সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়
একটু আমার কথা লিখি আজ...
দীর্ঘ প্রবাসী তা প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের অভিবাসী আমি। আমাদের মনও কখনও কখনও শ্রান্ত অবসরে রোমন্থন করে দেশ-কালের পুণ্য গৌরব, ব্যাকুলতা অনুভব করে স্বজন প্রিয়জনের সান্নিধ্যলাভ। তখন এক নতুন মেঘদূত রচনা করে যা আবেগ আকুলতায় অনুপ্রাণিত, স্মৃতিকল্পনায় অনুরঞ্জিত।
মাসের পর মাস যখন প্রিয়জনবিচ্ছেদে যক্ষ বিষণ্ণ, ক্লান্তিহীণ, দুর্বল, এমন সময়ে আকাশ অন্ধকার করে ঘন কালো মেঘের দল হাজিরা জানায়। মেঘের কাছেই যক্ষ কাতর আবেদন জানান অলকাপুরীতে তাঁর প্রিয়জনের কাছে মনের বার্তা পৌঁছে দিতে। বিষণ্ণ যক্ষ চেতনাচেতন বিস্মৃত হয়ে মেঘকেই দূত হিসাবে নির্বাচন করলেন।
নির্বাসিত যক্ষ তাঁর নির্বাসিত দূত মেঘকে তাঁর প্রিয় নগর-জনপদ, গিরি-উপবন, নদ-নদী এদের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করলেন এবং প্রকৃ্তির সাথে মানুষের মনের এক ঘনিষ্ঠ সৌহার্দ্যও রচনা করলেন। যক্ষের মতো আমাদের মেঘদূতও চলে যায় সেই দেশে যা আমাদের জন্মভূমি,- “বঙ্গ আমার, জননী আমার , ধাত্রী আমার , আমার দেশ”- আমাদের শিশুকালের ক্রীড়াভূমি, যৌবনের উপবন।
প্রবাসী মন মেঘদূত পাঠায় “গিরি হরী মাঠে- প্রান্তরে,” - “ধানের ক্ষেতে বনের ফাঁকে,” “ধুলি রাঙা পথের বাঁকে” যেখানে “বৈরাগিনী বীণ বাজায়”-সেই স্বপ্ন মধুর দেশে। “শান্তির নীড়” ছোট ছোট গ্রাম, 'সুখ-দুঃখ' , বিরহ -মিলনপূর্ণ সহজ সরল বাঙালির জীবনযাত্রার স্মৃতিতে প্রাণমন ভরে ওঠে।
পুজোর গন্ধ চারিদিকে। আকাশে, বাতাসে, মাটিতে এক অপূর্ব মিলনমেলা। সবার মনে একবুক আনন্দ চলকে পড়ছে। কাশফুল - শিউলি ফুল? হ্যাঁ-আছে তো। কারুর কারুর বাড়িতে শিউলি ফুল, রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই কাশফুল... আকাশে সাদা মেঘের ভেলা...সব আছে তাও যেন কি নেই? কিসের অভাব ...
এইবার বলি, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে এসে কি করে বা কি ভাবে বাংলাপ্রেমি হলাম এই সুদূর আমেরিকায় এসে-যে শহরে ১০ ঘর বাঙালি পরিবার মাত্র ছিল। অথচ দেশে থাকতে তো এইরকম বাংলার প্রেমিকা ছিলাম না?
এদেশের কলেজে পড়াশুনা করতে করতে কলেজের কিছু বাঙালি বন্ধু মিলে দুর্গাপূজা, কালীপূজার মতো একটা বড় পূজার আয়োজন করে ফেলেছিলাম। কারণ একটাই, বয়স্কদের লুইজিয়ানার রাজধানী ব্যটনরুজ থেকে পরের শহর নিউ অর্লিন্স-এ যাতায়াত করার বেশ কষ্ট সাপেক্ষ ছিল । দেড়ঘণ্টার ড্রাইভ আর সেটা বয়স্কদের জন্য আরো বেশি অসুবিধাজনক।
তাই লুইজিয়ানা স্টেট ইউনির্ভাসিটির কিছু বাঙালি বন্ধুরা মিলে ঠিক করা হল-যার মধ্যে ডক্টর মৌটুসি মিত্র(প্রেসিডেন্সী কলেজ)-এর নাম না করলে এ লেখার কোন মর্যাদা নিজের কাছেই থাকবে না। যদিও সে তখন স্টুডেন্ট। তার চাঞ্চল্যকর উৎসাহে সাড়া দিয়ে ফেললাম। কারণ দাদাদের ছিল চাকরির বাইরে ভারতীয়দের জন্য পারিবারিক “বেঙ্গল ইম্পোর্টস” ডিপার্মেন্টাল স্টোর- হ্যাঁ নামটাও তারা দিয়েছিল বাংলা নাম। অফিস শেষে অন্য কিছুতে মন না দিয়ে সামাজিক উপকার করার চেষ্টা মাত্র। ৪৫ বছর ধরে সেই ডিপার্টমেন্ট স্টোর চালিয়েছিল বাড়ীর দাদারা ও অবিবাহিতা মেজদিদি মিলে।
Indian Abroad -USA এর পাতায় ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছিল ডক্টর চন্দন শর্মার লেখায় এই 'বেংগল ইম্পোর্টস' নামে ভারতীয় দোকানটির।…... এই মহিলা ডক্টর কার্গিল যুদ্ধে গেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর চাকরি ছেড়ে দেন ছেলে মেয়ের মুখ চেয়ে এবং তাদের আবদারে। উনি লিখেছিলেন, “Bengali knows business” যেখানে সবার ধারণা ছিল, “বাঙালিরা ব্যবসা করতে জানে না।”
কাজেই নিউ অর্লিন্স পূজার সমস্ত খরচ যেত “বেঙ্গল ইম্পোর্টস” থেকে। আমাদের বাড়ি থেকেও সায় পেলাম আমরা।
ইতিমধ্যে এই বাংলা প্রচার নিয়ে আমি লুইজিয়ানায় নিজের উদ্যোগে সম্পাদক এবং টেক্সাস এ অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ডালাস 'আন্তরিক' ম্যাগাজিন-এ প্রতিনিধি সম্পাদক-হিসেবে অনেকদিন কাজ করেছি। নিজের লেখার ঘাটতির জন্য সব ছেড়ে লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। নিজের সৃষ্টির কাছে আমি সব সময় মাথা নত করে থাকি। এখানে চলে আসার পর এখন যদিও সব পুজো বন্ধ লুইজিয়ানায়। কেউ নিতে চায় না গুরুদায়িত্ব। পুজো হয় নামমাত্র করে।
🍂
স্টুডেন্ট থাকাকালীন ব্যটন রুজেও বাংলার সাথে টাচ এ থাকব বলে অনেক চেষ্টা করেছিলাম । যদিও নিউ জার্সি-নিউ ইয়র্ক এর মত অত বাঙালি নেই আজও। ২০০০ সালে ব্যটন রুজে মাত্র ১০টা বাঙালি পরিবার ছিল-তাদের নিয়ে মাঝে মাঝে এর ওর বাড়ীতে বাংলা কবিতা, গান আর বাচ্ছাদের গান, নাচ করাতাম আমরা। যাই করুক বাচ্চারা -- খুব আনন্দে সব করত।
নিউ ইয়র্ক "উদয়ন" থেকে আমাকে লুইজিয়ানার এবং টেক্সাস এ আসার পর
(Regional Representative) স্থানীয় প্রতিনিধি করা হয়েছিল। টেক্সাস এ বাংলা নিয়ে চর্চা হয় কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করেছিলাম আপ্রাণ...
লুইজিয়ানায় এইসব খুব করেছি। যে অল্প সংখ্যক বাঙালি ছিল তারা সংস্কৃতি ভাবাপন্ন ছিলেন। খারাপ লাগে আজ, উৎপল-উত্তরা চৌধুরীকে আনিয়েছিলাম। কিন্তু গুণে গুণে ১০ জন এসেছিল ৫ ডলার এর বিনিময়ে।
এমনকি ম্যাগাজিন "সুরধুনী" করেছিলাম-যদিও সব নিজের খরচায়-তারপরও যখন শুনতে হল-কার নামের আগে ডক্টর লেখা হয় নি এবং কেন হয় নি? এটা নাকি গুরুতর অপরাধ করেছিলাম।তখন মনটা ভেঙ্গে গেলেও একটা হাসির চু কিতকিত খেলেছিল অন্য মনে।
এই উদ্দেশ্যে একটা কথা লিখিঃ লুইজিয়ানার স্টেট- এ কাজ করার সময় আমাদের নতুন অ্যাাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারীকে ইন্ট্রোডিউস করার জন্য ডক্টর কার্ল চার্লস ব্রাউন বলাতে উনি সংশোধন করে দিয়েছিলেন এইভাবে যে, “ আমি শুধু মিস্টার ব্রাউন-ডক্টর নয়” । একটা স্টেটের হেড এর এই বাক্যে সব এমপ্লয়ী স্তব্ধ।
আমার টীনেজ ভাইঝিকে সাথে পেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ আমাদের চেষ্টায় আর উৎসাহে করে ফেলেছিলাম ম্যাগাজিন “সুরধুনী”। বাড়ী থেকেও সবাই দোষারোপ করতে লেগেছিল কেন এইসব করছি। কিন্তু এ যে বাংলার প্রতি প্রেম, ভালোবাসা। সত্যি মন থেকে ভালোবাসলে তাকে দমানো সাধ্যি কারুর নেই।
সে সব এখন স্মৃতির খেয়ায়। অবশ্যই বাংলার প্রসারের জন্য ২০১৭ সালে সান্টা ক্লারা, ক্যালিফোর্ণিয়া, বঙ্গসম্মেলনে সম্মানিত হই।
লিখে ফেললাম শুধু মানসিক কষ্টে- এই অভিবাসে কোথাও কোথাও বাংলার দুর্দশা দেখে । যদিও একটু একটু করে বাস্তব চেনা আমিটা এখন ভীষণ রকমের পরিণত, আত্মবিশ্বাসী। প্রতিটা আঘাত শিখিয়েছে জীবনের মানে। প্রতিটা ব্যর্থতা বুঝিয়েছে আরও পরিশ্রমের প্রয়োজন। প্রতিটা লড়াই বুঝিয়েছে সাফল্যের আনন্দ।
তাই...“আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে । তখন আপনি এসে দ্বার খুলে দাও ডাকো তারে”।
0 Comments