জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি -৫০ পর্ব /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

রোমের কালোসিয়াম

বার্লিনের ডায়েরি   
৫০ পর্ব      
 চিত্রা ভট্টাচার্য্য 
(রোমের পথে  কলোসিয়ামের শেষ অংশ )

শারদীয়া দুর্গোৎসবের বাঙ্ময় উজ্জ্বলতা তিনদিন ধরে  রাতের আকাশে আসর জমিয়েছিল আজ বেলাশেষের গোধূলির ধূসরিমায় বাতাস মথিত করে তার অবসানে চতুর্দিকে বিষাদের সুর বাজচ্ছে । নীলকণ্ঠ পাখি ও কৈলাসে উড়ে গিয়েছে। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় বিদায়ীবেলার ঢাকের আওয়াজের করুণ সুরের বোলে দিগন্ত কাঁপিয়ে বেজে উঠে সব হারানোর দীর্ঘশ্বাস।     শ্রী ও উৎসব শেষে ডুব দিয়েছিল পুরোনো সময়ের   সাগর তলে। ওর কলমে বারবার বিরতিতে মন ডায়েরির পাতা ছেড়ে বিজয়ার শুভেচ্ছা আশীর্বাদ কুশল সংবাদে ব্যস্ত। সন্ধ্যের শেষে রাত গড়ালে শ্রী লেখার টেবিলে কলম নিয়ে রাইটিংপ্যাডের সাদা কাগজে মনোনিবেশ করলে কি হবে ? তখন আবার বাজলো মিষ্টিসুরের রিংটোন।    
                                                                                                                                                                              ও প্রান্ত থেকে রিনরিনে মধুর হাসিতে মুখরিত পরিবেশ।  মন ভোলায় আসানসোল থেকে ছোট্ট মিষ্টি রাইসোনার একরাশ অভিযোগ , ফুলদিদুন গো ! তুমি একেবারে ভুলে গেছো আমাকে ?  সেই যে রোমের কলোসিয়ামের গল্পের শুরু টুকু মাত্র শুনিয়েছিলে ।  তারপর শুধু পথ চেয়ে বসে আছি। তুমি এলে না,গল্প ও শেষ করলে না। 
 ঠিক বড়োদের বকুনির গলা নকল করে রাইসোনা ওর ফুলদিদুন কে কপট ধমক লাগায়। আজকাল কাজে মন নেই শুধু ফাঁকি বাজি শিখেছো ? 
শ্রী হাসি চেপে বলে এই বারে মোটেই ফাঁকি দেবো না। প্রমিস করছি রাইসোনা কে পুরো গল্প টা যত তাড়াতাড়ি পারি লিখে শোনাবোই । 
রোমের স্থাপত্য

 শ্রীর লেখার জগতে সর্বকনিষ্ঠা পাঠিকা বা মুগ্ধ শ্রোতা ক্ষুদে রাইয়ের ইতিহাসের গল্প ভারী প্রিয়। তার মন গড়া উদ্ভাবনী শক্তিতে তখন হাজার প্রশ্ন। যার উত্তর শ্রীর মোটেই জানা নেই ,বেশীর ভাগ  সিলেবাসের বাইরে।আজকাল নানা কারণে সময় হয়ে ওঠেনা। মেয়ের তাই ভারী অভিমান। কী করে ওকে বোঝায় ইতিহাসের এত বিশাল কাহিনী কে ঠিক মত লিপিবদ্ধ করতে ওর ফুলদিদুনের অবস্থা ও বেশ কাহিল। বিশাল রোমসাম্রাজ্যের পরতে পরতে ছড়ানো সহস্র ঘটনার ঘনঘটা। ছোট্ট রাইয়ের পছন্দ মত করে গল্প সাজানোর সময় কোথায় ?

  রাত গভীর। পড়ার টেবিলে শ্রীময়ী কলম হাতে পাড়ি দিয়েছে অতীতের তীরে সেই কবে দেখা কলোসিয়ামের গ্যালারিতে। সামনে খোলা রাইটিং প্যাডের পাতা। ওর মানস চোখে ভেসে উঠছে সেই মর্মান্তিক দৃশ্য। রণক্লান্ত যোদ্ধাদের দীর্ঘশ্বাস বইছে অনবরত। আর্তের হাহাকারে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে বধ্যভূমির আকাশ। ক্ষত বিক্ষত গ্ল্যাডিয়েটরের হাপরের মত হাঁপানো বুকের ওঠানামা থেকে নিঃশব্দে ফিনকি দিয়ে তাজা রক্তস্রোতের নদী বইছে প্রেক্ষাগৃহের শ্বেতশুভ্র মঞ্চ ঘিরে। কিংবা কোথাও যেন দেখতে পেয়েছিল বরফ কঠিন শীতলতায় অসমসাহসী বীর যোদ্ধার দেহ কোষের ক্ষত থেকে বিন্দুবিন্দু রক্ত ফোঁটা চুইয়ে পড়ে জমাট বাধঁছে শ্বেত মর্মরের পাষাণবেদীতে ।                 
🍂
  সেদিন কলোসিয়াম ঘুরে দেখার সময় রিকার্ডো সাহেব রোমের প্রাচীন কাহিনী বিশদ ব্যাখ্যা করে নিখুঁত ভাবে বোঝাতে গিয়ে ভাবছিলেন এখানে উপস্থিত শ্রোতারা সবাই তার স্টুডেন্ট। এবং এটাও ভীষণ সত্যি অদৃশ্য এক মায়াজালে ওরা সবাই কলোসিয়ামের কাহিনীর প্রতি মন্ত্রমুগ্ধের মত আকৃষ্ট হয়েছিল। মনে আছে তিনি বলেছিলেন ,কলোসিয়ামটি ক্রমশ গড়ে উঠেছিল অপূর্ব সুন্দর ডোরিক আয়নিক এবং কোরিয়েন্থিয়াম স্থাপত্য শৈলীতে। এখানে প্রথমার্ধে শোভা পেতো স্টাকোর কাজের শিল্প নিদর্শন। যদিও এখন সবই অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।  শুধু তাই নয় শ্রীময়ী জানে অসংখ্য স্থাপত্য নমুনা জেরুজালেমের অন্যতম প্রধান ইহুদি মন্দিরের বিপুল সম্পদের একটি বিরাট স্থাপত্য অংশ নির্বিচারে লুট করে কলোসিয়ামের বহিরাংশের দেওয়ালের শোভা সমৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও কালের নির্মম চক্রের আবর্তনে একদিন এই রোমান সাম্রাজ্যের ও পতন অবশ্যম্ভাবী হওয়ায় তখন এই এর ওপরে ও লুন্ঠন অত্যাচার ভাঙচুর চলেছিল। এবং এর দেওয়াল থেকে সব মূল্যবান মূর্তি ও ভাস্কর্য্য গুলো একে একে লুঠ হয়ে যাওয়ায় সেখানে রয়েছে তার অজস্র ক্ষত চিহ্ন। 

শ্রী ভাবছিল ছাদ বিহীন রঙ্গমঞ্চের বিশাল ইমারতটির মধ্যে একটা কঠিন হিংস্রতা রয়েছে যা অন্য ঐতিহাসিক ইমারত গুলোর মত শুধু সমীহ জাগায় না গায়ে কাঁটা দেওয়া ভয় ও জাগায়। আলেক্সেই ও কোর্ডিলিয়ার সাথে ঋষভ গভীর অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে অভ্যন্তরে ঘুরে দেখতে ব্যস্ত। ওরা শুধু যে ম্যাক্সপ্লাঙ্কের পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক নয় যেন রোমাঞ্চকর অতীত ইতিহাসের প্রতি ও সমান আগ্রহী। 
নীচের দিকে কিছুটা সময় কাটিয়ে চওড়া সিঁড়ি বেঁয়ে অদ্রিজা ও কোর্ডিলিয়ার সাথে শ্রী উপরে উঠে দেখে এই অফসিজিনে ও অসংখ্য দর্শনার্থীর যথেষ্ট ভীড় জমে আছে । শ্রীময়ীর মনে পড়ে এখানেই কোথাও এক   প্রাচীন ঐতিহাসিক সামগ্রীর সংগ্রহ শালায় ও  দেখেছিল সেকালের যুদ্ধরত রোমান বীরদের ধাতব মূর্তি,  তাদের ব্যবহৃত বর্ম ঢাল, তরো য়াল,শিরস্ত্রাণ ,অস্ত্রশস্ত্র পোশাক আশাক, তৈজস পত্র ইত্যাদি।  
গ্ল্যাডিয়েটর

সেযুগে স্পার্টাকাসের ক্রীতদাস সৈনিকদের হাতে রোমান সেনাদের লড়াইয়ের জন্য যে বিশেষ ধরণের একটি ঢাল ব্যবহৃত হতো তাকে  'স্কুটুম ' বলা হতো । যেটি ছিল বিশেষ ধরণের তরোয়াল ও বটে , বেশ চওড়া হলেও মাত্র দেড়ফুটের মত লম্বা যাকে গ্ল্যাডিয়াস বলা হয় এবং যোদ্ধাদের গ্ল্যাডিয়েটর। এরা আদতে ছিলেন অসমসাহসী বিশাল বলশালী বীরযোদ্ধা। এদের বীরত্ব দেহ সৌষ্ঠব, চেহারার গরিমা অবশ্যই নজরে পরার মত। শোনা যায় তৎকালীন রাজমহিয়সী রানীরাও এই ক্রীতদাস গ্ল্যাডিয়েটর দের চেহারার প্রেমে পরে রাজ রাজত্ব সুখ হেলায় বিসর্জন দিয়ে তাদের জীবন সঙ্গী করে সুযোগ বুঝে প্রাসাদ ত্যাগ করে পালাতেন। কিন্তু  রাজার গুপ্তচর বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে পলাতক রানী ও প্রেমিক গ্ল্যাডিয়েটর টি দুজনেই রাজার আদেশে নির্দয় ভাবে হিংস্র উপোসী  পশুর খাদ্যে পরিণত হতো। তাদের ভবলীলা শেষ হতে বেশী সময় লাগতো না।
শ্রী বলে ইতিহাসে পড়েছি আফ্রিকা থেকে ধরে আনা বেশীরভাগ এই দাস বন্দি যোদ্ধাদের লড়াই করার জন্য বিশেষ ধরণের গ্ল্যাডিয়েটর স্কুল ছিল লুদুস ম্যাগনাস। এই স্কুলে সামরিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।  রোমানসম্রাট ও তার অনুচর বৃন্দ ও পরিষদ বর্গের এবং রোমান সৈন্যদের বিকৃত রুচির উল্লাসের বায়না মেটাতে গিয়ে এখানে কত অসংখ্য মানুষের যে অকাল আত্মবলিদান হয়েছে তার হিসেব নেই।

 রিকার্ডোর কৌতুহলী চোখ চারদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলেছিল , ঐ দেখ  এমফিথিয়েটারের প্রদর্শনের বড় স্টেজ টিকে ঘিরে গ্যালারির মত দর্শক আসনের বেশীর ভাগ অংশ থেকে শ্বেত মর্মর পাথরের অংশ কেমন লুঠ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছোট্ট একটি জায়গায় শ্বেত প্রস্থরে আবৃত অংশটি এখোনো অটুট রয়েছে। মঞ্চটির কেন্দ্রস্থলে মাটির ওপর ইট দিয়ে তৈরী মুক্ত ছাদের অনেক কুঠুরি ও সুড়ঙ্গ ছিল যা এখন সম্পূর্ণ জরাজীর্ন অবস্থায় এক ক্ষয়িত ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। অদ্রিজা উদাস চোখে তাকিয়ে বলে মনে পড়ছে অনেক দিন আগে দেখা গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমাটিতে মানুষের রক্ত ক্ষয়ী বীভৎস অত্যাচারের দৃশ্য এবং মৃত্যুর যন্ত্রনা নিয়ে আর্তনাদে আতঙ্কিত যুদ্ধ বন্দী ক্রিতদাস দের নিয়ে সম্রাট ও তাঁর তোষামোদকারী দর্শকবৃন্দের অট্টহাসি আমোদ উল্লাসের কুৎসিত দৃষ্টিকটূ অমানবিক চিত্র। 

 শ্রীর লিখতে বসে এতদিন পরেও মনের মুকুরে ভেসে ওঠে রিকার্ডো সাহেবের বর্ণনায় আঁকা এক জীবন্ত দৃশ্য। ও সেখানে স্ট্যাচ্যুর মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল এতো মানুষের জমায়েত তবু ও এক শ্বাসরোধ করা নৈঃশব্দ বিরাজিত। শুধু তোরণের গবাক্ষ ভেদ করে শীতল বাতাসের নিরন্তর শোশো বহমানতার শব্দে অত্যাচারিত অতৃপ্ত বিদেহী আত্মার হাহাকারের ক্রন্দন ধ্বনি দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে গুমরেমরে নিশার আকাশে আলোড়ন তোলে একতলা থেকে চারতলার ধাপে ধাপে। তিনি দেখিয়েছিলেন,ঐ যে নীচে চারদিক ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট কুঠুরীগুলো সেখানে অভুক্ত হিংস্র পশুদের মজুত করে রাখা হতো। ওখানেই কাঠের পাটাতন বিছিয়ে ডিম্বাকৃতির বিশাল বড় স্টেজটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভাবলে তাজ্জব লাগে ক্রীড়া প্রদর্শন কালে কাঠের তৈরী লিফ্ট বা মোটা দড়ির  সাহায্যে নীচের কুঠুরি থেকে কৌশলে হিংস্র পশুদের প্রদর্শনী স্থলে এনে লেলিয়ে দেওয়া হতো  এবং গ্ল্যাডিয়েটর অথবা মল্লযোদ্ধা, ক্রীতদাস বা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী যুদ্ধ বন্দী দাসদের। তাদের এই  স্টেজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো। ক্ষুধার্থ  হিংস্র পশুদের সাথে মানুষের অসম লড়াইয়ের অনুষ্ঠিত   দৃশ্য টি ভাবলেই মন স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজার খেয়ালে কখনো লড়াই লাগানো হতো দুটি উন্মত্ত ক্ষুধার্থ পশুর মধ্যে। দুই গ্লাডিয়েটরের মধ্যে চলত এক হিংস্র লড়াই ,দর্শকদের কাছে যা ছিল অতি উত্তেজক ও উপভোগ্য। এমন কি নির্বিবাদে এই কলোসিয়ামে বন্দী অপরাধীদের কোনো প্রকার অস্ত্র ছাড়াই তুলে দেওয়া হতো হিংস্র পশুর মুখে।  

অদ্রিজার স্মৃতি চারণে চোখের ওপর ভেসে উঠেছিল কৈশোরে বহুবার পড়া রাজবন্দী দাসএন্ড্রক্লিস ও সিংহের রোমহর্ষক গল্প টি। ও আলেক্সেইয়ের কাছে শুনেছিল কলোসিয়ামের পটভূমির নেপথ্যে সত্য ঘটনা অবলম্বনে ঐ এন্ড্রক্লিসের সেই বীরত্বের কাহানি টি গড়ে উঠেছিল। কোর্ডিলিয়া বলে  অবাক লাগে ভাবতে এই যুদ্ধবাজ হিংস্র রক্ত লোলুপ মনুষ্যকুল  আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। কত বিবর্তন পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে  আজ বর্তমান পৃথিবীর সুসভ্য নাগরিক হয়েছি কিন্তু খেয়াল করলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে রক্তের ধারায় এখনো সেই বর্বরতার হিংস্রতার স্রোত বইছে।   

  প্রত্নতত্ত্ববিদ একটু হেসে,অদ্রিজা ও কোর্ডিলিয়া কে লক্ষ্য করে বললেন পুরোনো ধুলো মাখা ইতিবৃত্তের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো ও তথ্য সংগ্রহ আমার কাজ। ইয়ং লেডি তোমরা কি জানো সম্রাট ট্রেজানের সেই ঘটনাটি ? তৎকালীন সময়ে সম্রাট ট্রেজান ১০৭ খ্রীষ্টাব্দে যে লড়াইয়ের আয়োজন করেছিলেন --কল্পনা করতে পারো সেই লড়াইটি চলেছিল  ১২৩ দিন ধরে। ১০হাজার গ্লাডিয়েটরের সঙ্গে ১১হাজার হিংস্র উন্মত্ত পশুর লড়াই চলেছিল যাকে ভেনাসিও বলা হতো। যুদ্ধ বন্দি কৃতদাস দের মরণ পণ লড়াই কে মুনেরা বলা হতো এবং এই লড়াই শেষ পর্যন্ত্য চালু থাকতো যতক্ষণ না দুই যোদ্ধার মধ্যে কোনো একজন ক্ষত বিক্ষত হয়ে মৃত্যু বরণ করতেন।  শুধু এখানেই শেষ নয় লড়াই চলাকালীন কোনো গ্ল্যাডিয়েটর আহত রক্তাক্ত হয়ে পরে গেলে তার রক্ত মাখা দেহ দেখে রাজা ও অমাত্য গণ ব্যাপক উল্লসিত হতেন। তাদের বিকট উল্লাসের  ধ্বনি ছড়িয়ে পড়তো কলোসিয়ামের প্রতিটি কোণে   কোণে খিলানে দেওয়ালে । রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত ৬৫ হাজার দর্শক সহ সম্রাট অমানবিক উৎফুল্ল হয়ে কলহাস্যে এই পাশবিক ক্রীড়া উপভোগ করতেন। 

এ খেলায় সে যুগের নিয়ম ছিল মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে ক্ষত বিক্ষত গ্ল্যাডিয়েটর শেষ মূহুর্তে তার বাঁ হাত টি তুলে সম্রাটের করুণা দয়ায় প্রাণ ভিক্ষা চাইতেন।  কিন্তু তার অন্তিম আর্জি সম্পূর্ণ নির্ভর শীল ছিল সম্রাটের মেজাজের ওপর। তিনি দয়ার পরবশ হয়ে বামহস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি যদি উপরের দিকে তোলেন ,তাহলে সে যাত্রায়  যুদ্ধ থেমে যায় ,এবং মৃত্যু পথ যাত্রী ও বেঁচেযায় । কিন্তু মোদিরা আসক্ত  উন্মত্ত রাজা রক্তের নেশায় তখন উন্মাদ। দর্শকের চিৎকারে লড়াই বন্ধ করার আদেশ দিতে অপারগ হতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অঙ্গুলি উর্দ্ধে তোলার বদলে নিম্ন ভূমির দিকে চালিত করতেন। অর্থাৎ সম্রাটের উৎফুল্লতা উল্লাসের বিনিময়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হোত পরাজিত গ্ল্যাডিয়েটর কে। 

এতক্ষন শুধুই ভিতরের দেওয়ালগুলো ওরা দেখছিল। এবার আলেক্সেই কলোসিয়ামের বাইরে উত্তর দিকের দেওয়ালের এক অংশ দেখাতে নিয়ে এলো। বিশাল ধ্বংস লীলা ও লুঠেরা দের হাত থেকে এই  অংশ টুকু আজ ও স্পষ্ট এবং সহজেই অনুমান করা যায়  শিল্প সৃষ্টির আদিতে কত নিখুঁত কত নিপুনতা দিয়ে এই শিল্প অপরূপ শোভা মন্ডিত  ছিল।  কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই ইমারতের ক্ষয় ক্ষতি দেখা দেয়  যেমন ২০৭সালে বাজ পরে এর সর্বোচ্চ তলের সর্বাপেক্ষা ক্ষতি ঘটে  এবং তেমনি ১৩৪৯ সালের প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্পে ও এই নির্মান টি বিশাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
পুরোনো রোম নগর

   প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তির সঙ্গে পঞ্চম শতাব্দীতে কলোসিয়াম যদিও পরিত্যক্ত হয়েছিল ,তবে আধুনিক সুসভ্য মানুষের লোভের পরিনামের ফলে এর  ক্ষয় ক্ষতির সীমা ক্রমশঃ বিপুলাকার হয়ে দেখা দিয়েছে। এর দেওয়াল ভেঙে পাথর এবং মার্বেল দিয়ে নিজেদের বাড়ি ঘরের শ্রী বৃদ্ধি করা এবং দেওয়াল গাত্রে যে মূর্তি টাঙানোর ব্রোঞ্জের আংটাগুলো ছিলো তাও খুলে নেওয়া হতে থাকে। এই কারণে কোলোসিয়ামের বাইরের দেওয়াল গাত্রে যে অসংখ্য ছিদ্র দেখা যায় এ তারই  লুঠের চিহ্ন।   বর্তমান দুনিয়ায় এ চৌর্য্যবৃত্তি সুসভ্য নাগরিকের চরম লজ্জা ছাড়া আর কিছুই নয়। শ্রী  ভাবছিল ইউরোপের মত সুসভ্য দেশে এমন টি ও ঘটে। কলোসিয়াম দেখা শেষ হোলো , রিকার্ডো সাহেব  বিদায়ী জানিয়ে এক নিরিবিলি কোণ খুঁজে নিয়ে পিঠের ঝোলা থেকে কাগজ পেন্সিল ড্রইং বোর্ড বার করে ছবি আঁকতে বসলেন।
                                             এক ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কলোসিয়াম থেকে বেরিয়ে  ওরা দেখলো তোরণ দ্বারটির সামনে দর্শকের ভীড় জমে গিয়েছে। পালোয়ানদের গ্ল্যাডিয়েটর সেজে ট্যুরিস্ট দের সাথে ছবি তোলা চলছে যুধ্বংদেহী পোজে জমকালো অস্ত্র হাতে। সাজ যদিও যোদ্ধার কিন্তু দাঁড়ানোর চেহারা গ্ল্যাডিয়েটরের মত নয় এবং হাতে ধরা অস্ত্র টি টিনের ওপর রঙ করা খেলনার ঢাল তরোয়াল। অস্ত্রটি মোটেই ধারালো নয়।                 ক্রমশঃ

Post a Comment

1 Comments

  1. লেখার মাধুর্যে আর কারুকার্যে প্রস্ফুটিত ইতিহাস। যেন চাক্ষুষ দৃশ্য পট।

    ReplyDelete