কমলিকা ভট্টাচার্য
রোজ ভোরে যখন আমার ঘুম ভাঙে, তখন সকালের আলোর চোখেও লেগে থাকে আলসেপনা। সেই সময় আমি জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি, স্কুটি নিয়ে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। বিল্ডিংয়ের দারোয়ান তখনও ঘুমিয়ে। তাঁকে ডাকার দরকার হয় না—তিনি নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে যান, বরঞ্চ রাতের জ্বলা লাইটগুলো নিভিয়ে দেন। কোনোদিন ভোররাতে টয়লেটে জল না থাকলে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ি। জানি, দারোয়ান ভুলে গেলেও তিনি ঠিক সকালে পাম্প চালাবেন।
সকালে গাছে জল দিতে গিয়ে দেখি, বাজার সেরে ফেরার পথে গেটের বাইরে কুকুরগুলোকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন। ঘরে ফিরে চা বানান, ঘরের মানুষটিকে দেন, যিনি তখনও ঘুমিয়ে। তাকে জাগিয়ে ছোটখাটো কাজ সেরে দোকানের জন্য তৈরি হন। ঠিক আটটার সময় স্কুটিতে প্যাক করা খাবার নিয়ে রওনা দেন তাঁর টেলারিং দোকানের উদ্দেশ্যে, যা বাড়ি থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে।
রাতে, যখন বিল্ডিং ঘুমিয়ে থাকে আর সিকিউরিটি চেয়ারে চোখ বুজে ডিউটি করে, তখনও তিনিই নিজে গেট খুলে ঢোকেন। ফেরার পথে যদি কোনো খাবার কেনেন, সিকিউরিটির জন্য আলাদা একটি প্যাকেট করে আনেন। সেটি তার হাতে দিয়ে ঘরে ফেরেন। তখন কোনোদিন রাত সাড়ে এগারো, কখনো বা বারোটা। মাসের শুরুতে হাউসকিপিং লেডির পরিবারের জন্য পুরো মাসের মুদির জিনিস কিনে দেন।
🍂
যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, একগাল হেসে নিজের কথা বলেন। কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগই দেন না। পরে জানি, তিনি কানে কম শোনেন। ভয় পান ভুল উত্তর দেবেন, তাই নিজের কথা বলে লজ্জা ঢেকে রাখেন। তাঁর পরিবারের মুখে শুনি, বাড়িতেও সবাইকে সামলান। কার কী দরকার, খেয়াল রাখেন, কিন্তু নিজের জন্য কখনো কিছু চান না।
মাঝে মাঝে তাঁদের বলি, “ওনার প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়স। এতটা পথ স্কুটিতে যান! ওনার কানে শোনার সমস্যা, শরীরও তো ধকল নিতে পারে না।” উত্তরে তাঁরা বলেন, “উনি শুনবেন না। দোকান আর সংসারটাই ওনার প্রাণ।” ছেলেরা ভালো কাজ করে—একজন তো বিদেশে। নাতি-নাতনিরা নিয়ে ভরা সংসার।
তাঁকে যত দেখি, ততই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। নিঃশব্দে নিজের সংসার আর বিল্ডিংয়ের মানুষদের জন্য যেভাবে নিঃস্বার্থে করে যান, তা বিরল। কোনোদিন মিটিংয়ে আসেন না। এসোসিয়েশনের বড় পোস্টের দাবি করেন না। জল না থাকলে, লিফট না চললে, কোনো কিছু খারাপ হলে নিজের মতো করে সমাধান করেন। অভিযোগ নিয়ে দাঁড়ান না।
এই মানুষটি আমার প্রতিবেশী দাদা তাজ মহম্মদ। আর আমার চোখে তিনি সত্যিকারের সংসারের তাজমহল।
আজ আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে, এই রকম সকল সংসারী পুরুষ, যাঁরা হাসিমুখে নিজের দায়িত্ব নীরবে পালন করে চলেছেন, তাঁদের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
2 Comments
খুব ভালো লাগলো কমলিকার লেখাটি। জীবনের টুকরো স্কেচ। আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে এর চাইতে ভালো নিবেদন বোধহয় হয় না !
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। প্রণাম নেবেন।
Delete