কলকাতার জল-হাওয়ায় তাঁর বড় হয়ে ওঠা। অন্ধকার ছাদে আলোকবর্ষ দূরের তারারা তাঁর পড়শী। তাঁর শৈশব ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ব্যতিক্রমী। শিশুকাল থেকেই অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহল। বাংলা তথা দেশ-বিদেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের অক্লান্ত একজন শিল্পী। তিনি ড. দেবীপ্রসাদ দুয়ারী। কলকাতার বিড়লা তারামণ্ডলের প্রাক্তন ডিরেক্টর। গবেষক। বিজ্ঞানী। এ হেন পণ্ডিত মানুষটির মুখোমুখি আমি। ভার্চুয়াল আলাপে আলোকিত তাঁর জীবনের একগুচ্ছ নিউক্লিয় ঘটনা। তাঁর জীবনের কঠিন বাস্তবের সহজাত রুক্ষতার মেঠোপথ থেকে ব্রহ্মাণ্ডের কৃষ্ণবিবরে ঘটনা-দিগন্ত নিঃসৃত গোপন বিকিরণ অব্দি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমাকে! সেদিন ছিল সোমবার। ১৭ই জুন ২০২৪। সময় সকাল সোয়া দশটা। পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনিময়ের পর আলাপচারিতা শুরু।
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা : স্যার, আপনার ছেলেবেলা স্কুল পড়াশুনা ইত্যাদি নিয়ে যদি দু-চার কথা বলেন…
দেবীপ্রসাদ দুয়ারী : আমার জন্ম কলকাতায়। পড়াশোনা কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষকতা জগতের মানুষ ছিলেন। প্রথাবিরুদ্ধভাবে তাঁরা দুজনে আমাকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন – আমরা চাই না ক্লাসে তুমি প্রথম হও। আমরা চাই ঠিকঠাক পড়াশোনা করে তুমি নিজের চিন্তাভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে চলো। বাড়িতে একা একাই পড়তাম। কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না।
পূর্ণচন্দ্র : শিক্ষক বাবা-মা কখনও সাহায্য করেননি?
দেবীপ্রসাদ : বাবা-মা কখনও আমাকে হাতে ধরে পড়াশোনা শিখিয়ে দেননি। উপর থেকে সর্বক্ষণ নজর রাখতেন তাঁরা। একেবারে আটকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে 'Spoon Feeding', সেটা কখনও করেননি।
পূর্ণচন্দ্র : রেজাল্ট কেমন হয়েছিল?
দেবীপ্রসাদ : মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছে। একেবারে প্রথম সারির প্রথম দশজন কিংবা প্রথম কুড়িজনে আমি কখনোই যেতে পারিনি। কারণ, আমার একক প্রচেষ্টায় তা সম্ভব ছিল না। তবে মাধ্যমিকের ন্যাশনাল মেরিট স্কলারশিপ পেয়েছি। ন্যাশনাল মেরিট সার্টিফিকেট পেয়েছি। যদিও র্যাঙ্ক করিনি।
পূর্ণচন্দ্র : পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি টান-ভালোবাসা-আবেগ কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
দেবীপ্রসাদ : ছোটবেলায় মূলত ক্লাস এইট-নাইন থেকে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো যার উত্তর হয়তো বইয়ে নেই। কেন একটা ঘটনা ঘটছে? কেন জল পড়লে শব্দ হচ্ছে? শব্দগুলো আলাদা আলাদা কেন হচ্ছে? কেন প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার পর আরো গুচ্ছ ঘটনা পরপর ঘটে চলেছে? বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম সব কিছুর পেছনে কোনও কারণ আছে। কারণটা বিজ্ঞানসম্মত।
পূর্ণচন্দ্র : প্রথম থেকেই কি ঠিক ছিল পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়বেন?
দেবীপ্রসাদ : যাদবপুরে পদার্থবিদ্যা পড়ার পেছনে একটা কারণ আছে। আমাদের চারপাশে যে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো ঘটছে, তার পেছনের কারণটা মূলত পদার্থবিদ্যা — স্কুল লাইফ থেকে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল। তখন থেকে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে আমার একটা আগ্রহ জন্মালো।
পূর্ণচন্দ্র : জ্যোতির্বিজ্ঞানের জার্নি শুরু কীভাবে?
দেবীপ্রসাদ : একখানা আর্টিকেল পড়েছিলাম। আমাদের শরীর, আমাদের বেঁচে থাকা, জীবন– সবকিছুর ওপরে একটা মহাজাগতিক প্রভাব রয়েছে। পরপর ঘটমান গুচ্ছ ঘটনার ফলে পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে। সেই প্রাণের আমি একটা অংশ। আমার চারপাশে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে মহাকাশের অনেক গোপন তত্ত্ব। তখন থেকে মহাকাশ সম্পর্কে আমার একটা আগ্রহ জন্মালো।
পূর্ণচন্দ্র : মহাকাশ নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনার নেশা কখন চেপে বসে!
দেবীপ্রসাদ : বিএসসি পড়ার সময় দেখলাম মহাকাশ সংক্রান্ত ঘটনা – তা পার্টিকেল-ফিজিক্স হোক অথবা থার্মোডাইনামিক্স – সবজায়গায় মহাকাশের ঘটনা বারবার চলে আসছে।
পূর্ণচন্দ্র : বিএসসি'র কোনো বিশেষ ঘটনা?
দেবীপ্রসাদ : বিএসসির পর ব্যাঙ্গালোরে রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে আমি দেড় মাসের একটা সামার রিসার্চ ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। সেখানকার ডিরেক্টর তখন নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক সি ভি রমন-এর ছোট ছেলে ভি রাধাকৃষ্ণণ। সেখানে আমার কাছে একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কলকাতা–যাদবপুরের পরিবেশ থেকে একেবারে অন্যরকম। ছাত্র-গবেষক-অধ্যাপক সবাই নিমগ্ন চিত্তে সারাদিন শুধু বিজ্ঞান-গবেষণা ও পড়াশোনার কাজ করে চলেছেন। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের লেগেছিল।
পূর্ণচন্দ্র : কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোর – দুটি আলাদা জায়গা। ভিন্ন পরিবেশ। পৃথক সংষ্কৃতি। দু'জায়গায় কাজের কী পার্থক্য?
দেবীপ্রসাদ : কলকাতার জীবন মানে শুধু পড়াশোনার গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখা নয়। পারিপার্শ্বিক ঘটনা-সাহিত্য-কবিতা-গান-নাটক-খেলাধুলা এসব নিয়েই জীবন। ব্যাঙ্গালোরে দেখেছিলাম সবার মধ্যে একটা একমুখী চিন্তাভাবনা।
পূর্ণচন্দ্র : সামার-ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা?
দেবীপ্রসাদ : ক্যাম্পে সম্পূর্ণ নতুন একটা প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়। আমাদের আকাশ-গঙ্গা বা মিল্কি-ওয়ে-গ্যালাক্সির বাহুগুলো মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। এই হাইড্রোজেনকে খুঁজে বার করে কোথায় কত হাইড্রোজেন আছে তা দিয়ে আমাদের মিল্কি-ওয়ে-গ্যালাক্সির একটা আকৃতি-আয়তন বার করার চেষ্টা। খুব শক্ত কাজ।
পূর্ণচন্দ্র : কতদিনে সম্পন্ন হল প্রোজেক্টের কাজ?
দেবীপ্রসাদ : রমন ইনস্টিটিউটের ১০.৪ মিটার ব্যাসের একটা রেডিও এন্টেনা ছিল। সেটিকে কাজে লাগিয়ে ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট-এর লোকেরা হাইড্রোজেন মাপার একটি ২১ সেমি লাইট – যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ২১ সেন্টিমিটার, হাইড্রোজেন অ্যাটম থেকে এরকম বিকিরণ বের হয় – তার একটা রিসিভার বানায়। সেটা দিয়ে আমি কাজ শুরু করি। প্রথমে খুব ঘাবড়ে গেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল খুব ভালো ফল আসছে। পরবর্তীকালে আমার দেড় মাসের অবস্থানটা বদলে তিন মাস হল। মাস তিনেক অবজারভেশন করে একটা রেজাল্ট বের হতেই ডিরেক্টর আমাকে অনেক বাহবা দিলেন। আমাকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে একটা বক্তৃতাও দিতে হলো। বক্তব্য রাখাটা আমার কাছে খুব গর্বের। ওই অল্প বয়সে বড় বড় বিজ্ঞানীদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার একটা ক্ষমতা বা প্রয়াস – সত্যিই একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা।
পূর্ণচন্দ্র : প্রোজেক্ট থেকে বড় প্রাপ্তি কী?
দেবীপ্রসাদ : জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সাহস সঞ্চয় বড় প্রাপ্তি। যাদবপুর থেকে এমএসসি পাসের পর পিএইচডির নেশা ঘাড়ে চেপে বসল। উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে ভবিষ্যতে কী করতে হবে তা নিয়ে আমাকে প্রচণ্ড কোনো চাপের মধ্যে রাখেননি আমার বাবা-মা। এও এক বড় প্রাপ্তি।
পূর্ণচন্দ্র : বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা ছেড়ে আগামীতে মহাকাশ-বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার জার্নি কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল?
দেবীপ্রসাদ : হঠাৎই একদিন ইউনিভার্সিটির নোটিশ বোর্ডে একটা বড় পোস্টার চোখে পড়ল। ১৯৮৯ সালে নতুন একটা ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে মহারাষ্ট্রের পুনাতে। ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাণ্ড অ্যাস্ট্রোলজি (IUCAA)। ডিরেক্টরের নাম জয়ন্তবিষ্ণু নার্লিকর। নামটার সঙ্গে আমি পূর্বপরিচিত। তবে আমি গুলিয়ে ফেলি উনি হয়তো বিদেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোক। ইন্টারভিউতে জানলাম উনি রীতিমতো ভারতীয় – মহারাষ্ট্রের লোক। বিশ্বজুড়ে তাঁর নাম-যশ। ইতিমধ্যে ১৬০০ অ্যাপ্লিকান্টের ভেতরে মনোনীত মাত্র দুজন রিসার্চ স্টুডেন্টের মধ্যে আমি একজন।
পূর্ণচন্দ্র : কার অধীনে গবেষণা শুরু করলেন?
দেবীপ্রসাদ : এক বছরের কোর্স ওয়ার্ক শেষে প্রফেসরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি — আমি আপনার কাছে গবেষণা করতে চাই। প্রথমেই শুনে চমকে উঠে তিনি বললেন – দেখো, আমি এমন একটা বিষয়ের উপরে কাজ করি যা পৃথিবীতে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করে না। হয়েল–নার্লিকার স্টেডি স্টেট তত্ত্ব। আমি চাই না আমার ছাত্র এমন একটা বিষয়ের উপর কাজ করুক যাতে পরবর্তীকালে চাকরির ক্ষেত্রে বা অন্য গবেষণার ফিল্ডে সুযোগ পেতে তার অসুবিধা হয়। সুতরাং আমার কাছে কাজ না-করাই শ্রেয়। আরও বড় বিজ্ঞানী আছেন, তুমি তাঁদের আণ্ডারে কাজ কর।