জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল পর্ব ১৮ /সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল 

পর্ব ১৮

সৌমেন রায়

চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি।


ভাসা ভাসা ভাষা

শিক্ষকের কাছে পঞ্চম মূর্তিমান সমস্যা হল ভাষা। ছাত্রছাত্রীদের অনেকের ভাষার ওপর দখল খারাপ বললে  কম বলা হয়, দখল প্রায় নেই। বাংলায় কথ্য ভাষার বহুরূপ বিদ্যমান। বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে তা পাল্টে যায়। এমনকি কুড়ি পঁচিশ কিমি দূরত্বে ভাষার প্রভেদ লক্ষিত হয়। এতসব ভাষায় পুস্তক রচনা করা সম্ভব নয়। তাই স্ট্যান্ডার্ড বাংলায় পুস্তক রচিত হয়। ছাত্রছাত্রীদের এমনিতেই তাদের জীবন বহির্ভূত অনেক বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করতে হয় খুব সঙ্গত কারণে। একে বিজাতীয় বিষয় তার ওপর আবার ভাষার জন্য তারা পড়ার অর্থ করতে পারেনা । মনের দরজা জানালা বন্ধ করে বইয়ের ভাষাটি রপ্ত করার চেষ্টা করে। ফলে মাঝপথে ভুলে যায়। পরীক্ষার খাতায় সে নিদর্শন মেলে অনেক।

 অনেক সময় দেখা যায় স্টুডেন্ট বুঝতে পারে কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। যেমন ভূগোলে দিন  - রাত কেমন করে হয় প্রায়  সবাই   বুঝতে পারে। কিন্তু লিখে বোঝাতে পারে না। পাটিগণিতে দেখা যায় লেখার ভার থেকে মুক্তি দিলে আরো দু চারজন বেশি  স্টুডেন্ট অংক করে দেখায়। ব্যাপারটা প্রথম নজরে আসে এক উত্তরপত্র দেখার সময়। পুরানো সিলেবাসে পরিসীমা কাকে বলে প্রশ্নটির উত্তরে এক কিশোরী লিখেছিল ‘গটা জেগাটাকে ঘিরে যে সীমাটা তাকে পরিসীমা বলে।‘ গটা মানে গোটা, জেগা মানে জায়গা। অর্থাৎ ক্লাসে বলা কথার কথ্য রূপ। এই রূপটি সবাই করতে পারে না। তাই তার পড়াও হয়ে ওঠেনা। এমন হওয়ার কারণ কি? কোন জিনিস বুঝতে পারা, করতে পারা বুদ্ধির একটা স্তর। আর সেটাকে বুঝিয়ে বলতে পারা উপরের আরেকটা স্তর। কোন বয়স্ক মহিলা হয়ত দারুন সুন্দর চচ্চড়ি রেঁধে খাইয়ে দেবে। কিন্তু কিভাবে করেছে, কোন মসলা কি অনুপাতে দিয়েছে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবে না। আবার কোন তরুণী ইউটিউবার সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবে কিভাবে চচ্চড়ি রাঁধতে হয়। কিন্তু তার রান্না  হয়ত খাওয়া যাবেনা। প্রথম জনের অভাব ভাষার অনুশীলনের, দ্বিতীয় জনের অভাব রান্নার অনুশীলনের। ভাষার উপর দখল আনতে গেলে দরকার যথেষ্ট অনুশীলন। সেই অনুশীলন ছোট থেকে করা হয়ে ওঠেনা বেশিরভাগের। পড়ার বই ছাড়া গল্পের বই পড়া  উচিৎ। কিন্তু সেটা প্রায় উঠেই গেছে। শিক্ষিত অভিভাবকও এখন এটাকে সময় নষ্ট বলে মনে করেন। অথচ গল্পের বই মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, মনে কোমল অনুভূতিগুলি  জাগায় , কল্প শক্তির বৃদ্ধি ঘটায়। ছোটবেলায় শিশু খানিকটা কল্প লোকে বিরাজ করে। গল্প তাকে সেই চিন্তার খোরাক দেয়। অভিভাবকরা আবার এই কল্প লোককে খুব ভয় পান। শঙ্খ ঘোষ তার কবিতা ‘মিথ্যে কথা’ তে সুন্দরভাবে  সেটা বলে গেছেন।

 ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে 

 ‘জানিস আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে’।

শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন, “শোনো, 

 এমন কথা আবার যেন না শুনি কখনো”।

 এই কল্প লোক কিন্তু পড়াশোনায় সাহায্য করে। একটু উপরের দিকে পড়াশোনা কিন্তু বেশিরভাগটাই বিমূর্ত কল্পনা। বেশি  উপরে যেতে হবে না । ক্লাস এইট  নাইন এ পড়া  পরমাণুর গঠন কিন্তু কেউ দেখেনি। নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ইলেকট্রন ঘুরছে এ দৃশ্য কেউ চোখে দেখেনি। পারিপার্শ্বিক কার্যকারণ ভিত্তিতে এটা হচ্ছে মানুষের কল্পনা,যা প্রয়োগ করে বাস্তব ফল পাওয়া যায়। সুতরাং কল্পনাশক্তি সাহিত্যে তো লাগেই এমনকি  বিজ্ঞানেও লাগে। হয়তো বা কিঞ্চিৎ বেশিই লাগে। হোমারের থেকে আর্কিমিডিসের কল্পনা শক্তি হয়ত একটু বেশিই ছিল। দাঁড়ান দাঁড়ান তেড়ে আসছেন কেন? আরে কথাটা আমার নয়। ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তিভূমি যারা প্রস্তুত করেছিলেন তাদের অন্যতম ভলতেয়ারের। কিছু বলতে হলে উনাকে বলবেন। তাই  কল্পনা করার শক্তিটি ছোটবেলা  থেকে বৃদ্ধি করাই সঙ্গত। কিন্তু অভিভাবকরা ভ্রান্ত ভয়ের কারণে তা করতে দেন না । ভালো ছেলে মেয়েদের ( ভালো মানে  এখানে পড়াশুনায় ভালো) গল্পের বই পড়ার সময় নেই। পারলে তারা ক্লাস টু থেকে জয়েন্টের কোচিং শুরু করে দেয়। স্কুলের লাইব্রেরী গুলো প্রায় অন্তিম শয্যায়। মোবাইল হাতে আসার পর  ভেন্টিলেশনে  আছে। ফাইভ সিক্সের ছেলেমেয়ে, যাদের হাতে এখনো মোবাইলটি আসেনি তারা তাও দু একটা বই পড়ে। উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা  ঐ পথ  মাড়া য় না। যদিও বা জোর করে বই দিতে চাওয়া হয় তারা খোঁজে  ঈশপ – কথামালার গল্প বা ভূতের গল্প। মস্তিষ্ক এর চেয়ে বেশি নেওয়ার মত অবস্থায় নেই ।দু একটা ব্যতিক্রম যা আছে সেটা ভয়াবহ স্বাভাবিক অবস্থাকেই প্রতিপন্ন করে।

🍂

 ভাষার উপর ন্যূনতম দখল না থাকলে কোন পড়াই সম্ভব নয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে গড় গড় করে রিডিং পড়তে না পারলে পড়াশোনা করা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে তার সমস্ত মনোযোগ চলে যায় বাক্যটি পড়তে। মানে বোঝার অবকাশ থাকে না। কয়েকটা বাক্য দিয়ে প্যারাগ্রাফ সে তো বিরাট ব্যাপার। অংক করাতে গিয়েও একই সমস্যা হয়।অংকের মানে বুঝতেই  সময়  গেলে  অঙ্ক  ভাববে কি করে? বিজ্ঞান  পড়াতেও একই সমস্যা । আর্কিমিডিসের নীতি পড়াতে  গিয়ে অপসারিত তরল আসে, আলো  পড়াতে গিয়ে অভিসারী  রশ্মি আসে।  এখন সেই অপসারিত, অভিসারী যদি মানে না বোঝে তাহলে সমস্যা হয়।দু একটা বলে দেওয়া যায়।কিন্তু সব বোঝাতে গেলে তা আসলে হয়ে ওঠে ভাষা শিক্ষার ক্লাস। ইতিহাসের ব্রাহ্মণ্যবাদ, স্বৈরাচার , জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি শব্দগুলি বেশিরভাগের কাছে বাউন্সার। যাহোক করে মাথা বাঁচায়। ইতিহাসের শিক্ষা নেবে কি করে?

ভাষা না শেখার আরেকটি কারণ এমসিকিউ জাতীয় প্রশ্ন। এম সি কিউ প্রশ্নের একটি  বিশেষ ভালো দিক আছে। বিষয়বস্তু খুঁটিয়ে না জানলে উত্তর করা মুশকিল।( যেহেতু মাধ্যমিক স্তরে খুব বেশি MCQ নেই তাই বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এই প্রবন্ধ নয়।)কিন্তু এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর করতে ভাষার উপর কোন দখল লাগে না। ছোট থেকেই তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে স্টুডেন্ট । উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখে এমন একজন শিক্ষক জানাচ্ছেন বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে স্টুডেন্টদের লেখার মান অত্যন্ত নিম্নগামী। যাহোক করে উত্তরে পৌঁছানোই যেন তাদের লক্ষ্য।

ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার ভাষা শিক্ষার পথে আর এক অন্তরায়। এখানে উত্তর দেওয়া, প্রশ্ন করা, যোগাযোগ করার জন্য সম্পূর্ণ বাক্য লিখতে হয় না। বুঝিয়ে দিলেই হয়। কখনো আবার ইমোজিতেই কাজ চলে যায়। স্টুডেন্টরা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। খাতাতে দেখা যায়  পূর্ণ বাক্যের পরিবর্তে খন্ডিত বাক্যে তারা উত্তর দিচ্ছে। ইন্টারনেট, ডিজিটাল মিডিয়া, সমাজমাধ্যম এইসবের অন্যতম আরেকটি কুপ্রভাব হচ্ছে অমনোযোগ। আগের পর্বে  অমনোযোগের কথা এসেছিল। তার অন্যতম কারণ ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার। এন্ডলেস কন্টেন্ট , পরিবর্তনশীল স্ক্রীন মনোযোগের দফারফা করে দিচ্ছে।বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সংক্রান্ত পর্বে।

ভাষাজ্ঞান বাড়ানোর  উপায় কি? উপায় একটাই পড়তে হবে, পড়াতে হবে। প্রাথমিকে শিশু যেন গড় গড় করে রিডিং পড়তে পারে সেটা দেখতে হবে। কিন্তু দেখবে কে?  তাত্ত্বিকভাবে দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে হয় না। ফলে একটা অনুচ্ছেদ বহু  কষ্ট  করে পড়ে  অনেক  স্টুডেন্ট বলতেই পারে না যে ওখানে কি বলতে চাওয়া হয়েছে। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে, হাজার হাজার ঘন্টা   স্কুল  আউয়ার, শয়ে  শয়ে শিক্ষক, কোটি কোটি ব্যয় কিন্তু সামান্য রিডিং পড়াই শেখেনা অনেক ছাত্রছাত্রী।

 তবে একটা কথা উল্লেখ না করা বোধহয় সত্যের অপলাপ হবে। কোন দিকেই যে ‘ভাষাজ্ঞান’ বাড়েনি তা  কিন্তু নয়।ইদানিং ক্লাস ফাইভ থেকেই ছেলেরাও ‘ ল্যা ‘ দিয়ে বিশেষ শব্দটি না ব্যবহার করে বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারছে না। শোনা যাচ্ছে টেলি সিরিজ গুলিতে নাকি এসব অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। সমাজ চাইলে শিশুর আর দোষ কি? যত উঁচু ক্লাসে ওঠে বাক্য পিছু স্ল্যাং এর সংখ্যা বর্গের সমানুপাতে বাড়ে।একবার এক স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দিনে  ক্লাস  সেভেনের একটি ইনোসেন্ট বালক  দেখি কনুই  ধরে টানছে। ‘স্যার চলুন না, ইউরিনালে চলুন না।‘কেন রে? 

স্যার কি লেখা আছে দেখাব । বললাম, ‘ ওখানে যে  সব অমৃত বাণী লেখা থাকে আমাদের সে সব জানা। ওখানে আমি যেতে চাই না।‘ বলল, ‘স্যার ,একবার চলুন।‘ নিষ্পাপ মুখটিকে ব্যথা দিতে মন চাইল না। বাধ্য হয়ে যেতে হল । চালু অমৃত বানীগুলির পাশাপাশি নূতন লেখা একটি শব্দবন্ধের দিকে নিরীহ ছেলেটি আঙুল দেখাল। লেখা আছে লাগাও ---------- ।  জিজ্ঞাসা করলাম  কি রে, গাছ লাগাতে বলেছে নাকি? তার দৃষ্টিটি আমার প্রতি করুণাঘন হয়ে উঠল।



Post a Comment

5 Comments

  1. Subrata ChakraborttyOctober 08, 2024

    👍 এখনও একাদশ দ্বাদশে অনেকে ইংরেজি তো অনেক পরের কথা, বাংলাটাও ভালো করে পড়তে পারেনা। মাধ্যমিকের মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা সহজেই অনুমেয়।

    ReplyDelete
  2. আরও একটি করুণ আখ্যান। ভাষা দুর্বলতার কারণে যদি সবটাই ভেসে যায়, তাহলে হৃদয় ও মগজে র‌ইলো কি? এক কোমর কাদার মধ্যে যদি উইসেনকে স্প্রিন্ট টানতে বলা হয় তাহলে তাঁর যে অবস্থা হবে মাস্টারমশাইদের হাল বোধকরি তেমন‌ই। হায় ধ্রুপদি ভাষা! গৌরবের যে দফারফা !

    ReplyDelete
    Replies
    1. 🙏🙏
      উপমাটি বেশ দিয়েছেন।

      Delete
  3. নির্মাল্য ঘোষOctober 13, 2024

    নিম্নবর্গীয় বলে যে সমস্ত মানুষের মুখের ভাষাকে শিক্ষিত সমাজ গুরুত্ব দিতে চায় নি, পক্ষান্তরে যে সমস্ত অবদমিত ভাষা কোনদিন মুখ খোলার সুযোগ পায় নি সেইসব ভাষাহীন মুখগুলোর যোগদান খাতায় কলমে বিগত কয়েক দশকে অনেকটা বেড়েছে। সেটাও বোধহয় ভাষা নিয়ে বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিয়েছে। মনের ভাষা কথ্য ভাষা পড়ার ভাষা লেখার ভাষা এত কিছুকে ছোট মাথাগুলো বাঁধবে কি করে?

    ReplyDelete