জ্বলদর্চি

সাগরে অগ্নি/ সুদেব কুমার ঘোষ

সাগরে অগ্নি
                                              
সুদেব কুমার ঘোষ

                            
প্রথম পর্ব
এক সময় পাঠশালায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ দিয়ে পাঠ শুরু হত। দুটি ভাগ সমাপ্ত হতে দু - বছর সময় লাগত। এই দুই বছর যদি কেউ ঠিক মতো দুটি বিভাগ সমাপ্ত করত , তাকে বানান, রিডিং পড়া এবং উচ্চারণ সমন্ধে পিছন ফিরে তাকাতে হত না। তারপর প্রাথমিক স্কুলে ছয় বৎসর বয়সে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হতে হত। আমাদের সময় তখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ চালু হয়নি। আমরা আমাদের গ্রামে শচীনন্দন  চক্রবর্তী মহাশয়ের পাঠশালাই দুই বৎসর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ শেষ করে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক শীতল চন্দ্র পাল মহাশয় ঘোষণা করেছিলেন যারা শচীনন্দন চক্রবর্তীর পাঠশালায় দুই বৎসর যাবৎ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ সমাপ্ত করেছে তারা শিশু শ্রেণী থেকে সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হবে। তাদের প্রথম শ্রেণী পড়ার প্রয়োজন হবেনা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই দুটি বিভাগ তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন ছিল। কেবল বর্ণ পরিচয় নয় , পরবর্তী অধ্যায় গুলিও ছাত্রদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন। কারণ বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব সহজ ভাবে দুটি বর্ণ দিয়ে শব্দ , তিনটি বর্ণ দিয়ে শব্দ , চারটি বর্ণ দিয়ে শব্দ পাঁচটি বর্ণ দিয়ে শব্দ গঠন করেছেন। আ - কার থেকে শুরু করে চন্দ্রবিন্দু যোগে শব্দ পর্যন্ত সুন্দর করে লেখা আছে। সরল বাক্য যোগে লেখাগুলিও সুখপাঠ্য। বর্তমানে এই দুটি বিভাগ সকলের পড়া উচিৎ। এতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাথে শিশুরা পরিচিতি লাভ করতে পারবে। গোপাল এবং রাখাল নামে যে দুটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তাদের সমন্ধে ছাত্র - ছাত্রীরা জানতে পারবে।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাম এবং তাঁর আদর্শ তেমনভাবে পরিচিতি লাভ করেনি। প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরীদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সহজ সরল ছেলে কোলকাতায় গিয়ে মেধার পরিচয় দিয়ে কীভাবে বিদ্যাসাগর হয়ে উঠলেন তা এক বিস্ময়ের বিষয়। কেবল তাই নয় একই সাথে দয়ার গুণও তাঁর হৃদয়ে প্রতিভাত হয়েছিল। দুই সাগর তাঁর জীবনে বিদ্যমান। সেই সাগরে নোনা জল নয় , ছিল অগ্নি। কিন্তু প্রশ্ন হল কীভাবে তিনি এই দুই গুণের অধিকারী হয়েছিলেন তার উপাদান বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই লেখার উদ্দেশ্য ঈশ্বরচন্দ্র কীভাবে বিদ্যাসাগর এবং দয়ার সাগর হয়ে উঠলেন তাঁর উপাদানগুলি খোঁজার চেষ্টা করা। প্রথমত , সন্তান - সন্ততির মধ্যে গুণাবলী অনেকটা বংশপরম্পায় প্রতিভাত হয়। দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক পরিবেশ কিছুটা দায়ী থাকে। তৃতীয়ত , তিনি যে সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়েছেন সেই পরিবেশও তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করেছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে এই তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

🍂

 প্রথমে বীরসিংহ ও তার আশে - পাশের ভৌগোলিক পরিবেশ সমন্ধে আলোচনা করা যেতে পারে। আমাদের আলোচনা হুগলী জেলার পশ্চিমাংশ ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উত্তরাংশের ভৌগোলিক পরিবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব। সেই সময় বীরসিংহ গ্রাম হুগলি জেলার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর পূর্ব পুরুষদের আদি বাসস্থানও ছিল হুগলি জেলা। তাঁর ঠাকুমা দূর্গাদেবী বীরসিংহ গ্রামে বাপের বাড়িতে বসবাসের জন্য চলে আসেন। বর্তমানে বীরসিংহ গ্রাম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার ঘাটাল ব্লকে অবস্থিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পূর্বপুরুষদের  আদি বাসস্থান ছিল আরামবাগ শহরের উত্তর - পূর্ব কোণে আরামবাগ থেকে প্রায় দশ - বারো কিলোমিটার দূরে বনমালী পুর গ্রামে। তাঁর মামা বাড়ি ছিল হুগলী জেলার গোঘাট গ্রামে। তাঁর মায়ের মামা বাড়ি ছিল খানাকুল ব্লকের পাতুল গ্রামে। তাঁর শ্বশুর বাড়ি ছিল ক্ষীরপাই। আরামবাগ এবং ঘাটাল মহকুমা জুড়ে তাঁর আত্বীয় স্বজন বসবাস করতেন। সেই সময় থেকে ইংরেজরা  ঘাটাল মহকুমায় ঘাটাল , খড়ার , ক্ষীরপাই , চন্দ্রকোনা টাউন এবং রামজীবনপুর মিউনিসিপ্যালিটি গড়ে তুলেছিল। ঘাটাল বাদে বাকী চারটি স্থান মূলত মফস্বল অঞ্চল। কিন্তু বহু প্রাচীন কাল থেকে এই চারটি স্থান কুটির শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। যেমন রামজীবনপুর তাঁতের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। খড়ার বিখ্যাত ছিল কাঁসা - পিতল দ্বারা নির্মিত বাসনপত্র। এখন সেই কুটির শিল্পের কদর আর নেই। এই এলাকা গুলিতে ছোটো বড় নিম্নগতি সম্পন্ন অনেক নদী বহে গেছে। আরামবাগ শহরের দক্ষিণ দিক ঘেঁষে বহে গেছে দ্বার কেশ্বর নদী। কিছু দূরে প্রবাহিত হয়েছে দামোদরের নিম্নাংশ আর মুন্দেশ্বরী নদী। ঘাটাল শহর ভেদ করে চলে গেছে শিলাবতী নদী। বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যা যেমন ফসলের ক্ষতি করে তেমনি মাঝে - মধ্যে ঘর - বাড়িও ধ্বংস করে। দলকার জলা এই অঞ্চলের বিখ্যাত জলা। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত হলে কেবল ঘাটাল নয়, আরামবাগের বেশ কিছু অঞ্চল উপকৃত হবে। এই অঞ্চল গাঙ্গেয় সমভূমির অন্তর্গত।ফলে ফসল ভালো হয়। ধান এই অঞ্চলের প্রধান ফসল। আলু প্রধান অর্থকরী ফসল। তাছাড়াও পাট, আখ,  তিল, সরিষা সহ শাক - সবজি ভালো হয়। চারিদিকে গাছপালা ঘেরা গ্রামগুলিতে সকলে মিলেমিশে বসবাস করে। মানুষজন খুবই সহজ - সরল। অধিকাংশ কৃষিজীবী। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আমল থেকে বেশ কিছু বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। ফলে শিক্ষার হার বেশ ভালই।
এই অঞ্চলের ছোটো একটি ইতিহাস আছে। রামকৃষ্ণ দেবের জন্মস্থান কামার পুকুরের অতি সন্নিকটে গঢ় মান্দারন নামে এক ছোটো গ্রাম আছে। বাংলায় হোসেন শাহের আমলে তাঁর বিখ্যাত সেনাপতি ইসমাইল গাজি এই গ্রামে দুর্গ নির্মাণ করেন। কালক্রমে জয়ধর সিংহ নামে একজন হিন্দু সেনাপতি এই অঞ্চলে জায়গীর পান। তাঁরই উত্তরাধিকারী বীরেন্দ্র সিংহ এই জায়গীরের অধিপতি হন। মান্দারন গ্রামের পাশ দিয়ে বহে গেছে আমোদর নদী। এই নদীর তীরে বীরেন্দ্র সিংহের বাসস্থান ছিল। তখন মোঘলদের সাথে পাঠানদের প্রায় যুদ্ধ লেগেই থাকত। আকবরের আমলে মোঘলদের দুর্বলতার সুযোগে  পাঠানরা কতলু খাঁয়ের নেতৃত্বে এই অঞ্চল আক্রমণ করতে আসে। আকবর এর মোকাবিলার জন্য মান সিংহকে এই অঞ্চলে প্রেরণ করেন। মান সিংহ জাহানাবাদ তথা আরামবাগের নিকট দারকেশ্বর নদীর তীরে শিবির করেন। পাঠানদের মোকাবিলা করার জন্য তিনি তাঁর পুত্র জগৎ সিংহকে নির্দেশ দেন। এই যুদ্ধের পটভূমিকায় বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী রচনা করেন। গঢ় মান্দারন গেলে এখনো দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যাবে। বর্তমানে এখানে একটি পার্ক আছে। এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র।
 রাধানগর , বীরসিংহ এবং  কামারপুকুর এই তিনটি গ্রাম সরল রেখা দ্বারা যোগ করলে একটি ত্রিভুজের মতো পাওয়া যাবে। ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে তিনজন মহাপুরুষের অবস্থান। তাঁরা হলেন যথাক্রমে রাজা রামমোহন , বিদ্যাসাগর এবং রামকৃষ্ণ দেব। তিনজনই সে যুগে আধুনিক মানুষ ছিলেন। তিনজনই কোলকাতায় অবস্থান করে সমাজ সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁদের আধুনিকতার প্রভাব এই এলাকাতে কিছুটা হলেও পড়েছে। 
এবারে আলোচনা করা যাক সেই সময়ের শিক্ষা সংস্কৃতির বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত সারা ভারতের মতো বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে হিন্দুদের জন্য ছিল পাঠশালা ও টোল। মুসলমানদের জন্য ছিল মক্তব ও মাদ্রাসা। টোল ও মাদ্রাসা ছিল উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র। পরবর্তী কালে বহু তর্ক - বিতর্কের পর পর্যায়ক্রমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটে। রাজা রামমোহন রায় ,  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের পক্ষপাতি। পাশ্চাত্য শিক্ষার আন্দোলন এবং তার প্রসার মূলত শহর কেন্দ্রিক ছিল। গ্রামে - গঞ্জে তখনো শিক্ষা বলতে ছিল পাঠশালা , টোল , চতুষ্পাঠী , মক্তব এবং মাদ্রাসা। বাংলায়  সংস্কৃত শিক্ষার পীঠস্থান ছিল নবদ্বীপ। তাছাড়াও বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সংস্কৃত পড়ানো হত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আত্বীয় - স্বজন সংস্কৃত পাঠদানের সাথে যুক্ত ছিলেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পূর্বপুরুষ আরামবাগ ব্লকের বনমালিপুর গ্রামে বসবাস করতেন। এই গ্রামটি আরামবাগ শহর থেকে ঈশান কোণে প্রায় আট - দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রপিতামহদেব ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের পাঁচ সন্তান। তাঁরা হলেন নৃসিংহরাম , গঙ্গাধর, রামজয়, পঞ্চানন এবং রামচরণ। রামজয় তর্কভূষণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতামহ। ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যুর পর ভাইদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। বিশেষ করে গঙ্গাধরের সাথে রামজয় তর্কভূষণের মধ্যে মনান্তর ঘটে। রামজয় তর্কভূষণ বাড়িতে থাকা অনাবশ্যক ভেবে দেশান্তরী হলেন। ইতিমধ্যে দুর্গাদেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয় এবং তাঁদের দুই পুত্র ও চারটি কন্যা জন্মলাভ করে। বড় পুত্রের নাম ঠাকুরদাস যিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পিতা। অপর পুত্রের নাম কালিদাস। চার কন্যাদের নাম মঙ্গলা , কমলা, গোবিন্দমণি, এবং অন্নপূর্ণা। রামজয় গৃহত্যাগী হওয়ার পরও দুর্গাদেবী পুত্র সন্তান নিয়ে তথায় বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর সাথেও ঠিক বনিবনা হচ্ছিল না। অগত্যা তিনি  পুত্র - কন্যাদের নিয়ে বীরসিংহ গ্রামে বাপের বাড়িতে চলে আসেন।

Post a Comment

1 Comments

  1. কমলিকা ভট্টাচার্যNovember 29, 2024

    ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে তিনজন মহাপুরুষের অবস্থান। তাঁরা হলেন যথাক্রমে রাজা রামমোহন , বিদ্যাসাগর এবং রামকৃষ্ণ দেব। তিনজনই সে যুগে আধুনিক মানুষ।
    ভীষণ ভালো লাগলো। আপনার লেখায় নতুন করে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জানার আগ্রহ রইল।
    প্রণাম নেবেন।

    ReplyDelete