জ্বলদর্চি

জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবীপ্রসাদ দুয়ারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবীপ্রসাদ দুয়ারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা 


কলকাতার জল-হাওয়ায় তাঁর বড় হয়ে ওঠা। অন্ধকার ছাদে আলোকবর্ষ দূরের তারারা তাঁর পড়শী।‌ তাঁর শৈশব ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ব্যতিক্রমী। শিশুকাল থেকেই অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহল। বাংলা তথা দেশ-বিদেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের অক্লান্ত একজন শিল্পী। তিনি ড. দেবীপ্রসাদ দুয়ারী। কলকাতার বিড়লা তারামণ্ডলের প্রাক্তন ডিরেক্টর। গবেষক। বিজ্ঞানী। এ হেন পণ্ডিত মানুষটির মুখোমুখি আমি। ভার্চুয়াল আলাপে আলোকিত তাঁর জীবনের একগুচ্ছ নিউক্লিয় ঘটনা। তাঁর জীবনের কঠিন বাস্তবের সহজাত রুক্ষতার মেঠোপথ থেকে ব্রহ্মাণ্ডের কৃষ্ণবিবরে ঘটনা-দিগন্ত নিঃসৃত গোপন বিকিরণ অব্দি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমাকে! সেদিন ছিল সোমবার। ১৭ই জুন ২০২৪। সময় সকাল সোয়া দশটা। পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনিময়ের পর আলাপচারিতা শুরু।

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা : স্যার, আপনার ছেলেবেলা স্কুল পড়াশুনা ইত্যাদি নিয়ে যদি দু-চার কথা বলেন…

দেবীপ্রসাদ দুয়ারী : আমার জন্ম কলকাতায়। পড়াশোনা কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষকতা জগতের মানুষ ছিলেন। প্রথাবিরুদ্ধভাবে তাঁরা দুজনে আমাকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন – আমরা চাই না ক্লাসে তুমি প্রথম হও। আমরা চাই ঠিকঠাক পড়াশোনা করে তুমি নিজের চিন্তাভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে চলো। বাড়িতে একা একাই পড়তাম। কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না।

পূর্ণচন্দ্র : শিক্ষক বাবা-মা কখনও সাহায্য করেননি?

দেবীপ্রসাদ : বাবা-মা কখনও আমাকে হাতে ধরে পড়াশোনা শিখিয়ে দেননি। উপর থেকে সর্বক্ষণ নজর রাখতেন তাঁরা। একেবারে আটকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে 'Spoon Feeding', সেটা কখনও করেননি।

পূর্ণচন্দ্র : রেজাল্ট কেমন হয়েছিল? 

দেবীপ্রসাদ : মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছে। একেবারে প্রথম সারির প্রথম দশজন কিংবা প্রথম কুড়িজনে আমি কখনোই যেতে পারিনি। কারণ, আমার একক প্রচেষ্টায় তা সম্ভব ছিল না। তবে মাধ্যমিকের ন্যাশনাল মেরিট স্কলারশিপ পেয়েছি। ন্যাশনাল মেরিট সার্টিফিকেট পেয়েছি। যদিও র‍্যাঙ্ক করিনি। 

পূর্ণচন্দ্র : পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি টান-ভালোবাসা-আবেগ কীভাবে তৈরি হয়েছিল? 

দেবীপ্রসাদ : ছোটবেলায় মূলত ক্লাস এইট-নাইন থেকে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো যার উত্তর হয়তো বইয়ে নেই। কেন একটা ঘটনা ঘটছে? কেন জল পড়লে শব্দ হচ্ছে? শব্দগুলো আলাদা আলাদা কেন হচ্ছে? কেন প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার পর আরো গুচ্ছ ঘটনা পরপর ঘটে চলেছে? বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম সব কিছুর পেছনে কোনও কারণ আছে। কারণটা বিজ্ঞানসম্মত। 

পূর্ণচন্দ্র : প্রথম থেকেই কি ঠিক ছিল পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়বেন?

দেবীপ্রসাদ : যাদবপুরে পদার্থবিদ্যা পড়ার পেছনে একটা কারণ আছে। আমাদের চারপাশে যে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো ঘটছে, তার পেছনের কারণটা মূলত পদার্থবিদ্যা — স্কুল লাইফ থেকে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল। তখন থেকে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে আমার একটা আগ্রহ জন্মালো। 


পূর্ণচন্দ্র : জ্যোতির্বিজ্ঞানের জার্নি শুরু কীভাবে?

দেবীপ্রসাদ : একখানা আর্টিকেল পড়েছিলাম। আমাদের শরীর, আমাদের বেঁচে থাকা, জীবন– সবকিছুর ওপরে একটা মহাজাগতিক প্রভাব রয়েছে। পরপর ঘটমান গুচ্ছ ঘটনার ফলে পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে। সেই প্রাণের আমি একটা অংশ। আমার চারপাশে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে মহাকাশের অনেক গোপন তত্ত্ব। তখন থেকে মহাকাশ সম্পর্কে আমার একটা আগ্রহ জন্মালো। 

পূর্ণচন্দ্র : মহাকাশ নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনার নেশা কখন চেপে বসে!

দেবীপ্রসাদ : বিএসসি পড়ার সময় দেখলাম মহাকাশ সংক্রান্ত ঘটনা – তা পার্টিকেল-ফিজিক্স হোক অথবা থার্মোডাইনামিক্স – সবজায়গায় মহাকাশের ঘটনা বারবার চলে আসছে। 

পূর্ণচন্দ্র : বিএসসি'র কোনো বিশেষ ঘটনা?

দেবীপ্রসাদ : বিএসসির পর ব্যাঙ্গালোরে রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে আমি দেড় মাসের একটা সামার রিসার্চ ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। সেখানকার ডিরেক্টর তখন নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিক সি ভি রমন-এর ছোট ছেলে ভি রাধাকৃষ্ণণ। সেখানে আমার কাছে একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কলকাতা–যাদবপুরের পরিবেশ থেকে একেবারে অন্যরকম। ছাত্র-গবেষক-অধ্যাপক সবাই নিমগ্ন চিত্তে সারাদিন শুধু বিজ্ঞান-গবেষণা ও পড়াশোনার কাজ করে চলেছেন। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের লেগেছিল। 

পূর্ণচন্দ্র : কলকাতা ও ব্যাঙ্গালোর – দুটি আলাদা জায়গা। ভিন্ন পরিবেশ। পৃথক সংষ্কৃতি। দু'জায়গায় কাজের কী পার্থক্য?

দেবীপ্রসাদ : কলকাতার জীবন মানে শুধু পড়াশোনার গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখা নয়। পারিপার্শ্বিক ঘটনা-সাহিত্য-কবিতা-গান-নাটক-খেলাধুলা এসব নিয়েই জীবন। ব্যাঙ্গালোরে দেখেছিলাম সবার মধ্যে  একটা একমুখী চিন্তাভাবনা। 

পূর্ণচন্দ্র : সামার-ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা?

দেবীপ্রসাদ : ক্যাম্পে সম্পূর্ণ নতুন একটা প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়। আমাদের আকাশ-গঙ্গা বা মিল্কি-ওয়ে-গ্যালাক্সির বাহুগুলো মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। এই হাইড্রোজেনকে খুঁজে বার করে কোথায় কত হাইড্রোজেন আছে তা দিয়ে আমাদের মিল্কি-ওয়ে-গ্যালাক্সির একটা আকৃতি-আয়তন বার করার চেষ্টা। খুব শক্ত কাজ। 

পূর্ণচন্দ্র : কতদিনে সম্পন্ন হল প্রোজেক্টের কাজ?

দেবীপ্রসাদ : রমন ইনস্টিটিউটের ১০.৪ মিটার ব্যাসের একটা রেডিও এন্টেনা ছিল। সেটিকে কাজে লাগিয়ে ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট-এর লোকেরা হাইড্রোজেন মাপার একটি ২১ সেমি লাইট – যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ২১ সেন্টিমিটার, হাইড্রোজেন অ্যাটম থেকে এরকম বিকিরণ বের হয় – তার একটা রিসিভার বানায়। সেটা দিয়ে আমি কাজ শুরু করি। প্রথমে খুব ঘাবড়ে গেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল খুব ভালো ফল আসছে। পরবর্তীকালে আমার দেড় মাসের অবস্থানটা বদলে তিন মাস হল। মাস তিনেক অবজারভেশন করে একটা রেজাল্ট বের হতেই ডিরেক্টর আমাকে অনেক বাহবা দিলেন। আমাকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে একটা বক্তৃতাও দিতে হলো। বক্তব্য রাখাটা আমার কাছে খুব গর্বের। ওই অল্প বয়সে বড় বড় বিজ্ঞানীদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার একটা ক্ষমতা বা প্রয়াস – সত্যিই একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা। 

পূর্ণচন্দ্র : প্রোজেক্ট থেকে বড় প্রাপ্তি কী?

দেবীপ্রসাদ : জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সাহস সঞ্চয় বড় প্রাপ্তি। যাদবপুর থেকে এমএসসি পাসের পর পিএইচডির নেশা ঘাড়ে চেপে বসল। উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে ভবিষ্যতে কী করতে হবে তা নিয়ে আমাকে প্রচণ্ড কোনো চাপের মধ্যে রাখেননি আমার বাবা-মা। এও এক বড় প্রাপ্তি।

পূর্ণচন্দ্র : বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যা ছেড়ে আগামীতে মহাকাশ-বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার জার্নি কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল?

দেবীপ্রসাদ : হঠাৎই একদিন ইউনিভার্সিটির নোটিশ বোর্ডে একটা বড় পোস্টার চোখে পড়ল। ১৯৮৯ সালে নতুন একটা ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে মহারাষ্ট্রের পুনাতে। ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাণ্ড অ্যাস্ট্রোলজি (IUCAA)। ডিরেক্টরের নাম জয়ন্তবিষ্ণু নার্লিকর। নামটার সঙ্গে আমি পূর্বপরিচিত। তবে আমি গুলিয়ে ফেলি উনি হয়তো বিদেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোক। ইন্টারভিউতে জানলাম উনি রীতিমতো ভারতীয় – মহারাষ্ট্রের লোক। বিশ্বজুড়ে তাঁর নাম-যশ। ইতিমধ্যে ১৬০০ অ্যাপ্লিকান্টের ভেতরে মনোনীত মাত্র দুজন রিসার্চ স্টুডেন্টের মধ্যে আমি একজন।

পূর্ণচন্দ্র : কার অধীনে গবেষণা শুরু করলেন?

দেবীপ্রসাদ : এক বছরের কোর্স ওয়ার্ক শেষে প্রফেসরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি — আমি আপনার কাছে গবেষণা করতে চাই। প্রথমেই শুনে চমকে উঠে তিনি বললেন – দেখো, আমি এমন একটা বিষয়ের উপরে কাজ করি যা পৃথিবীতে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করে না। হয়েল–নার্লিকার স্টেডি স্টেট তত্ত্ব। আমি চাই না আমার ছাত্র এমন একটা বিষয়ের উপর কাজ করুক যাতে পরবর্তীকালে চাকরির ক্ষেত্রে বা অন্য গবেষণার ফিল্ডে সুযোগ পেতে তার অসুবিধা হয়। সুতরাং আমার কাছে কাজ না-করাই শ্রেয়। আরও বড় বিজ্ঞানী আছেন, তুমি তাঁদের আণ্ডারে কাজ কর।

পূর্ণচন্দ্র : আপনি মেনে নিলেন প্রিয় মাস্টারমশাই-এর উপদেশ?

দেবীপ্রসাদ : আমার জেদ চেপে গেছিল। বললাম আমি আপনার কাছেই গবেষণা করব। এবং যদি আপনি পারমিশন দেন একটা অন্য বিষয়ের উপর– যেটা আপনার ফিল্ড নয়– তার উপরে কাজ করব। ছাত্রের আস্পর্ধায় রেগে যাওয়ার বদলে অদ্ভুত উত্তর দিলেন মাস্টারমশাই নার্লিকর। প্রথমত, আমার কাছে পিএইচ.ডি করতে গেলে আলাদা পরীক্ষা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি তুমি নতুন বিষয়ের উপর কাজ করতে চাও যেটার অতটা গভীরে আমি যাইনি, তুমি পড়ো এবং তোমার সঙ্গে আমিও পড়বো। আমি জেনে নিয়ে তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। 

পূর্ণচন্দ্র : শেষমেশ শুরু হল গবেষণার কাজ?

দেবীপ্রসাদ : সাড়ে-তিন চার বছরের মধ্যে আমি পিএইচডির কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। এবং উনি তাতে খুব খুশি হয়েছিলেন। 

পূর্ণচন্দ্র : শুনেছি বক্তৃতা দিতে আপনি বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন ?

দেবীপ্রসাদ : হ্যাঁ। আমি বিশ্বের প্রায় নটি দেশ ঘুরে আমার কাজের বক্তৃতা দিয়েছি। বক্তৃতা দেয়ার জন্য এবং যাওয়ার জন্য যে-খরচাপাতি, সেটা নিজের পকেট অথবা ভারত সরকার কিংবা ইনস্টিটিউশনের টাকা থেকে নয়। যারা আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ (ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ইত্যাদি) থেকে, সেসব জায়গায় বক্তব্য রেখেছি তাদের খরচায়।


পূর্ণচন্দ্র : বিদেশে বক্তব্য রাখার অভিজ্ঞতা কেমন? 

দেবীপ্রসাদ : বিদেশের লোকজন, তাদের সংষ্কৃতি-চিন্তাভাবনা-কার্যকলাপ এবং কাজের পরিবেশ ভীষণ মনোমুগ্ধকর। তবে বিদেশে গিয়ে উপলব্ধি হল ভারতবর্ষে সব রয়েছে। তাহলে গণ্ডগোল কোথায়? সমস্যা মূলত দু'রকম। এক, ন্যাচারাল রিসোর্সের দিশাহীন অপব্যবহার। দুই, লাগামহীন জনস্ফীতি। বিদেশে সুযোগসুবিধা বেশি। কারণ, জনপ্রতি ন্যাচারাল রিসোর্স ব্যবহারের সুযোগ বেশি। মাত্র ৫০ বছর আগে স্বাধীন ভারতবর্ষে যা অসম্ভব।


পূর্ণচন্দ্র : বিদেশে পিএইচডির স্বপ্ন…

দেবীপ্রসাদ : স্কলারশিপ পেয়েও আমেরিকায় পিএইচডি করতে যাইনি অজ্ঞাত কারণে। 

পূর্ণচন্দ্র : আপনার পিএইচডির বিষয়টি ঠিক কী?

দেবীপ্রসাদ : মহাবিশ্বের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতার সংকেতকে বলা হয় কোয়েজার (Quasars)। কোয়াসি-স্টেলার অবজেক্টস (Quasi-steller objects)। বর্তমানে যা 'অ্যাক্টিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াস' (Active Galactic Nucleas)। এগুলো কী জিনিস? সমস্ত নীহারিকা কিংবা গ্যালাক্সির কেন্দ্র অঞ্চলে অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন যে-ব্ল্যাকহোল রয়েছে, সেগুলো অতিকায় পরিমাণের। কত তার ভর? সূর্যের ভরের এক-দশ-একশো কোটি গুণের বেশি। কৃষ্ণবিবর থেকে নির্গত প্রচণ্ড ক্ষমতা সম্পন্ন বিকীর্ণ আলো মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্ত থেকে পৃথিবীতে আসে। ওদেরকে নিয়েই মূলত আমার কাজ। গবেষণা। 

পূর্ণচন্দ্র : স্যার, আপনার থিসিস নিয়ে সংক্ষেপে দু-চারকথা!

দেবীপ্রসাদ : নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে আইনস্টাইন পাল্টে দিয়েছিলেন তাঁর 'সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব' দিয়ে। অপেক্ষবাদ তত্ত্বের হাত ধরে এল বিগ-ব্যাং তত্ত্ব। এই তত্ত্বানুসারে — আজ থেকে ১৩৮০ কোটি বছর আগে আমাদের ব্রহ্মাণ্ড একটি বিন্দুসম জায়গা থেকে প্রসারিত হতে শুরু করে। তার ফলে দুটো ধারণার জন্ম। এক, ইউনিভার্সের প্রতিসমতা। ব্রহ্মাণ্ডের কোনো জায়গার আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। মহাশূন্যে চারপাশের স্পেস দেখতে সামগ্রিকভাবে একইরকম। এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেকটি অঞ্চলের সামগ্রিক পার্থক্য নেই। কিন্তু কোয়েজারদের ডেটাবেস অ্যানালাইসিসে দেখা গেল কোয়েজাররা একইভাবে Randomly ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। মহাবিশ্বের এক কোণে দাঁড়িয়ে যদি দেখি, একটা অন্তর্বর্তী জায়গার ব্যবধান রেখে কোয়েজারগুলি পুঞ্জীভূত। এমন ঘটনা বিগ-ব্যাং তত্ত্বের ব্যাখ্যার অতীত। এটা ছিল আমার থিসিসের প্রথম ভাগ। 
শেষভাগটা আরও ইন্টারেস্টিং। দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া কোয়েজারের আলো যখন পৃথিবীতে আসে, ওদের যাত্রাপথে কিছু গ্যালাক্সিও পড়ে। ছায়াপথের মধ্য দিয়ে আলো পৃথিবীতে আসবার সময় গ্যালাক্সির গ্যাসগুলো আলোককে শোষণ করে পুনর্বিকিরণ করে। সেই পুনর্বিকিরিত আলো আমরা দেখি। এখন যে-আলোটা পৃথিবীতে আসে, তার মধ্যে অন্তর্বর্তী গ্যালাক্সির খানিকটা সিগনেচার কিংবা প্রমাণ থাকে শোষণ ও পুনর্বিকিরণের জন্য। সেটা দিয়ে কাজ করে থিসিসের দ্বিতীয় ভাগে আমি দেখিয়েছিলাম, ছড়ানো ছিটানো গ্যালাক্সির একটা পিরিওডিসিটি (Periodicity) রয়েছে, যার প্রমাণ বিগ-ব্যাং তত্ত্ব থেকে মেলে না।

পূর্ণচন্দ্র : বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম পর্যন্ত জার্নিটা কেমন ছিল?

দেবীপ্রসাদ : পিএইচডির পর পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে যোগ দিই। ব্রহ্মাণ্ডের তারামণ্ডল নিয়েই আমার আগ্রহ বেশি। বিশেষ ধরণের নীহারিকা বি ই স্টার (BE Star) দিয়ে শুরু হল গবেষণা। সাত মাসের মাথায় হঠাৎ ছন্দপতন। ক্যানসারে মারা গেলেন গাইড-বৈজ্ঞানিক। বিশেষজ্ঞ ছাড়াই একলা চালিয়ে গেলাম গবেষণা। আমেরিকা ইজরায়েল থেকে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পেলাম। কিছুদিন ইরানের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড বেসিক সায়েন্স-এ অধ্যাপনা। সেখান থেকে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার। ইংল্যান্ডে চলল মৃতপ্রায় তারার শকওয়েভ থেকে আণবিক কণিকা তৈরির সম্ভাবনা সংক্রান্ত গবেষণা এবং আংশিক অধ্যাপনা। ওদিকে কলকাতায় বাবা-মা ভীষণ অসুস্থ। একমাত্র সন্তান আমি। শেষমেশ ম্যানচেস্টারের সোনার সংসার ছেড়ে কলকাতায় ফেরা মনোস্থির করি। এইসময় বিড়লা তারামণ্ডল থেকে ই-মেল পাই। ২০০০ সালের ১৪ই এপ্রিল কলকাতা ফেরার দুদিন পর বিড়লা তারামণ্ডলে ডিরেক্টর পদে যোগ দিই। একটানা ২২ বছর কাজ করেছি সেখানে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে দিনপাত করেছি।


পূর্ণচন্দ্র : দেশে বিজ্ঞান চর্চার অভিমুখ…

দেবীপ্রসাদ : বিগত পঁচিশ-তিরিশ বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফিল্ডে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে আজ ভারতের অবস্থান। এক্সপেরিমেন্টাল বিজ্ঞান গবেষণায় প্রভূত উন্নতি করেছে দেশ।

পূর্ণচন্দ্র : আমাদের রাজ্যে বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ কতখানি?

দেবীপ্রসাদ : তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যার প্রতি বাঙালি পড়ুয়াদের প্রচণ্ড উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একসময়। দুঃখের বিষয় – অতীতের সেই তীক্ষ্ম মেধা ক্রমশ ক্ষয় হতে শুরু করেছে। কারণ বিবিধ। নড়বড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা। পরিকাঠামোর অভাব। বিনিয়োগ-শূন্যতা। অপরিমিত সুযোগ। 


পূর্ণচন্দ্র : জ্যোতির্বিজ্ঞানে ভবিষ্যৎ কেমন?

দেবীপ্রসাদ : টেকনোলজি, মেটেরিয়াল-সায়েন্স, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বায়োকেমিস্ট্রি প্রভৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত চল্লিশ বছরে জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। প্রকৃতির গূঢ় তত্ত্ব এবং তার গোপন রহস্য জানতে মহাকাশ বিজ্ঞানের জুড়ি মেলা ভার। 

পূর্ণচন্দ্র : মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা কতটা জরুরি?

দেবীপ্রসাদ : মাতৃভাষায় যেকোনো বিষয় চর্চা করার বিস্তর সুবিধা। তবে সেটা অজুহাত হতে পারে না। বাংলা হোক বা ইংরেজি, নিজের ভেতরে উৎকৃষ্টতা আমদানি করতে হবে। শুধুমাত্র ভাষার দোষ দিয়ে বিজ্ঞান চর্চার অপ্রতুলতা দর্শানো ভুল। এখন বাঙালি বিজ্ঞানীরা কে কী কাজ করছেন সেটার আলোচনা হয় না। কে কী বলল তা বেশি গুরুত্ব পায়। তাই কাজ নয়, বলা কথাগুলো দিয়ে মানুষকে বিচার করছি আমরা। এটা ঠিক না। 

পূর্ণচন্দ্র : মাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়াদের ফিজিক্স ভীতি!

দেবীপ্রসাদ : যেভাবে ফিজিক্স পড়ালে স্টুডেন্ট-মনে আগ্রহ তৈরি হবে, স্কুলে সেই ভাবে পড়ানো হচ্ছে না। শিক্ষক সমাজের সীমাহীন অহংবোধ এবং নতুন বিষয় পড়াশুনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করছে। 

পূর্ণচন্দ্র : বিজ্ঞান-পুস্তক ও আর্টিকেলে জটিল ও কঠিন সমীকরণের আমদানি সাধারণ পাঠকের কাছে বোঝা মনে হয়। কীভাবে লিখলে সর্বস্তরের পাঠক বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হবে?

দেবীপ্রসাদ : বিজ্ঞান চর্চার জন্য সমীকরণ এবং গণিত আশু প্রয়োজন। সেজন্য বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য এবং সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কলোনিয়াল রেসিডেন্সিয়াল বেড়া ভাঙতে বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানীকে এগিয়ে আসতে হবে। 

পূর্ণচন্দ্র : ধর্ম ও কুসংস্কারের সঙ্গে বিজ্ঞানের কী সম্পর্ক?

দেবীপ্রসাদ : ধর্ম ও কুসংস্কার দুটো এক জিনিস নয়। কোনো ধর্মই প্রকৃতির কার্যাবলী থেকে মানুষকে দূরে সরাতে অপারগ। কুসংস্কারের ব্যুৎপত্তি ভয়-ভীতি, অজ্ঞানতা, দারিদ্র্য, মানসিক দুর্বলতা এবং শিক্ষার অভাব। ভয়ে, বিপদের গন্ধে, লোভ-লালসায় মানুষ জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ে। যা অর্জনের ক্ষমতা আমার নেই, অথচ আমাকে পেতে হবে; সেটা আদায় করতে গিয়ে মানুষ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। 

পূর্ণচন্দ্র : বিজ্ঞান কী ধর্মের ভিত্তি?

দেবীপ্রসাদ : যা আমাকে ধারণ করে, তাকে বলা হয় ধর্ম। বিজ্ঞান হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার ধর্ম। এমন কিছু জিনিস-পড়াশুনা-উপলব্ধি যা আমাকে প্রকৃতি পরিবেশ এবং আরও বেশি কিছু সম্পর্কে অবহিত করে, তা-ই বিজ্ঞান। ক্ষমতা-লাভ-ব্যবসার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ। ব্যক্তির মানসিক গঠন-প্রচেষ্টা-দৃষ্টিভঙ্গির সুষ্ঠু উৎকর্ষতা বাড়ায় যে-ধর্ম, তা সনাতন ধর্ম। সনাতন ধর্ম শুধু হিন্দু ধর্মকে বোঝায় না।  

পূর্ণচন্দ্র : জিওর্দানো ব্রুনোর হত্যা, গ্যালিলিও গ্যালিলাই-এর শাস্তি কি প্রমাণ করে একটা সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করত ধর্ম, বিশেষ করে খ্রিস্ট-ধর্ম?

দেবীপ্রসাদ : নিজেদের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তার চিন্তাভাবনা ও কথার পরিপন্থী তথ্য ও তত্ত্ব প্রচারকারী বিজ্ঞান-মনস্ক লোকজনকে আঘাত করে। মধ্যযুগে এটা বেশি ঘটত। রাজার কথা শোনা হল না বলে গলা-কেটে-ফেলার আকছার ঘটনা ঘটত। আজও কতিপয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের দ্বারা আমাদের জীবন পরিচালিত হয়। তারা চেষ্টা করে আমাদের মনকেও চালনা করতে। যেহেতু মন কারও অধীনে নয়, সব সব সময় তা মেনে চলে না তখন সংঘাত বাধে। তবে ধর্ম নয়, দর্শনের সঙ্গে বিজ্ঞানের খানিক যোগ থাকলেও থাকতে পারে। কারণ, সক্রেটিস প্লেটো আর্কিমিডিস এরা কেউ বিজ্ঞানী ছিলেন না। তাঁরা মূলত দার্শনিক।
---
🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীকে নমস্কার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে সম্পূর্ণ কুসংস্কারের কুক্ষিগত হচ্ছে ও কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া গবেষণা ব্যাপারটাই যে তাচ্ছিল্য ও বিদ্রূপের বিষয় হয়ে গেছে তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

    ReplyDelete
  2. ভাস্কর সেনNovember 01, 2024


    পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যার নেওয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানী দেবীপ্রসাদ দুয়ারীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার পড়লাম। এবং বলা যায় একবারেই পুরোটা পড়ে ফেললাম। কৃতী বৈজ্ঞানিক শ্রী দুয়ারী এবং তাঁর গবেষণার এই বিস্তৃত পরিধির ব্যাপারে কিছুই জানা ছিল না। আমাদের সামনে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য শ্রী ভূঞ্যা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।

    সাক্ষাৎকারটি যেমন খুবই সাবলীল তেমনই গভীর গবেষণামূলক।

    শ্রী দুয়ারীর ব্যক্তিগত জীবনের অংশবিশেষ খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁর প্রত্যয়, মানসিক দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার ছবি আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

    ReplyDelete