পর্ব- ৪১
স্বপন কুমার দে
সেদিন মল্লিকার প্রথম মনে হল, তার কঠোর শুষ্ক জীবনের মাঝখানে নব বর্ষার ঘন বর্ষণে হৃদয় তটিনী বেগবতী স্রোতস্বিনী হল। সেদিন সে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল। বুঝতে পারল, তার নীরস জীবনে 'কোমল হৃদয়' বলে কোনো সরস সত্তা আছে। সেদিন মনে হল, এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ের পাশাপাশি হৃদয়বৃত্তিরও একটা দাবী আছে। সেদিন তার গাইতে ইচ্ছা করল। সুর জানে না, তাল জানে না, শুধু গানের কথাগুলো জানে। তাই দিয়ে গুনগুন করে উঠল,--
" যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকাবনে
তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি
আমার মল্লিকাবনে, আমার মল্লিকাবনে।"
মনের জমাট কালো অন্ধকারে এতটুকু ক্ষীণ আলোর রেখা, তাই দিয়ে যেন সর্বাঙ্গ আলোয় ভরিয়ে দিতে চায় মল্লিকা। খুব ছোটবেলায় সে মাকে হারিয়েছে। জগতের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় উৎসটা তার কাছে অধরা রয়ে গেছে। বাবা ভালোবেসেছে কিন্তু সে ভালোবাসার মধ্যে কর্তব্যটাই বেশি ছিল। তারপর বাবাকেও হারিয়েছে। চারপাশের এই সমাজটা তার কাছে অনেকটা রুক্ষ মরুভূমির মতো। বেশিরভাগ সহপাঠিই তাকে অবজ্ঞা করেছে, ঈর্ষা করেছে। লোভী, ধূর্ত অমানুষগুলো তাকে অধিকার করতে চেয়েছে। ভালোবাসা পায়নি। আজ সম্পূরকের কাছ থেকে প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছে। এই অনাস্বাদিত মাধুর্য রসে সে আপ্লূত। আয়নার সামনে দাঁড়াল মল্লিকা, ঘামে ভেজা মুখটাকে ওড়না দিয়ে মুছে চুলগুলোকে ঠিক করল একদৃষ্টে চেয়ে রইল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। মনে হল, কেউ যেন আড়াল থেকে তাকে দেখছে। এসে বসল বিছানায়। তারপর বসে বসে কী যেন ভাবতে লাগল।
অদ্ভুত একটা অনুভূতির জায়গায় পৌঁছে গেল সে। ভালো- মন্দ, সুখ-অসুখ, আশা-নিরাশা-- সব মিলিয়ে এক অপ্রাপ্তি অধরার জন্য ব্যাকুলতা তাকে আচ্ছন্ন করল। এ অবস্থায় লোকে বন্ধুদের সান্নিধ্য চায়, পরামর্শ চায় কিন্তু তার নিকট বন্ধু স্বজন কেউ নেই। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, উচিত-অনুচিত বোধ সে এই অনুভূতির তল খুঁজে পেল না। তার মনে হতে লাগল, সে কোন্ দূর গ্রহের যাত্রী। তার সীমানা নেই, নিশ্চয়তা নেই, শুধু দ্বিধাহীন চিত্তে নিজেকে সমর্পণ করা, শুধু নিজেকে স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সার্থকতা।
সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করল। বিছানা ছেড়ে পড়ার টেবিলে বই খাতা নিয়ে বসল, কিন্তু আজ মনসংযোগ করতে পারল না। বারে বারে এক চিন্তা, এক অনুভূতি তার সমগ্র সত্তা গ্রাস করল। পড়ার টেবিল ছেড়ে বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইল কিছুক্ষণ। আজ রাতের খাবার তৈরির ঝামেলা নেই। স্যারের বাড়িতে বিকেলে ভুরিভোজনটা রাতের খাবারের পাট তুলে দিয়েছে। তাই তার অন্য গৃহকর্মের দায় নেই।
ফোনটা বাজছে। বাজুক, টিউশন বাড়ির কেউ হয়তো? বেজে বেজে কেটে গেল। আবারও কিছুক্ষণ পরে রিং হতে লাগল। এবার আর না দেখলেই নয়। মল্লিকা ফোনটায় দেখল, মন্টির মায়ের ফোন। সে তো একবার জানিয়েই দিয়েছে মন্টিকে আর পড়াবে না, তাহলে? ফোনটা ধরতেই সম্পূরকের মায়ের গলা ভেসে এল," মল্লিকা বলছো?"
" হ্যাঁ জেঠিমা, বলুন।"
" আজ তোমার সঙ্গে সমুর দেখা হয়েছিল?"
" হ্যাঁ, ঐ রাস্তায় আসতে আসতে..."
" সমু কি মাঝেমাঝেই লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে?"
" এ আপনি কী বলছেন? উনি আমার সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে যাবেন কেন?"
" কেন, তা তোমরাই জানো। কিছুদিন আগেও তোমাদের পাড়ায় তার দেখা হয়েছিল। আবার আজ কথায় কথায় তোমার কথা বলল। ও তো তোমার খুব প্রশংসা করছে।"
" সেটা আমি কী করে বলবো জেঠিমা? কেউ যদি আমায় নিয়ে নিন্দা বা প্রশংসা করে, তার জন্য আমি তো জবাবদিহি করতে রাজি নই।"
" বুঝতে পারছি, সমুই যেচে তোমার সাথে দেখা করতে যায়।"
" না, তাও নয়। আজ ওনাকে মাঠে দেখে আমিই কথা বলতে গিয়েছিলাম। দোষ আমারই। আমি বুঝতে পারিনি, এ নিয়ে আপনাদের বাড়িতে অশান্তি হবে। সম্পূরকবাবু নির্দোষ, তাঁকে অযথা দোষ দেবেন না।"
অপর প্রান্তে সম্পূরকের মা চুপচাপ মল্লিকার কথা শুনছিলেন। এবার তার কন্ঠস্বর আরও কঠোর শোনাল। তিনি বললেন," শোনো মল্লিকা, তোমার সঙ্গে বেশি কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই। শুধু একটা কথা শুনে রাখো, আমরা কেউই চাই না যে, তোমরা মেলামেশা করো।"
আকস্মিক আঘাতে মল্লিকা হতবাক্ হয়ে গেল। বুঝতে পারল একটু আগে দেখা তার সুখ কল্পনার ফানুসটা চুপসে আছড়ে পড়ল মাটিতে। নিজের জায়গাটা ঠিক কোথায়, আর একবার সমাজ তাকে চিনিয়ে দিল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল," আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি জেঠিমা, আর কোনোদিন, কখনও আমি সম্পূরকবাবুর সঙ্গে দেখা বা কথা কোনোরকম সম্পর্ক রাখবো না। আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।"
" ঠিক আছে।" বলে সম্পূরকের মা ফোনটা কেটে দিলেন।
🍂
মল্লিকার মনে হল, উচিত শিক্ষাই হয়েছে তার। এটা তার প্রাপ্য ছিল, দরকার ছিল এই আঘাতের। যে কঠোর সাধনায় সে এতদিন নিজেকে ব্রতী করেছে, ব্রহ্মচর্যের কঠোর শৃঙ্খলে নিজেকে বেঁধে রেখেছে, সেই শৃঙ্খল সে নিজেই ভাঙতে চেয়েছিল। এ অন্যায়, এর ক্ষমা নেই। তার একমাত্র কাজ কঠোর সাধনা, নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া, কোনোকিছুতেই সেই স্বপ্নকে মরতে না দেওয়া। কোনো দুর্বলতা থাকা তার চলবে না। তার কোনো ভয় নেই, মোহ নেই, লোভ নেই, তাই তার থামাও নেই। অনেক রাত্রি জাগরণের পর ভোরবেলায় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
বেচারা সম্পূরক কিছু বুঝতেও পারল না। মা বাবা তাদের নিজেদের রুমে দরজা বন্ধ করে মল্লিকাকে যে ফোন করেছিলেন, সেটা বড় বৌমা ছাড়া অন্য কেউ জানতেও পারল না। সেই সন্ধ্যা এবং রাত্রি তার কাছেও মোহের, সুখস্বপ্নের এবং অনাগত ঐশ্বর্য প্রাপ্তির আবেগ নিয়ে এসেছিল। তার মনে হয়েছিল, দুস্তর মরুভূমিতে সে হয়তো মরুদ্যানের সন্ধান পেয়েছে। এই আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে পরদিন সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
অধিক রাত্রি জাগরণের ফলে পরদিন মল্লিকার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হল। মনে হল, কে যেন তার নাম ধরে বাইরে থেকে ডাকছে। ঘুম ভাঙা চোখে দরজা খুলে যে সংবাদ সে পেল, তাতে হাহাকারের বিরাট শূন্যতা তার সমস্ত অস্তিত্বকে টলিয়ে দিল। মাথাটা ঘুরে গেল। পড়ে যেতে যেতে সামনের দরজাটা চেপে ধরল। যন্ত্রণায় সারা শরীর কুঁকড়ে গেল।
মল্লিকা দ্বিতীয়বার পিতৃহীন হল। নিমাইকাকু মারা গেছে। কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিল। মল্লিকা নিজে হাসপাতালের আউট ডোরে ডাক্তার দেখিয়েছিল। সেখান থেকে কিছু ওষুধ দিয়েছিল, এছাড়াও বাইরে থেকেও কিছু ওষুধ কিনতে হয়েছিল। সেসব ব্যবস্থা মল্লিকাই করেছিল। মাঝেমাঝেই দেখতে যাচ্ছিল। এই তো গত পরশু দেখে এল। নিমাইকাকু মল্লিকাকে কাছে বসিয়ে বলেছিল," আগের জন্মে তুই আমার মা ছিলি রে। তাই তো এখনও মায়া ছাড়তে পারিসনি। কিন্তু মা, এবার আর আমাকে ধরে রাখতে পারবি না। আমি বেশ বুঝতে পারছি।" মল্লিকা, তার দু'হাত দিয়ে কাকুর মুখ চেপে কেঁদেছিল। বলছিল," ওরকম কথা আমার সামনে বলবে না কাকু, বললে আমি আর কোনোদিন তোমার কাছে আসবো না।" নিমাইকাকু তার স্নেহের হাত মল্লিকার মাথায় রেখে বলেছিল," পাগলি মেয়ে আমার!" সেই কথাই শেষ কথা। তারপর আজ নিমাইকাকুর প্রতিবেশীর কাছ থেকে এই মৃত্যুসংবাদ তার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিল।
নিমাইকাকুর মৃতদেহটি তখনও খাটে শোয়ানো আছে। তাকে ঘিরে রয়েছে তার ছেলে,বৌমা, মেয়ে জামাইয়েরা। মল্লিকা হাঁটু গেড়ে বসল। কতক্ষণ পা দুটোকে জড়িয়ে ধরল। চোখে অনর্গল শ্রাবণের ধারা। অনেকক্ষণ পরে তাকে সরিয়ে নিল নিমাইকাকুর নিজের মেয়ে। শ্মশানের চিতার লেলিহান শিখায় লুপ্ত হয়ে গেল মল্লিকার জীবনে রক্ত-সম্পর্কহীন স্নেহ ভালোবাসার এক মন্দির।
0 Comments