হ্যাপি ১৪ শাক, ১৪ পিদিম...
সীমা বন্দ্যোপাধ্যায়
হ্যালোইন আর ভূত চতুর্দ্দশী সাধারণতঃ এক দিনেই পড়ে। কাজেই সন্ধ্যে সাতটা থেকে নটার মধ্যে টিকিরি টিকিরি করে ছোট ছোট বাচ্চাদের ক্যান্ডী দেওয়ার পর আলো নিভিয়ে ঘরে এলাম। খুব সুন্দর সাজে আসে ওরা। বিশ্বাস -এই দিনে ভূতেরা মর্ত্যে নেমে আসে। দুপুরে চোদ্দ শাক ভাজা খেয়ে, সন্ধ্যায় চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে, দরজায় চোদ্দ ফোঁটা দেওয়ার এই রেওয়াজ আমাদের বাড়িতে বহুদিনের। হিন্দু পুরাণে থাকলেও ভূত চতুর্দশী একান্তই বাঙালির উৎসব বলা চলে। কারণ বাঙালি ছাড়া অন্য অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে ভূত চতুর্দশী উদযাপন করার প্রচলন শোনা যায় না। দানবরাজ বলির পৃথিবী সফরকে কেন্দ্র করে উৎসব চলে ভারতের কেরালাতেও। তবে এই উৎসবে ভয়ের বদলে থাকে আনন্দ।
হঠাৎ সুদূর নিউ ইয়র্ক থেকে মিষ্টি গলায় ছোদ্দির ফোন। “খাওয়া হয়েছে, সীমু? গল্প শুনবি না?"
মেজদিদিয়া তারা হবার পর ছোদ্দি এই কাজটা করে। বল্লাম, "না খাচ্চি। এই তো সবে সব আলো নিভিয়ে ঘরে এলাম। খেয়ে নিচ্ছি তাড়াতাড়ি। খাওয়া শেষ হলেই ফোন করব।"
যদিও ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে। তাও বড়রা কেউ বললে-খুব ভালো লাগে আমার।
আমাদের ডালাসের সময় থেকে নিউ ইয়র্ক এক ঘন্টা এগিয়ে -তাই ওদের(বড় ছেলে, বৌমনি, দুই নাতি নাতনি(১২, ১৬) ডিনার শেষ। আমরাও দুপুরে চোদ্দ শাক, আর রাতে চোদ্দ পিদিম দিয়ে ডিনার সেরে নিলাম। নিয়ম মত সব পাওয়া না গেলেও কিন্তু জমে গেল চোদ্দ শাক। ফোন গেল ওয়াশিংটন (ছোদ্দির ছোট ছেলের বাড়ি, তারাও রেডি দুই(৭-৯) কচিকাঁচা নিয়ে। বাচ্চারাও শুনতে খুব ভালোবাসে।
শুরু হল গপ্পঃ
এক গ্রামে খুব গরীব এক বামন আর বামনি বাস করে। তারা কোন রকম ভিক্ষা করে দিন গুজরান করে। পাঁচটা বাচ্চা আছে তাদের। খুবই কষ্টে সংসার করে বামুন বামনি। একটা মাত্র ঘর আর তার লাগোয়া একফালি বারান্দা। বৃষ্টি ঝড়ে প্রায় জেগেই কাটাতে হয় তাদের।
একদিন কাকভোরে বামুন যখন ঝোপের আড়ালে প্রাতঃক্রিয়া সারছিল, তখনও দিনের আলো ফোটে নি ঠিক মতন। ...ঠিক সেই সময় বামুন শুনতে পেল নাকি সুরে কারা যেন বলছে ঝোপের মধ্যে থেকে...
"হ্যাঁদেরে বাঁমন হ্যাঁলেঞ্চা
কাঁঠি দিঁয়ে দাঁত ছ্যাঁলেঞ্চা-
কুঁনিকে বঁলিস বুঁনির ব্যাঁটা হয়েঁছে।"
কুনি (ঘরের কোণের পেত্নি) আর বুনি (বনের পেত্নী)। তারা দুই বোন।
বামুন বেচারা কোনো রকমে নিজের কাজ সেরে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি এসে দেখে... ঘুম থেকে উঠে গেছে সবাই। বাচ্চারা খিদের জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে আর তার সাথে তাদের মায়ের পরিত্রাহি চিৎকার। তাদের থামানোর জন্য বামুন সবাইকে ডেকে বলল, “আজ সবাইকে একটা দারুণ গল্প শোনাবো। চুপ করে এসে শোন সেই গল্প।
জানিস তো ?আজ ভোরে যখন প্রাতঃক্রিয়া সারতে গেছিলাম, সেই সময় ঝোপের আড়াল থেকে আমি শুনি -কারা যেন নাকি সুরে বলছেঃ
"হ্যাঁদেরে বাঁমন হ্যাঁলেঞ্চা
কাঁঠি দিঁয়ে দাঁত ছ্যাঁলেঞ্চা-
কুঁনিকে বঁলিস বুঁনির ব্যাঁটা হঁয়েছে।"
...ঠিক সেই সময় তাদের নোংরা ঘরের চার কোণ থেকে চারটে ভূত উঠে উদ্দাম নৃ্ত্য করতে করতে বলতে আরম্ভ করেছে...
"হ্যাঁ রেঁ বাঁমুন, তুঁই কিঁ বঁললি?
হ্যাঁদেরে বাঁমন কিঁ বঁললি-?
ওঁ বাঁমুন তুঁই কিঁ বঁললি?
হ্যাঁদেরে বাঁমুন কিঁ বঁললি?"
কাঠি কাঠি হাত পা -ওয়ালা আর ড্যাবডেবে জ্বলন্ত চোখ জ্যান্ত ভূতদের দেখে তো বাচ্চারা সব ভিরমি খেয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। বাচ্চাদের মা তো গোঙাতে লেগেছে। বামন একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। তখন ভূতেরা বলে...
"কোন ভয় নেই বামুন। আমরা তোর এই ঘরের চার কোণে থাকি। তোর বৌ খুউব নোংরা। তাই আমরা এখানে বাসা করে আছি। আমরা আজ চলে যাচ্ছি তোর মুখে এই সুখবর শুনে। তুই আমাদের বনের বোনের ছেলে হবার খবর দিয়েছিস। তাই তোকে আমরা উপহার দিতে চাই, মানে তোর ভাল করতে চাই। এখন আমরা যা বলি তা মন দিয়ে শোন।"
বামুন তো ব্যাঙের মতো মস্ত হাঁ করে...ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। কিন্তু কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। তখন না শুনে তো উপায় নেই। ভূতেরা শুরু করল...
"কাল ভূত চতুর্দ্দশীর দিন। তোর বৌকে বলবি চারিদিক পরিষ্কার করে রাখতে। ছেলে মেয়েদের ভাল করে চান করিয়ে, নিজেরাও ভালভাবে চান করিস। তারপর ভিক্ষে করে তেল, সাবান আর চোদ্দ শাক এনে খাবি দুপুরবেলা। চোদ্দ পিদিম দিতে বলবি সন্ধ্যেবেলা। মাটি দিয়ে পিদিম গড়ে নিস। কোথা থেকেও চেয়ে চিনতে একটা চট এনে তাকে থলির মতন করে বামনিকে সেলাই করতে বলবি। তারপর সেই থলিতে ইঁট-পাটকেল সব ভরে নিবি, বুঝলি? গভীর রাতে সেই থলি কাঁধে ফেলে শ্মশান -এর দিকে এগিয়ে যাবি তুই একা, কেমন? দেখবি অনেক ভূতের মেলা বসেছে। ভয় খাস নি যেন আবার। সেখানে তাদের মত করে দাঁড়াবি থলিটা মাটিতে রেখে।
সেই অমাবস্যার রাতে যারা বিশাল লাইন করে নিজেদের ঝোলা মাটিতে রেখে ক্ষিঁ ক্ষিঁ, ক্ষ্যাঁক ক্ষ্যাঁক হাসিতে মাতিয়ে রাখবে তাদের সাথে গিয়ে দাঁড়াবি। ...ঠিক সেই মুহূর্তে ভূতেদের সর্দার আকাশ ছোঁয়া যার শরীর সবাই কে পিন্ট অফ সাইলেন্ট হয়ে দাঁড়াতে বলবে...আর ১০০০ বজ্রের মতন হুঙ্কার ধ্বনিতে সবাইকে বলবে তাঁর আদেশ ঠিক ঠাক পালন করতে ।
সর্দারের কথা যেই না তিনবার শেষ হবে তুই তোর সামনের ভূত বা পেত্নির একটা ঝোলা নিয়ে পোঁ পাঁ দৌড়ে একেবারে সোজা বাড়িতে ফিরে আসবি। এসে দরজা বন্ধ করে তারপর যা করার করবি । পেছন ফিরে ভুলেও তাকাবি না কিন্তু। তাকালেই কিন্তু মহাবিপদ তাই আমাদের কথা শুনলে দেখবি... তোদের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে।"
... এই বলে ভূতেরা চলে গেল। বামুন সবার মুখে জলের ছিটা দিলে তারা উঠে বসল। বামন বামনী সব খুলে বলল। তারপর ভূতেরা যা যা বলে গেছিল পরের দিন তাই তারা করল। সন্ধ্যেবেলা বামুন কাঁধে চটের থলি নিয়ে শ্মশান এর দিকে এগিয়ে চলল।
ওখানে ভূতেরা যা যা বলেছিল সেই মতো সব করল।এইবার ভূতেদের সর্দার এসে শুরু করল...
..."- দাঁড়াও হেঁ ভাঁই শ্যাঁম হঁয়ে
মাঁটির ঝোঁলা কাঁধেতে থুঁয়ে
- দাঁড়াও হেঁ ভাঁই শ্যাঁম হঁয়ে
কাঁধের ঝোঁলা মাঁটিতে থুঁয়ে
-দাঁড়াও হেঁ ভাঁই শ্যাঁম হঁয়ে
মাঁটির ঝোঁলা কাঁধেতে থুঁয়ে"...
তিনবার বলার পরেই ভূতেদের কথামত সামনে থেকে একটা থলি নিয়ে চোঁ চাঁ দৌড় বাড়ির দিকে। ভূতেরা তো তখন নানা রকম অদ্ভুত সব আওয়াজ করে ওর পিছন পিছন দৌড়োতে শুরু করেছে। কিন্তু বামন আর পিছন ফিরে তাকায় নি। সোজাআআআ নিজের বাড়ির দরজার কাছে এসে "ও বামনি দরজা খোল"- বলে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ।
একটা লম্ফ জ্বেলে বামনি জেগেই ছিল ...বামুনের গলা পেয়েই দরজা খুলে বামুনকে ধরে ঘরে নিয়ে এল। চোখে মুখে জলের ছিটে দিলে বামুন একটু সুস্থ হল। ওরা তখন থলি খুলে লম্ফের আলোতে দেখে হিরে, মনি -মাণিক্য-এর দ্যূতিতে একেবারে ঘরের চারিদিক আলোকময়। বামুন বামনিকে বলল, “কাউকে এসব কথা বলিস না বামনি। বাচ্চারাও যেন জানতে না পারে, বুঝলি? ভোর হবার সাথে সাথেই আমি এক টুকরো সোনা নিয়ে স্যাকরার দোকানে যাব। আর ভাঙ্গিয়ে সব দরকারি জিনিস কিনে আনব। ভূতগুলো আমাদের সব দুঃখ দূর করে দিল রে বামনি।”
ব্যাস! পরের দিন বামুন দোকানে গিয়ে সেই সোনা ভাঙ্গিয়ে যাবতীয় দরকারি সব কেনাকেটা করে আনল। এখন তো অনেক পয়সা। তাই সেসব দিয়ে খুব সুন্দর রাজপ্রাসাদের মত বাড়িও বানিয়ে ফেলল।
রাজার কানে খবর গেল।
"কী! এতবড় আস্পর্ধা! আমার চেয়েও বড় রাজপ্রাসাদ। ধরে আনো বামুনকে। নিশ্চয়ই চুরি ডাকাতি করে এই রাজপ্রাসাদ বানিয়েছে।"
দেশের রাজার হুকুম... কাজেই সেপাইরা গিয়ে বামুন কে ধরেবেঁধে নিয়ে আসল। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বামুন বেচারী তো হাত জোড় করে এসে রাজার সামনে দাঁড়াল।
"কী ব্যাপার রাতারাতি এত বড়লোক হলে কি ভাবে? সমস্ত সত্যি কথা খুলে বলো, নয়ত তোমার গর্দান যাবে।" রাজা কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন করল বামুনকে।
বামুন কথা বলবে কি? সে তো কেঁপেই চলেছে। তাও মনে একটু সাহস এনে হাত জোড় করেই বলতে শুরু করল। বামুন সেই প্রথমদিন থেকে শেষ অবধি সব গল্প করল রাজার কাছে। বামুনের মুখে সব গল্প শুনে রাজা খুব খুশি হল। বামুনকে কিছু সোনার মোহর দিয়ে বিদায় করল। আর চোদ্দ শাক কি কি জেনে নিল বামুনের কাছে।
পালং শাক, লাল শাক, সুষণি শাক, পাট শাক, ধনে শাক, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, গিমে শাক, মূলো শাক, কলমি শাক, সরষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, লাউ শাক অথবা হিঞ্চে শাক এই হল চোদ্দ শাক। আয়ুর্বেদ মতে প্রাচীন বাংলায় এই চোদ্দ শাকগুলি খাওয়া হত।
এই শাক আমিষ ও নিরামিষ রান্না করে অনেকে। আমাদের বাড়িতে হত শুধু এই শাক ভাজা।
মনে পড়ে যায় শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো। ভূত চতুর্দশীর দুপুরে এই চোদ্দশাক খেয়ে সন্ধ্যেবেলা চোদ্দ মাটির পিদিমে সড়ষের তেল দিয়ে তাতে হাতে পাকানো পলতে দিতে হত। তারপর চোদ্দ পিদিম (প্রদীপ) জ্বালানো হত। এই পিদিমগুলো আবার মাটি দিয়ে তৈরী করতে হত। তারপর রোদে শুকোতে দিতে হত। আগে থেকে করলে হত না, সেইদিনই করতে হত। উঠোনের মাঝখানে একটা পঞ্চপিদিম দিতে হত যেটা একটা মাটিরই তৈরী স্ট্যান্ডের ওপর রাখতে হত। সন্ধ্যেবেলা সব ঘরের কোণে সেই পিদিম দিয়ে বলতাম আমরা মনে আছে এখনও।
“চোদ্দ পুরুষ অন্ধকারে ছিলে... আলোয় এসো।"
ওদিকে চোদ্দ শাকের নাম গুলো তখন জানতামও না। আর জানার কোনো ইচ্ছাই ছিল না কেননা মন পড়ে থাকত বাজি গুলো রোদে দিতে হবে। কতরকম বাজি আনা হত। তুবড়ী, ফুলঝুড়ি,কালিপটকা, আতস বাজি আরো অনেক বাজী।
সব শুনে রাজা রাজ্যে প্রচার করে দিল "এবার থেকে রাজ্যের সবাই চারিদিক পরিষ্কার করে রাখবে ভূত চতুর্দশীর দিন। নিজেরাও পরিষ্কার হয়ে চোদ্দ শাক আর চোদ্দ পিদিম দিয়ে ভূত চতুর্দ্দশী উদযাপন করবে।"
তাই তো আমরা চোদ্দ শাক খাই আর চোদ্দ পিদিম দিয়ে বাড়ি ঘর আলোময় করি। ভূতেরা আমাদের যে খুব ভালবাসে ।
আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিতে কালীপূজা বা দিওয়ালি উদযাপন করা হয়। দিওয়ালির একদিন আগে চোদ্দ পিদিম জ্বালিয়ে চোদ্দ পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করে অশুভ শক্তিকে দূর করার প্রথা পালন করা হয় বলে এই দিনটাকে 'ভূত চতুর্দশী' বলে। এক সঙ্গে চোদ্দ পিদিম জ্বালিয়ে ক্ষতিকারক কীটের হাত থেকে হৈমন্তিক ফসল রক্ষা করার তাগিদে কৃষিজীবী বঙ্গবাসীকে এই উপাচার পালন করতে হত । ভেষজবিজ্ঞানীদের মতে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে এই শাকগুলি খাওয়া হয়।
কাজেই, হ্যাপি চোদ্দ শাক আর চোদ্দ পিদিম জানাই সক্কলকে। রাতে শোবার সময় চোখে কাজল দিতে যেন ভুল না হয়। কারণ, তাতে চোখদুটো খুব সুন্দর হবে।
0 Comments