জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /সৌমিত্র শংকর রায়চৌধুরী

গুচ্ছ কবিতা 
সৌমিত্র শংকর রায়চৌধুরী 


কালের গতি

আপসহীন সময় বয়ে চলে আপন নিয়মে, সম্পর্কের গুরুত্ব বাড়ে আড়েভারে মনের টানে, কখনো তা আপেক্ষিকতার সিঁড়ি বেয়ে নামে আর ওঠে, ঠিক নদী যেমন মেশে সাগরে সব বাধা পেরিয়ে, কালের নিদানে আমরা সবাই হেঁটে চলি সময়ের স্রোতে, মুক্তোর দানার মতো জীবনের না বলা কথারা ডুবে থাকে শ্রাবণের গভীর আলস্যে, মধুর স্বপ্নেরা আঙুর বেদনায় ঠোকরায় মনের নরম কোষে, সব ব্যথা সরিয়ে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে সুস্থ যাপনের স্থির দিশায় এগিয়ে চলি লোকবৃত্তে আনন্দবাতাসের প্রসন্ন উল্লাসে...


কনকাঞ্জলি    

বেনারসির সবুজ নম্র আঁচলে
একলা দাঁড়িয়ে উঠোনের ধারে,
নিভে যাওয়া সিঁদুর আলোয়
দীর্ঘশ্বাস ডুবে যায় ক্লান্ত বুকে।

উজ্জ্বল দিন পোড়ে রাতের গহ্বরে
পদবীহীন নীলশিখা আগুনে,
সারা শরীরে মাখা বিষণ্ণ প্রেম
রাত জাগে মনের মঞ্জুষায়।

সপ্তপদী রাঙাসিঁথি লজ্জাবস্ত্র
মিশে যায় আগ্রাসী হিমবাতাসে,
গোপন সম্পর্কের রঙতামাশা
মুখ ঢাকে আয়নার ফাটা কাচে।

মনকেমনের দীর্ঘতর দিনে
মেঘ ঘনায় চোখের তারায়,
অন্ধপথের নীরব ভালোবাসা
নুয়ে পড়ে কাতর আর্তনাদে।

সব কালো ধুয়ে যায় সাদা জলে
ঋণ কি শোধ হয় দু'মুঠো চালে!


আশ্বিনের বৃষ্টি

আঁধার ঘেরা সকালে বৃষ্টি হয়ে চলেছে অবিরাম, কখনও আস্তে কখনও বা জোরে...ঘন মেঘে ঢেকেছে আকাশ, সূর্যের মুখভার...অলস মন আলো চায়, রাশি রাশি ভালোবাসার রঙে রাঙানো জীবনের আলো, সব অসুখ সারিয়ে আসবেই সে জানি এ মহাবিশ্বে... জয়ডঙ্কা বাজিয়ে স্বর্ণাভ সাতঘোড়ার রথে আসীন হয়ে...বরাভয় মন্ত্রধ্বনিতে দিগ্বিদিক মুখরিত হয়ে উঠবে...সেই সুসময়ের অপেক্ষায় প্রহর গুণি আমরা একবুক আশায় বুক বেঁধে...মধুর যাপনের অদূর সম্ভাবনায়...মানুষের ভালোবাসার তপ্ত নিঃশ্বাসের নৈকট্যে...প্রীতির হাতে নির্ভয়ে হাত রেখে, বহতা জীবনের রম্যবাতাসে... আমাদের মেয়ে অভয়ার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচারের দাবিতে জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ আলোর মুখ দেখবে নিকট ভবিষ্যতে, এ আমাদের সবার একনিষ্ঠ কামনা...

নিত্য আসে ভেসে সেই ধ্বনি 
কবিগুরুর অমোঘ বাণী --
 _'আমি মৃত্যু চেয়ে বড়,_ 
 _এই শেষকথা বলে যাব আমি_ _চলে'।



মনকথা

রোদ ঝড় জলে পাপপুণ্য সব ধুয়ে মুছে লীন
শ্রাবণের অপেক্ষায় ক্রমে অগ্রসর আষাঢ়ের দিন;
পবিত্র ভাগীরথীর জল স্পর্শ করি মুগ্ধতায়
দুপুরের ফ্রেমে হঠাৎ বৃষ্টি শরীর ভেজায়।

আজও আমি মেঘকে কুড়োই অস্পষ্ট কুয়াশায়
একটু ছুঁতে চেয়ে গোধূলির আলো দু'হাত বাড়ায়,
গোপন ঝড়ের ঝাপ্টা তাড়া করে অস্থির আঠেরো
লাল শাড়ি কালো চুলে তখন তুমি সবেই পনেরো।

এখন শুধু প্রাণের গানে ভরা সুরাপাত্র খানি
নিত্য সঙ্গী কবিতায় ঝরাই হৃদয়ের গ্লানি,
শুদ্ধ জীবনে আখর পিপাসায় নিজেকে জাগাই
যাবতীয় মনকথা লিখি শুধু তোমাকে নিয়েই।


 সুরঙ্গনা, বন্ধু আমার


সুরঙ্গনা, কবেকার বন্ধু তুমি 
স্বপ্নে আসো নিশুতি রাতে,
লতিয়ে যাওয়া সবুজ আঁচল 
রবিঠাকুরের বই হাতে।

জীবনের পথে তোমাকে আমি
নিজের চেয়েও বেশি চিনি
এ আমার এক শাল অহংকার।

স্মৃতির স্ফীতকায় ঘড়া
দোল খায় পিচ্ছিল কাঁখে,
চোখের পর্দা জুড়ে ভেসে ওঠে
কবেকার সুচর্চিত মুখচ্ছবি,
মুগ্ধ যাপনের ধারাপাতে
সুবোধের আলোবীজ ঝরায়।

নক্ষত্রের তুচ্ছ আলোকরেখা
বিষণ্ণ রাতকে উদ্ধার ক'রে
জানলার পাশে শ্বাস নেয়,
সময়ের দিনলিপি মুছে দিয়ে
আদিম মনে হাওয়া বয়,
শুদ্ধ হাসির গন্ধ ভাসে
পাতাঝরা শিশিরের ঘাসে।

শব্দহীন নিয়তির রঙবেরঙে
লোভ লতানো বয়েসের ফাঁস
কেটে ফুরফুরে ইচ্ছেরা ওড়ে
নির্জন ঘরের বাদামি যৌবনে।


অশ্বমেধের ঘোড়া

 সময়ের নিঃশ্বাসে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটে নদী সাগর পাহাড় জনপদ পেরিয়ে,খুরের শব্দে কতোই না মানুষ আসে জীবনের স্রোতে, আঁকাবাঁকা পথ দূরে স'রে স'রে যায়, গতি ক্রমেই ক'মে আসে, বিকেলের আবছা আলোয়
ঠিক বয়ে চলা জীবনের মতোই।

সাগরের জলে ফেলে দিয়ে সব
ক্লেশ দুঃখ রাগ দ্বেষ সাগ্নিকের বেশে আনন্দে বাঁচবো আরও মনকে বেসে ভালো সুবিশাল এ ধরার বুকে।
সঞ্চিত অভিজ্ঞান যত্নে রেখে দেব' 
আগামী প্রজন্মের শিক্ষার আয়োজনে।

আজ নেই আর স্মার্ট বেশ, বরফ কুচিতে ঢাকা স্বল্প কেশ তবু আছি বেশ, এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ব্যর্থ অন্বেষায়।

আমরা সবাই বাঁধা নিয়তির আলিঙ্গনে 
শুধু জানি জন্ম থেকেই এগিয়ে চলার মন্ত্র, পশ্চিম আকাশে দেখি রক্তের আলপনা, সূর্য ডোবে সন্ধ্যের গহ্বরে, তারার মেলায়, শেষ রাতে আলো আসে প্রৌঢ় শয্যায়, সব অ-সুখ ভুলে আবার ঘোড়া ছোটে বেঁচে থাকার এক অতৃপ্ত কামনায়,আদতে সবাই আমরা ভালো থাকার পথে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি ফেলে আসা দিনের তর্পণে অনিত্য এ জীবনের পথে সুজনের শুভেচ্ছায় সুস্থ শরীরে যাপনের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায়...

Post a Comment

0 Comments