সুমনা পাল
শুদ্ধোদন পুত্র সিদ্ধার্থ একদিন ঘর ছেড়েছিলেন নিজেকে জানার উদ্দেশ্যে। ছেড়েছিলেন সদ্যোজাত সন্তান, উপেক্ষা করেছিলেন সুন্দরী স্ত্রীর চোখের জল। খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন জীবনের অর্থ। বয়স তখন মাত্র তাঁর ২৯। আর এক রাজার পুত্র, তিনি মহাবীর বর্ধমান। পরমাত্মাকে জানার আকুতি নিয়ে ঘর ছাড়লেন, ঐশ্বর্য ছাড়লেন, ছাড়লেন সিংহাসন। আর আমাদের ঘরের ছেলে নদের নিমাই , বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখের জল উপেক্ষা করে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন ভগবান কৃষ্ণের পায়ে।
যুগে যুগে মানব আত্মা খুঁজে ফিরেছে জীবনের অর্থ। সেই যে পরমাত্মা যাঁর আমরা অংশ, সেই পরম মমতাময় অস্তিত্বকে আমরা মানুষরা বারবার অনুভব করতে চেয়েছি, ভালবাসতে চেয়েছি, পূজা করতে চেয়েছি, আপন করতে চেয়েছি ; কখনো দাস রূপে, কখনো বন্ধু রূপে, কখনো সন্তান রূপে ,কখনো প্রেমিক রূপে। মনে পড়ে সেই রাজরানি মীরাকে, যিনি ভগবান কৃষ্ণকে স্বামী রূপে ভজনা করেছিলেন।
সর্বজয়া আচার্য নন্দের ‘রাত্রির তপস্যা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে কেন জানিনা আমার বার বার এইসব কথাগুলোই মনে পড়ছিল।
এক সময় তিনি ঘর-পরিবার সামলেছেন,সংসার সামলেছেন, সামলেছেন কর্মক্ষেত্র। সন্তান ধারণ করেছেন, পালন করেছেন, মিটিয়েছেন জীবনের যাবতীয় লেনদেনের হিসাব-নিকাশ। আজ হয়তো সংসারের কাছে তাঁর আর নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই। সংসার সীমান্তে এসে অনুভব করেছেন নিজেকে। অনুভব করেছেন তাঁর অন্তরের গভীরে থাকা সেই পরম পিতাকে যিনি সুখে -দুঃখে ,কান্নায়- হাসিতে, প্রেমে-অপ্রেমে, আনন্দ -যন্ত্রণায় নীরবে তার সঙ্গে ছিলেন।
জীবনের গোধূলিবেলায় লেখা কবিতাগুলি কী অসীম আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ ।
কবিতাগুলো যে ভীষণ বিশ্বাসের কবিতা, আত্মসমর্পণের কবিতা, আত্ম-উৎসর্গের কবিতা।
ঈশ্বর আছেন কি নেই জানি। কিন্তু যে ঈশ্বরে বিশ্বাস মানুষকে ধৈর্য ধরতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়, ক্ষমা করতে শেখায় , মানুষকে স্খলন থেকে রক্ষা করে সেই নিরাবয়ব ভগবানকে ভালো না বেসে থাকতে পারিনা।
এই কবিতাগুলোই বোধহয় তার প্রমাণ।
তবে আজকের যুগে দাঁড়িয়ে মনে হতেই পারে এই কাব্যগ্রন্থের ভাষা হয়তো সময়ের সাথে ঠিক খাপ খায় না, কেমন যেন একটু সেকেলে। হোক সেকেলে। ‘রাত্রির তপস্যা’ পড়তে পড়তে কেন জানিনা কবি হিসাবে এমন এক লক্ষ্মীমন্ত-কমনীয়-মমতাময়ী নারীর ছবি ফুটে ওঠে, যিনি আজীবন তুলসী তলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে এসেছেন।
গোধূলি পার হয়ে সন্ধ্যে নেমেছে, ঘরে ঘরে মঙ্গলদীপ জ্বালাবার পালা, রাত্রি হবে গভীর। ঘুমিয়ে পড়বে সমগ্র বিশ্ব চরাচর, আর এক নতুন ভোরের আশা নিয়ে।
‘রাত্রির তপস্যা’ সেই নতুন আলোর দিশা দেখায়।
🍂
0 Comments