কমলিকা ভট্টাচার্য
নীলা তৈরি হয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। সে সাজতে গুজতে খুব একটা ভালোবাসে না—একটু হালকা লিপস্টিক, সিঁথিতে সিঁদুরের একটু ছোঁয়া আর কপালে সিঁদুরের টিপ, ব্যস। এই তার সাজ। নীলা সাধারণভাবে থাকতে খুব ভালোবাসে।
নীলা সবে কপালে সিঁদুরের টিপ লাগাবে, আয়নায় সে দেখল জীবনকে, তার পিছনে। নীলার চোখ বুঝে এলো, কানের পাশে ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে জীবনের ঠোঁট। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস নীলাকে অবশ করছে। নীলা আলতো গলায় বলে, "কি চাও?"
জীবন নীলার কাঁধে মাথা রেখে বলে, "আজ শাড়ি পরলে যে..."
নীলা কপালে সিঁদুরের টিপটা লাগাতে লাগাতে বলে, "অনেক হয়েছে, এবার পিছনে ব্লাউজের দড়িটা বেঁধে দাও দেখি।"
জীবন ব্লাউজের দড়িটা বাঁধতে বাঁধতে বলে, "মিস্টার রেড্ডি ফোন করছিলেন, জানতে চাইছিলেন আমরা কতক্ষণে পৌঁছব।"
নীলা বলে, "আমি তৈরি, তুমি রেডি হয়ে নাও। আমার না খুব ভালো লাগছে এটা ভেবে, মাত্র দুদিনের রাস্তায় মর্নিং ওয়াকের আলাপেই রেড্ডি বাবু আমাদেরকে নিজেদের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছেন। আমরা তো ওনার বিষয়ে কিছুই জানি না, বাড়িতে কে কে আছে, কিছুই জানি না। ওনারা এত বড়লোক, এত বড় ফার্মহাউসের মত বাড়ি..."
জীবন বলে, "ওনার বাড়িতে ওনার স্ত্রী আছেন, ছেলে বিদেশে থাকে।"
নীলাদের বাড়ির দু-চারটে বাড়ি পরেই রেড্ডি বাবুদের বিরাট বাংলো। ফার্মহাউসও বলা যেতে পারে অনেকটা জায়গা জুড়ে।
নীলা আর জীবন, দুজনেই খুব এক্সাইটেড। পশ্চিমবাংলার বাইরে এই সুদূর দক্ষিণে কোনো অচেনা মানুষের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। নীলা আর জীবন রেড্ডি বাবুর বাড়ি পৌঁছতেই, মিসেস রেড্ডি বেরিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে নীলা আর জীবনকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বললেন মিস্টার রেড্ডি একটু বাইরে গেছেন, এক্ষুনি এসে পড়বেন।
মিসেস রেড্ডির বয়স প্রায় ষাট হবে, একটি দামী লাল কাঞ্জিভরম শাড়িতে তাঁকে খুব সুন্দর আর কমবয়েসী লাগছিল। বাড়িটি সাবেকি জিনিসে পরিপাটি নিখুঁত করে সাজানো। কোথাও এতটুকু ধুলো পর্যন্ত নেই। দামী দামী আসবাব, পেইন্টিং। বাড়ি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, মিস্টার ও মিসেস রেড্ডি দুজনেই খুব সৌখিন মানুষ। মিসেস রেড্ডি খুবই মিশুকে। আসার সাথে সাথেই একদম অপরিচিত মানুষদের যেভাবে আপন করে কথা বলছিলেন, নীলার ভীষণ ভালো লাগছিল। নীলারা যেতেই তিনি নিজে হাতেই সুন্দর কাঁচের গ্লাসে সরবত এনে দিলেন। তবে বারবার মিস্টার রেড্ডি তখনও বাড়ি পৌঁছননি বলে নীলাদের কাছে ক্ষমা চাইছিলেন। ঘুরে ঘুরে তিনি নীলাদের নিজের বাড়ি দেখাচ্ছিলেন। নীলা যতই ওনাকে দেখছিল, ততই ওনার ব্যবহারে, আতিথেয়তায় মুগ্ধ হচ্ছিল। তাঁর প্রাণোচ্ছল ভাব নীলাকে ওনার কাছে আরো টানছিল।
🍂
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিস্টার রেড্ডি এসে গেলেন। মিসেস রেড্ডি মিস্টার রেড্ডিকে কিছু দেরি হবার জন্য অভিযোগ করার আগেই মিস্টার রেড্ডি নীলাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। তারপর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে মিসেস রেড্ডির হাতে চিমটি কেটে বললেন, "ডার্লিং, ইউ আর লুকিং ভেরি গর্জাস টুডে।"
মিসেস রেড্ডি বলে উঠলেন, "আমার এই চিমটি কাটা একদম ভালো লাগেনা, ঠিক যেন ইঞ্জেকশন ফোটাও..." মিসেস রেড্ডির কথা শেষ হবার আগেই টেবিলের উপর রাখা স্যালাডের প্লেট থেকে কয়েকটি লংকা মিস্টার রেড্ডি মিসেস রেড্ডির মুখে পুরে দিলেন। মিসেস রেড্ডি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে জল খেলেন। ঝালে তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। মিসেস রেড্ডি একটু প্রশ্রয় ভরা গলায় বললেন, "তোমার এইরকম ইয়ার্কি আমার একদম ভালো লাগে না।"
মিস্টার রেড্ডি হা হা করে হেসে উঠলেন। নীলা রেড্ডি দম্পতির এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁদের মধ্যের যে দাম্পত্য প্রেম আর কেমিস্ট্রি সেটা বেশ এনজয় করছিল।
মিসেস রেড্ডি বললেন, "চলুন, চা পর্বটা সেরে ফেলা যাক। তারপর অনেক গল্প করা যাবে।"
চায়ের টেবিল সুন্দর করে সাজানো, রকমারি স্ন্যাকস, ফাইন কাপ, প্লেট, টি পটের উপর সুন্দর হাতের কাজ করা টি কোজি। নীলা জানতে চাইলো, এই টি কোজিটি মিসেস রেড্ডির নিজের বানানো কিনা।
মিস্টার রেড্ডি খুব গর্বের সঙ্গে জানালেন, তাঁর স্ত্রী এসব হাতের কাজে ভীষণ গুণী। এত খাবার, এত স্ন্যাকস সব মিসেস রেড্ডি নিজে হাতে সকাল থেকে বানিয়েছেন। তাঁরা আসবেন বলে কিছু বাইরে থেকে আনতে দেননি।
মিসেস রেড্ডি নিজের হাতে চা বানিয়ে নীলা আর জীবনকে দিলেন। আজ অনেকদিন পর নীলা কারো বাড়িতে গিয়ে এতটা আপ্যায়ন পেয়ে ভীষণ খুশি হল।
নীলা ভেবেই পাচ্ছিল না আজকের দিনেও কেউ কারো বাড়ি গেলে মানুষ এতটা আপ্যায়ন করে, বাইরের মানুষকে এতটা আপন করে নেয় কি?
নীলা অবাক হয়ে মিসেস রেড্ডির দিকে তাকিয়ে...
জীবন কনুই দিয়ে নীলাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, "তাড়াতাড়ি চা টা শেষ কর, ঠান্ডা হয়ে গেছে আমাদের এবার উঠতে হবে।"
নীলার ঘোর কাটলো। চায়ের কাপটি সে ধুলো পড়া টি টেবিলে রাখলো, যাতে রাখা আছে অনেক অনেক ওষুধ আর ইঞ্জেকশন...
নীলা এগিয়ে গেল হুইল চেয়ারে বসে থাকা মিসেস রেড্ডির দিকে, নীলা হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিল, মিসেস রেড্ডি নীলার হাতটা চেপে ধরল, কিছু বলতে চাইলেও ঠোঁট সাথ দিলনা।
নীলা তার আরেকটা হাত মিসেস রেড্ডির হাতের ওপরে রাখলো। নীলার গলাও ভারী হতে লাগলো...
সেদিন বিকেলের চায়ের নিমন্ত্রণটা ছিল একদম অন্যরকম, সেদিনের সেই আতিথেয়তা, আত্মীয়তা, আপ্যায়ন, ভালোবাসা ভরা সান্নিধ্য কিছুই ভোলার নয় নীলার জন্য, নীলা যে সেদিন অনুভবে সব পেয়েছিল মিসেস রেড্ডির চোখের কোণ থেকে ঝরে পড়া জলের জলছবিতে...
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments