জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়-আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী /চল্লিশতম পর্ব

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
-আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 
চল্লিশতম পর্ব

সে দিনটা এখনও বেশ মনে পড়ে বিজয়ার।পুজো-কালীপুজোর শেষে প্রথম ঠান্ডার আমেজ এসে গিয়েছে আবহাওয়ায়, হাতে পায়ে শুকনো ভাব।তখনকার দিনে তো পুজোর পরে পরেই ঠান্ডা পড়ে যেত বেশ।বাজার জুড়ে কচি মূলো,পালং-ফুলকপির পশরা,কয়েৎবেলে নুন তেল কাঁচালঙ্কা দিয়ে মেখে দুপুরের অলস মেয়েলি মৌতাত, বাড়ির পেছনের ছোট্ট মাটির জায়গায় ধনেপাতা আর টমেটোর গাছগুলো বেশ তরতরিয়ে বাড়ছে নতুন লাগানো গ্যাঁদাচারার পাশে।শিউলীর ডালে ফুল ফোটা কমে এসেছে,বৌমার চেহারায়ও আসন্ন প্রসবের সম্ভাবনা…
তো সেদিন সকাল থেকেই মেয়েটি কেমন যেন অস্হির আচরণ করছিলো,এখানে ওখানে বসে পড়ছিল, খাওয়ার ইচ্ছে নেই।দুবার বোধহয় বাথরুমেও গিয়েছিল।ছেলের আপিসের তাড়ায় আলগোছে দেখলেও ততটা খেয়াল করেননি বিরজা।ছেলে বেরিয়ে যেতে যখন তার খোঁজ করতে গেলেন,দেখেন মাদুর পেতে গুটিশুটি পাকিয়ে শুয়ে পড়েছে মেঝেয়,কোমরের নিম্নাঙ্গ জলে জলাক্কার,ঘরময় কেমন যেন এক আঁশটে গন্ধ।
প্রথমে ভেবেছিলেন পাশের কুঁজোটা বুঝি ভেঙেছে,ওখান থেকেই এসেছে জল। তারপরে দেখেন,না। সেটা তো ঠিকঠাকই আছে।
এদিকে বৌমাকে জিজ্ঞেস করলেও  কিছুই তেমন বলতে পারছেনা, খুব যে অসুস্থ তাও মনে হচ্ছে না। এদিকে বাড়িতে বৌদিদিদের এমন অবস্থায় দেখলেও তাঁরও তো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই এ ব্যাপারে। উপায়ান্তর না দেখে,পাশের বাড়ির দিদিকে ডেকেছিলেন। তিনি এসেই সবকিছু বুঝে তাড়াতাড়ি একটু দইভাত খাইয়ে হাসপাতালে পাঠাবার উদ্যোগ নিলেন। রিক্সা ডেকে আপন দায়িত্বে কাছাকাছি রেডক্রসের সেবাসদনে নিয়ে গেলেন, পাশাপাশি তাঁদের ছেলে বিল্টু বিরজাকে পৌঁছে দিলেন সাইকেলে বসিয়ে।ও বাড়ির দাদা গেলেন কোর্টে ভাইপোকে খবর দিতে। 
তেমনভাবে না হলেও গ্রামের মানুষের একটা ধারনা ছিল, শহরের মানুষেরা নাকি আত্মকেন্দ্রিক হয়, তাই বিরজা তাঁদের সঙ্গে মিশতেনও ভয়ে ভয়ে।কিন্তু সেদিনকার প্রতিবেশীর আন্তরিকতার যে আস্বাদন তাঁরা পেয়েছিলেন,তা চিরদিন মনে ছিল।এমনকি,পরে পরে,বৌমার ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েও প্রতিবেশী দাদু-ঠাম্মার কাছে যে আদর পেতো,বোঝার উপায় ছিল না, সম্পর্ক রক্তের নয়।
আদপেই সে দিনগুলি ছিল বড়ো সুখের।
এখনও মনে পড়ে, সারাদিনের ব্যস্ততা এবং দুশ্চিন্তার শেষে রাত নেমেছিল ধীরে। ভেতরের প্রসূতি সদনে তখনও বৌমার প্রসব হয়নি,ভাইপো একটু দূরে,বিল্টুর সঙ্গে বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছতলায় অপেক্ষমান।পাশের বাড়ির দাদা-বৌদিদি বাড়ি গেছেন সব ব্যবস্থা করে,একটু বিশ্রামের জন্য ।প্রয়োজন পড়লে রাতে আবার আসবেন,এই বলে।বিরজা একাই বসেছিলেন বারান্দায় কাঠের বেঞ্চিতে, সারাদিন তেমন খাওয়া বা বসার সুযোগ হয়নি, খানিক অবসন্ন লাগছিল হয়তো তাই।
সামনে তাকিয়ে আনমনে দেখছিলেন,নির্মেঘ আকাশ জুড়ে সোনার কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে, পাশাপাশি অসংখ্য তারার মিটিমিটি…উল্টোদিকের পীচ রাস্তা পেরোনো গলি দিয়ে পরপর মানুষ জন বাড়ি ফিরছে, ল্যাম্প পোস্টের হলুদ বাল্বের তলায় অগুন্তি পোকামাকড়ের ভীড়।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়লো মাস দুয়েক আগের এমনই কোন এক সন্ধ্যার কথা। সেদিনও এমনই চাঁদ উঠছিল, ভাসানের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল ল্যাম্প পোস্টের তলার পতঙ্গের মতো রাস্তার মানুষের ভিড়, আবছা আলো…সবার চোখ ছিল সেদিকেই। হঠাৎ গোলমাল, চেঁচামেচি,বোম বা পটকা ফাটার আওয়াজ … তার মধ্যেই উল্টোদিকের গলি বেয়ে দু একটা ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল দ্রুত,বিরজা সতর্ক ছিলেন না,তবে জামাটা তিনি ঠিকই দেখেছিলেন। একাধিক বার জোর করে কেড়ে কেচে দিয়েছেন যে,সে খুব বেশি জামাকাপড় তো সঙ্গে আনেনি,ঐ একটিই জামা আর টেরিলিনের প্যান্ট,দুটি পাজামা,ফতুয়া। সঙ্গে মাত্রই একটি শান্তিনিকেতনী ব্যাগ।সে রাত থেকে ব্যাগটিও ছিল না।
ঐটা কি সত্যিই ঐ ছেলেটাই ছিল!এমন হিংসাত্মক কাজে কি সত্যিই সে লিপ্ত ছিল! সারাদিন তো শুধু বইই পড়তো…পরেরদিন যখন কানাঘুষো শুনেছিলেন পাড়ায়, শুনেছিলেন যে গুলি চলেছিল,ও কি গুলি চালিয়েছিল,ও কি গুলি চালাতে জানতো?
পুলিশ যথেষ্ট ধরপাকড় করলেও কাউকেই ধরতে পারেনি। অদ্ভুত ভাবে ছেলেটির কথা তাঁদের বাড়িতে কেউ আলোচনাও আর করেনি। দাদা বৌদিদি তো তারপরেই ফিরে গিয়েছিলেন দেশে, বৌমার বাবাও। কিন্তু বৌমা বা ভাইপোর মুখেও কোন কথা ছিল না তাকে নিয়ে।তবু ঐ চরম বিপদের দিনে, সামনের গলির দিকে তাকিয়ে বিরজার কেন কে জানে তার কথাই মনে পড়েছিল।
🍂
কেমন আছে? কোথায় আছে?বেঁচে আছে তো?
এসব ভাবতে ভাবতেই টের পেলেন ভেতরের ব্যস্ততা,এক নবজাতকের গগনভেদী কান্না কানে এলো,কাঁচের বন্ধ জানালায় গাল ঠেকিয়ে দেখলেন, বৌমার খাটে শোওয়া ক্লান্ত দেহ,তারপাশে দাঁড়ানো লেডি ডাক্তারের হাতে রক্তমাখা শিশুর পা,পাছায় অল্প চাপড় দিতেই চিৎকার…এলো মহাজনমের লগ্ন!
ওদিকে চিৎকার শুনেই বিল্টু আর ভাইপো দৌড়ে এলো দরজার কাছে, সাদা টুপি আর ড্রেস পরা নার্স জানালেন,এক সুস্থ কন্যা সন্তানের জনক জননী হয়েছে নবদম্পতি। আকাশের অযুত তারাদল সাক্ষী রইলো, সাক্ষী রইলো রেডক্রস আঁকা প্রসূতিসদন; অগ্রহায়ণের হিমেল বাতাস,সামনের কৃষ্ণচূড়ার পাতায় পাতায় আশীর্বাদ পাঠালে জগন্মাতার।চক্রবর্তী পরিবারের নতুন প্রজন্ম নিরাপদে এসে পৌঁছলো তার এই জন্মের আবাস গৃহে…
খানিকক্ষণ পরে স্নান করিয়ে নবজাতিকাকে তাঁর কোলে এনে দিলো নার্স,স্নেহ চুম্বনে কপাল ছুঁলেন তিনি, ফুটফুটে হিরন্ময়ী কন্যা,বৌমাকেও বাইরে এনে তার খাটে শোয়ানো হলো,মাথার কাছে তার স্বামী, নতুন কাকা হওয়ার গৌরবে বিল্টু তার সাইকেল নিয়ে চললে পাড়ায় আনন্দের খবরটুকু দিতে,পরের সকালে পাড়ার প্রতিটি ঘরে রাজভোগ পৌঁছে দেওয়ার মহাদায়িত্বও যে নিয়েছিল ভীষণ ভালোবেসে…
বিরজাও আবার নতুন ব্যস্ততা এবং কর্তব্যে ফিরেছিলেন, বাচ্চার আদর যত্ন,তেল মালিশ,নবপ্রসূতির দেখাশোনা, ফুরসৎ ফেলার সময় পাননি বেশ কয়েকবছর। এরমধ্যেই ধীরে ধীরে এসে যায় আরও নাতি নাতনীর দল,ভাইপো-বৌমাও ধীরে ধীরে স্বয়ম্ভর সংসারী হয়ে ওঠে, বড়োবৌদিদি হঠাৎ মারা যান।বিরজাও দেশে ফিরে আসেন সংসারের প্রয়োজনে।শেষ হয় মেদিনীপুর বসবাস অধ্যায়।
এই তো জীবন।তাই হয়তো জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি চলে মানুষের পরিযায়ী ভ্রমণ,এঘাটে ওঘাটে…দেখা হয়,কথা হয়।সম্পর্ক,ভালোবাসা…,মনে রাখা,ভুলে যাওয়াও হয়না কি! এই তো জীবন,এইই তো জীবন!...(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments