জ্বলদর্চি

ড. পুলক রায় (গবেষক, সম্পাদক, প্রবন্ধকার, দাসপুর, ঘাটাল)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩৫
ড. পুলক রায় (গবেষক, সম্পাদক, প্রবন্ধকার, দাসপুর, ঘাটাল) 

ভাস্করব্রত পতি

ছোটবেলা থেকে এমন একটি পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন, যেখানে শিক্ষা সংস্কৃতি সামাজিকতা বিদ্যানুশীলন তাঁর শিক্ষাজগতকে পরিশীলিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে, ঋদ্ধ করেছে। সেইসাথে তাঁর সংস্কৃতি, মেধা, মানসিকতাকে লালন পালন করেছে। একসময় বাড়িতে নিয়মিত আসতেন অগুনতি গবেষক ক্ষেত্রসমীক্ষক। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ সাঁতরা, বিনয় ঘোষ, তরুণদেব ভট্টাচার্য প্রমুখ মানুষের পাশাপাশি আসতেন ডেভিড ম্যাক্কাচনের মতো কিছু বিদেশী মানুষও। তাঁরা সবাই ছিলেন পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থের দর্শনপ্রার্থী। যিনি ঘাটাল মহকুমার প্রথম আঞ্চলিক ইতিহাসকার হিসেবে পরিচিত। সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন পরিব্রাজক পঞ্চানন রায়ের সুযোগ্য পুত্র ড. পুলক রায়। দাদা ছিলেন অধ্যাপক ড. প্রণব রায়। একজন দিকপাল মানুষ। ফলে পারিবারিকভাবে ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রত্নতত্ত্ব এবং সাহিত্যের সঙ্গে ওঠাপড়া অন্য মাত্রা তৈরি করেছিল তাঁর জীবনে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আজ নিজের অনুসন্ধানী জ্ঞানচক্ষুকে পাথেয় করে হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন। 
ঘাটাল আকাদেমি শারদ সংখ্যা নিয়ে ড. পুলক রায়

১৯৫৬ এর ২৭ শে মার্চ দাসপুর থানার বাসুদেবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ড. পুলক রায়। একসময় কেন্দ্রীয় সরকারের রেল দপ্তরের অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করার পর এখান থেকেই সম্পন্ন করেছেন পি এইচ ডি ডিগ্রি। বিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই দশম শ্রেণীতে কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। সেসময় দেওয়াল পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পান। শুরু হল পথচলা। কলেজে পড়াকালীন লেখার মাত্রা বেড়ে যায়। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের ডালি ঘাটাল মহকুমার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হতে লাগল। ক্রমশঃ হয়ে উঠলেন আদ্যন্ত সাহিত্যপ্রেমী। 
পরিব্রাজক পঞ্চানন সংগ্রহশালা

কোনও পিতৃ পরিচয়ে নয়, কোনওভাবেই অগ্রজের ছত্র ছায়ায় নয়, ড. পুলক রায়ের এই সাহিত্যজগতে পথচলাটা শুরু হয়েছিল সাহিত্যের অন্য কয়েকটা জনপ্রিয় বিষয় দিয়ে। প্রথমে কবিতা লেখা, এরপর গল্প লেখা। সেখান থেকে আঞ্চলিক ইতিহাসকার। একসময় ছোটগল্পকার হিসেবেই পরিচিতি তৈরি হয়ে যায় তাঁর। শুরু করলেন পত্রিকা সম্পাদনা। কচিকাঁচাদের জন্য 'রাজপুত্তুর' এবং পিতৃদেব পঞ্চানন রায়কে স্মরণ করে 'সেই পরিব্রাজক' পত্রিকা প্রকাশ করতে লাগলেন। সবশেষে ঘাটাল মহকুমা সাহিত্য আকাদেমির মুখপত্র 'ঘাটাল আকাদেমি'র সম্পাদনা করছেন। আপাতত এই পত্রিকাটি পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম পত্রিকা হিসেবে (১৪২৮ এবং ১৪৩১) পরিচিতি লাভ করেছে। এই পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় ৫০ টি করে প্রবন্ধ স্থান পায় আর বিভিন্ন জেলার লেখকদের স্থান মেলে এখানে। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন কবি কোরাস, বারান্দা, সংস্কৃতি নামের ম্যাগাজিনগুলি। 
দাসপুর কৃষ্টি সংসদ থেকে সম্মানিত হলেন ড. পুলক রায়

২০০২ সালে দাসপুরের গান্ধী মিশনে সারা বাংলার সাহিত্যসেবীদের নিয়ে একটি বিশাল সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। ঠিক পরের বছর ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন 'দাসপুর সাহিত্য সংসদ'। একসময় নিজের বাড়িতে যে সাহিত্যচর্চা চলত, তা একটা প্লাটফর্ম পেল এই সংসদ গঠনের পর। দাসপুরের সাহিত্যসেবীরা ড. পুলক রায়ের নেতৃত্বে নতুন করে সাহিত্য ভাবনায় জারিত হলেন। ফলে অনেকেই তখন নিজেদের বই প্রকাশ করতে উদ্যোগী হলেন। সেসব বেশিরভাগ বইয়েরই মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন তিনি। এবার প্রকাশ করলেন দাসপুরের কবিদের কবিতা নিয়ে বিশেষ কাব্য সংকলন 'কবিতার নীল মিছিল'। প্রতিবন্ধী কবি সুনীল আকাশকে সম্মান জানিয়ে সুনীলের উদ্দেশ্যে 'লজ্জা কি তুমি পাবে না' কাব্য সংকলন প্রকাশ করলেন। এরপর আজ পর্যন্ত সমানতালে চলছে তাঁর কলমের দৌড়। বহু কবিকে কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। এছাড়াও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দিতে এলাকার তিন গ্রামীণ সাংবাদিক শ্যামাপদ পাত্র, অলোক কুমার ঘোষ এবং অশোক চট্টোপাধ্যায়কে সম্মাননা দেওয়ার সাথে সাথে ড. রামরঞ্জন রায়কে তুলে দেন দাসপুর সাহিত্য সংসদের সম্মান। আসলে তিনি চেয়েছিলেন একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে। এসব কাজ তারই অঙ্গ। 

ঘাটাল মহকুমায় সাহিত্যচর্চাকে আরও বিস্তারলাভ করার মানসিকতা থেকে জন্ম দিলেন 'ঘাটাল মহকুমা সাহিত্য আকাদেমি'। দ্বিতীয় বছরেই ঘাটাল মহকুমার কবিদের কবিতা নিয়ে প্রকাশ করলেন 'কবি ও কবিতায় ঘাটাল' কাব্য সংকলন। মেদিনীপুরের মহিলাদের নিয়ে কাব্য সংকলন 'মেয়েদের কবিতায় মেয়েদের কথা' আগে কেউ কখনো করেননি। ড. পুলক রায়ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এরকম একটি কাজ করলেন মেদিনীপুরের বুকে। ঘাটাল শিশুমেলায় ছড়া পাঠের আসর শুরু করে পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠে সাহিত্যবাসর। সেই ছড়ার আসরে প্রকাশিত হতে থাকে ছড়ার সংকলন। অনুগল্প নিয়েও সংকলন করেছেন। সত্তর দশকে যৌথভাবে প্রকাশ করেছেন 'হাঁটতে হাঁটতে এতদূর' কাব্য সংকলন। আবার গড়বেতার কবি কাশীনাথ সাহাকে সাথে নিয়ে প্রকাশ করেছেন 'স্বাধীনতার কবিতা'। তাঁর সম্পাদিত অন্যান্য কাব্য সংকলনগুলি হল সীমানার ওপার থেকে, লজ্জা কি তুমি পাবে না, আবার বীরপুরুষ, এই বৃষ্টি রোজ বৃষ্টি, ছড়ায় ছড়ায় ছড়াছড়ি, বই মেলাতে ভূতের সাথে ইত্যাদি। এর পাশাপাশি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ মেঘ জানালায় বিদ্যাসাগর তুমি, মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ জীবন ও কর্মকৃতিত্ব এবং যুগপুরুষ রামমোহন। অখণ্ড মেদিনীপুরের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক তথ্য রয়ে গিয়েছিল লাইমলাইটের আড়ালে। অনেক অজানা তথ্য চাপা পড়েছিল। মেদিনীপুরের বিদগ্ধ লেখকদের সাথে নিয়ে সেইসব অজানা তথ্য নিয়ে তিনি সম্পাদনা করলেন 'মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস' নামক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থের। 

যেহেতু ঘাটাল মহকুমার একটি গ্রাম বীরসিংহ। যা কিনা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান। তাই ঘাটাল সাহিত্য একাডেমি থেকে বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করে 'আমাদের বিদ্যাসাগর' গ্রন্থ প্রকাশিত করেন। এরপর রাজা রামমোহন রায়ের ওপর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থপ্রকাশ করলেন। ড. পুলক রায়ের সম্পাদিত পরবর্তী গ্রন্থ 'রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতি'। যা কিনা এরাজ্যের অসংখ্য লৌকিক উপাদান ও তার বিবরণ নিয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ঘাটালের অসংখ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ এবং সেগুলির বিবরণ নিয়ে লিখে ফেললেন 'ঘাটাল মহকুমার দর্শনীয় স্থান' বইটি। এই মুহূর্তে পর্যটকদের কাছে ঘাটাল মহকুমার একটি সত্যিকারের গাইড বুক হিসেবে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি লিখেছেন যেসব গ্রন্থ, কবিতাগ্রন্থ ও গল্পগ্রন্থ, সেগুলি হল -- নিকুড় নিতুর বন্দে ঝিঙ্কি ছড়ায় ছন্দে, হাঁটতে হাঁটতে এতদূর, সুখ আসে তবু ভালোবেসে, জন্মদাত্রী, মোহনার কাছে একা, আবার জলপ্রপাত, ঝিরঝির বৃষ্টির বাগানে, ছোটে ঐ চৈত্রের বিকেল, অনিবার্য সন্ধ্যে ঘরে একা, লিমেরিক কার্ড (১ম, ২ য়), সেরা লিমেরিক ৬০ এবং দাসপুর : ইতিহাস ও সংস্কৃতি। 

চাকরি থেকে অবসর জীবনে প্রবেশ করে শুরু করলেন নিজের বসবাস স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস রচনা 'দাসপুর : ইতিহাস সংস্কৃতি'। আজ থেকে ৬৫ বছর আগে দাসপুরের ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন পঞ্চানন রায়। এরপর এখানকার অনেক আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক পটভূমি বদলে গিয়েছে। সেসব তিনি তুলে ধরেছেন দুই মলাটের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে ড. পুলক রায় উল্লেখ করেছেন, "পিতৃদেব পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ কৃত 'দাসপুরের ইতিহাস' প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬৫ সালে। অর্থাৎ পঁয়ষট্টি বছর আগে। দাসপুরের ঐতিহাসিক সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক বিষয় সম্পর্কিত নতুন তথ্য সমাহারে তাঁর অভিজ্ঞতা উপলব্ধির অমৃততত্ত্ব, তাঁর প্রজ্ঞাদৃষ্টির আলোকে আলোকিত হয়ে থেকেছে সেই সময়কাল থেকেই। পাঠকের কাছে তার গুরুত্ব আজও অসীম অপরিসীম। আজও 'দাসপুরের ইতিহাস' দাসপুরের মানুষের কাছে একটি আকর গ্রন্থ বিশেষ। তখনকার দিনে একজন ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু গবেষকের কাছে সমস্তটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন, সবটাই অনালোকিত। সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকার সরিয়ে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ যে কতখানি ক্লেশকর শ্রমসাধ্য কষ্টকর ছিল, তা এখন আমরা যারা দাসপুরের ইতিহাস সংস্কৃতির তথ্য অনুসন্ধানে নিজেদের নিয়োজিত করি, সেই অবক্ষয়িত অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের হতাশা অন্ধকারের সংকেতগুলি অনুভব করি, আমাদের সৃষ্টি সম্ভাবনার অনন্ত আলোকের অনুসন্ধানে বিচরণ করি। তখন বুঝতে পারি, তৎকালীন সময়ের বনজঙ্গল কর্দমাক্ত পথঘাট পেরিয়ে কীভাবে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন, অন্ধকারময় ইতিহাস অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। তাই তাঁর দেখানো পথে অগ্রসর হয়েও বর্তমান সময়ের পথঘাট শিক্ষার আলোক সমৃদ্ধ সমাজের কাছাকাছি থেকেও তার সহযাত্রী হতে পারিনি, সতীর্থও হতে পারিনি। ........ দাসপুরের প্রাচীন ইতিহাসের অনুসন্ধান এবং ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে তথ্য তুলে ধরা কম কথা নয়। আমি নিজে সেভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষক নই, গবেষকও নই। সেই দাবীও করি না। পঞ্চানন রায়ের 'দাসপুরের ইতিহাস' প্রকাশিত হওয়ার পঁয়ষট্টি বছর পরে দাসপুরের আর্থ সামাজিক সংস্কৃতি ইতিহাসের যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে সেইটুকু তথ্য অনুসন্ধানে তুলে ধরার প্রয়াস করেছি মাত্র। এখানে প্রাচীন ইতিহাসের কথা যেমন আছে, তেমন বর্তমান সংস্কৃতি, ঘটনাপ্রবাহের কথাও তুলে ধরা হয়েছে"। এই মুহূর্তে কাজ করছেন সারা বাংলার লৌকিক দেবতা নিয়ে। সেইসাথে ঘাটাল মহকুমার গ্রাম : সভ্যতা সংস্কৃতি' নিয়ে দশ খণ্ডে প্রকাশ করতে চলেছেন ঘাটালের ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা বিখ্যাত গ্রামগুলির বিবরণ। 

সম্প্রতি তাঁর এহেন কর্মকাণ্ডের দরুন দাসপুর কৃষ্টি সংসদ থেকে সম্মানিত করা হয়েছে তাঁকে। এছাড়াও আরও বেশকিছু সংগঠন থেকে সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এই মুহূর্তে বাসুদেবপুর পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় সংগ্রহশালার তিনি সম্পাদক পদে আসীন। সাহিত্য সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্য বহু কৃতি মানুষকে তাঁর পিতৃদেবের নামে 'পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় একাডেমি পুরস্কার' এবং মাতা সুধাদেবীর নামে 'সুধা স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার' দিয়ে আসছেন আঞ্চলিক ইতিহাস, সাহিত্য সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়কে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। নিরলসভাবে ঘাটালকে কেন্দ্র করে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কবি সাহিত্যিক লেখক গবেষক প্রবন্ধকারদের নিয়ে কলমের কালিতে বিনি সূতার মালা গেঁথে চলেছেন ড. পুলক রায়।

🍂

Post a Comment

0 Comments