দূর দেশের লোক গল্প-- ২১১
এক এক পাখির বাসা এক এক রকম
আয়ার্ল্যাণ্ড (ইউরোপ)
চিন্ময় দাশ
[দুনিয়ায় কত রকমের যে পাখি, তার ঠিক-ঠিকানা নাই। কত রকম তাদের চেহারা। কত রকম তাদের নাম। মুখের ডাকও কত রকম তাদের! এমনকি বাসার গড়নও আলাদা আলাদা। এক এক নামের পাখির,বাসার গড়নও এক এক রকম।
এক এক জাতের পাখি, এক এক রকম বাসা বোনে কেন? কেন সবাই ম্যাগপাইর মতো সুন্দর করে বাসা বুনতে পারে না? তাই নিয়ে গল্প আছে ইউরোপের পূর্ব অঞ্চলের দেশে দেশে। তারই একটি গল্প আজ শুনব আমরা।]
ম্যাগপাই নামটা যেমন সুন্দর, নিজের বাসাটিও সে বোনে ভারি যত্ন করে। মুখ ফুটে বলে না কেউ, কিন্তু অন্য অন্য পাখিদের অনেকেই তাকে ঈর্ষা করে। অথচ, মনে মনে সকলেরই বাসনা, যদি এমন সুন্দর বাসা আমরাও বুনতে পারতাম।
পাখিদের মধ্যে বেশ ছোট হোল সিসকিন পাখি। সে একবার প্রস্তাব দিল—মনে মনে আমরা সকলেই চাই ম্যাগপাইয়ের মত বাসা আমরাও বুনি। পারি না বলে, ম্যাগপাইকেই দোষ দিই। ঈর্ষা করি। এতে লাভটা কী?
অন্য পাখিরা বলল—কী বলতে চাস তুই? খোলসা করে বল। সিসকিন বলল—চলো, আমরা ম্যাগপাইর কাছে যাই। সবাই মিলে অনুরোধ করলে, সে নিশ্চয় শিখিয়ে দেবে, ভালো বাসা কী করে বুনতে হয়।
দোনামনা করলেও, শেষমেষ সবাই রাজি হোল। ম্যাগপাইর মতো পুঁচকে একটা পাখির কাছে বাসা বোনা শিখতে হবে—এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছে না। তবুও গেল সকলে।
ছোট হলে কী হবে, স্বভাবে ম্যাগপাই খুব ভালো। এতজন পাখি তার কাছে এসেছে বাসা বোনা শিখতে, ভারি খুশি সে।
সবাই বসেছে গোল হয়ে। ম্যাগপাই বলতে শুরু করল—শোন সবাই। বাসা বোনার কাজটা এমন কিছু কঠিন নয়। কেবল একটু ধৈর্য থাকতে হয়। নিজের বাচ্চার জন্যই বাসা বানাচ্ছি—এই কথাটা মনে রাখলে, ধৈর্যের অভাব হবে না।
থ্রাস ছিল সেই দলের মধ্যে। গায়ক পাখি হিসাবে ভারি সুনাম আছে থ্রাসের। কিন্তু হলে কী হবে? সুনাম আছে দেশ জোড়া-- তাই ভারি দেমাক তার। ম্যাগপাইর কাছে আসতে একেবারেই ইচ্ছে ছিল না তার। বাধ্য হয়েই এসেছে।
থ্রাস বলে উঠল—সেসব আমরা জানি। তুই কাজের কথাটুকু বল। অতো বাখানি শোনার সময় নাই আমার।
ম্যাগপাই গায়ে মাখল না থ্রাসের কথাটা। বলল—ঠিক আছে। তাই করছি। বলে, খানিকটা কাদা নিয়ে এলো। একটা গোল বাটির মতো বানাতে লাগল চেপে চুপে।
যেই না সেটা শেষ হয়ে এসেছে, থ্রাস বলে উঠল—ওহ, এই ভাবে! এ আর এমন কী কাজ। বলেই উড়ে গেল সে। পুরোটা দেখেনি, সেজন্য আজও থ্রাসের বাসা দেখতে অনেকটা একটা ধ্যাবড়া বাটির মতো।
ম্যাগপাই এবার কিছু সরু শুকনো ডালপালা নিয়ে, কাদাটার চারপাশে জড়াতে লাগল।
ভীড়ের ভিতর ছিল কালোপাখি। (অনেকটা কোকিলের মতো দেখতে। সেকারণে, তার নাম—ব্ল্যাকবার্ড।) সে বলে উঠল—এবার বুঝে গেছি। বলেই সে উড়ে চলে গেল। তাই তো কালোপাখির বাসা দেখতে কেমন খোঁচাখোঁচা।
ম্যাগপাই এবার করল কী, ডালপালাগুলোর ওপর আবার এক প্রস্থ কাদার প্রলেপ দিতে লাগল।
প্যাঁচা ছিল পাখিদের দলে। সবাই তাকে জ্ঞানী বলে মানে। বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকা তাকে মানায় না। সে বলল—বাহ,কাজটা তো বেশ সরল। আমি বুঝে গিয়েছি।
বলে, প্যাঁচা চলে গেল। সেজন্যই প্যাঁচার বাসা ভালো হয় না।
এবার আবার কিছু সরু ডালপালা নিয়ে কাদার পাঁচিলটার বাইরের দিক জুড়ে সাজিয়ে দিতে লাগল ম্যাগপাই।
--ওহ, আচ্ছা। এইভাবে বাসা বুনতে হয়! বুঝে গিয়েছি। এই বলে ঘুঘুও উড়ে গেল। সেজন্যই চিরকাল ঘুঘুর বাসা বড্ড অগোছালো।
এদিকে দেখা গেল, ম্যাগপাইর এদিকে নজর নাই। সে নিজের কাজে মগ্ন। কিছু পালক নিয়ে এল সে। বাসাটার ভিতর বরাবর ভারি যত্ন করে পালক সাজিয়ে, আরামদায়ক করে তুলছে বাসাটাকে। এবার কথা বলে উঠল স্টার্লিং। ভারি সুন্দর হয়েছে বাসাটা। খুব পছন্দ হয়েছে আমার। আর বেশি কিছু চাই না। বলে, সে উড়ে গেল। সেদিন থেকে স্টারলিঙ্গের বাসা যেমন সুন্দর আর মজবুত, তেমনি আরাদায়কও।
এভাবেই চলতে লাগল আরও কিছু সময়। এক একটা পাখি কিছুটা দেখে, আর বাসা বুনবার আদব-কায়দা শেখা হয়ে গিয়েছে, এই ভেবে উড়ে চলে যায়।
তাতে ম্যাগপাইর মনে কোন অসন্তোষ নাই। কাজটা সে করেই চলেছে। এক একজন করে প্রায় সবাই চলে গেছে, সে ভ্রূক্ষেপ করেনি। এখন একমাত্র একটা কচ্ছপ-ঘুঘুই একলা বসে আছে।
সে এবার ডেকে উঠল-- টেক টু, ট্যাফি, টেক টু-উ-উ-উ।“
কাজের একেবারে শেষ ধাপে চলে এসেছে ম্যাগপাই। তখনই ঘুঘুর ডাকটা কানে এলো তার। সে তখন একটা করে সরুমতন ডাল বেছে বেছে বসাচ্ছিল। ঘুঘুটা আবার ডেকে উঠল-- টেক টু, ট্যাফি, টেক টু-উ-উ-উ।“
ম্যাগপাই জবাব দিল—একটাই যথেষ্ট, বুঝলে। দুটোর দরকার নাই।
ঘুঘুটা আবার ডেকে উঠল আগের মতো। সে দুটো ডাল নিতে বলছে না। তার ডাকটাই এরকম। ম্যাগপাই সেটা বোঝেনি। সে বলল--আচ্ছা বেকুব তো! বললাম না, একটাই যথেষ্ট। দুটো দরকার নাই। বলেই, কাজ ফেলে মাথা তুলতেই চোখে পড়ল, কচ্ছপ ঘুঘুটা ছাড়া, এ তল্লাটে আর কেউ নাই।
ভারি রাগ হয়ে গেল ম্যাগপাইর। কাজ ফেলে, উঠে পড়ল। উড়ে যেতে যেতে বলতে লাগল—বয়ে আমার কাউকে বাসা বোনা শেখাতে। যে যেমন পারো বোন। আমার তাতে কী বয়ে যাবে!
সেদিন থেকে পাখিরা, যে যেমন পারে বাসা বানায়। কিন্তু ম্যাগপাইর মতন বাসা কেউ বানাতে পারে না।
0 Comments