উত্তর বেলা
পুলককান্তি কর
- মিঠিদি, আমি কি আর কোনও হেল্প করে দেব তোমাকে? আন্তরিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করল আর্য।
- না, দরকার হবে না। তুই বরং চা’টা খেয়ে স্নানে যা। তোর তা না হলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।
- খুব দেরী হবে না। সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে পৌঁছালেই হবে। এখন তো সবে দশটা। আমি বরং বাজারটা গুছিয়ে দিই। তোমার সুবিধা হবে।
- ও পড়ে থাক। কাল রীনা এসে গুছোবে। তুই বরং গীজারের সুইচটা দিয়ে দে। আমি ভুলে গেছি দিতে।
- তুমি আজ আর শুধু শুধু রান্না করবে কেন মিঠি দি? আমি হোম ডেলিভারিতে ফোন করে দিচ্ছি। একার জন্য ফালতু রাঁধবে?
- ওই তো একটু কিছু সেদ্ধ করে নেবো। আর রাতের জন্যও কিছু করে রাখা দরকার। নইলে রাতের খাবার আবার কিনতে হবে।
- ও তুমি চিন্তা করো না। আজ রাতে বরং পিজজা অর্ডার করে দিলে হবে। বা আমি আসার সময় সিটি সেন্টার টু তে ঢুকে কিছু কিনেও আনতে পারি!
- বেশ। তাহলে শুধু আমার এবেলার মতো একটু সেদ্ধ করে নেবো। কিন্তু আর্য, আজ তোদের দুপুরে ভারী খাওয়া দাওয়া হবে। রাতে আবার এসব খাবি? তোর কদিন থেকে পেটটা ভালো নেই বলছিলি। ছেড়ে দে, আমি রাতে ভাতে ভাত করে দেব। তুই খেতেও ভালোবাসিস, আর লঘুপাচ্যও হবে।
- এই রোববারে কাজের লোক না এলে ভারি সমস্যা। সারা সপ্তাহ কাজের পর আজও রান্না ঘরে ঢুকে আগুনে সেঁকবে - খারাপ লাগছে মিঠিদি। আমিও থাকবো না আজ। তুমি একটু নিজের মতো শুয়ে বসে রেষ্ট করো না!
- এত ভাবিস না তো তুই! কতটুকু সময় আর যাবে! এই তো চা টা ছেঁকে নিয়েই ভাত আলু ডিম সব একসাথে চাপিয়ে দেবো।
মিঠি মানে লাবণ্য হঠাৎ শুনতে পেল আর্য সি.ডি প্লেয়ারটায় ওর প্রিয় দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত লাগিয়েছে। ওঁর সেই স্বকীয় মেঘমন্দ্র উচ্চারণে যেন রবিঠাকুর আর্তি জানাচ্ছেন – ‘তুমি তো সেই যাবেই চলে, কিছু তো না রবে বাকি/ আমায় ব্যথা দিয়ে গেলে জেগে রবে সেই কথাটি/ তুমি পথিক আপন মনে, এলে আমার কুসুম বনে/ চরণপাতে যা দাও দলে সে সব আমি দেব ঢাকি’। গানটা শুনে মনটা বিষন্ন হয়ে গেল তার। চা’টা ছেঁকে মিঠি এসে বসল ওর জন্য বরাদ্দ একটা বিশেষ চেয়ারে। ও সচরাচর সোফায় বসতে চায় না। ওর বাবার সেগুন কাঠের ঋজু চেয়ার ছিল, তাতেই বসে সে। আর্যকে বলল, তোদের গেট টুগেদার আজ কখন শেষ হবে?
- সাড়ে চারটা-পাঁচটা।
- তাহলে তো ফিরতে ফিরতে সাতটা হবে। তুই একসেট চাবি মনে করে নিয়ে যাস কিন্তু।
- কেন, তুমি কি কোথাও বেরোবে?
- টুকটাক কেনাকাটা করতে বেরোতে পারি।
- তাহলে বলো না, আমি সেখানেই তোমাকে জয়েন করবো।
- না রে, তাহলে আমাকে টাটিয়ে বসে থাকতে হবে, কখন তুই আসবি ভেবে। এক বছর বাদে পুরোনো বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হবে। মিছিমিছি পিছুটান নিয়ে যাবি কেন?
- তাও বলো না! আমি ঠিক সময়ে ঢুকবো। তোমার সাথে যাওয়ার চেয়ে ওরা বড় আকর্ষণ নয়। এক কাজ করো না, তুমি পাঁচটা নাগাদ সিটি সেন্টার টু এ চলে এসো। বিকেলে ওখানেই একটা ফিল্ম দেখে রাত্রে খেয়েটেয়ে ফিরব।
- আচ্ছা দেখি।
- দেখাদেখির কি আছে! চল, অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না।
- আচ্ছা তোকে ফোন করে নেবো।
- এত ভাও খাচ্ছ কেন মিঠি দি? এসোই না বাবা! আমার ভালো লাগবে।
- না রে, ওজন্য নয়। আজ বিকেলে অরিন্দম আসবে বলেছিল, বাইচান্স যদি চলে আসে, তাই বলছিলাম।
- ফোন করে নাও একটা।
- তুই যা, তারপর করবো। যদি না আসে তো যাবো নিশ্চই।
- দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ো না কিন্তু!
- বা রে! এতদিন বাদে চান্স পেয়েছি, দুপুরে একটু ল্যাদ খাবো না?
- খেলে খাও! কিন্তু অ্যালার্ম দিয়ে রেখো। এখান থেকে সিটি টু তে পৌঁছোতে মিনিমাম একঘন্টা তো যাবেই। একটু তাড়াতাড়ি বলো, তবে ফিল্মের টিকিট বুক করতে পারবো।
- তাহলে তুই গেট টুগেদারে মন দিবি কি করে? তুই চিন্তা করিস না, আমি নেটে টিকিট কাটতে জানি। আমাকে এত আন্ডারএস্টিমেট করিস কেন? হাসলো লাবণ্য।
- আমি তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করি? তুমি তো আমার সব কিছুরই গুরু যে গো!
- ঠিক আছে, এবার তুই স্নানে যা। গল্প করতে বসলে তোর তো আবার বেলা কেটে যাবে। যা এবার। সাড়ে দশটা বাজে।
একটু বাদে আর্য চলে যেতে একটু টেবিলটা গুছিয়ে নিল লাবণ্য। কিছু টুকটাক অফিসিয়াল কাজও নিয়ে এসেছে সে। ওর আন্ডারে কতগুলো প্রজেক্ট ওয়ার্ক চলছে - সেই সংক্রান্ত কিছু মেইল টেলও করতে হবে। রবিবার তার এসব করতে ইচ্ছে করে না। তবু না করেও উপায় কই? অনেকক্ষণ পরে মনে হল – একমনে দেবব্রত গেয়েই চলেছেন, ওদের ওদিকে এতক্ষণ হুঁশই ছিল না। কেমন অপরাধ বোধ হল তার। কী যেন চলছে গানটা – ‘তোমার সুধারসের ধারা গহন পথে এসে/ ব্যথারে মোর মধুর করি নয়নে যায় ভেসে/ শ্রবণে মোর নব নব শুনিয়েছিলে যে সুর তব/ বীণা থেকে বিদায় নিল, চিত্তে আমার বাজে/ নয়ন ছেড়ে গেলে চলে এলে সকল মাঝে।‘ একটু একটু গলা মেলালো সে। কখন কাজের ফাঁকে জীবন থেকে গান হারিয়ে গেছে – ভাবলেও কষ্ট হয়। ওর বাবা ওকে ক্লাশ থ্রী থেকেই গানের টিচার দিয়েছিলেন। ক্লাসিক্যাল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিগ্রি আছে তার। অথচ অনভ্যাস তার সবটুকু আদায় করে নিয়েছে। আর্য বহুবার ওর কাছে গান শোনার বায়না করে, কিন্তু আজকাল যেন কী হয়েছে তার, গাইতে একেবারেই ইচ্ছে করে না। কোথায় যে হারিয়ে গেল সুর! জীবনটা যে কেমন স্রোতে বইতে শুরু করল – তার গতি আর বাঁধা গেল না।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর লাবণ্য অনেক গুলো চিঠি একসাথে গুছিয়ে নিয়ে বসল বিছানায়। দৈনিক খবরের কাগজে পাত্রী চাইতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল আর্যর জন্য। কতকগুলো জবাব এসেছে, দেখে নেওয়া দরকার। আর্য জানে না, ফলে আজকেই ভালো সুযোগ এসব দেখে নেওয়ার। যাঃ, অরিন্দমকে তো ফোন করা হল না! সেই বুঝে তো আর্যকে বলতে হবে!
- কী রে অরিন্দম, আসবি নাকি আজ?
- আসছি তো। তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাবে তোর বাড়ী। কেন রে, বেরোবি কোথাও?
- না, না তুই আয়।
আর্য মন খারাপ করবে। কী আর করা? একটু আগে ফোন করলে – না বলার একটা সুযোগ ছিল। মাঝপথে একজন মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক দেখায় না। ভেবেছিল – ফোন করবে না আজ আর্যকে, এস.এম.এস করে দেবে, কিন্তু ও এতখানি আশা করে আছে, মুখে না বললে বড় নির্দয় শোনাবে। তাই ফোন করে মানা করে দিল ওকে। দু-একটা চিঠি দেখতে না দেখতেই কলিং বেল বেজে উঠলো তার। নাইটির উপর একটা হাউসকোট চাপিয়ে আইহোল দিয়ে দেখলো, বাইরে অরিন্দম দাঁড়িয়ে।
- আয় আয় ভেতরে আয়। আন্তরিক আহ্বান জানালো লাবণ্য।
- কী রে তুই একা? আর্য নেই?
- ও ওদের এম.এস.সি ব্যাচমেটদের একটা গেট টুগেদারে গেছে সল্টলেক।
- ফিরবে কখন?
- এই সাড়ে ছটা-সাতটা। কেন রে?
- ভাবছিলাম একটু সোয়েটার কিনতে যাবো। তোকে নিয়ে যেতাম।
- কোথায় যাবি? এখানকার কোনও বড় দোকানে, নাকি অন্য কোথাও!
- ভাবছিলাম ওই ভূটিয়াদের থেকে কিনবো। মলে গিয়ে কিনলেও হয়!
- না রে অরিন্দম, আজ আর বেরোনো হবে না। তুই এই লোকালি যদি কোথাও কিনতে চাস তো যেতে পারি। নইলে কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে ওই হেদুয়াতে নেমে পড়লে হবে। ওখানেই তো ভূটিয়ারা বসে।
- কেন রে লাবু, কী এমন কাজকর্ম আজ?
- একটু প্রজেক্টের কাজকর্ম করতে হবে। তোর সাথে বেরোলে আটটার আগে ঢুকতে পারবো না। তোর কী খবর?
- আমার আপাতত সব কিছু ঠিকঠাক।
- তোর কলেজের কাজকর্ম কেমন চলছে?
- ওই সরকারী জায়গায় যেমন হয় আর কি? উত্থানের সম্ভাবনা নেই, অধঃপতনেরও ভয় নেই। কেবল দিনগত পাপক্ষয়।
- মিলি কেমন আছে?
- ভালো। এখন বাপের বাড়ী থেকে এসে আমার এখানেই আছে। ওষুধ পত্র চলছে, সমস্যা নেই।
- সন্দেহ কমেছে?
- এখন তো তেমন কিছু করছে না। কতদিন এমনটা মেনটেইনড থাকে সেটাই দেখার।
- তুই এখানে এসেছিস, জানে?
- না। বলিনি।
- তোর মেয়ে কেমন আছে রে? ওদের উইন্টার ভ্যাকেশন কবে থেকে চালু হবে?
- ওটা তো পঁচিশে ডিসেম্বরের সময়ে পড়ে। এখনও মাসখানেক দেরী আছে।
- বাড়ী আসবে তো তখন? না কি অন্য প্ল্যান তোদের?
- না, না। বাড়ী আসবে। তখন তো হোস্টেল বন্ধ থাকবে।
- ও তোদের কান্ডকারখানা জানে না?
- না। কিন্তু ভয় পাচ্ছি - এবার না বুঝে যায়। বয়স তো ওর যথেষ্ট হয়েছে, বুঝবে না এটাই অস্বাভাবিক। মিলি কে বোঝাচ্ছি। দেখি কী হয়!
- তুই বেকার বাড়ীতে আসতে গেলি কেন? জানিস যখন সমস্যা হয়, তখন সেগুলোকে যথা সম্ভব পরিহার করাই তো উচিৎ।
- ওই যে বললি ‘যথা সম্ভব’। আমি ওটাই মেনে চলার চেষ্টা করি। তুই ভাব - এ জন্য আমি তোর সঙ্গে যোগাযোগ ছেড়ে দেব? আজ তোকে ছাড়বো, কাল অন্য কাউকে নিয়ে শুরু হবে। এটা ওর মনের ভেতরে ঢুকে আছে। বের করা মুশকিল।
- নিজের পরিবারটা আগে ঠিক রাখতে হবে রে! বাড়িতে অশান্তি নিয়ে তুই বাইরে কাজ করবি কী করে?
- ঠিক কথা। এটাই জীবন! এভাবেই চালিয়ে নিতে হবে বাকী দিনগুলো! লাবু, তুই ই বা এত চিঠিপত্র নিয়ে কী করছিস?
- ওই তো আর্যর জন্য মেয়ের বিজ্ঞাপণ দিয়েছিলাম। ওগুলো দেখব ভাবছিলাম। স্ক্রুটিনি করতে হবে তো!
- আর্য জানে?
- না, বলিনি।
- তবে? এভাবে তোর এগোনো ঠিক হচ্ছে না রে! আগে ওকে বল।
- ওকে বললে তো না বলবে।
- কিন্তু ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে দেখাশুনো করবে তবেই না সামনে এগোবি। ওকে অন্ধকারে রেখে তুই ই বা কতদূর একা একা সিদ্ধান্ত নিবি?
- না, এবারে বলবো। আগে বেসিক দেখাটেখাগুলো সেরে নিই, তারপর বলবো।
- কিন্তু লাবু, তুই থাকবি কী করে একা একা?
- এবার ওই অভ্যেসটাই করবো রে অরিন্দম। আমি এবার নিজের সাথে ভালো থাকতে চাই, নিজেকে ভালোবাসতে চাই, আরও বেশী করে সময় নিজেকে দিতে চাই।
- আসলে পলাশ যে এভাবে খেল দেখাবে কে জানতো বল।
- হ্যাঁ। আমার কপাল! কে জানতো - বিয়ের ছমাসের মধ্যে কিডনির রোগ ধরা পড়বে। দু বছর যেতে না যেতেই চলে যাবে সবার মায়া কাটিয়ে।
- সত্যি রে, কী উচ্ছল ছিল পলাশ! ওর যে এরকম কোনও রোগ আছে বোঝার কোনও উপায় ছিল না। আচ্ছা লাবু তুই বিয়ের পরে এমন কোনও কিছু নোটিশ করেছিলি?
- কী রকম?
- এই যেমন বার বার ইউরিন ইনফেকশান বা ইউরিনে গাঢ় কিছু বের হওয়া।
- না রে! আমি তেমন কিছু টের পাইনি। একবার ভয়ানক পেট ব্যাথা হল, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ধরা পড়ল লাষ্টস্টেজ কিডনি ডিজিজ।
- কী সব দিন ছিল আমাদের, লাবু! ইউনিভার্সিটির বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসের সেইসব দিন এখনও মনে ভাসে।
- বিশেষ করে পলাশের হয়ে মিডিয়েট করতে এসে চপ্পল পেটা হওয়াটা।
- যাঃ লাবু! এভাবে বলিস না! চপ্পল খুলবি খুলবি করেছিলি, খুলিস নি।
- ওতো একই হল! মারব বলা আর মারা – ভদ্রলোকের জন্য একই!
- তোরও বেশী বাড়াবাড়ি ছিল।
- বাড়াবাড়ির কি দেখলি?
-পলাশ চিঠি লিখে তোর হাতে পাঠিয়েছে, নীচে নাম দেয়নি। তুই এসে আমার হাতে ধরিয়ে বললি, ‘বাড়ী গিয়ে পড়বি’। তুইও বলে দিসনি ওটা পলাশের চিঠি। তাতে আমার যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে অন্যায়টা কোথায়?
- ধর চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম। আমিও কি এতটাই খারাপ ছিলাম লাবু? তোর জন্য এতটাই মিস ফিট?
- ব্যাপারটা তেমন ছিল না অরিন্দম। বাড়ী গিয়ে দেখলাম - প্রেম প্রস্তাব। আমি ভাবলাম এটা তোরই কীর্তি। তোর একটা স্টেডি গার্লফ্রেন্ড ছিল – আমরা সবাই জানতাম। আর জানিসই তো এসব ব্যাপারে আমি ভীষণ কনজার্ভেটিভ। পরের দিন সুযোগ পেতেই জিজ্ঞাসা করলি, ‘কী রে, কী ভাবলি?’
- আমি বলেছিলাম একথা? তখন তুই কী বললি যেন?
- আমি বললাম টিফিন আওয়ার্সে কলেজের পিছন দিকের ওই পার্কটায় দেখা করতে। টিফিনে দেখি তুই দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে গিয়ে উপস্থিত। আমাকে দেখে একগাল হেসে বললি, কী রে ভাবলি কিছু? আমি বললাম, ‘তোর লজ্জা করে না? মেয়েদের কি কুকুর ছাগল ভাবিস? যখন খুশী যার তার সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে বিবেকে বাধে না তোর?’
- তখন আমি বুঝেছিলাম তোর বোজায় ভুল হচ্ছে। তুই আমাকেই চিঠির লেখক ভেবে বসে আছিস। দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। অমনি বললাম তাতে কী হয়েছে? কৃষ্ণ করিলে লীলা খেলা? আমরা করিলে ড্যাশ শালা? দ্যাখ না কদম্ব গাছের তলায় আমি তোকে প্রোপোজ করছি। বলেই হাটুঁ গেড়ে বসে তোর হাতে চুমু খেয়ে নিয়েছিলাম।
- এতে যদি কোনও মেয়ে চপ্পল দেখায়, সেটা কি অন্যায়?
- তবুও! আমার প্রেমিক ইগোকে হার্ট করেছিলি তুই লাবু!
- আমার তো তোকে নিয়ে সমস্যা ছিল না। তুই তখন ওই লেডি ডাফরিনের মেয়েটার সাথে ডেট করছিলি। সেটাই প্রবলেম ছিল। আচ্ছা ওই মেয়েটার এখন কী খবর রে?
- জানিস তো লাবু, মাস দুয়েক আগে একেবারে রবিঠাকুরের ‘হঠাৎ দেখা’ কেস রে! আমি একটা কাজে নৈহাটির থেকে ফিরছিলাম, দেখি একই ট্রেনে ও ফিরছে।
- ওর নামটা কী ছিল যেন?
- নন্দিতা।
- যাইহোক, তারপরে বল।
- হ্যাঁ, প্রথমে একটু চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল। সিঁদুরটিঁদুর পরে – তাছাড়া বাচ্চাফাচ্চা হয়ে এখন একটু পৃথুকায়া। যা হোক, ওই আমাকে এসে চিনলো। ওকে জায়গা ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ বাদে ওর পাশেই বসার জায়গা হ’ল।
- কী বুঝলি? এখনও কি ‘হঠাৎ দেখার’ অনুভূতি আছে?
- মানে?
- ওই যে, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।
- মনে তো হ’ল রে! আফটার অল, ফার্স্ট লাভ! তবে কিনা - মেয়েরা অনেকটা তরল পদার্থের মতো। যখন যে পাত্রে, তখন তার মতো। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা এতখানি পতি কেন্দ্রিক হয়ে যায় - মনে হয় তখন আর পুরোণোটুকুকে মনেও করে না।
- ‘মনে করে না’ না বলে ‘মনেও করতে চায় না’ বলা ভালো রে অরিন্দম। মেয়েরা মনে রাখলে অনেক জ্বালা। পুরুষেরা অনেক প্রকোষ্ঠ নিয়ে বাঁচতে পারে বা সংসার যাত্রা নির্বাহ করতে পারে। মেয়েরা তেমনটা করলে তার ইনভলভ্মেন্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা মেয়েরা এই দ্বৈত যাপন চালাতেও পারে না, তাদের গড়নটাই ঈশ্বর এভাবে করেছেন।
- একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছা করে রে লাবু! তুই কি ছোট বেলায় কাউকে ভালবাসতিস? মানে পলাশের আগে?
- না। আমি একটু গুডগার্ল মার্কা ছিলাম। স্কুলে স্ট্যান্ড করাটাই আমার তখন একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। প্রস্তাব, কানাকানি অসংখ্য ছিল, তবে আমি একটুও টলিনি। ইনফ্যাক্ট পলাশের ক্ষেত্রেও যে আমি খুব ইনভলভ ছিলাম তা নয়।
- তবে পলাশের সাথে তোর বিয়ে হল কী করে? মানে আমি যতটুকু জানি তার বাইরে কিছু আছে কি?
- দ্যাখ – যখন আল্টিমেটলি তুই বললি এটা ওর লেখা চিঠি - আমি খুব একটা যে খুশী হয়েছিলাম তা নয়। এম.এস.সি তে ভালো রেজাল্ট করাটাই একটা ইস্যু ছিল তখন। তোরা আকারে ইঙ্গিতে খ্যাপাতিস, এটা ওটা বলতিস শুনতে শুনতে ওর নামের সাথে নিজের অস্তিত্বটা একটু একটু অবচেতনে জমে যাচ্ছিল এটা ঠিক কথা, তবে সে অর্থে প্রেম হয়নি। ও আমাদের সবার আগে চাকরী পেয়েছিল। আমি সি.এস.সি দিয়ে প্রায় ন’দশ মাস বাদে কলেজে চাকরী পেয়েছি। এই ইউনভার্সিটির চাকরী তো তার পরে। যাইহোক ও চাকরী পেয়েই ওর বাবা-মাকে দিয়ে আমার বাড়ীতে প্রস্তাব পাঠালো। জানিসই তো, আমার মা বহুদিনই গত। বাবাও আমার মত চাইলেন, আমি আর বারণ করিনি।
- তুই কি তবে এখন পলাশকে মিস করিস না?
- দ্যাখ অরিন্দম, তোর কাছে তো অকারণ আদিখ্যেতা করার দরকার নেই। টু বি ফ্র্যাঙ্ক, পলাশের সাথে সত্যিকারের হৃদয় বিনিময় আমার হয়ইনি কখনও। বিয়ের ছমাসের মধ্যেই সিরিয়াস রোগ, তারপরে রোগভোগ বাকী দেড়বছর। ও তো আমার সেবা নিতেই এসেছিল। ও আমাকে কতটা ভালোবাসতো - তাও বোঝার অবকাশ হয়নি আমার!
- সে তো তোকে ভালোবাসতোই। কলেজ পড়ার সময় তার সেসব অনুভূতির সাক্ষী তো আমি, তাই জানি।
- ছাড় ওর কথা।
- তুই তো আরেকটা বিয়ে করতে পারতিস লাবু!
- আর বাঁধনে জড়াতে ইচ্ছে করেনি রে! জানিসই তো তখন কেমন দিন কেটেছে।
- এখন করে নে। এখন তো স্থিতাবস্থা।
- আমার বয়সটা তো ভাব। লোক হাসিয়ে লাভ কী!
- বয়স আর কত? এখন তোর চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ!
- তাহলে?
- তোকে দেখে মোটেও অতখানি লাগে না লাবু। মনে হয় হার্ডলি ছত্রিশ কি সাঁইত্রিশ।
- লাগলেই বা। অরিজিনালি বয়সটা তো বেড়েছে।
- এখনকার দিনে এই বয়স এমন কিছু না। বিদেশে তো আকছারই এই বয়সে বিয়ে হচ্ছে। আমাদের দেশের সেলিব্রিটিরাও করছে।
- তুই এত বিয়ে নিয়ে পড়েছিস কেন অরিন্দম? বিয়ে করে লাভটা কী? ভবিষ্যতের সুরক্ষা?
- ধর তাই।
- ও চিন্তা আমি করি না রে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ‘দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না।‘ আর যেদিন সত্যিকারের মৃত্যু আসবে - সেদিন ঠিক দাহ কাজ হয়ে যাবে। বিয়ে করা বরের জন্য আটকে থাকবে না।
- একটু চা খাওয়া না রে লাবু।
- আরে হ্যাঁ রে! কথা বলতে বলতে ভুলে গেছি একদমই। বোস একটুখানি। টোস্ট খাবি?
- না রে! শুধু চা আন। আমি একটু আর্যের সম্বন্ধগুলো দেখব?
- দ্যাখ।
চা খেতে খেতে দু একটা মেয়ের কথা আলোচনায় তুলল অরিন্দম। ‘আজকাল আর কেউ প্রথম প্রথম ফটো পাঠায় না বল’
লাবণ্য বলল, ‘হ্যাঁ। আসলে এখন তো হোয়াটস আ্যপ ট্যাপে প্রোফাইল পিকচার পাওয়া যায়। হয়তো সেজন্যই দেয় না।‘
- না রে লাবু; তা নয়। যোগাযোগের জন্য তো বাবা বা মায়ের নম্বর দেওয়া থাকে। মেয়ের নম্বর তো থাকে না। মনে হয় দু-একবার কথা চালাচালি হলে তবে ফটো পাঠায়। প্রথমবারেই পাঠালে সিলেকশনে অনেক সুবিধা হত।
- তা ঠিক। কিছু কি বাছলি?
- দু-একটা আলাদা করে রেখেছি। তুই ও দ্যাখ।
- কবে আর্যকে বলবি?
- আজকেই বলবো ভাবছি।
- বলে দ্যাখ।
রাতে খাওয়ার পর বারান্দায় বসে রোজ কিছুক্ষণ গল্প করার অভ্যেস আর্য এবং লাবণ্যের। ওদের বাড়ীর ঠিক সামনে বহু পুরোণো আমলের দুটো শিরীষ এবং শিমূলের গাছ আছে। ওদের ডালপালার ফাঁক দিয়ে আকাশের তারা দেখাটা ঠিক যেন লুকিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে সামনের বাড়ীর মেয়ে দেখার মতো! অনেক এটা সেটা বলার পর লাবণ্য বলল, ‘আর্য, তোর জন্য পেপারে পাত্রী চাই’র বিজ্ঞাপণ দিয়েছিলাম। কতকগুলো জবাবও এসেছে। আমি তার মধ্যে থেকে দু-চারটে বেছেও রেখেছি। তুই সময় মতো একটু দেখে নিস।‘
মানে?
মানে যেটা শুনলি, সেটাই।
সেটাই তো জানতে চেয়েছি। তুমি কী চাইছো?
আমি চাই তুই জীবনে সেটল্ কর। এভাবে কদিন বাউন্ডুলের মতো থাকবি?
তুমি স্ট্রেট কাট বলে দাও না - আমি যেন তোমার বাড়ী থেকে চলে যাই। তাতেই তো হয়। এত সিন ক্রিয়েট করার দরকার তো নেই তার জন্য!
এভাবে ভাবছিস কেন আর্য? আমি তো তোর ভালো চাই।
তোমার আর ভালো চেয়ে কাজ নেই। তোমার ভালো চাওয়া আমি বুঝে গেছি।
কী বুঝেছিস?
তা তোমাকে বলতে যাব কেন? আমি আমার মতো বুঝেছি।
ঠিক বুঝেছিস কিনা আমাকে বাজিয়ে দেখতে হবে কিনা? বিশেষ করে বিষয়টা যখন আমার ভালো চাওয়া নিয়ে। হাল্কা মজার গলায় বলল লাবণ্য।
ও, তোমার মজা হচ্ছে, না - কথাগুলো বলতে? হঠাৎ তোমার এমন মতলব কেন এল শুনি! অরিন্দম স্যারের বুদ্ধি নাকি?
এ তো আজকের মতলব নয় আর্য! এ আমি অনেকদিন ধরেই ভাবছি। তোকে বলবো বলবো করে বলা হয়নি।
আমি কোনও বিয়ে টিয়ে করবো না। এই স্পষ্ট তোমাকে জানিয়ে দিলাম। আশাকরি আর এই নিয়ে তুমি কোনও কথা আমাকে বলবে না। আর তোমার যদি আমাকে না পোষায়, বলে দিও অন্য জায়গায় আমি শিফ্ট করে যাবো।
শোন না আর্য, আমি দুটো জায়গায় অলরেডি ফোন করে দিয়েছি। তুই দুটো জায়গায় অন্তত একবার মেয়েগুলোকে দেখে আয়। পরে ভাবা যাবে তুই বিয়ে করবি কি করবি না সে সব কথা।
আমি কোথাও যেতে পারবো না।
লক্ষ্মীটি। লাবণ্য এসে আর্যের পাশে দাঁড়িয়ে ওর একটা হাত ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল, আমার কথা শুনবি না তুই?
না। দৃঢ় গলায় জবাব দিল আর্য।
এই না তুই আমার বাধ্য বলে দাবী করিস! এই একবারটা অন্তত আমার কথা শোন।
দেখ মিঠিদি, আমি যদি মেয়েটাকে বিয়ে না করি, তবে মিছিমিছি ওকে এমব্যারাস করব কেন বা নিজেই এমব্যারাসড হবো কেন?
ধর আমার কথার দাম চোকাতে।
এই তো সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি শুরু করলে! তুমি জানো আমি তোমার কথা এড়াতে পারি না। বেশ, এই শেষ বার। তবে একটাই শর্ত, আমি যে কোনও এক জায়গায় যাবো। তুমি দুটোর মধ্যে বেছে দাও-কোনটা যাবো।
ঠিক আছে। এখন শুতে যাবার সময় হয়েছে। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। কালকে বলবো – কোথায় যাবি।
পরের দিন রাতে খাবার পর লাবণ্য বলল, নে এই বায়োডাটাটা দেখ। আজ মেয়েটার সাথে কথা হয়েছে। সায়নী মুখার্জী নাম মেয়েটির।
বায়োডাটা তুমি দ্যাখো। ও সব আমার দেখতে লাগবে না।
আরে দ্যাখ না। তোদের সমসাময়িক হতে পারে। তোর থেকে দুবছর বাদে এম.এস.সি পাশ করেছে। চিনতেও তো পারিস।
এই নাম খুবই কমন মিঠি দি। আমি অনেক সায়নী মুখার্জীকে চিনি। তুমি বল কোথায় গিয়ে সং সেজে বসতে হবে।
সং সাজবি কেন? স্মার্টলি যাবি। তুই তো এভারস্মার্ট!
আবার বার খাওয়াচ্ছ? আমি কী, আমি জানি না?
স্বভূমিতে ‘অরিবান্দা’ বলে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানেই বৃহস্পতিবার সন্ধে ছ’টায় চলে যাস। আর শোন, ওখানে গিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকিস না। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলিস।
ও সব নিয়ে তোমায় আর চিন্তা করতে হবে না। যা করার আমি করে আসবো।
আর্য আড়চোখে একবার দেখল লাবণ্যকে। একটা নাইটির উপর শ্রাগ পরে চুল আঁচড়াচ্ছে– যেন সত্যি সত্যি শ্রাবস্তীর কারুকার্য্য। শ্রাবস্তী তো সে দেখেনি – তার কারুকার্য কেমন তাও জানা সম্ভব নয়, তবু মিঠিদিকে এভাবে দেখলে সত্যি সত্যি তাই মনে হয়। সুন্দরী অথচ এত ডিগনিফায়েড – খুবই কম দেখা যায়। এমন একটা ব্যক্তিত্বের পরত আছে চেহারায় যেখানে অন্য কোনও ভাবনার আগে এমনিই মাথাটা নুয়ে যায়। মুখ দেখে ওর বোঝারই উপায় নেই – হঠাৎ করে বিয়ে নিয়ে কেন মেতেছে মিঠিদি। আজ কি কথায় কথায় বুঝতে চাইবে ওর মন? থাক আজ। কথা যখন দিয়েছে একবার ঝামেলাটা চুকিয়েই আসা যাক।
যথা সময়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাও হল, আর্য কলেজ ফেরৎ রেষ্টুরেন্টে উপস্থিতও হল। ওখানে গিয়ে ও সায়নীর নম্বরে ফোন করে যে মেয়েটিকে দেখল, ও ওর চেনা। ওর থেকে দু বছরের জুনিয়ার, জুলজির মেয়ে। আর্য কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিল। তবে কলেজের পরিসর আর কতটুকু। আর্য বলল, আরে সায়নী তুই?
কেন নাম দেখে বুঝতে পারোনি?
ইনফ্যাক্ট, আমি তেমন করে ভেবে দেখিনি। এটা যে তুই হতে পারিস এ আমার কষ্ট কল্পনাতেও আসেনি।
আমি তো তোমার নাম আর চাকরী শুনেই বুঝে গেছি - এটা তুমি!
কোথায় চাকরী করি, ওটাও কি বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল নাকি?
না, না। ফোনে এক ভদ্রমহিলার সাথে কথা হল, উনি বলেছেন! আচ্ছা আর্যদা, ভদ্রমহিলা কে? তোমার মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই বলেই তো শুনেছিলাম।
উনি ফোনে তোকে ওনার পরিচয় দেন নি?
দেখ, ডাইরেক্টলি তো জিজ্ঞাসা করা যায় না! খুব একটা পরিষ্কারও উনি করেন নি। উনি কি তোমার কোনওরকম তুতো।
এক বেলাতেই এত জানতে গেলে তো অন্য কথা এগোবে না। চল আগে বরং কিছু খাওয়া দাওয়া করা যাক। কি খাবি বল?
তুমি কি এখন থেকেই খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছ নাকি? না এটা পুরুষের স্বাভাবিক দাবী? আমিও তো খাওয়াতে পারি?
তুই আবার নারী পুরুষ নিয়ে পড়লি কবে? খাওয়াতে তুই অবশ্যই পারিস। কিন্তু প্রথমে এই চিন্তাটা আমার মাথায় এলো বলেই বললাম, পুরুষ হয়ে বলেনি।
ছাড়ো ওসব ঝগড়ার কথা। তোমার খবর কী বলো! এখন কোথায় থাকো? বিরাটীতে?
তুই তো আমার সব খবর জানিস দেখছি।
বাঃ – এটা আর এমন কঠিন কী! ওই ঠিকানায় বায়োডাটা পাঠানো হল বলে প্রাথমিক অনুমান লাগালাম - তুমি ওখানে থাকলেও থকতে পারো।
আরো অনেক খবরই তো রাখিস দেখছি। কোন কলেজে পড়াই, তুই জানলি কি করে?
খবর রাখতে চাইলেই রাখা যায়! কলেজ থেকে বেরোবার পর তুমি কোনও খবর রাখতে চাওনি আমার বলেই তুমি আমার কিছু জানো না।
তা ঠিক! বল তুই এখন কী করিস!
স্কুল সার্ভিস দিয়ে বসে আছি। এখনও ভাগ্যে কোনও শিকে ছেঁড়েনি।
এতদিন বিয়ে করিস নি কেন?
যাকে আমি ধরতে চাই, সে তো ধরা দেয় না!
পৃথিবীতে অনেক সুপাত্র আছে সায়নী। মিশলে হয়তো দেখা যাবে তাদের স্বামী হওয়ার গুণ প্রশ্নাতীত বা তাদের ধরতে চাওয়ার মতো অসংখ্য গুণ আছে আমাদের চোখের আড়ালে। একবার সেই রত্নের সন্ধান করাটাও জরুরী।
সে জন্যই তো পাত্র চাই বিজ্ঞাপণ অথবা মেট্রিমনিয়ালে খোঁজাখুজি!
কিছু পাওয়া যাচ্ছে না?
যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের পেতে ইচ্ছে করছে না, আর যারা মোটামুটি ইচ্ছে জাগানোর মতো, তাদের বয়স পেরিয়েছে অনেক।
তুইইবা এত দেরী করলি কেন?
ভাবছিলাম একটা চাকরী বাকরী জুটিয়ে তবেই এগোব। আসলে বিয়ে হয়ে গেলে নতুন করে কেউ চাকরী করতে দিতে চায়না। যে অলরেডি চাকুরীরতা একজনকে বিয়ে করে ফেলবে সে আর নিশ্চই চাকরী ছাড়তে ইনসিস্ট করবে না।
তা ঠিক।
তুমি কী রকম মেয়ে চাও আর্যদা? চাকরী করা না কি চাকরী ছাড়া?
আমি? ঠিক জানিনা রে!
জানিনা মানে কী? তোমার এই সংক্রান্ত কোনও ভাবনা চিন্তা নেই?
এখনও নেই।
তবে? বিয়েটা করতে চাও নাকি তাও চাও না?
জানি না।
তবে আজ এখানে এলে কেন?
চাপে পড়ে।
কার?
আর্য চুপ করে রইল। সায়নী আবার বলল, বাড়ীতে গিয়ে কী বলবো আর্যদা? ওরা তো আজকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবে।
না বলে দিস।
জানতে তো চাইবে কারণটা!
আর্য আবার চুপ করে রইল। সায়নী বলল, ‘আর্যদা, আমি কি এতটাই খারাপ?’
দূর বোকা, তুই খারাপ হতে যাবি কেন?
কোনও দিন তো তুমি আমাকে তোমার যোগ্যই মনে করলে না। আমি তো ভেবেই পেলাম না এতগুলো বছরে, কী করলে তোমার নাগাল পাবো। এতদিন বাদে কাগজে বিজ্ঞাপণ দেখে মনে হ’ল – এবার বুঝি একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমার কপালটাই এরকম।
এভাবে ভাবছিস কেন সায়নী। আমিই তোর যোগ্য নই রে! এটা আমার অক্ষমতা যে আমি তোর ভালোবাসাকে মর্যাদা দিতে পারিনি।
আমি তো সেই কারণটাই জানতে চাই আর্যদা।
দ্যাখ যখন তুই বি.এস.সি ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকলি তখন আমি ক্যারিয়ার নিয়েই বেশী সচেতন ছিলাম। আমি জানি তুই নানা ভাবে আমার কাছে পৌঁছোবার চেষ্টা করতিস, কিন্তু আমি সিম্পলি চোখ বন্ধ করে নিতাম। তোকে আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তোকে আমার ভালোই লাগতো। তুই আমাকে পেতে চাস – এই ভাবনা আমাকে আনন্দ দিত।
ঠিক আছে। এম.এস.সি পড়তে পড়তে তো যোগাযোগ রাখতে পারতে। বা তারপরে।
এম.এস.সি পড়ার সময়ে আমার বাবা এবং মা দুজনেই গত হলেন কয়েকমাসের ব্যাবধানে। আমার মাথার তখন ঠিক ছিল না সায়নী। কীভাবে বাড়ী সামলাবো, খরচা কোথা থেকে আসবে - এসব ভাবনাতে রাতে ঘুম আসতো না, প্রেম ভালোবাসা নিয়ে ভাববো কখন বল?
ঠিক আছে। এখন তো এসব সমস্যা নেই। তুমি এষ্টাবলিশড হয়েছো। এখন কেন আপত্তি করছো?
এক কাজ কর সায়নী। আগামী বৃহস্পতিবার এরকম সময়ে আমাকে একটু মিট করতে পারবি?
আমি তো সবসময় ফ্রি। তুমি চাইলে কালই আসতে পারি।
আমার হবে না রে। কাল বিকেলে প্র্যাকটিকাল ক্লাস আছে। ওই বৃহস্পতিবারই ঠিক আছে।
কোথায় আসবো?
বাগবাজারে গঙ্গার পাড়ে আসতে পারবি?
পারবো।
রাতে খাবার পর লাবণ্য বলল, কী রে আর্য, কী হল আজ বললি না তো!
না করে দিয়েছি।
সে না হয় দিলি। কিন্তু কেন দিলি মেয়েটা জানতে চাইলো না?
চাইলো।
তুই কি বললি?
কিছু বলিনি। তুমি আর এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করো না মিঠিদি, আমার বলতে ইচ্ছে করছে না।
কেন রে, পুরোনো প্রেম চাগাড় দিল?
মানে? তুমি জানো, ওকে আমি চিনতাম?
হ্যাঁ।
কীভাবে জানলে?
তুইই একদিন আবেগের বশে বলেছিলি। তোর কলেজ জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলেছিলি।
তা না হয় হল, তুমি একে আইডেনটিফাই করলে কীভাবে?
অ্যাকচুয়ালি তোর জন্য যে বিজ্ঞাপণ আমি দিয়েছিলাম, এর সম্বন্ধটা ওর কানেকশনে আসেনি। একটা ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে ওর বিজ্ঞাপণ ছিল। আমি ওটাই দেখে যোগাযোগ করেছিলাম। পরে ফোন টোন করে কনফার্ম হয়ে গেলাম – এ মেয়েটি তোর কলেজেই পড়তো। তুই যখন একটা সম্বন্ধ দেখতে রাজী হলি, আমি তখন এর নামটাই ভাবলাম। তোর একে পছন্দ করতে সুবিধা হবে।
সে গুড়ে বালি। তুমি আর এমন চিন্তা করো না।
আচ্ছা সে দেখা যাবে। তোরা আবার কবে ডেট করছিস বল!
আর্য খুব আগ্রহ ভরে লাবণ্যের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল। খুবই স্বাভাবিক এবং নিরুত্তাপ। আর্য বলল, আগামী বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা। বাগবাজার ঘাট। আর কিছু?’
না আপাতত। কী খেলি আজ?
হাওয়া-বাতাস!
তাতে না হয় তোর পেট ভরলো, রেষ্টুরেন্টের মালিকের তো আর ভরবে না! তাদের শান্ত করলি কী করে, তাই জানতে চাইছি।
ওই একটু কফি আর প্যাটিস নিলাম।
ব্যস! তোর প্রতি মেয়েটার ইমপ্রেশন কেমন হবে? বলবে কঞ্জুষ।
ওই তো অর্ডার করলো। আমি বললাম আরো কিছু নিতে। না নিলে কী করব?
জোর করবি। মেয়েরা জোর জবরদস্তি করাটা ভালোবাসে।
তুমি কি সেই দলে পড়ো? নাকি জবরদস্তি করাটা তোমার হবি?
আমি আবার কোথায় জবরদস্তি করলাম?
এই বিয়ে বিয়ে করে যা করছো, এটা কি?
যেটা করা উচিৎ বলে মনে করেছি তাই করছি।
কেন এমন করছ মিঠিদি? তুমি কি কোনও কারণে আমার প্রতি বিরক্ত হয়েছ?
বাবা, মা কি ছেলের উপর বিরক্ত হয়ে বিয়ের জোগাড় করে?
তোমাকে বোঝা সত্যি বড় কঠিন।
তাহলে আর চেষ্টা করিস কেন?
২
কী গো আর্যদা, এত দেরী হল আসতে? বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বলল সায়নী।
একটু দেরী হয়ে গেল রে! ডিপার্টমেন্টের কিছু ইনষ্টরুমেন্ট নেওয়ার ছিল। তার টেন্ডার কল করার বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। চল একটু কোথাও গিয়ে চা খাই!
কোথায় খাবে? এই ষ্টলগুলোর থেকে?
যা হোক খাই তো আগে। ফেরার পথে শ্যামবাজারে ভালো করে চা খাওয়া যাবে।
চা খেয়ে ওরা ঘাট থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে বসল একটা গাছের নীচে। গোধূলি ও ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। গঙ্গার উপর ধূসর নিঃসঙ্গতার ছায়া যেন চারদিকটাকে বড় বেশী স্তব্ধ করে দিয়েছে। পাড়ে জলের ছলাৎ ছল শুনতে শুনতে সায়নী আর্যের ডানহাতটা নিজের কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘আজকে কিছু বলবে বলেছিলে’।
বলার তো আছে রে অনেক কিছু। কিন্তু কীভাবে বলব, ভাবতে পারছি না।
বলতে যখন হবেই, বলে ফেল। তোমার থেকে আঘাত সইতে সইতে আমি সর্বংসহা হয়ে গেছি। তোমার ‘না’ শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে, তবে ভেঙে পড়বো না, কথা দিচ্ছি।
বেশ, তাহলে শোন, তোর সাথে এই বিয়েটা আমার হতে পারবে না।
কেন, সেটাই তো বলবে বলেছিলে। ‘না’ টুকু তো আগেই শোনা।
আমি একটা রিলেশনে আছি।
বেশ তো! তাকেই বা বিয়ে করে নিচ্ছ না কেন? তাকে ঝুলিয়ে রেখে বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপণ দিচ্ছ – সেটাই বা কোন ঠিক কাজ?
যার সাথে রিলেশনে আছি, বিজ্ঞাপণটা তো সেই দিচ্ছে রে!
মানে?
মানে এত সহজ নয় সায়নী। তুই সেদিন যে ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলেছিস, আমি তার সাথে লিভ টুগেদার করি।
তা সেই মেয়েটি বা রিলেশন থেকে বেরোতে চাইছে কেন? তোমাকে আর পছন্দ নয়?
আমি ঠিক বুঝি না রে!
কী করে মেয়েটা?
মেয়েটা মেয়েটা কী করছিস? উনি মোটেই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। কেমিষ্ট্রির অধ্যাপিকা। প্রচুর প্রজেক্টের কাজ করেন, অনেক পেটেন্ট আছে।
আমি চিনি?
তুই কী করে চিনবি?
সে যাই হোক। অধ্যাপিকারা কি বিয়ে করে না, নাকি সাইনটিস্টদের এসব দরকার পড়ে না?
উনি আমার টিচার ছিলেন।
বলো কী? কীভাবে হল এসব?
সে এক দীর্ঘ কাহিনী। আমি যখন এম.এস.সি র সেকেন্ড ইয়ারে, তখন উনি ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেন। আমার তো অরগ্যানিক কেমিষ্ট্রি ছিল। ওনার ফিজিক্যাল, ফলে ডাইরেক্ট ক্লাস উনি নিতেন না। তবু টুকটাক নানা কারণে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হ’ত বা কথাবার্তা হ’ত।
এতো ‘ম্যায় হুঁ না’ ফিল্মের স্টোরি হয়ে গেল যে!
তেমনটা আর হল কই? শুধু শিক্ষিকা - প্রেমিকা – এই মিলটুকু পেতে পারিস।
বাই দা বাই, উনি দেখতে কেমন আর্যদা?
এই তো – মেয়েলি কৌতুহল শুরু হয়ে গেল! তুই কি তোর সাথে তুলনা করতে চাস?
না। তবু...
ভীষনই ডিগনিফায়েড। এতটাই ডিগনিফায়েড যে ওর সৌন্দর্য তার মধ্যে চাপা পড়ে যায়। এমন ডিগনিটি যে রূপের প্রশংসা করতেও মানুষের বুক কাঁপবে! তাহলেই ভাব!
এমন মহিলাকে তুমিই বা কব্জা করলে কী করে?
যদি দেখতিস মিঠিদি কে, তবে ওই ‘কব্জা’ শব্দটা ব্যাবহার করতে পারতিস না।
যাইহোক, তারপর বলো।
তখন মিঠিদিকে খুব ডিষ্টার্বড লাগতো। কথায় কথায় জানতে পারলাম – ওর বরের কিডনি ডিজিজ। সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে – অথচ এত বড় বিপদ। ডাক্তার বলেছে কিডনি বদলাতে হবে, ডোনার দরকার।
তা উনি নিজে দিয়ে দিলেন না?
মিঠিদির সাথে গ্রুপ ম্যাচিং হয়নি।
কী হল তবে?
আমি তখন বললাম, আমি দিতে রাজী, যদি ডাক্তার পারমিশন দেন।
তুমি বললে? আর তাতে মিঠিদি রাজী হয়ে গেলেন?
মিঠিদি প্রথমে রাজী হয়নি। বললো তা কী করে হয়! সামনে তোর এত বড় জীবন পড়ে আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি...
আল্টিমেটলি তুমি দিলে?
শোননা ধৈর্য্য ধরে। তারপর অনেক বিজ্ঞাপণ-টন দেওয়া হল, যদি ডোনার পাওয়া যায়। দালাল ধরা হল – আল্টিমেটলি কাউকে পাওয়া গেল না। তখন আমাকে ছাড়া অন্য কোনও অপশানও ছিল না। ডাক্তার টেষ্ট ফেষ্ট করিয়ে ডেটও দিয়ে দিলেন।
তোমার বাবা-মা আপত্তি করেন নি?
গতদিনই তো বললাম, ওঁরা তখন আপত্তি করার জন্য পৃথিবীতে ছিলেন না।
ওঃ স্যরি। তারপর?
যেদিন ডেট ফাইনাল হল, তার সপ্তাহখানেক আগেই হঠাৎ করে ওঁর হাজব্যান্ড মারা গেলেন। মিঠিদি একা হয়ে গেল, সেইসব দিনে ওর একজন বন্ধু আছেন অরিন্দম নামের – তিনিও কলেজের টীচার - তিনি আর আমি দুজনে মিলে হাল ধরলাম। আমারও তখন চালচুলো নেই। হোস্টেলে থাকার খরচ সামলানো দায় হয়ে উঠেছিল। আমি ধীরে ধীরে মিঠিদির বাড়ীতে থাকা শুরু করলাম। এরপর আস্তে আস্তে কখন কী হয়ে গেছে বুঝতেও পারিনি।
তুমি তখন এম.এস.সি পড়তে; মানে ধর ব্যাপারটা ছ-সাত বছর হয়ে গেল?
হ্যাঁ। তা তো হবেই।
তাহলে উনি বা এতদিন বাদে তোমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লাগলেন কেন? বুড়ো বয়সে বিবেক দংশন হচ্ছে?
আর্য বুঝলো সায়নী ঈর্ষা থেকে এই ধরনের মন্তব্য করছে। সে কিছু না বলে চুপ করে রইল। সায়নী আবার বলল, ‘তুমিই বা এই সুযোগ নিচ্ছ না কেন?’
তাহলে তো ওটা ‘সুযোগ নেওয়া’ ই হত সায়নী।
স্যরি আর্যদা, আমার ইনটেনশনটা তেমন ছিল না। আমি বলতে চাইছি, ব্যাপারটা তো সত্যিই ঠিকঠাক সম্পর্ক নয়। এতদিন বাদে উনি যখন ব্যাপারটা রিয়েলাইজ করেছেন, তোমারও তাতে সায় দেওয়া উচিৎ।
সম্পর্কটা কি মিঠিদি একা গড়েছে?
মানে?
আমি বলতে চাইছি – সম্পর্কটা তো ও একা গড়েনি, সুতরাং ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তটাও তার একার হওয়া উচিৎ নয়।
ঠিক আছে, তোমরা মিলিতভাবে নাও।
এসব কথা থাক, তুই বুঝবি না।
আর্য চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পরে বলল, ‘চল উঠি।’
সায়নী বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? ঠিকঠাক উত্তর দেবে তো?’
বল।
তোমাদের এই সম্পর্কে কে প্রথম কাছে এসেছিল? তুমি?
আর্য কিছু না বলে হাসল শুধু। বলল, ‘চল তোকে তোর বাড়ী অবদি দিয়ে আসি।‘
থাক আর্যদা। আর স্মৃতি বাড়িও না। এইটুকু আমি একাই যেতে পারবো।
ঠিক আছে, শ্যামবাজার পর্যন্ত তো চল। কিছু খেয়ে তারপর যাওয়া যাবে।
আজ আর খাওয়ার মুড নেই আর্যদা। অন্য কোনও দিন হবে। আমার ফোন নম্বর তো তোমার কাছে রয়েছেই। ইচ্ছে হলে ফোন করো। আমি অপেক্ষা করবো।
অপেক্ষাটা শুধু কলেরই করিস, অন্য কিছুর নয়, প্লীজ।
তুমি বড় নিষ্ঠুর, আর্যদা!
রাত প্রায় আটটা বাজলো, আর্য এখনও ফিরলো না। অনেক বার বারান্দা দিয়ে উঁকি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে গিয়ে চেয়ারে বসল লাবণ্য। আজ কেন এত একাকী লাগছে তার? মাথাটাও ধরে আছে। আর্য এলে একসাথে চা খাবে বলে আর জলটাও চড়ানো হয়নি। ওর কি আর্যের উপর রাগ হচ্ছে? হওয়া তো উচিৎ নয়। সে নিজের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করল। নাকি আর্য দেরী হবে কথাটা জানিয়ে দেয়নি বলে অবচেতনে ক্রোধ জমছে? নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো সে। এখন একটু গান শুনলে হয়। নাকি গাইবে সে? ‘তারে দেখাতে পারি নে কেন প্রাণ খুলে গো/ বুঝাতে পারি না হৃদয়বেদনা/ কেমন সে হেসে চলে যায়, কোন প্রাণে ফিরেও না চায় -/ এত সাধ এত প্রেম করে অপমান...’ হঠাৎ দেখলো অরিন্দমের ফোন। ‘কী রে! তুই একা?
হ্যাঁ।
আর্য ফেরেনি?
না।
কেন এমন করছিস লাবু। আমি তো জানি তুই ওকে ভালোবাসিস। মিছিমিছি কেন ওকেও কষ্ট দিচ্ছিস, নিজেও পাচ্ছিস?
মিছিমিছি নয় রে!
সেদিন আমি তোর পাগলামি দেখে কিছু বলিনি, কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি। এটা তোর একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে লাবু।
আমি অনেক ভেবে চিন্তে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি অরিন্দম।
তোর লজিকটা শুনি? শিক্ষিকা-ছাত্র?
না। তাহলে এতদিন কি টানতাম? প্রথম দিনেই কেটে ফেলতাম।
তবে?
দ্যাখ অরিন্দম, আমার বয়স এখন চুয়াল্লিশ। দেখতে যত খুকীই লাগুক না কেন, শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার স্যাপার গুলো তো তা মানবে না। এখন আর্যর বয়স পঁয়তিরিশ। ধর আর আট ন’বছর পর ও যখন আমার আজকের বয়সে পৌঁছাবে - তার এই সম্পর্কের জন্য গ্লানি হবে না তো? সে মনে করবে না তো আমার জন্য তার জীবনের কোনও সাধ পূর্ণ হল না!
সে এমন কিছু কখনও বলে কি?
না। তবে আজ বলেনি মানে কাল বলবে না, তার তো কোনও মানে নেই।
সে অবশ্য ঠিক কথা। কিন্তু সব দায় তো তোর নয়। এই সম্পর্কে তো তারও ইনভলভ্মেন্ট আছে। ফলে এই আফসোস করার তার কোনও অধিকার নেই।
ব্যাপারটা আইনি নয় অরিন্দম। বিষয়টা আদৌ মনে আসাটাই যথেষ্ট ক্লেশকর।
তাহলে তোরা বিয়ে করে নে।
আমি বাঁধন ছিঁড়তে চাইছি অরিন্দম। নতুন করে বাঁধনে জড়াতে চাইছি না আর! অন্তত শেকল খোলা থাকলে - ওর যে কোনও দিন উড়ে যাবার অবকাশ থাকবে। বিবেকের দোহাই দিয়ে সহবাস আমার সহ্য হবে না রে!
কিন্তু আর্য তোকে ভালোবাসে। এভাবে ওকে কষ্ট দিস না! তুই এত রূঢ় হয়ে গেলে সম্পর্কটা স্ট্রেইন হয়ে যাবে।
শরৎচন্দ্র কী বলেছেন মনে কর - বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও সরিয়ে দেয়। আমাকে দৃঢ় হতেই হবে অরিন্দম। আমি যদি এখন শক্ত না হই তবে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। এই কলিংবেল বাজলো, রাখ এখন। আর্য এল বুঝি!
দরজা খুলে দেখল, আর্য। মুখে বলল, ‘এত দেরী?’
কেন তুমিই তো চেয়েছিলে যাতে ঘুরে ফিরে আসি। ডেট করতে গেলে কি আর টাইম জ্ঞান থাকে?
লাবণ্যের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘না থাক, একটা ফোন করে দিলে আর উদ্বেগ থাকে না, এটাই বলতে চাইছিলাম।‘ আর্য মনে মনে জরিপ করল, এটা কি কোনও রকম অভিমানের কথা? সে তো ইচ্ছে করেই এদিক ওদিক ঘুরে দেরী করে এসেছে যাতে লাবণ্যের ভেতরের কোনও ঈর্ষা-অভিমান সে আঁচ করতে পারে। সে দেরী করে এসেছে বলে ওর রাগ হবে এমন তো নয়। বরং সায়নীর সাথে ঘুরে দেরী করেছে – এটা কোথাও একটা ঈর্ষার আগুন জ্বালাতে পারে। সে ব্যাপারটা আরও উস্কে দেওয়ার জন্য বলল, ‘বাগবাজারের গঙ্গার ঘাটে বসে ছিলাম, জানো তো! কখন গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। তারপর তোমার কথা মতো ভালো মতো কিছু খাইয়ে টাইয়ে বিদায় করতে হ’ল তো! তাতে আরও সময় গেল!’
লাবণ্য আবার নিজেকে খোলসে ঢুকিয়ে ফেলেছে। সে শুধু বলল, ‘চা খেয়ে এসেছিস? নাকি জল চড়াব?’
তুমি খেয়েছ?
না।
তবে খাবো। আর্য ভাবলো, এই কারণেই হইতো মিঠিদির রাগ হয়েছে। এতক্ষণ চা না খেয়ে ওর জন্য বসে আছে সে। আচ্ছা এই প্রতীক্ষাটা অভ্যাস না ভালোবাসা? আর্য দেখলো, লাবণ্য একমনে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাপে জল মাপছে। ওর ইচ্ছে করলো – এই মুহুর্তে গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ওর চিবুকটুকুতে একটা চুম্বন এঁকে বলে ‘বঁধূ মিছে রাগ করো না, করো না। মম মন বুঝে দেখ মনে মনে। মনে কোরো, করো করুণা’। তবু নিজেকে দমন করল সে। এখন কেমন যেন একটা অধ্যাপিকা সুলভ মুখোশ পরে আছে লাবণ্য। নিজেকে বড় অসহায় মনে হল তার। সে কি পারে না এই মুখোশটুকু থেকে ভেতরের নরম মনের মানুষটাকে বের করে আনতে? ওই সুন্দর শরীরে তার হাতের স্পর্শে কি কোনও দিন বাঁশি বাজেনি? কোনও দিনই কি ওর কুঁড়িরা ফুটে ওঠার জন্য ওর আলিঙ্গনের প্রতীক্ষা করে নি? ওর পৃথিবীর সব কিছুই কি এতখানি ডিগনিফায়েড, এতটাই আভিজাত্যে মোড়া? ওর নিজেরই তো প্রগলভ হতে ইচ্ছে করে খুব। ওর কানও প্রতীক্ষা করে অন্যের প্রগলভতার। অনেক স্মৃতি হাতড়েও তেমন কিছু মনে করতে পারলো না আর্য। তার মনে পড়ল প্রথম আলিঙ্গনের রাত। আর্য যখন পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছিল তাকে, লাবণ্য শুধু খুব মৃদু ভাবে ওর চুল বিলি কেটে দিয়েছিল। আর্য শুধু বুঝেছিল ওতে প্রশ্রয়ের সম্মতিটুকু আছে – উষ্ণতার তল সেদিনও সে খুঁজে পায়নি – এখনও পায় না।
নে চা খা।
রাখো ওখানে।
ও বাবাঃ। এখনু তুই জামা কাপড় চেঞ্জ করিস নি? যা আগে চেঞ্জ করে আয়।
থাক না মিঠিদি। ঠান্ডা হয়ে যাবে।
আমি গরম করে দেব আবার। ফ্রেশ হয়ে চা খা, ভালো লাগবে। আবার সেই আগের মতো অভিজাত নির্দেশ, স্বাভাবিক গলার স্বর। এই নির্দেশ উপেক্ষা করার শক্তি ঈশ্বর আর্যকে দেননি। সে বাধ্য ছেলের মত উঠে গেল বাথরুমে।
রাত্রে খাওয়ার সময় আজ তেমন কোনও বাক্যবিনিময় হলনা। লাবণ্য বলল, ‘কাল একটু আমার সকাল সকাল বেরুনোর আছে, আজ আর বসবো না বাইরে।‘ রান্না টান্না গুছিয়ে, টেবিল পরিষ্কার করে সে চলে গেল শোবার ঘরে। শোওয়ার আগে আলগা একটা হাতখোঁপা করে মুখে ক্রীম লাগানো ওর বরাবরের অভ্যাস। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মুখে ক্রীম লাগাতে লাগাতে সে অনুভব করলো, আর্য ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। সে মৃদু বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কী হল’?
দেখতেই তো পাচ্ছ।
ছাড়।
ছাড়বো না।
ভালো লাগছে না বলছি, ছাড়।
আমার ভালো লাগছে। ছাড়বো না।
তুই জোর করবি?
দরকার পড়লে করবো। এই তো সেদিন বললে মেয়েরা জোর জবরদস্তি ভালোবাসে।
ও গুরুমারা বিদ্যা! আমারই শেখানো বিদ্যা আমার উপরেই প্রয়োগ করবি?
অগত্যা।
কিন্তু আমি কি তেমন মেয়ের দলে পড়ি?
পড়ো না, কিন্তু এবার তোমায় তেমন ছাঁচে ফেলবো।
তোর অনেক কনফিডেন্স বেড়ে গেছে যে রে!
সঙ্গগুণ বলতে পারো।
নে ছাড় এবার।
আর্য আরও দৃঢ় আলিঙ্গনে জাপটে ধরল একথার উত্তরে।
কী রে, কথা শুনছিস না কেন? ছাড়। এখন থেকে তোর সাথে এসব বন্ধ।
কারণ?
ন্যাকামো করিস না আর্য। তুই জানিস না?
না জানিনা। তুমি স্পষ্ট করে বলো।
কেন আমার পেছনে মিছিমিছি জীবনটা নষ্ট করছিস তুই?
তোমাকে ছাড়াই জীবনটা নষ্ট হবে মিঠিদি।
তুই পালা আর্য। আমি তোর জীবনে বিষকন্যা। এই বিষের আগুনে জ্বলে যাবি তুই।
এই জ্বালা আমাকে জুড়োয় মিঠিদি। তুমি চিন্তা করো না।
কেন আমার অপরাধের বোঝা বাড়াচ্ছিস আর্য। ভুল আমি যেটুকু করেছি – তার প্রায়শ্চিত্ত তো করতে চাইছি। তুই যদি সাহায্য না করিস, কী করে তা সম্ভব হবে?
তুমি কোনও ভুল করো নি মিঠিদি। তুমি অকারণ এসব নিয়ে ভাবছো।
দ্যাখ আর্য, আমি তোর থেকে জীবন অনেক বেশী দেখেছি। আজ যেটা তুই অস্বীকার করছিস – একদিন এই নিয়ে তোর আফসোস হবে।
তুমি আমার থেকে অনেক বিষয়ে হয়তো অভিজ্ঞ। কিন্তু আমি নিজেকে তো তোমার থেকে বেশী চিনি। তুমি অকারণ অনিশ্চিত ভবিতব্যের কল্পনায় নিজেকে ব্যস্ত করো না। নাও এবার আমার দিকে ঘোরো।
প্রায় জোর করে লাবণ্যকে নিজের মুখোমুখি ঘোরালো আর্য। হালকা আলিঙ্গনে ওর কপালে একটা চুমু খেল। লাবণ্য বলল ‘নতুন নতুন প্রেম করে এলি, তাতে বুঝি মন ভরলো না?’
এই তো মুখোশের ভেতরের মানুষটার মতো শোনালো কথাটা। আর্য সজোরে লাবণ্যকে বুকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো ‘তোমার মধ্যেই তো প্রেমটাকে রোজ রোজ নতুন করে পাই মিঠিদি, তুমি বুঝতে পারো না?’ জবাবে লাবণ্য আর্য্যের বুকে মুখটা চেপে অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলল, আর্য ভালো বুঝলো না। কিছুক্ষণ পরে সোজাসুজি চোখ তুলে সে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের লম্বা কাচটায় ওদের যুগলবন্দী ফটোফ্রেমের মতো স্থির হয়ে আছে – সেখান থেকে সে চোখ ফেরাতে পারলো না অনেক্ষণ।
1 Comments
উত্তর বেলা এই মাত্র পড়ে উঠলাম। কি বলবো এ লেখা নিয়ে? চোখ বুজে বসে রইলাম অনেক ক্ষণ।
ReplyDelete