম না, এমন তো নয় বড়ি!

-এখনই বা করতে চাইছিস না কেন? তোদের এ লাইনে নাকি একদম ফ্রি মিক্সিং? নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটাই নাকি বড় চ্যালেঞ্জ?

-এটা ঠিক কথা। তবে আমার কেন জানিনা - কোনও সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছে করে না।

-তোদের যে ফিমেল ভয়েসরা রয়েছে - তাদের সাথে ইন্টু মিন্টু করিস না?

-দু-তিনটে রিলেশন বেশ অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। প্রায় বিছানা পর্যন্ত। কিন্তু জানিস তো বড়ি-শেষ মেষ কোথায় যেন একটা বাধা এল। কোথাও যেন মনে হল নিজেকে এসব ছোঁয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। কেন মনে হল জানি না, তবু আমি মেনে নিলাম।

-তারপর?

-যা হবার তাই হল। আমাকে ইমপোটেন্ট, বৃহন্নলা এইসব ভেবে টেবে যে যার নিজের পথ ধরে নিল।

-এই মুহূর্তে কেউ নেই?

-একটা লটর পটর করছে। আমি বিশেষ পাত্তা দিচ্ছি না।

-কেমন দেখতে?

-দেখা নিয়ে কি যায় আসে? তবে তোর ধারে কাছে নয় এটা যদিও চোখ বন্ধ করে বলা যায়।।

-বাজে কথা বলিস না। কী করে মেয়েটা?

-আমাদের এখনকার ফিমেল ভয়েস। ভালো গান করে মেয়েটা। এখানকার মারাঠি চ্যানেল যদি দেখিস, দেখবি মাঝে মাঝে আদলান কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখায়। ওটা ওর ভয়েস। এছাড়াও বেশ কিছু অ্যাড করেছে আগে।

-তুই রাজী হচ্ছিস না কেন?

-আসলে জানিস তো, মন সায় দিচ্ছে না। মনে এমন একটা পয়েন্ট সেট হয়ে আছে, সবসময় আমি তার সাথে কমপেয়ার করে চলেছি।

-তাহলে আর জীবনে হবে না রাই। প্রতিটি মানুষকে তার মতো করে বিচার করতে হবে। অন্যের অ্যাঙ্গেলে বা অন্যের অ্যাসপেক্টে বিচার করলে তো জীবনে ম্যাচ করানো যাবে না রে?

-তা ঠিক। তবু...

-কিচ্ছু  ‘তবু’ নয়। দেখি ওর ফটো।

  মোবাইলে ওর বেশ কয়েকটি ছবি ছিল। বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েটি। নাম গৌরী। শর্বরী বলল, ‘বেশ সুন্দর দেখতে তো রে! আলাপ করিয়ে দিস’।

-ও পরে দেখা যাবে। চল, আপাতত খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হোক।

                              (৫)

  সকাল থেকে চারপাশটা কেমন মেঘলা হয়ে আছে। চা টা খেয়ে বারান্দা থেকে নীচের রাস্তাটা দেখছিল শর্বরী। হঠাৎ দেখল সৈকতের ফোন। আজ উনিশ দিন হয়ে গেল সে এসেছে বাড়ী ছেড়ে, কই সৈকত তো একবারও ফোন করেনি? ভীষন ইগো ওর! খুব রাগ হয়ে গেল তার। অবশ্য সে রাগই বা করছে কেন? এটাই তো ওরা দুজনে চেয়েছিল। যাইহোক ফোনটা তুলে বলল, ‘হ্যালো। কী বলছ?’

-কেমন আছো বুলু?

-তুমি কি এটা জানতে ফোন করেছ?

-না। আসলে তোমার এল.আই.সির প্রিমিয়ামটা ডিউ হয়েছে আগামীকাল। এসব তো তুমিই ডিল করতে। আমি চেক সই করে দিলে তো হবে না। তোমার সই লাগবে। কী করবো?

-থাক পড়ে। জমা করার দরকার নেই।

-ডিফল্টার হবো কেন? পরে দিলে ফাইন দিতে হবে।

-একমাস পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড আছে। ওর মধ্যে ফাইন দিতে হয় না।

-দিতেই যখন হবে, ফালতু ওয়েট করবো কেন বুলু?

-তুমি কী চাইছো? আমি গিয়ে চেক সই করে আসি?

-এভাবে কথা বলছ কেন? আমি তো জানতে চাইছি, কী করব।

-বললাম তো, দেওয়ার দরকার নেই।

-দেব তো বটেই, কীভাবে দেব তাই বলে দাও। তুমি ‘না’ বললে এল.আই.সি অফিসে যেতে হবে এই আর কী !

-ক্যাশে জমা করে দেওয়ার কথা মাথায় আসছে না তোমার? এই বুদ্ধি নিয়ে একা থাকার স্বপ্ন দ্যাখো?

-দ্যাখো বুলু, একা থাকার স্বপ্ন আমি কখনও তোমাকে বলছি? তোমার এইসব ইংলিশ হ্যালুসিনেশন হয়, আর আমার ঘাড়ে ফেলো দাও। থাক গে । যাক, রাখছি এখন।

  ঠক করে ফোনটা কেটে দিল সৈকত। শর্বরীর সারা গা পুরোনো রাগে আবার রি রি করে জ্বলে উঠল। এত অহংকার কিসের? আজ এতদিন ও বাইরে, ফোন করতে ইচ্ছে করে না একবারও? ওরা তো মিউচুয়ালি কিছুদিন একা থাকতে চাইছে, কথাবার্তা তো বন্ধ হয়নি! একবারও কি ও বলতে পারতো না - ‘বুলু ফিরে এসো। অনেক দিন একা আছি, খেতে কষ্ট হচ্ছে’। চম্পার রান্না এত চমৎকার? সেই বা এত কষ্ট করে তবে ভালো মন্দ রাঁধতো কেন? খাক ওই আধসেদ্ধ খাবারগুলো! খাক! পোড়া মশলা ঝোলে ভেসে থাক চাক চাক হয়ে। ও কিছুতেই ফিরে যাবে না। বেশ তো কেটে যাচ্ছে এখানে। কই তার নিজেরও কি খুব কষ্ট হচ্ছে সংসার ছেড়ে? প্রথম দু-একদিন অভ্যাস মতো মনে হচ্ছিল। ইদানীং তো বেশ বিন্দাস লাগছে তার। মুক্ত পাখী। এতদিন তার ডানার ঝটপটানি কেউ শুনতো না, কেউ শুনতে চাইতো না। আজ এখানে এত বড় আকাশ মিলছে তার। এত গভীর তার তল, পাখার ঝটপটানি মালুমই হয় না তার নিজের। সে এবার উড়বে; নিজের মতো বাঁচবে।

  দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রাই বলল, ‘আজ কোথায় যাবি?’

-আজ কোথাও যাবো না রে রাই। ঘরেই থাকবো। গল্প করবো তোর সাথে।

-সে তো বেড়াতে বেড়াতেও করা যায়।

-না। আজ বেড়াতে যাওয়ার মুড নেই।

-সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কী হয়েছে তোর আজ?

-হয়নি কিছুই।

-তবে? বাড়ীর কথা মনে হচ্ছে? বাড়ী ফিরে যাবি?

-আমি জীবনে আর বাড়ী ফিরতে চাইনা রাই!

-কেন রে? সৈকতদা ফোন করেছিল নাকি?

-হ্যাঁ।

-ঝগড়া করেছিস?

-না।

-বড়ি, অন্যভাবে নিস না আমার কথাগুলো। তুই এখানে আছিস, আমি যারপরনাই খুশী। যাকে বলে এ আমার স্বপ্নাতীত পাওয়া। তবুও বলবো, তোর কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। 

-কিসের ভুল? নিজের স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাওয়াটা ভুল?

-দ্যাখ বড়ি, আমি তো তোদের সব ব্যাপার জানি না। তুই যতটা বলেছিস তার ভিত্তিতে এক পাক্ষিক যুক্তি দিয়ে আমার সবকিছু বিচার করতে যাওয়াটাও অন্যায়। তবু বলব, আরও কিছুদিন সময় নে। আরও ভাব। তারপর ডিসিশান নিস্‌।

-রাই, আমি ইংলিশ এ এম.এ পাশ এবং ইংলিশ মিডিয়াম। এখানে কোনও প্রাইভেট স্কুল এ আমাকে ঢুকিয়ে দিতে পারবি?

-তোর কাগজপত্র আনিয়ে রাখ। চেষ্টা করা যেতে পারে। এখন যদিও সেশনের মাঝে, তাও দেখব। দু-একটা স্কুলের মালিকপক্ষের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। ওদের ফেষ্ট টেষ্ট হলে আমাকে গান গাইতে ডাকে।

-কাগজপত্র আমার সঙ্গেই আছে। আমি আজকেই রেডি করে রাখব রাই। তুই আমাকে কালই নিয়ে চল।

-কাল আর পরশু আমার সময় হবে না রে। একটা ভয়েস ওভার আছে। তারপরের দিন রবিবার হবে না। তার পরের দিন নিয়ে যেতে পারি। তোর রিসেন্ট তোলা পাসপোর্ট সাইজের ফটোগ্রাফ আছে তো?

-না।

-ঠিক আছে। আজ বিকেলে তুলিয়ে আনবো। কিন্তু ধর তোর এখানে চাকরী হয়ে গেল,তখন কী করবি?

-এখানেই থাকবো। তোকে ভাড়া দেব ঘরের। তুই না নিলে কোনও পি.জি তে থাকবো।

-যাঃ। তা বলিনি। আমি বলতে চাইছি, কলকাতার পাটটা কী হবে?

-মানে সৈকত তো?

-শুধু তাই কেন! তোর বাবা-মা। ওনাদের কথাও তো ভাবা দরকার।

-আজ না হলে কাল ওদের তো জানাতেই হবে রাই। বলে দেব, আমি মুম্বাইতে থাকবো, এখানে চাকরী করব।

-আর সৈকতদা?

-ও যদি চায় ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব।

-‘ও যদি চায়’ মানে?

-মানে ওরও তো আবার সংসার করার ইচ্ছে হতে পারে। আমার জন্য সেই বা বঞ্চিত হবে কেন?

-তোর কি মনে হয় সৈকতদা আবার সংসার করতে চাইবে? আই মিন তোকে ছেড়ে অন্য কারুর সাথে?

-সৈকত কি তোদের মত? ওর কাছে আমার কোনও ভ্যালু নেই। এখনও চাইছে না। তবে চাইতেই পারে।

-আর সৈকতদা যদি না চায়?

-তবে এমনি থাকবো। মিউচুয়ালি সেপারেটেড।

-আর তুই? তোর অন্য কারোর সাথে সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছে করবে না?

-জানিস তো রাই, তোর সৈকতদা প্রায়ই একটা কথা বলে, ‘ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়?’ আগে কথাটা শুনে প্রায়ই গায়ে লাগতো, আজ মনে হচ্ছে একেবারে খাঁটি কথা! ওই রাস্তায় আবার পা? নৈব নৈব চ!

-যাঃ। আমি ভাবছিলাম লাইন ক্লিয়ার হলে আমার একটা চান্স আছে। গৌরী ফৌরীকে হটিয়ে দেবো। সে গুড়েও বালি ফেলে দিলি? হাল্কা মজার ছলে বলল রাই।

-ইয়ারকি মারছিস, না? মেরে নে, মেরে নে। এখন হাতি গাড্ডায় পড়েছে তো!

-হাতি নিজের খাদ নিজে খুঁড়লে কী করা যাবে বল? তবে আমার ইচ্ছে কিন্তু জেনুইন।

-আর ফানুস ফোলাস না রাই। আমি ওই সম্পর্কের পাঁক থেকে বেরোতে চাই রে! একটা ছেড়ে আরেকটা পাঁকে জড়াতে চাই না। 

  রাই এবার যথেষ্ট সিরিয়াস গলায় বলল, ‘বড়ি, আজ এমন সিরিয়াস আলোচনায় কথাটা বলছি বলে হয়তো ভাবছিস সুযোগ নিচ্ছি, তবু একটা কথা না বলে পারছি না।’

-কী কথা?

-তুই যে বললি ‘আরেকটা পাঁকে জড়াতে চাইছি না’! কথাটা আমাকে খুব আহত করল জানিস। যদি এমন কখনও হয় আমি জীবন দিয়ে চেষ্টা করব যাতে আমার সাথে তোর সম্পর্ককে কখনও পাঁক মনে না হয়!

-প্রথম প্রথম এমনই মনে হয় রে রাই। একবার অধিগত হয়ে গেলে তখন আর এসব প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে না। তখন সবকিছুই টেকেন ফর গ্রান্টেড।

-মুখে আর কী বলব বড়ি। শুধু বলতে পারি ‘পরীক্ষা প্রার্থনীয়!’

শর্বরী হেসে বলল, সে সুযোগ আসবে নারে রাই। জানিসই তো, আমি হৃদয় দিয়ে ভাবি না।

-বেশ। এসব আকাশকুসুম ভেবে লাভ নেই। এই উইকএন্ডে খান্ডেলা যাবি? তাহলে হোটেল বুক করে রাখব আজ!

-গেলেই হয়। কিভাবে যাবো?

-আমার গাড়ীটাই নিয়ে নেবো।

-কতক্ষণ লাগবে? 

-এই ঘন্টা পাঁচেক।

-কদিন থাকবো?

-শনিবার যাবো। রবিবার রাতে বা সোমবার সকালে ফিরবো।

-এই যে বললি শনিবার তোর রেকর্ডিং!

-ও তো সকালে। দেড়টা দুটোর মধ্যে মিটে যাবে। তারপর যাবো। তুই চল এখন বাজারে, টুকটাক কিছু শীতের পোষাক কিনে নে। ওখানে বেশ ঠান্ডা।

-চল। আচ্ছা রাই, লোনাভালা কি ওই একই দিকে?

-না। ওটা অন্য দিকে। আর একদিন ওদিকে যাবো।

                                (৬) 

  ভারী চমৎকার জায়গা এই খান্ডালা। এতদিন শুধু নামই শুনেছিল শর্বরী। এসে মনে হল, বড় অপরূপ। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপর গড়ে ওঠা এই শৈলশহর এখন পর্যটকদের এক অন্যতম আকর্ষনের জায়গা। সুন্দর সুন্দর রিসর্ট, প্রচুর গাছপালা, প্রচুর মানুষ অথচ আশ্চর্য এক নিঃসঙ্গতা যেন ওখানকার আকাশে বাতাসে। রাই যে রিসর্টটা বুক করেছে, সেটাও চমৎকার। এক একটা কটেজে দুটো করে রুম। নিজের মতো করে কেউ যদি হারিয়ে যেতে চায় কিছুদিনের জন্য তবে নিঃসন্দেহে এই জায়গাটি তাদের জন্য স্বর্গোদ্যান। আজ আসার পথে ‘কুনে ফল্‌স্‌’টা ঘুরিয়ে এনেছে রাই। কী যে আশ্চর্য সুন্দর, বলে বোঝানো যাবে না। এখানকার খাবার রেস্তোঁরাটাও খুব ভালো। রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাই এসে বসল শর্বরীর ঘরে। এসেই বলল, ‘বাঃ চমৎকার সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিস তো রুমটাকে! মনেই হচ্ছে না এটা হোটেলের ঘর! এজন্যই জীবনে মেয়ের দরকার বুঝলি! জীবনটাও গুছিয়ে দিতে পারে ওরা’।

-আমার সবকিছু সাজানো গোছানো আর পরিপাটী ভালো লাগে। অগোছালো যেকোনও কিছুতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

-জানিস বড়ি, আজকে আমি বারবার নিজেকে চিমটি কেটে দেখছি, এই যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু হচ্ছে সব কি সত্যি? নাকি স্বপ্ন?

-কেন রে?

-আসলে কোনওদিন যে তোর সাথে এভাবে একা একা বেড়াতে আসা বাস্তবে সম্ভব হবে, বিশ্বাসই করতে পারিনি। 

-মানে? মনে মনে ভাবতিস নাকি?

-সে তো কতরকম ভাবে কতবার! যখন তোর বিয়ে হয়নি, তখনকার স্বপ্নগুলো একরকম ছিল। বিয়ে হওয়ার পর কত অমঙ্গল চিন্তা করেছি তোর! তোর যেন ডিভোর্স হয়ে যায় বা তোর বর যেন মরে যায়! 

-তাই নাকি? কপট রাগ দেখালো শর্বরী। অল্প হেসে আবার বলল, তাতে তোর লাভ?

-তারপর তুই একা হলে আমার চান্স আসবে। তোকে নিয়ে এরকম জায়গায় বেড়াতে আসবো। আরো কতরকম ছেলেমানুষী কল্পনা করতাম রে!

-যেমন?

-ধর কোথাও বেড়াতে গেছি। অমনি মনে হত, হঠাৎ করে তোর সাথে ওখানেই দেখা হয়ে গেল। তুইও আমার মতোই একা গেছিস বেড়াতে। অতঃপর চার চক্ষুর মিলন, ইত্যাদি ইত্যাদি...

-তোর স্বপ্নের জোর আছে বলতে হবে রাই। তুই সবকিছু বাস্তবে ঘটাতে পারলি। 

-তুই বিশ্বাস কর বড়ি, মনে মনে যখন স্বপ্ন দেখতাম, তোকে নাগালে পাবার কথা ভাবতাম; তখন কিন্তু এত তলিয়ে ভাবতাম না রে! মন এসব ভাবনাতেই কোথায় যেন মুক্তি পেত, বা বলা ভালো, স্বস্তি পেতো। অনেক সমস্যা মাড়িয়ে রাত্রে যখন শুতে যেতাম তোকে নিয়ে, এসব আকাশকুসুম ভাবনা কোথাও যেন আমার স্ট্রেসগুলোকে কমিয়ে দিত। দিনের পর দিন মাচায় গেয়ে গেয়ে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, বড় গায়ক হবার স্বপ্নগুলো আবার তখন নতুন করে ইনস্‌পিরেশন দিত। 

-আমি এই গত কয়েকদিনে দেখলাম রাই, তোর মধ্যে সত্যি সত্যি যেন আর বড় হওয়ার স্বপ্ন বেঁচে নেই। কোনও মতে দিনগত পাপক্ষয় করে যাচ্ছিস তুই!

-স্বপ্ন দেখতে হলেও তাকে যত্ন করতে হয় বড়ি। তাকে জল দিতে হয়, সার দিতে হয়। দিনের শেষে যখন মনে হয় সবই নিষ্ফল, তখন আর উদ্যম বেঁচে থাকে না।এ খন মনে হয় শুধু জীবনটা কাটিয়ে দিই। চল্লিশ তো হয়েই গেল! কার জন্য আর বড় হওয়া!

-নিজের জন্যই হবি। খ্যাতি তো ট্রান্সফারেবল নয়। ওটা নিজেরই হয়।

-জানিস বড়ি, তুই আসার পর থেকে মনে হচ্ছে আবার একবার ভালো করে ঝাঁপাই। মিউজিক ডিরেকটারদের বাড়ী বাড়ী ধর্ণা দিই। কিছু একটা করি। তুই যদি এখানে স্কুলে চাকরী পেয়ে যাস, তবে দেখবি একবছরের মধ্যে আমি কিছু না কিছু একটা করে দেখাবো। অবশ্য ভাগ্যটাও একটা ফ্যাক্টর।

-ভাগ্য ফ্যাক্টর  ঠিক আছে, কিন্তু সার্বিক একটা চেষ্টা অবশ্যই করা উচিৎ।

-এবার দেখবি ভাগ্যও প্রসন্ন হবে। গানটা তো আমি ভালোই গাইতাম।

-সে তুই এখনও ভালো গাস।

-তুই জানলি কোত্থেকে?

-ইউটিউবে তোর গান আপলোড করা আছে দেখলাম তো। ওগুলোই শুনলাম।

-কই বলিসনি তো, তোর ভালো লেগেছে বলে।

-সুযোগ হয়নি বলার। 

-তুই জানিস, তুই ভালো বলবি - এই আশায় আমি নিজেকে অতিক্রম করে গেয়েছি এই গানগুলো, অথচ তোর শোনার সময়ই হয়নি এত বছর !

-আমি কী করে বুঝবো, পৃথিবীশুদ্ধ এত সঙ্গীতবোদ্ধাদের মাঝে আমার ভালোলাগাই তোর কাছে ম্যাটার করে?

-তুই বুঝিস না?

শর্বরী চুপ করে রইল। রাই আবার বলল ‘কতবার তোকে হোয়াটস অ্যাপেও গান পাঠিয়েছি, তুই কোনও কমেন্টও দিস নি। আমার বিশ্বাস, তুই ডাউনলোড করে শুনেও দেখিস নি।‘

-হয়তো তাই রে রাই! আমি তখন অন্য ‘ধুনে মস্ত’ ছিলাম। সে ধুনটা আমার ছিল না। আমিও তখন আমাকে কেউ প্রশংসা করবে এই আশায় প্রহর গুনতাম। আমার ছোটখাটো সাজগোজ, ঘরের সবকিছু সাজানো, যত্ন করে রান্নাবাড়ী - এসব কারো নজত কাড়তো কিনা সেই অনুমানেই মন ব্যস্ত থাকতো। অন্য কিছুতে মন দেওয়ার তখন সময় ছিল না রে!

-এই জন্য রিসেন্টলি আমার আর মনও লাগে না গানে। সুর, তাল, লয় - এগুলো তো অভ্যেস, ভুল হয়না। এর এক্সট্রাটুকু দেওয়ার জন্য যে মনযোগ লাগে - সেই মনটাই তো এখন ঝিমোচ্ছে।

-এটাই যখন তোর জীবিকা এবং একই সঙ্গে প্যাশন, এতেই মন দে রাই। 

খানিকক্ষণ কোনও কথা বললো না কেউই। শর্বরী এখন ঘরের নাইট গাউনটার উপর পাতলা একটা কার্ডিগান পরে চুল আঁচড়াচ্ছে। রোজ রাত্রে শোওয়ার আগে এটা ওর অভ্যাস। ওকে একমনে চুল আঁচড়াতে দেখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল রাই।

-কী দেখছিস হাঁ করে? শর্বরী জিজ্ঞাসা করল।

-তোর এখনও এতখানি চুল! সত্যি সৈকতদার ভাগ্যকে ঈর্ষা করতে হয়!

-ও তো কোনওদিন তাকিয়েও দেখতো না রে!

-জানিস তো আমার একটা গান খুব মনে পড়ছে।

-কোন গান?

-ও শাম কুছ আজীব থি।

-শোনা না।

-এখন আর গাইতে ইচ্ছে করছে না রে বড়ি। রাতের খাওয়াটা ভারী হয়ে গেছে। পেটে এত খাবার নিয়ে নাভি থেকে আওয়াজ বের করা যায় না। এটা আমার ইউটিউবে আপলোড করা আছে। চালিয়ে দিচ্ছি, শোন। 

  সত্যি, গানটা ভালোই গাইছে রাই। ওর হিন্দি উচ্চারণটা বেশ ভালো। ভাষায় দাপট না থাকলে আবেগ আসে না। কী সুন্দর করে গাইছে ‘ঝুঁকি হুয়ি নিগাহ মে/কঁহী মেরা খয়াল থা/দবী দবী হঁসী সে এক হসীন সা গুলাব থা/ম্যায় শোচতা থা মেরা নাম গুনগুনা রহী হে উও... 

 হঠাৎ রাই বলল, ‘বড়ি, একটা জিনিস চাইবো, বল ‘না’ বলবি না!’

-কী?

-আগে প্রমিস কর।

-আরে এতে প্রমিসের কী আছে, বলই না!

-তোকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিবি? প্লীজ ‘না’ বলিস না।

শর্বরী কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। চুপ করে রইল।

-কী রে, ধরব?

শর্বরী মাথা নীচু করে রইল। রাই উঠে এসে হাত ধরে দাঁড় করালো ওকে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে খুব সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরল ওর বুকে। চিরুনিটা এখনও চুলে লাগানো। এক ঢাল কালো চুল শর্বরীর পিঠ ছাড়িয়ে নেমে গেছে নীচে। চিরুনিটাকে সরিয়ে মাথার চুলের উপর আলতো করে চুম্বন এঁকে দিল রাই। বলল, ‘রাগ করলি?’

  শর্বরী নিরুত্তর। শুধু যেন সাক্ষীর মতো প্রত্যক্ষ করছে সে সবকিছু। রাই আবার বলল, ‘আসলে খুব ইচ্ছে করল তোকে কাছে পেতে! তুই তো সবসবয় নাগালের বাইরেই ছিলি!’

শর্বরী একথারও কোনও উত্তর দিল না। চুপ করে থাকলো একটুক্ষণ। একটু পরে বলল, ‘নে ছাড় এবার’। 

-আর একটুখানি থাকতে দে না! আর একটুখানি নিজেকে জড়িয়ে নিতে দে। একথা বলেই খাটটায় বসে শর্বরীর বুকের উপর মাথার একপাশটা চেপে ধরল সে। শর্বরী রোবটের মতো স্থানু হয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। এক একটা সেকেন্ড বড় দীর্ঘ মনে হতে লাগলো তার। একটু আড়চোখে মুখটা নামিয়ে দেখলো রাই চোখদুটো বন্ধ করে একমনে একইরকমভাবে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। কেমন ছেলেমানুষের মতো মনে হল তার ওকে। ও ধীরে ধীরে ওর ডান হাতটা ওর মাথার চুলে রেখে হাল্কা বিলি কেটে দিল দু-একবার। বলল, ‘রাই, রাত হয়েছে। শুতে যা এবার।‘

 রাই বাধ্য ছেলের মতো আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। চুলটা আঁচড়ে দরজাটা লাগিয়ে শর্বরী শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায়। হঠাৎ সৈকতের মুখটা মনে এল তার। কেমন একটা পাপবোধ এসে ভর করল ওকে। শর্বরী লাফ মেরে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে ভালো করে চোখমুখে জল দিল। এমন কেন মনে হচ্ছে তার? সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কোনও অবস্থাতেই সে তার বিগত কয়েক বছরের কোনও স্মৃতির সাথে কোনও কিছুকেই প্রতিতুলনা করবে না। কোনও অবস্থাতেই সে ভাবতে চাইবে না যে আগেরটাই ছিল ভালো। সে তো ওই জীবন থেকে নিষ্কৃতি চায়! নতুন দিনগুলোর সাথে নিজেকেও মানিয়ে নিতে চায়! তবে এটাই কি সংষ্কার? এই সংষ্কারকে মোটেও আমল দেবে না সে। সে স্বাধীন জীবন বেঁচে দেখবে, কারও প্রতি নির্ভরতাহীন জীবন কাটাবে। তার মতো মেয়ে যে রাস্তায় বেরোলে রাইদের মতো ছেলেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেতো - আজ সে এতটাই অবিন্যস্ত? সামান্য হাওয়াতেই তার ডালপালা ভেঙে যাবে? নিজেকে আরও শক্ত করে গড়বে সে। 

  রাতে ভালো মত ঘুম হল না শর্বরীর। নানান এলোমেলো অসংলগ্ন স্বপ্ন এসে মনটাকে কেমন অগোছালো করে দিল তার। ভোর বেলায় ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে যখন ওর রুমের বাইরের বারান্দাটায় এলো, দেখলো রাই ওখানে অলরেডি চেয়ার পেতে বসে আছে। ওকে দেখে শর্বরী যারপরনাই বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী রে, তুই তো এগারো বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিস না। আজ কী বলে?’

-দ্যাখ না, কী অদ্ভুত সকাল! ওই যে দূরে পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে, তার গায়ের রাস্তাটা হাল্কা কুয়াশায় কেমন হাতছানি দিচ্ছে, চেয়ে দ্যাখ!

-হুঁ। 

-চা খাবি বড়ি?

-খেলে তো হতো! কিন্তু এত সকালে বোধ হয় রুমি সার্ভিস চালু নেই।

-আচ্ছা দাঁড়া; গিয়ে দেখে আসি।

  খানিকক্ষণ বাদে ব্যাজার মুখে ফিরে এল রাই - ‘স্যরি সাড়ে সাতটার আগে কিছু পাওয়া যাবে না’।

-ও ঠিক আছে। বোস এখন।

  ওরা দুজনে নিজের মতো করে দূরের প্রকৃতির দিকে চেয়ে রইল শুধু, বিশেষ কথা হল না। রাই দেখলো শর্বরী কেমন যেন গম্ভীর, অন্যমনষ্ক। ওর নিজের খারাপ লাগা শুরু হল গতরাতের ব্যাপারটা নিয়ে। অনেকক্ষণ বাদে বলল, সকাল দশটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব বুঝলি বড়ি। আজকে এবেলাতেই ভাজা আর কারলা কেভ দুটো দেখে নেব। বিকেলে রাজমাচী ফোর্ট হয়ে সানসেট পয়েন্ট যাবো।

-আজকেই কি ব্যাক করবি?

-না। কাল বিকেলে বেরোব। দু-নাইটের বুকিং করা আছে। অবশ্য তুই বললে আজও ফিরতে পারি।

-আমার আর বলাবলির কী আছে রাই! বেকার মানুষ। এখানে থাকলেও যা, ওখানেও তাই!

-না, তুই কাল স্কুলে যাবি বলেছিলি।

-ওটা আর এমন কী? একদিন এদিক ওদিক হলে কিচ্ছু যাবে আসবে না।

-ঠিক আছে, আমি রুমে যাচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নিই। সাড়ে আটটায় তোর রুমে আসবো। ওখানেই ব্রেকফাষ্ট করে বের হব, কেমন?

  রাই চলে যেতে শর্বরী নিজেকে খুব শাসন করলো। ও কেন এমন শীতল ব্যবহার করছে রাই এর সাথে? ও বেচারা মরমে মরে যাবে! ও কেন স্বাভাবিক হতে পারছে না? হোক বোকাবোকা, বেশী বেশী কথা বলবে ও আজ রাই এর সাথে। ধীরে ধীরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে।

  (৭)

  বিকেলে ফোর্ট টোর্টগুলো দেখে যখন রাইরা সানসেট পয়েন্ট এল, তখন সানসেট হতে আরও ঘন্টাখানেক বাকী। একটু নিরিবিলি দেখে একটা পাথরের উপর উঠে বসল ওরা দুজন। একটু দূরেই খাড়াই ঢাল - এখান থেকেই গাটা ছ্যাৎ করে ওঠে। রাই বলল, ‘কী রে ভয় লাগছে নাকি?’

-ভয় কিসের?

-এই যে এতখানি ঢাল! 

-বেশ অ্যাডভেঞ্চার এর ফিলিংস হচ্ছে রে রাই।

-কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে, তুই আজকে বেড়ানোর আনন্দ নিতে পারছিস না। অকারণ জোর করে আমার সাথে কথা বলছিস। আমি বুঝতে পারছি বড়ি, তুই স্বাভাবিক নেই। কী হয়েছে,বল?

-কিচ্ছু হয়নি।

-হয়েছে তো বটে! তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস?

শর্বরী চুপ করে রইল। ওকে নিরুত্তর দেখে রাই আবার বলল, ‘কী রে রাগ করেছিস?’

 শর্বরী ঘাড় নেড়ে জানালো ‘না’।

-দ্যাখ বড়ি, আমি জানি, আমার তোকে এভাবে এমব্যারাস করা উচিত হয়নি, তবু বিশ্বাস কর - ওটা জাষ্ট একটা মোমেন্টের চাওয়া। না রে, ভুল বললাম। ওই চাওয়াটা আমার বহু কালের, বহু বছরের। কিন্তু তাই বলে এমনটা যে আমি প্ল্যান করে করেছি তা নয়! তোকে ওরকম ভাবে চুল আঁচড়াতে দেখে হঠাৎই ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছিল। আমি সত্যি সত্যি দুঃখিত।

  শর্বরী আস্তে করে ওর হাতটা দিয়ে রাইয়ের হাতটা চেপে বলল, ‘এভাবে বলিস না। আমি এজন্য কিছু মনে করিনি’।

-তাহলে তুই এরকম হয়ে আছিস কেন আজ? আজ বাইশ দিন হল তুই এসেছিস, এমনটা তো তোকে কখনও দেখিনি!

-এমনি। একটু মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে এটা ঠিক; তবে কালকের জন্য বোধহয় নয়।

-তোর কি সৈকতদা’র কথা মনে হচ্ছে?

-হওয়াতে চাইছি না। তবু হচ্ছে।

-কিন্তু তুই চাইছিসই না বা কেন? জোর করে মনকে কি বাঁধা যায়? তুই আসলে সৈকত’দাকেই ভালোবাসিস বড়ি। 

-ওটাই তো আমার সবথেকে বড় ভুল রে রাই।

-ওটা তোর ভুল না। আসলে সারাজীবন আমাদের মতো ছেলে-ছোকরাদের থেকে বা পরিবারের লোকদের থেকে তুই এত অ্যাটেনশন পেয়ে এসেছিস, সেটাই এখন তোর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুই আশা করছিস সৈকত’দাও তেমনটা হবে। 

-তুই ওর এত তরফদারি করছিস রাই, তুই জানিস ও আমাকে একটুও পাত্তা দেয় না। সারাদিন নিজের জগৎ নিয়ে থাকে। আমি যদি দিনের শেষে ওর একটু অ্যাটেনশন চাই, সেটা কি অন্যায়?

-দ্যাখ বড়ি, আমি তোর অন্ধ ভক্ত। তোর সব বক্তব্যে হ্যাঁ বলতে পারলেই আমার সব থেকে ভাল লাগে, তবু যতটুকু তোর থেকে শুনি, তাতে মনে হয় কোথাও বোধ হয় তোর চাওয়াতে ভুল আছে।

-বেশ। আমার বাবা মাও মনে করে আমার ভুল। তোরও তাই মনে হয়। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।

  অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দুজন। রাই বলল, ‘তুই অকারণ রাগ করছিস বড়ি! আমার ইনটেনশনটা তোকে দোষী করার নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, তোর ভাবনার অ্যাঙ্গেলটা বদলে দ্যাখ। সবসময় নিজেকে ডিপ্রাইভড, আণ্ডার প্রিভিলেজড হিসাবে ভাবলে ভাবনার স্বচ্ছতা থাকবে না।

-বেশ, আমি না হয় বায়াসড্‌। ওর হয়ে তুই এত ওকালতি করছিস; বলতো আজ কতদিন হয়ে গেল-সৈকত একবার ফোন করতে পারতো না?

-ওর দোষ দেখছিস, তুই নিজেও কি করেছিস? নাকি দেখছিস ইগোর খেলায় কে জেতে? আজ এখানে বেড়াতে এসে তুই ওকে ফিল করছিস - তুই একথা ওকে বলতে পারিস না?

-সবসময় আমিই তো বলি। এতদিন তো তাই বলে এসেছি। একবার আমারও তো শুনতে ইচ্ছে করে!

-দ্যাখ বড়ি, প্রত্যেকের প্রকাশ ভঙ্গি আলাদা। হয়তো সে একভাবে তোকে এসব কথা বলে বা বোঝায়! কিন্তু মুশকিল হল তুই শুধু স্তুতির ভাষাই শুনতে চাস! 

-জানিস তো রাই, এজন্যই লোকে বলে - বিয়ে তাকেই করো যে তোমাকে ভালোবাসে; তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয়! 

-ইস্‌, আগে যদি এমনটা ভাবতিস বড়ি, তবে আমার কপালে শিকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারতো। মজা করল রাই। ‘তবে কিনা তখন তুই সৈকতদার ভুমিকায় থাকতিস, আমি তোর মতো অভিমান করে পালিয়ে বেড়াতাম। লাভ কিছু হতো না। এটাই ভগবানের নিয়ম রে! উনি এই ভেবেই তোদের মিলিয়েছেন। ভাব, সৈকত’দাও যদি আমার মতো বা কিশোরের মতো তোর পেছনে ল্যাজ নাড়াতো, তবে তার অবস্থা কি আমাদের মতোই হতো না?’ 

-তুই কি বলতে চাস সৈকত এসব জেনে বুঝে করে?

-তা জানিনা। হয়তো এটাই ওর স্বভাব। তবে আমার মনে হয়, ও তোর সাথে এই দূরত্ব তৈরী করেই নৈকট্যটা বজায় রাখতে পারে। এটাই হয়তো তোকে জয় করার সঠিক স্ট্রাটেজি।

 শর্বরী হঠাৎ চোখ মেলে চাইল দিগন্তে। সূর্যাস্তের তোড় জোড় শুরু হয়েছে আকাশে। নানান আকারের মেঘে নানান রকমের রঙের মেলা। এত রঙ আছে ঈশ্বরের ক্যানভাসে? সূর্য্যকে এত বড় আর এতখানি লাল সে আগে দেখেনি কোনওদিন। বছরতিনেক আগে মাউন্ট আবুর সানসেট পয়েন্টে সৈকতের সাথে সূর্যাস্ত দেখার কথা হঠাৎ মনে পড়ল তার। সৈকত এসব দেখতে খুব ভালোবাসে। ও রাইকে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘চল,সূর্যাস্ত শুরু হয়েছে’। 

Post a Comment

0 Comments