তনুশ্রী ভট্টাচার্য
পুজো শেষ হলো। দেবী আরাধনা সাঙ্গ হলো। আদৌ শেষ হলো কী? শেষ হয় কী? স্বত্ত্ব: তম: রজ:--এই তিন পথে পূজারী মায়ের পুজো সমাপ্ত করলেন। শারদীয়া পুজো শেষে হৈমন্তী দেবীর আরাধনাও শেষ। এই যে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই সব পুজোতে, বৃহৎ উৎসব, প্যান্ডেল, আলো, সজ্জা ইত্যাদি ইত্যাদি ,-- সেখানে পুজোর বা পুজারীর স্থান ঠিক কী?মন্ত্র তন্ত্র ,আচার নিয়ম রীতিনীতি কে মান্যতা দিয়ে পুজারী বিশ্বভুবনের প্রতিটি মানুষের সার্বিক মঙ্গল প্রার্থনা করলেন ।
🍂
আমরাও করলাম। বিনা মন্ত্রে কেবল ভক্তি দিয়ে শ্রদ্ধা দিয়ে বিশ্বাস দিয়ে। আসলে মনের বিশ্বাসটা ঠিকঠাক ধরে থাকতে পারলে মনে হয় মানুষ আরো উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। মনটাই ত সব কাজের কাজী।
মনকে ত্রাণ করে যা তাই মন্ত্র ,তনুকে ত্রাণ করে যা তাই তন্ত্র। শরীর আর মন মিলেই ত সাধনা। উপবাসে থাকার প্রচলিত ধারনা নেহাত অশাস্ত্রীয় নয়। পরম শক্তিকে হৃদয়ে বাস করাতে শিখতে হয় জানতে হয়, একটা ফোকাস রাখতে হয় ,মনকে কেন্দ্রীভূত করতে হয় সেই পরম শক্তির প্রতি। আর সেজন্যই লাগে উপবাসের মতো একটা বাহ্যিক উপচার যা সাহায্য করে একজন ঋত্বিককে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে । হৃদয়ে বাস করেন যিনি তাঁর সমীপে থাকাই উপবাস। একটি উচ্চমার্গের সাধনপথ এটি। যেদিন যে উদ্দেশে যা নিবেদন করা হয় সেই কারণের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার জন্যই উপবাসের রীতি। সেজন্য শুদ্ধ জীবনাচারন, পরিমিত আহার নিদ্রা প্রভৃতির মাধ্যমে উপবাস পালনের মতো শরীরকে তৈরী করেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। শরীরের ব্যথায় কাবু হলে বা দুর্বল শরীর হলে একজন ব্রাহ্মণের পক্ষে মন্ত্রের যে তেজ, যে ভাইব যে ফোর্স তা উচ্চারণে বা আবৃত্তিতে পুরো রূপ ফুটিয়ে তোলা যায় না। আর মন্ত্র দিয়েই তে আবাহন স্থাপন চক্ষুদান প্রাণ প্রতিষ্ঠা ভোগ নিবেদন যাবতীয় ষোড়শ উপচার সম্পন্ন করতে হয় ,তবেই সে আরাধনা হয়ে ওঠে সর্বাঙ্গীন --বহিরঙ্গে আর অন্তরঙ্গে। এই মন্ত্র তন্ত্রের পুজো একপ্রকার সৃষ্টি। একজন পূজককে একজন "স্রষ্টা" হতে হয়। পুজোর সময় বা দিনগুলোয় তিনিই তো মৃন্ময়ী মাকে চিন্ময়ী তে পরিবর্তিত করেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীর পুজা পদ্ধতি একাগ্রতা নিষ্ঠা শ্রদ্ধা ভক্তি দিয়ে । যেমন করে প্রেমের কবিতায় বিপ্লবের ভাষ্য অনুপস্থিত থাকে বা ভ্রমণ কাহিনীতে উপন্যাসের পরত থাকে না-- যে যার একটা নিজস্ব ভাষা থাকে আঙ্গিক থাকে, একজন কবির নিজস্ব দর্শন ও সেইমতো ভাষা রূপক উপমা ব্যবহার করে তার কবিতাকে শ্রুতিমধুর ,হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন পুজো ব্যাপারটাও ঠিক তাইই। একজন পূজারী একজন কবি একজন চিত্রশিল্পী একজন গায়ক বা বাদ্যকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই সেই আদ্যাশক্তির বা আদি শক্তির আরাধনা করেন।আর কে না জানে প্রকৃতিতে অবিরল ওম্ কার ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে যাচ্ছে। একজন দীক্ষিত মানুষ জানেন প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির মেলবন্ধন ঘটাতে হয় কি প্রকারে। মাধ্যমটা আলাদা। এই মন্ত্র উচ্চারণে র সময় ভারতীয় রাগ রাগিণীর প্রয়োগ দেখা যায়। প্রকৃত দীক্ষিত ব্রাহ্মণ জানেন পুজোর প্রারম্ভ থেকে ঘট বিসর্জন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে দিন রাতের বিভিন্ন সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কখনো মালব কখনো ললিত কখনো কেদার,বিভাস আবার কখনো বসন্ত বা ধানসি ইত্যাদি রাগের সুরে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে দেবীকে জাগ্রত করতে হয়,মনোরঞ্জন করতে হয়,প্রীত, সন্তুষ্ট করতে হয়।সঠিক মন্ত্র ,কন্ঠ মাধুর্য বাচনভঙ্গী মন্ত্রের সিলেবল মেনটেইন কন্ঠের উচ্চাবচ সাবলীলতায় একটা সুরেলা পুজা মন্ডপ তৈরী করেন একজন পুরোহিত। এ হেন একজন সত্যিকারের ব্রাহ্মণের শক্তি ও ক্ষমতা সাধারণের বোধের অগম্য। চন্ডীপাঠের কথাই যদি ধরি সেখানে নির্ভুল উচ্চারণ শুধু নয় সেখানে মন্ত্রের অর্থবহতার একটা ব্যাপার থাকে । সব মন্ত্রের ই অর্থ আছে এবং একজন পন্ডিত মানুষ জানেন কি কৌশলে পড়লে সংস্কৃত মন্ত্র সামান্য হলেও সাধারণের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। তবে আজকের যুগে মাইক্রোফোনে চন্ডীপাঠের ব্যাপারটা বহুল প্রচলিত হলেও একেবারে ক্ল্যাসিক ঘরাণার যে সকল ব্রাহ্মণ আছেন তাঁরা এটা পছন্দ করেন না। কারণ এমন কিছু গূঢ়বিষয়ভিত্তিক মন্ত্র আছে যা সর্বসমক্ষে উচ্চারণ করা যায় না,এবং তা পুজা পদ্ধতি বিহিত নয়।
মহালয়া মহিষাসুরমর্দিনী তে যা রেকর্ড করা যায় বিক্ষিপ্তভাবে তা দেবীর বেদীর সামনে আসনে বসে সংকল্প করে একটি নির্দিষ্ট পুজা পদ্ধতি মেনে একজন পূজারী ব্রাহ্মণের পক্ষে বলা যায় না। তখন সেটি সম্পূর্ণ একটি পুজা পদ্ধতি থাকে। শুধু চন্ডীপাঠ নয়। তাই অনেক পূজারী এই মাইক্রোফোনে বলাটা মানতে পারেন না। প্রাচীন কালের উদাহরণ টানি আমরা সবসময়। কিন্তু আধুনিক কালেও এমন নিষ্ঠাবান শুদ্ধ জীবন বিধি মেনে চলা মানুষ নিতান্ত অমিল নয়। যারা এই মুহূর্তে দেবী দুর্গা বা দেবী কালিকার আরাধনায় নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে খুঁজলেও এমন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের দেখা পাওয়া যায়।
আমরা শুনি বিগ বাজেটের পুজো । অনেক লম্বা আয় ব্যয়ের হিসাব দাখিল হয়। তবে বিগ বাজেটের পুজো হলে কি হবে পুরোহিতের জন্য বরাদ্দ টা কিন্তু লো বাজেট! পুরোহিতরা ওতেই সন্তুষ্ট থাকেন কারণ একজন প্রকৃত ব্রাহ্মণ সব পরিস্থিতি তে মনে সন্তোষ বিধান করতে পারেন বলেই তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছেন। তিনি পুজোর আসনে বসে সংকল্প করে সকলের মঙ্গল বিধানের দায়িত্বটি তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। পুরবাসী জনের হিত সংকল্প যিনি করেন তিনিই তো পুরোহিত। তাঁর আরাধনা শেষ হয় না। বিশ্ব জনের মঙ্গল কামনায় সর্বজীবের হিত সাধনায় ব্রাহ্মণের নিত্য পুজো চলে।
1 Comments
Valo likhechhen
ReplyDelete