পর্ব- ৪৩
স্বপন কুমার দে
এক ছুটির দিনে মল্লিকা সত্যি সত্যিই দুখিদের গ্রামে উপস্থিত হল। গ্রামের নাম বাবলাডিহি বা সংক্ষেপে বাবলাডি। 'ডিহি' মানে ডাঙা বা শুকনো নীরস ভূমি। বাবলা,খেজুর বা ঐ জাতীয় কাঁটা গাছে পরিপূর্ণ রুক্ষ ঊষর ভূমি এই বাবলাডি। ভূমিরূপ বন্ধুর,-- কোথাও উঁচু ঢিবির মত, তো কোথাও একেবারে নীচু। বৃষ্টির জল দাঁড়ায় না, অতি বর্ষণেও মাঠে জল থাকে না। এই অঞ্চলে এমনিতেই বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম, জলসেচ ব্যবস্থা নেই, তার ওপর মাটির প্রকৃতির গুণে চাষবাসের অবস্থা একেবারেই খারাপ। গ্রামের জোয়ান পুরুষেরা কেউ কেউ পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে বাইরের স্টেটে বা কয়লা খাদানে, ইঁট ভাটায় কাজ করে কেউ কেউ পুবে চাষের কাজে খাটতে যায়। খাদ্যের অভাবে ধুঁকতে থাকে মানুষগুলো। সরকারি রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছুটা ঘাটতি মেটানো হয়, সবটা নয়। অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে। পিলে বড়, পেট মোটা, সরু সরু হাত পা, লিকলিকে আঙুল, রুগ্ন শিশু হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়।
দুখিকে সঙ্গে নিয়ে মল্লিকা দেখছিল সব। ঘুরে ঘুরে গোটা গ্রামটা দেখল। ষাট সত্তরটি পরিবারের বাস এখানে অধিকাংশ বাড়িই মাটির তৈরি। দুয়েকটি পাকা বাড়ি দেখা গেল। দুখির কাছ থেকে জানল, তাদের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। বাকি সব ঘরের চেহারা আর মানুষগুলোকে দেখেই বুঝতে পারা যায় যে তারা অনাহারের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া কোনও রকমে কষ্টে সৃষ্টে বেঁচেবর্তে থাকা মানুষ। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের। রুক্ষ দেহ আর জীর্ণ পোশাক তাদের অভাবটাকে বড় বেশি স্পষ্ট করছিল। বাচ্চাদের এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে যুবা ও বৃদ্ধদেরও আদুড় গায়ে ঘুরতে দেখা গেল। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে মল্লিকাকে দেখছিল। এক মধ্য বয়সিনী কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে দুখিকে জিজ্ঞেস করল," ইনি কে বঠেন গ?"
দুখি বলেছিল," ইনি হামদের কলেজের দিদিমণি। খুব ভাল মানুষ বঠে। হামদের গেরাম দেইখতে আস্যেছেন।"
" অঃ, তাই বলি! তা কেমন দেখছ গ দিদিমণি, হামদের গেরাম? শহরে যাঁয়ে নিন্দা কইরবে ত।"
মল্লিকা বাধা দেয়," না না নিন্দে কেন করবো? আপনারা কত ভালো! এই যে নিজে থেকেই আপনারা আমার সঙ্গে আলাপ করছেন, এতে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি আসলে এখানে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। আপনারা যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহলে আমার সুবিধা হয়।"
" তা, কী কইরতে আস্যেছেন, বলুন। তা বাদে আমরা সাহায্য কইরতে পাইরব কিনা বইলব।"
" আমি বলি কি মাসিমা, আপনাদের গ্রামের যাঁরা মুরুব্বি আছেন আর আপনাদের মতো মহিলারা আছেন, তারা সবাই মিলে একটা জায়গায় বসবার ব্যবস্থা করে দিন, আমি সেখানেই সব বলবো।"
এরপর দুখিদের উঠানে বসে বেগুন পোড়া দিয়ে মুড়ি মেখে খেতে খেতে দুখির স্বামী এবং বাচ্চাদের সাথে গল্প করতে লাগল মল্লিকা। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। সেই মধ্যবয়সি মাসিমা মল্লিকা ও দুখিকে গ্রামের আটচালায় ডেকে নিয়ে এল।
" আপনারা, এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই আমার গুরুজনতুল্য, অনেকে সমবয়সি, কিছু আমার চেয়ে ছোট। আমি সকলকে সম্মান জানাচ্ছি এবং আমাকে কথা বলবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি যে কথা বলবার জন্য আপনাদের ডেকেছি, তার বিষয় হল ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াশোনা। আমি জেনেছি, অভাবের কারণে অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি। আবার, যারা স্কুলে ভর্তি হয় তাদের মধ্যে সবাই পড়াশোনা করার সময় পায় না। পড়াশোনার বদলে তাদের পয়সা রোজগারের জন্য খাটতে হয়। ফলে স্কুল ছুট হয়ে যায়। আর তাদের অজ্ঞতার জন্য সারাজীবন ভুগতে হয়। আপনারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যান। মনে করেন, স্কুলে নাম থাকলেই পড়াশোনা হয়ে যাবে। এটা মস্তবড় ভুল ধারণা। স্কুলে ভর্তি হওয়া মানে শুধুমাত্র মিড ডে মিল খেয়ে বাড়ি চলে আসা নয়, পড়াশোনা মানে নিজের প্রয়োজনে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারা। এই জায়গাতেই ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তাই আমি এদের পড়াতে চাই। আমি চাই, এরাও স্কুলে নিয়মিত হোক, পরীক্ষায় ভালো ফল করুক। আমি প্রতিদিন সকালে দু'ঘণ্টা পড়াবো এবং ছুটির দিন সকাল ও বিকাল। এরজন্য আপনাদের কোনও টাকা পয়সা লাগবে না। সকালের টিফিনটাও ওরা এখানেই খাবে। আপনারা শুধু আপনাদের ছেলেমেয়েদের আমার কাছে পাঠাবেন।"
🍂
বৃদ্ধ কুশ মাহাত প্রশ্ন করল," আপনি নিজে থাক্যে হামদের উবগার কইরবেন ক্যানে?"
" আমি আমার বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, তাই।" মল্লিকা বলে।
প্রত্যুত্তরে ভিড়ের মধ্য থেকে প্রশ্ন আসে," ইরকম হবেক নাই ত, যে আপনি লোক দেখানো ক'টা মাস পড়ালেন, হামদের মন ভুলালেন, তারপর ভোটে দাঁড়াই গেলেন আর হামদের ভোট চাইলেন।"
মল্লিকা হেসে ফেলে," না গো খুড়োমশাই, আমি রাজনীতি করিনা, আর কখনো করবার ইচ্ছেও নেই। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।"
তখন সবাই মিলে আলোচনায় বসল। ঠিক হল, দিদিমণি যখন বলছেন তখন তাঁকে বিশ্বাস করে দেখাই যাক না। অন্যরকম হলে তখন না হয় বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাহলে, এই কথাই হল, গ্রামের এই আটচালাতেই বসবে দিদিমণির পাঠশালা। পড়ুয়াদের বাড়তি খাতা, বই, পেন দিদিমণিই দেবেন। এছাড়াও বাচ্চাদের টিফিনের ব্যবস্থাও তিনিই করবেন। আর সেগুলো তৈরি করে দেবেন গ্রামের মেয়েরা। ব্যাস্, সামনের রোববার থেকেই হবে দিদিমণির টোল।
* * * * *
প্রায় ছ'মাসের মত হল মল্লিকার পাঠশালা চলছে। বিভিন্ন ক্লাসের, বিভিন্ন বয়সের বত্রিশ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে যে শিক্ষাকেন্দ্রটি শুরু হয়েছিল এখন তা পঞ্চাশের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। মল্লিকার একার পক্ষে অতগুলো ছেলেমেয়েকে দেখানো সম্ভব হচ্ছিল না, তাই সে আরও দু'জন শিক্ষিত বেকারকে রেখেছে যোগান। ওদের পারিশ্রমিক মল্লিকা দেয়। শুধুমাত্র এই গ্রামের ছেলেমেয়েরাই নয়, পাশাপাশি গ্রাম থেকে ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। সমস্যা হয়েছে পড়ানোর স্থান সংকুলন নিয়ে। সমস্যা অর্থেরও। এত স্টুডেন্টের খাই খরচাও কম নয়। মল্লিকার নতুন চাকরি। বেতন যা পায় তা প্রায় পুরোটাই এখানে চলে যায়। এই অবস্থায় নতুনভাবে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করা একেবারেই সম্ভব নয়। আবার মিটিং বসল। উপায় বার করলেন গ্রামেরই লোকেরা। গ্রামের অদূরে যে খাস জায়গা পড়ে আছে সেখানেই তৈরি হবে নতুন পাঠশালা। পাশাপাশি গ্রাম পুরুলডি, চৌকান, শ্রীপুর প্রভৃতি গ্রামের মানুষ বাঁশ, খড়, শ্রম দিয়ে বাড়ি তৈরি করে দেবে।
মাস দুয়েকের মধ্যে গড়ে উঠল নতুন শিক্ষাকেন্দ্র। সকলের সম্মতিতে মল্লিকা এই শিক্ষাকেন্দ্রের নাম রাখল ' আলো '।জলের ব্যবস্থা হল, বিদ্যুতের ব্যবস্থা হল। এজন্য অবশ্য মল্লিকাকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে ঘুরে, তোষামোদ করে শেষ পর্যন্ত সে সফল হয়েছে।
এখানের ছেলেমেয়েরা স্কুল শিক্ষার সাথে সমান্তরালভাবে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ নেয়। বিকেলে শরীরচর্চা করে। স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা আবার স্কুলমুখী হচ্ছে। দেখে খুব ভালো লাগল মল্লিকার। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে সেও যেন শিশু হয়ে যায় হেলথ্ ডিপার্টমেন্টে জানিয়ে মাসে একবার হেলথ্ চেক আপের ব্যবস্থাও হয়েছে।
এই মল্লিকাই কলেজে আবার অন্যরকম। স্টুডেন্টদের পড়াশোনার ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট। মিষ্টি স্বভাবের ম্যাডামের মধ্যে যে এত তেজ থাকতে পারে, তা তার স্টুডেন্টরাই জানে।
0 Comments