জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/ বিয়াল্লিশ তম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
বিয়াল্লিশ তম পর্ব 
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


-’মানে!!!কি বলছিস কি তুই!’
সইকে থামিয়ে চমকে উঠলেন বিরজা।আকৈশোর তিনি জানতেন,বিশু তাঁকেই…এখন শুনছেন তাঁরই প্রিয়সখীকে…কেমন যেন এক না জানা বিবমিষায় মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো যাপনঋদ্ধ মধ্যবয়সিনীর।
মুহুর্তমধ্যেই অবশ্য ফিরেছিলেন বাস্তবে,বাল্যসখী মারণ অসুখে আক্রান্ত, দেখা করতে এসেছে তাঁর সঙ্গে,হয়তো শেষ দেখাই…তাঁর জীবনও তো অস্তাচলের পথে…এখন আর এসব নিয়ে…
আজও মনে পড়ে,তারপরের খানিক সময় ধরে গ্রামবাংলার এক নিতান্ত সাধারণ প্রবাসী গৃহিণী তার জীবনে ঘটে যাওয়া উপন্যাসোপম ঘটনাবলী বিবৃত করেছিল।শুনতে শুনতে শিউরে উঠেছিলেন অনেক গল্প উপন্যাস পড়া বিরজা।পরে ভেবেছিলেন,ঠিকই তো। জীবন তো আসলে গল্পের চেয়েও বৈচিত্র্যময়,লেখক শিল্পী কবি তো জীবন থেকেই আহরণ করেন তাঁর সৃষ্টির পাথেয়…
ভাদ্রের সেই নয়নতারা ফোটা পড়ন্তবেলায়,পচা পাট থেকে উঠে আসা গভীর কুঘ্রাণ যেমন কৃষকের অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তামুক্তির সুসংবাদ নিয়ে আসে,আচরাচর মানুষ এবং প্রকৃতি আসন্ন শারদীয়া মাতৃবন্দনার প্রস্তুতিপূর্বে যেমন পিতৃপিন্ডের সুকৃতি সাধন করে,বিরজা শুনলেন এক দেবোপম মানুষের দেবোত্তর হয়ে ওঠার গল্প, এবং এক সাধারণীর দেবীত্বে উত্তরণ।
সেদিনকার সেই প্রায় বালিকা কন্যাটিকে এক ভীনদেশী পরিনত মানুষটি নাকি বুঝিয়েছিলেন, জন্মগ্রহণ অথবা জন্মদানের অধিকার যেমন আমাদের নেই, হত্যার অধিকারও আমাদের নেই।
এবং কি স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে সবকিছু জেনেও বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন,একা মানুষ;কারো কাছে কোন কৈফিয়ত দেওয়ার দায় তাঁর ছিল না। গভীর রাতে কার কাছ থেকে যেন বাবা খবর পেয়ে পৌঁছেছিলেন,তাঁর মতো করে দুজনের বিবাহ দিয়েছিলেন, একসঙ্গে শুরু হয়েছিল নতুন যৌথজীবন।বাবাও ছিলেন সঙ্গে,শেষ জীবনটি তাঁর ভালোই কেটেছিল কন্যা এবং জামাতাকে নিয়ে। 
এবং যথাবিহিত সময়ে সন্তান এসেছিল, পুত্র সন্তান,মুখে পিতার আদল স্পষ্ট। মানুষটি কিন্তু তার কর্তব্য ভোলেননি স্ত্রী পুত্রের প্রতি।কুমুও প্রাণভরে,শ্রমে শ্রদ্ধায় তার জীবনোপচার সাজিয়ে দিয়েছে তার দেবতাকে।আয়াসসাধ্য প্রচেষ্টায় দুজনে মিলে তীর্থযাত্রীদের জন্য সুলভে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দিয়ে যাত্রা শুরু।প্রথম থেকে  আজও রান্না এবং অতিথি দেখভালের দায়িত্ব একা কুমুরই।সস্নেহ পরিচর্যা এবং সুস্বাদু রান্নার গুণে কারবারে এখন সুখের রমরমা। ইতিমধ্যে ছেলেও বড়ো হয়ে কাজ বুঝে নিতে শিখেছে,বাবা সাধনোচিত নামে। কর্তা গিন্নীর ইচ্ছে হয়েছিল কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে তীর্থ যাত্রার। তারমধ্যেই এই মারণ অসুস্থতা,দেশে ফেরার ইচ্ছে,বাল্যসখীর সঙ্গে দেখা করা এবং তার সঙ্গে গিয়ে একবার অন্তত বিশুকে দেখিয়ে আসা যে এই পৃথিবীতে দানব যেমন আছে,দেবতাও আছে; পুরুষ মাত্রেই মেয়েদের ভোগ্য মনে করেনা,কেউ কেউ মেয়েমানুষকে মানুষ বলেও মনে করে।
🍂
এখনও মনে আছে,কথা কয়টি বলতে বলতে কেঁপে উঠেছিল কুমুর ঠোঁট।ভালোবাসায়,আবেগে।আর বিরজা ভাবছিলেন,কেন তাঁর জীবনটিও কুমুর মতো হলোনা!
খানিক পরে,আঁচলতলা থেকে বের করেছিল এক সদ্য যুবার ছবি, সুন্দর বেশবাস; এবং ওমা!এ যে পুরো বিশু!
স্খলিত স্বরে বলে ফেলেছিলেন বিরজা; মুহুর্তে সংশোধন করে দৃপ্ত জননীর উত্তর,
-’না।ওর নাম অনন্ত পান্ডে।বাবার নাম গিরিধারী পান্ডে,মা আমি।ও আমাদের একমাত্র সন্তান।’
-’ওকে সঙ্গে এনেছিস,সই?’
ভাবজগৎ থেকে মাটিতে পা দিয়ে মায়ের উত্তর,
-’না রে।সাহস পাইনি। তাছাড়া,কি হবে কাদা খুঁচিয়ে…ছেলে কাজকারবার দেখছে,যার আশ্রয়ে ও শিক্ষায় বেড়ে উঠেছে,তিনিই তো ওর বাবা।
খানিক  থেমে আবার বলে উঠলো,
-’আমরা কলকাতায় ডাক্তার দেখিয়ে দেশে এলাম।উনি নিয়ে এলেন, এই আমার তীর্থযাত্রা…’
-’অতো ভেঙে পড়ার কিছু নেই ভাই!’
গলা জড়িয়ে বলেছিলেন বিরজা।শুনে কুমু ম্লান হেসেছিল,
-’ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে।অনেক দিন তো বাঁচলাম রে।বলতে গেলে বাঁচার মতো বাঁচা…শেষে একবার দেখে গেলাম বাপের ভিটে, দেখা হলো তোর সঙ্গেও। আর কোন সাধ নেই।তবে একবার ঐ শয়তানটার সঙ্গে মোলাকাত করতে ইচ্ছে করছে। আমার সঙ্গে যাবি সই?’
ইচ্ছে না থাকলেও রাজি হয়েছিলেন।গার্হস্থ্য কাজ ফেলে,শেষ বিকেলের আলোটুকু পেরিয়ে আশ্বিনের ভরাক্ষেত মাড়িয়ে আবার অনেকদিন পরে দুই সখী চলেছিলেন এক অভাগার সন্ধানে;বাল্যের দুই বরবর্ণিনীর সুখসান্নিধ্য পেয়েও যে তার মূল্য দিতে পারেনি…
গ্রামের শেষপ্রান্তে অনেক দিন না আসা এলাকায় পৌঁছে দেখা গিয়েছিল, জরাজীর্ণ তার বাড়ি;কতোদিনের, অযত্নে অবহেলায় বাসযোগ্যতা হারিয়েছে প্রায়,তারই মধ্যে স্যাঁতসেঁতে ভিজে দাওয়ায় শতচ্ছিন্ন মাদুরে প্রায় লীন হয়ে যাওয়া শরীরটি নিয়ে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ,কাশির দমকে রক্ত উঠছে, দুর্গন্ধ চারিদিকে…
ভাঙাচোরা সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে দুজনের মনেই করুণা হলো।পথে আসতে আসতে মনে মনে শানিয়ে তোলা অসংখ্য প্রশ্নবানের বদলে উথলিয়ে উঠলো করুণা…এই সেই উঠোন, যেখানে কতোদিন বিশুর মায়ের মেখে দেওয়া মুড়ি নারকেল খেয়েছেন, পুকুর থেকে কাঁকড়া তুলে লুকিয়ে হাঁড়িতে জিইয়ে এনে রান্না করেছেন, পেছনের কামরাঙা গাছের টুপটুপে পাকা ফল পেড়ে…কতো,কতো যে সুখস্মৃতি ছড়িয়ে চতুর্দিকে!
কথা ছিল অভিযোগের, কিন্তু পরিস্থিতির অসহায়তায় খানিক ধাতস্থ হয়ে সামনে এগিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-’বিশু!চিনতে পারিস? আমি বিরজা। সঙ্গে কুমু’
ঘোলাটে চোখে কিছু দেখলো বলে মনে হোলনা ওদের।শুনলে শুধু গলার ঘড়ঘড়।তখনই ঘরের আঁধার থেকে দাঁত উঁচু এক শীর্ণকায় প্রৌঢ়া বেরিয়ে বলছিলেন,
-’আপনেরা কে বটেক!’
মহিলাটিকে দেখেই কেমন যেন মায়া,হল ওদের, সারা শরীর জুড়ে দুর্দশার চিহ্ন। ভগবানের বিচার হয়তো এভাবেই…ভাবতে ভাবতেই কুমু বলেছিল,
-’আমরা ওর ছোটবেলার সাথী, একসঙ্গে খেলে বড়ো হয়েছি।দূরে বিয়ে হয়ে গিয়েছে,এসেছিলাম, দেখা করতে ইচ্ছে হোল,তাই এসেছিলাম।’
-’ও!উনার অবস্থা তো ভালো নয়।আমি ভাবলাম কে না কে!’
বলেই একবার চাটাইটার দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। তাঁরা দুই সখী ন যবৌ না তস্থৌ অবস্থায় খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে ফেরার পথ ধরলেন।
পথে কোন কথা হয়নি। যে যার ভাবনায় হয়তো ডুবেছিলেন। মেঠোপথ পেরিয়ে গ্রামে ঢুকতেই এক ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক দেখে ঘোমটা টানার উদ্দ্যোগ করতেই মুখ ব্যাঁকালে সই,
-’আ মোলো যা! ওঁকে দেখে ঘোমটা কেন লা!’
-’কে?’
ফিসফিসিয়ে জানতে চাইবার আগেই দেখলেন, পরস্পর কথা বলতে শুরু করেছেন ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে, কথাবার্তার আন্তরিকতাই বুঝিয়ে দিল, দাম্পত্যের অন্তরঙ্গতা…মনে পড়েছিলো একটু আগে দেখে আসা অন্য এক দাম্পত্য…
কুমু কাছে এসে শোনালে,
-’সই,গাড়ি এসে গিয়েছে, উনি ডাকছেন।আসি!’
-’এখনই!’
-’হ্যাঁরে।রাতেই খড়গপুর ইষ্টিশন থেকে ট্রেন।যদি বাঁচি, দেখা হবে। ভালো থাকিস’
একখানি একান্ত আলিঙ্গন,অশ্রুসিক্ত বিচ্ছেদ।তাঁর চোখের সামনেই স্বামীর হাত ধরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে গিয়ে উঠেছিল কুমু।গাড়ি চলে গিয়েছিল মাটির রাস্তায় ধূলো উড়িয়ে,ঘরে ফিরে এসেছিলেন একা।আর দেখা হয়নি।…(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments