বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪২
শালুক
ভাস্করব্রত পতি
একসময় মিশরের দেবী 'ইশতারে'র পূজায় নীল শালুকের প্রচলন ছিল। ভূমধ্যসাগরীয় দেবী রণরঙ্গিনী 'ভারগো' পূজিতা হতেন পদ্মের পাশাপাশি শালুকেও। মাইসেনী সভ্যতার সিংহবাহিনী শক্তির প্রতিক দেবী 'সিবিলি'র আশীর্বাদী ফুলও এই নীল শালুক। গ্রীক দেবী 'রিয়া'ও তুষ্ট হতেন পদ্ম এবং শালুকে। রোমান দেবী 'ওপস', আফ্রিকার রুদ্রের দেবী 'তানিতে'র পূজোতেও শালুক লাগতো। কথিত আছে, সর্পদেবী মনসার পূজাতেও এই শাপলা ফুল দেওয়া হয়।
Nympheaceae পরিবারভুক্ত সকল উদ্ভিদদের বলে 'শাপলা'। শালুক হোলো শাপলার মাঝামাঝি জন্মানো এক ধরনের সবজি জাতীয় খাদ্য। শাপলার গোড়ায় একাধিক গুটি জন্মায়। যা পরে শালুকে পরিনত হয়। এগুলো ৪০ - ৭০ গ্রাম ওজনের হয়। সুস্বাদু খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই শাপলাকেই গ্রামবাংলায় শালুকও বলে।
জলাশয়ে ফুটে থাকা শালুক ফুল
'নিমফিয়েসী' গোত্রের এই ফুল বাংলায় শুঁদিফুল, কুমুদ, মালয়লামে নিরাম্বল, কন্নড়ে কান্নাইদিলি, অসমীয়াতে নাল, মনিপুরীতে থারো আংগৌবা এবং তামিলে ভেলাম্বাল নামে পরিচিত। গ্রামবাংলায় সাধারণতঃ তিন ধরনের শালুক জন্মায়। শুঁদিফুল পরিচিত বানিপুষ্প, হিমাব্জ, নিশাফুল, উৎপল এবং অনুষ্ণ নামে। সাদা শালুককে বলে ইন্দু, কমল, কহ্লার, কৈরব, ধবলোৎপল এবং চন্দ্রাব্জ। এছাড়া নীল শালুক পরিচিত নীলোৎপল, অসিতোৎপল, ইন্দীবর, কুবলয়, উৎপলক নামে। ছোট শালুক পরিচিত নীলোৎপলিনী, কুবলয়িনী, কৈরবিনী, ইন্দিবর, উৎপলিনী, কুমুদ্বতী, চন্দ্রেষ্ঠা নামেও। চট্টগ্রামে বলে অঁলাফুল। প্রাচীন সংস্কৃত, সিংহলী ও পালি ভাষার সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকে কুভালয়া, ইন্ধিয়ারা, নীলুপ্পালা, নীলথপালা, নীলুফুল নামে পাওয়া গেছে, যা পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠতা, শৃঙ্খলার প্রতীক।
শালুক ফুলকে বলা হয় 'হেলাফুল'। এছাড়া 'শুদি' এবং 'কুমুদ ফুল' নামেও ডাকা হয়। শালুক তিন ধরণের দেখা যায়। সাধারণত কাশ্মীর, সাইবেরিয়া এবং ইউরোপের মতো শীতল এলাকায় যে সাদা রঙের শালুক জন্মায়, তার বিজ্ঞানসম্মত নাম 'Nymphea alba’। আবার Nymphea nouchali প্রজাতির শালুক বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। গ্রামবাংলায় যা প্রচলিত সাদা শালুক, তা এটিই। এমনকি এই প্রজাতির গোলাপী লাল, ফিকে লাল, গাঢ় লাল কিংবা গোলাপী আভাযুক্ত শালুকও জন্মায় বিভিন্ন জলাশয়ে। যে নীলবর্ণের শালুক আমরা দেখি, তার বিজ্ঞানসম্মত নাম 'Nymphea stilata'। শালুকের অন্য একটি প্রজাতির বিজ্ঞানসম্মত নাম Nymphea lotus। ইংরেজিতে বলে Water Lily।
শালুক যখন সুন্দরীদেরও প্রিয়
প্রথমেই বলা হয়েছে, শালুক ফুলের অন্য নাম শুঁদিফুল। ১৭৭৪ সালের গ্রন্থ 'রাজ নির্ঘণ্টকার' এ বলা হয়েছে, সৌনন্ধিক তথা শালুক ফুলের প্রচলিত নাম হল 'শুদি’। ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতাব্দীর গ্রন্থ অমরকোষ, চরক সুশ্রুত অনুসারে শালুকের অন্য নামগুলি আগেই উল্লেখ করেছি। মাধব নিদানের টিকাকার শ্রীকণ্ঠ বলেছেন— 'ওটা নীলপদ্ম বলা অপেক্ষা নীলশুঁদি বলাই শ্রেয়'। তবে ইন্দিবরকে স্থলপদ্ম হিসাবে দেখান হয়েছে চরকের সূত্রস্থানের ৩৮ অধ্যায়ে। যদিও নীলপদ্মকেই নীলশুঁদি হিসাবে মেনে নিয়েছেন সুশ্ৰুত টীকাকার ডল্বন। চরকের সূত্রস্থানের ৪৯ অধ্যায়ের টীকায় ‘কুমুদ’ শব্দের ব্যাখ্যায় চক্রপানি বলেছেন, যদিও কুমুদ বলতে শ্বেত শুঁদি বুঝি, তবে তার বৈশিষ্ট্য হল— শুক্লপক্ষ না হলে শ্বেতশুঁদি ফুটবেনা। অর্থাৎ চন্দ্রকিরণেই প্রস্ফুটিত হয় কুমুদ। কিন্তু নীল বা লাল কুমুদ কৃষ্ণ ও শুক্ল উভয়পক্ষতেই ফোটে।
গোলাপ নয়, সাধারণ শালুক যখন ভালোবাসার ফুল হয়ে ওঠে
শালুকের আভিধানিক অর্থ কুমুদাদির মূল বা কন্দ বা গেঁড়। অর্থাৎ পঙ্কশূরণ। শালুককে এই বঙ্গের কোথাও কোথাও 'নাল' বা 'হেলাও' বলে। কোল ভাষায় বলে 'শালুকাড'। বৃহৎসংহিতাতে এই 'শালুক' নামটি মেলে। কবিকঙ্কন চণ্ডীতে 'নৈবেদ্য শালুকপোড়া'র তথ্য দেখতে পাওয়া যায়। রাজশেখর বসু 'চলন্তিকা'তে শালুক অর্থে লিখেছেন, 'পদ্মাদির মূল'। সংসদ বাঙ্গালা অভিধানেও এটাই বলা হয়েছে।
(সংস্কৃত শাল + উক / ঊক > শালুক)
দেওয়ালির আলোর সংসারে প্রদীপ, মোমবাতির সাথে আজও সমান চাহিদা গ্রামবাংলার অতি সাধারণ ফুল শাপলা শালুকের। দেওয়ালিকেন্দ্রীক লোকপচারের একটি দরকারী উপকরণ এই শালুক। শারদ সংসারে পদ্মফুলের কৌলিন্য থাকলেও শালুক কিন্তু ফেলনা নয়। পদ্মের মতো বড় নয়। তবে পদ্ম যদি 'শতরূপা' হয়, শালুক কিন্তু 'অপরূপা'। দেওয়ালির সময় গোধন পূজার কালে গরুর গলায় শালুক ফুলের মালা পরানোর চল আছে।
জলাশয় থেকে শালুক তুলে বিক্রির জন্য ক্ষীরাই রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ এক মহিলা
ভাইফোঁটার ভোরে দক্ষিনবঙ্গে গরুপূজা এবং বাঁধনা পরব আয়োজিত হয়। গৃহপালিত গরুর গলায় ঝোলানো হয় শালুকের মালা। এ সময় 'চাঁদ বাঁধানি', 'ধা রে মশা ধা', 'শুক বাঁধানি' আয়োজিত হয়। সব ক্ষেত্রেই গরুপূজাই মুখ্য উপলক্ষ্য। গেরস্থের লোকজন ভোর রাতে তেল হলুদ গরুর সিঙে মাখানোর পাশাপাশি গরুর গলায় পরায় শালুক ফুল। অপরদিকে জঙ্গলমহলে বাঁধনা পরবের দ্বিতীয় দিন তথা 'গরয়া'তে অমাবস্যা শেষ হলেই প্রতিটি বাড়ির একজন করে মদ্দ জোয়ান চাষের কাজে ব্যবহৃত মই, লাঙল, জোয়াল পূজো করেন। এই কৃষিযন্ত্র গুলোতে আড়াআড়িভাবে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে শালুক ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়।
ফলে এসময় শালুকের চাহিদা হয় খুবই। সব যায়গায় এখন আর শালুক ফোটেনা তেমন। যেসব জমিতে শালুক হত, সেখানে এখন মাছের ভেড়ি হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের তুলনায় পূর্ব মেদিনীপুরে বেশি শালুক হয়। এক শ্রেনীর মানুষ এই সময় তাই শালুক তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে কিছু পয়সা আয় করেন। ইদানিং তাই এই অপাংক্তেয় শালুকও ক্রমশঃ মহার্ঘ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু বেশি দামে হলেও ধর্মভীরু বাঙালির কাছে শালুক এখন মারাত্মক নষ্টালজিক উপকরণ।
সাদা শাপলা বাংলাদেশের এবং নীল শাপলা শ্রীলঙ্কার 'জাতীয় ফুল' হলেও এই শালুক কখনো কৌলিন্য পায়নি সভ্য সমাজে। কিন্তু নানা ধর্মের মানুষের লোকাচারে নানাভাবে জড়িয়ে আছে এই শালুক। সিংহলী বৌদ্ধদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপে পাওয়া ১০৮ টি শুভ চিহ্নের মাঝে একটি ফুল ছিল এই শালুক। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর এক শিষ্য থিউফ্রাস্টাস বলেছেন, এই উদ্ভিদ প্রায় ৩০০ খৃস্টপূর্বাব্দের প্রাচীন।
শালুকের ঝাড়
শালুক নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার খুব একটা কম নেই। আমরা প্রায়ই বলি, 'শালুক চিনেছেন গোপাল ঠাকুর'। এই প্রবাদের ব্যবহার এই শালুক হল দেবতা ঘন্টাকর্ণের নৈবেদ্য। সংস্কৃতে বলা হয়েছে— ‘পায়সং ভাস্কর। ইচ্ছেৎ গণেশশ্চ পুপুলিকাম / সদ্য ক্রুদ্ধো ঘণ্টাকর্ণঃ নৈবেদ্যং দগ্ধ শালুকম' অর্থাৎ সূর্যের নৈবেদ্য পায়াসান্ন, গণেশের নৈবেদ্য পিঠে পুলি । আর সর্বদা ক্রুদ্ধ ঘন্টাকর্ণের প্রিয় নৈবেদ্য গন্ধশালুক। লোকগানেও পাওয়া যায় শালুকের অস্তিত্ব 'শালুক ফুলের লাজ নাই / রাইতে শালুক ফুটে লো, রাইতে শালুক ফুটে / যাঁর সনে যাঁর ভালোবাসা, সেই তো মজা লুটে লো / বকুল ফুল বকুল ফুল / সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি'!
0 Comments