জ্বলদর্চি

চওড়া হাসি /মিলি ঘোষ

চওড়া হাসি

মিলি ঘোষ


ওই যে হাসিটা, বিক্রি হয়? পথশিশুদের কথা বলছি। একদিন ভরপেট খাইয়ে দেখুন, কী একটা নতুন জামা। বিনিময়ে যে হাসিটা পাবেন, ওটার পরিমাপ হয় না। রাস্তার শিশুদের হাসির থেকে বাড়ির শিশুদের হাসির কিন্তু প্রভেদ অনেক। ওই চওড়া হাসিটা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এমনকী নিম্নবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদের মুখেও কিছুতেই পাবেন না। না পাওয়া থেকে হঠাৎ পাওয়ার হাসি! এত সহজে সরলীকরণ করা যায় না। অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির বহিঃপ্রকাশ তো থাকেই। বড়রাই উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারেন না তো শিশুরা। তবুও এ হাসির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা রাস্তার বাচ্চাদের মুখেই থাকে। নিম্নবিত্ত পরিবারের বাচ্চারাই বা কী পায়? কী খেয়ে কী পরে বড়ো হয় তারা? তাহলে এক থালা মাংস ভাত বা একটা নতুন জামা পাওয়ার হাসি তাদের মুখে নেই কেন? আসলে এরা কেউ চাপমুক্ত নয়। না খেয়ে না ঘুমিয়েও এদের বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করান। নিজেদের জীবন থেকে তাঁরা বুঝেছেন পড়াশুনাটা প্রয়োজন। ওটা অধিকারের মধ্যেই পড়ে। হয়তো তাঁরা বোঝেন না, শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায়। কিন্তু এটুকু তাঁরা অনুধাবন করেছেন জীবন ধারণের অন্যতম শর্ত হলো শিক্ষা। অনেক আশা থাকে, ভবিষ্যতে তাঁদের ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হবে। আয়নায় নিজেদের যে প্রতিবিম্ব দেখেন, তা সন্তানের মধ্যে দেখতে চান না। সন্তান দুধেভাতে থাকুক, এমন বাক্যের সঙ্গে তাঁরা পরিচিত নন। স্বপ্নেও এমন চিন্তা তাঁদের আসে না। কিন্তু শিক্ষা যে জরুরি এটা তাঁরা বুঝেছেন। এর ফলেই নিজেদের অজান্তে শিশুদের থেকে বাবা মায়েদের একটা চাহিদা তৈরি হয়। সেই সময় থেকেই বাচ্চাদের মুখের হাসি কমতে থাকে। সেই জায়গা নেয় একটা মানসিক চাপ, যা শিশুরা কারোর কাছে প্রকাশ করতে পারে না। পড়াশুনায় দুর্বল ছেলেমেয়েদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। এই বুঝি স্কুল থেকে ডেকে পাঠাল, এই বুঝি বাড়ি গিয়ে উত্তম মধ্যম পড়ল পিঠে। যে সংসারে বাবা মা উভয়ই শিক্ষিত, সে সংসারে সন্তানের থেকে চাহিদা আরও মারাত্মক। এই ধরনের পরিবারে সব সময়ই যে পিঠে তাল পড়ে তা নয়। কিন্তু বাবা মায়ের মুখের বচন একটা শিশুর হাসি কেড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। অন্যের সঙ্গে তুলনা, দিনরাত পড়ার পেছনে লেগে থাকা, বিকেল বলে জীবনে কিছু না থাকা, মাঠ না থাকার অজুহাতে খেলা বিমুখ করা এগুলোই বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে হানীকর। তুলনামূলক মনোযোগী ছেলেমেয়েরা পরিস্থিতি সামাল দিলেও বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতার আবহ ওদের মানসিকভাবে একা করে তোলে। এই প্রতিযোগিতা মা বাবাদের মধ্যেও সংক্রামিত। বনে জঙ্গলে অন্তরীক্ষে ইঁদুর প্রতিযোগিতা তাই অব্যাহত। পরিণত মানুষের মধ্যে নিজের ভুল খুঁজে পাওয়ার লোক এক শতাংশ বা তারও কম। কিন্তু তাঁরা অন্যের ভুল সহজেই খুঁজে বার করেন এবং নিজেকে একশো ভাগ ঠিক বলে মনে করেন। সন্তানের দিক থেকে সাফল্য এলে তাঁরা নিজেদের আদর্শ মা বাবা বলে দাবি করেন। সন্তানের জন্য অভিভাবকগণ প্রাণ পাত করে দিচ্ছেন। অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য, যার জন্য করা, সে যেন আমাকে ফুলে ফলে সমৃদ্ধ করে তোলে। একটা লক্ষ্য নিয়ে ছুটছেন এবং নিজেরাই নিজেদের মনের চাহিদা মেটাতে এই সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। শুধু শিশু মনোজগতের কোনও স্থান এদের মনোজগতে নেই।

সব থেকে করুণ অবস্থা মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদের। প্রথম শুরু হয় তাদের খাওয়া নিয়ে সমস্যা। নানারকম স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাইয়ে তাদের যেভাবেই হোক মোটাসোটা বানানোই লক্ষ্য। খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, রসাস্বাদনের যে তৃপ্তি সে সব বুঝে ওঠার অবকাশ শিশু পায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় খাবার দেখলেই শিশু ছুটে পালায়। মায়ের সঙ্গে রীতিমত চোর পুলিশ খেলা চলে। একটি শিশুর স্বাভাবিক নিয়মে খিদে পাবে, স্বাভাবিক নিয়মেই খাওয়ার ইচ্ছা জাগবে। কিন্তু খিদে পাবার আগেই যদি খাবার চলে আসে, তাহলে এই স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো হারিয়ে যেতে বাধ্য। ঘড়ি ধরে ঘুম, ঘড়ি ধরে ওঠা। উঠতে হয়তো হয় সময় দেখেই, কারণ স্কুল থাকে পড়তে যাওয়া থাকে। তাই বলে ঘড়ি ধরে ঘুম? আসে কারোর? বড়দের আসে? পরিশ্রম হলে ঘুম খিদে আপনেই আসবে। সেজন্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছড়ি হাতে বসে থেকে বাড়তি লাভ কিছু হয় না। বাঙালি হয়ে জন্মে ফুচকা, আলুকাবলির স্বাদ জানবে না, তা হয় নাকি। এক আধ দিন খেলে ক্ষতি যে কিছু হয় না, সে মা বাবারা নিজেরাও জানেন। নিম্নবিত্তের শিশুদের এই চাপ নেই। যা পায় তাই খায়। মা যখন লোকের বাড়ি কাজে যান বা ক্ষেত থেকে সব্জি তুলে বাজারে নিয়ে বসেন, বাবাও হয়তো রিক্সা বা ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে গেছেন সকাল সকাল, তখন এই বাচ্চারা বস্তির গলিতেই নিজেদের মধ্যে খেলা শুরু করে। মাঝেমাঝে যে কুকুরের পেছনে ঢিল ছোঁড়ে না অথবা তুলনামূলক অর্থবান লোকের বাড়ির জানলার কাঁচে ইট যে পড়ে না একেবারে তা নয়। কিন্তু ভয় থাকে। মায়ের কানে গেলে আনন্দ বেরিয়ে যাবে। একেবারে স্কুলছুট এরা না। তবে আহামরি কিছু রেজাল্ট এদের থেকে আশা না করাই ভালো। দিন কিন্তু এদেরও বদলেছে। সন্ধের পর এদের মেয়েরাও ছেলেমেয়ের পড়ার বই-খাতা উল্টেপাল্টে দেখেন। তাঁর পক্ষে যতটা সাহায্য করা সম্ভব হয়, করেন। না পারলে এমন কোনও গৃহ শিক্ষক খোঁজেন যিনি কম টাকায় সব বিষয় পড়িয়ে দেবেন। 


বাল্য থেকে কৈশোরে পা দিয়ে শরীরের উচ্চতার সঙ্গে অন্যান্য চাপও বাড়তে থাকে। অর্থবান বাবা দেওয়াল জোড়া টিভিতে বিশ্বকাপ দেখছেন, পাশের ঘরে ছেলে কান খাড়া করে অঙ্ক কষছে। হৈ হৈ শুনে একটু যদি উঁকি দিয়েছে তো পরীক্ষার রুটিন মনে করিয়ে দেওয়া হয়। 

   "বাবা, ব্রাজিলের খেলা ব'লেই ...... অন্যদিন দেখব না।"

ফুটবলপ্রেমী বাবার হৃদয়ের পাথর সহজে গলে না। ছোটবেলায় বাবা কত কষ্ট করেছেন টিভির দিকে চোখ রেখে তার ফিরিস্তি চলে।

তারপরেও যদি বুকে অতি সাহস সঞ্চয় করে ছেলে বলেই বসে, "প্রত্যুষ তো আর্জেন্টিনার খেলাগুলো দেখছে।"

ব্যাস আর যায় কোথায়। 

   "প্রত্যুষ ক্লাসের সেকেন্ড বয়। তার সঙ্গে তোমার তুলনা? আগে প্রত্যুষের মত হয়ে দেখাও।"

গল্প ওখানেই শেষ। ব্রাজিল গোল দিলেই বা কী, খেলেই বা কী!

🍂

মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই ছবি। পড়াশুনার সঙ্গে জোর করে আঁকা আর গানের নিয়মিত চর্চা। সে হয়তো অভিনয় ভালোবাসে। আবৃত্তি শিখতে চায়। কিন্তু তার চাওয়াই তো শেষ কথা নয়। এরপরও কি তাদের মুখে আমরা চওড়া হাসি আশা করব?

ছেলেমেয়ে আশা পূরণ করলে অভিভাবকদের শারীরিক ভাষা পাল্টে যায়। তারপরেও আত্মীয়, প্রতিবেশী, অন্য অভিভাবকদের বলবেন, "ও তো পড়তই না। ঠিক মত পড়লে পার্সেন্টেজ আরও ভালো হতো।"

ফেসবুকে ফলাও করে বলবেন, রেজাল্ট আশানুরূপ হয়নি। তলায় মার্কশিটের ছবি। ৯৭.৯৯ শতাংশ নম্বর। স্বাভাবিকভাবেই ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়া বন্ধুটি হীনমন্যতায় ভুগছে। বছর ছয়েক পড়ে খোঁজ নিন, দেখবেন দু'জনেই একই চাকরি করছে। হয়তো দু'জনকেই বাইরে থাকতে হচ্ছে, শহরের বা দেশের।

নিম্নবিত্তের এত চাপ নেই, এত আশা নেই। পাশ করলেই খুশি। কিন্তু সমস্যায় পড়বে এরাই। না পারবে বাবার মতো ভ্যান চালাতে। না পাবে চাকরি। ছোটবেলায় মুখের হাসি যেটুকু এদের ছিল। বড়ো হয়ে সেটুকুও যাবে। কিন্তু আরও কিছু কিশোরদের দেখা যায়, যারা চায়ের দোকানে, খাবারের দোকানে কাজ করে। প্লেট ধুচ্ছে, চা নিয়ে এসে টেবিলে রাখছে।

খাবার দিয়ে যাচ্ছে। বিয়েবাড়িতে ট্রেতে করে স্টার্টার নিয়ে নিমন্ত্রিতদের সামনে এসে ধরছে। নিজেরা না খেয়ে অন্যের সামনে খাবার দিয়ে যাচ্ছে। অথচ এরা কিন্তু এই কাজ করছে খিদের জ্বালায়। দোকানে যারা খাবার পরিবেশন করছে, তাদের কাজে যত্ন থাকবে না, না বললেও চলে। যত্নের সঙ্গে মনের একটা সম্পর্ক আছে। সেই জায়গাটা এরা কোথায় পাবে? দুটো খাবারের আশায়, কিছু টাকা পাবার জন্য এই কাজ করছে এরা নিজেদের বাল্য কৈশোর বিসর্জন দিয়ে। ব্যাগ কাঁধে সমবয়সীদের স্কুলে যেতে দেখে এরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিনা, মাঠ দেখলে এদের বল নিয়ে দৌড়তে ইচ্ছা করে কিনা সে খোঁজ রাখেন না দোকানের মালিক অথবা ক্যাটারিং-র ব্যবসা করে লাল হয়ে যাওয়া মানুষটি। একটা কাঁচের গ্লাস অথবা একটা কাপ ভাঙলে মালিক ছেলেটির বেতন থেকে টাকা কেটে নেন কিনা সে খবর জানতে চান না টেবিলে বসে আরাম করে চায় চুমুক দেওয়া খরিদ্দার। বরং ওই কিশোরদের খাবার পরিবেশনে অবহেলার ছাপ তাঁদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বয়সী মেয়েদেরও অনেক বাড়িতে কাজে বহাল করা হয়। অচেনা অজানা পরিবারে কোনও বউদির বাচ্চা সামলাবে একটি দশ বছরের মেয়ে। নয়তো সব্জি মাছ ধুয়ে কেটেকুটে দেওয়া, পাড়ার দোকান থেকে এটা ওটা আনা, জামাকাপড় কেচে ছাদে মেলে দেওয়া, বৃষ্টি পড়লে এক দৌড়ে নিয়ে আসা। বিনিময়ে চার বেলা খাওয়া, বছরে দুটো জামা।কাজের সামান্য এদিক ওদিক হলে বাণী বর্ষণ তো আছেই। রাত্রে ডাইনিংয়ে অন্ধকারে একা শুয়ে ভয় করে মেয়েটির? মনে পড়ে মায়ের মুখটা। খোঁজ নেবার কেউ নেই। এরা তাহলে কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত? না এরা রাস্তার ছেলেমেয়ে, না এরা আধপেটা খাওয়া স্কুলপড়ুয়া। চওড়া হাসি, হালকা হাসি, মুচকি হাসি, সব রকম হাসির আওতার বাইরে এরা। শুষ্ক মুখে ক্লান্ত চোখে এরা কাজ করে যায়। এই জীবন প্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রের, সমাজের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। যেন তারা নিজেরাই নিজেদের জীবন বেছে নিয়েছে।

তাই ছড়ানো হাসি ওই রাস্তার ছেলেমেয়েদেরই থাকে। ওদের না আছে জীবনে কোনও আশা, না কোনও চাপ, না ভবিষ্যতের চিন্তা। চাপ বলতে সারাদিনে দু'মুঠো জুটবে কিনা। অর্থাৎ লড়াই ওই পেটের সঙ্গে এবং সেটা প্রত্যক্ষ। এই চাওয়াটা এক দিনের জন্যও যদি কেউ মিটিয়ে দেয়, ওরা হাসবে না?

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments