জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৭ / সালেহা খাতুন

এন এস এস ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে আমরা চার প্রোগ্রাম অফিসার

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৭ / সালেহা খাতুন

সোশ্যাল মিডিয়ার মতোই সোশ্যাল ওয়ার্ক অনেক সময়ই নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে জিতিয়ে দিয়েছে আমায়। ঐ যে বাড়ি থেকে দূরে থাকার জন্য লিখতে পারি বলে খুব তৃপ্তির কথা উচ্চারণ করেছি, তারও একটা অ্যান্টিথিসিস আছে। আমার যাপিত জীবনে অনেক লোক প্রবাদ আশ্চর্যজনকভাবে মিলে গেছে। ভালোবাসা-মন্দবাসা সমেত জীবন বয়ে চলেছে পুরোদমে। সংসার জীবনের নানা হার্ডল পেরোতে পেরোতে চলেছি। হার্ডলগুলো রক্তাক্ত করেছে অনেকবারই। সেই নিঃশব্দ রক্তপাত অলিন্দ নিলয়ের ক্ষমতা বাড়িয়ে ক্ষমার পথে হেঁটে বুঝিয়ে দিয়েছে জীবনে টিকে থাকাটাও একটা আর্ট।

আমি আমি করে তো অনেক দিন কাটলো, কিন্তু জীবন বদলে গেল জাতীয় সেবা প্রকল্পে যোগ দিয়ে। মূল মন্ত্র হয়ে গেল, “নট মি বাট ইউ”। ২০০৮ থেকে ২০১২ টানা চারবছর কাজ করলাম এন এস এস প্রোগ্রাম অফিসার ও সেক্রেটারি রূপে। শিক্ষার্থী ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে সঙ্গে আমারও পার্সোনালিটি ডেভলপ করলো। তখন ইউনিট ছিল চারটি। দায়িত্বে ছিলাম আমি, ভূগোলের অধ্যাপক ড. মণিশ্রী মণ্ডল, বোটানির দুই অধ্যাপক ড.দুলাল দে এবং সোমদত্তা ঘোষ। অ্যাডাপ্টেড স্লামগুলি ছিল – গির্জা বস্তি, হরিজন পল্লী, মজদুর নগর এবং বেহারাপাড়া। পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকার নিয়ে কলেজকে ক্যাম্পাস থেকে কম্যুনিটির কাছে পৌঁছে দিলাম। ক্যালেন্ডার ধরে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নানান কার্যক্রম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেলাম পুরো চার বছর।

 আমাদের সময়কালে মোট তিনটি স্পেশাল ক্যাম্পের আয়োজন করেছিলাম। প্রতি শনিবার এন এস এস – এর ক্লাস হতো। ক্যাম্পাস ক্লিন করা থেকে বাগানে জল দেওয়া সব কাজ শিক্ষার্থী ভলান্টিয়াররাই করতো। টিফিন প্যাকেট নিজেরা সংগ্রহ করে এনে হিসেব নিকেশ করা, নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে টিফিন ডিস্ট্রিবিউট করা, বিল সাবমিট করা সব কাজে পোক্ত হয়ে উঠলো ওরা। শুধু ওদের সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব ছিল আমাদের। ওরা শিখলো মানুষের সেবা অর্থ না থাকলেও করা যায়। মানুষের পাশে থাকা যায়। হাতেকলমে শিক্ষা নিল সবাই। সে সময় একটা ক্যাম্পে ফিজিওলজির ছাত্র কালিশঙ্কর কোনো কারণে NSS থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, ওকে একদিন সারাদিন NSS গার্ডেনে কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় এই কাজে ও কতটা আগ্রহী। বিজ্ঞান বিভাগের আর এক শিক্ষার্থী বৈষ্ণমা NSS এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতো। চোখ বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতা উচ্চারণ করে যেতো। একটা অন্য পরিবেশ তৈরি হতো তখন। এক একটা ইউনিটের একশো জন করে মোট চারশো ভলান্টিয়ার নিয়ে কাজ চলতো । প্রত্যেক বছরে নতুন করে নতুন নতুন ভলান্টিয়ার এনরোল হতো।

 নিজের বিভাগই শুধু নয় অন্যান্য সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একেবারে মাটির কাছে নেমে এসে ঘটে গেল গভীর সংযোগ। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ছিল কাঁচা দুধের মতো। ওদের একটু ফুটিয়ে নিলেই হলো। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা ওদের সঙ্গে কানেকটেড থাকতাম। তখন অ্যাসিসটেন্ট ছিল ফিজিক্যাল এডুকেশনের প্রাক্তন ছাত্র নয়ন পাত্র। আমার দুইহাতের মতোই ছিল। ও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতো, যখন রাত তিনটেতেও ওকে মেসেজ করে বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা চলতো। একবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের ভোরে আমার ছাত্র সুশান্ত ফোন করে গাঁদা ফুলের মালা সংগ্রহ হয়ে গেছে বলে খবর দেয়। কেননা বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে চাহিদা বেড়ে গেলে একটা ক্রাইসিস তৈরি হতো। দাম বেড়ে যেতো। এন এস এস এর আর্থিক সামর্থ্য কম। যা গ্রান্ট আসতো তা ভলান্টিয়ারদের টিফিনের জন্য বরাদ্দ ছিল। তবুও ঐ ক্ষুদ্র সামর্থ্য থেকে কাজ হতো অনেক।

২০০৮ এ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমরা পূর্বসূরিদের থেকে এন এস এস-এর ব্যাটন হাতে নিলাম। এন এস এস ডে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হলো। পুজোর ছুটিতে অক্টোবরের ষোলো থেকে পঁচিশ পর্যন্ত চললো স্পেশাল ক্যাম্প। ক্যাম্পাস এবং প্রতিটি অ্যাডাপ্টেড স্লামে ক্লিনিং থেকে শুরু করে ওষুধ বিতরণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির আয়োজন এবং বেহারাপাড়ায় একটি কালভার্টও নির্মাণ করে দেওয়া হয়। টানা দশদিন ভলান্টিয়ারদের নিয়ে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত নানান কার্যক্রম রুটিন ধরে সম্পন্ন করে চললাম। ভলান্টিয়ারদের আটটা গ্রুপে ভাগ করে গ্রুপ লিডার নির্বাচন করে দেওয়া হতো। এ বি সি ডি নাম দেওয়া হতো। তবে আমি সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে ২০০৯ - এ  আয়োজিত শীতকালীনক্যাম্পে গ্রুপ গুলোর নাম দিই জীবনানন্দের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের নাম অনুযায়ী।

 প্রত্যেকদিন সকাল ছটায় যোগা ক্লাস করে দিন শুরু হতো। তারপর ব্রেকফাস্ট করে ক্যাম্পাস থেকে স্লামে গিয়ে বাসিন্দাদের লাইফ স্টাইল নিয়ে সার্ভে চলতো। আর এসব ক্যাম্পের জন্য মিউনিসিপ্যালিটির আগাম অনুমতি নেওয়া, সি ও এম এইচ-এর কাছ থেকে ব্লিচিং পাউডার, হ্যালোজেন ট্যাবলেট, ও আর এস, মাল্টি ভিটামিন ট্যাবলেট, আয়রন ট্যাবলেট,ফিনাইল, অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট প্রভৃতি আগে থেকে আবেদন করে সংগ্রহ করে রাখা, ক্যাম্পে আগত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সংবর্ধিত করার জন্য বেশ কিছু উপহার বড়ো বাজার থেকে আগেই কিনে রাখতে হতো।

প্রোগ্রাম অফিসারদের মধ্যে আমাকে সেক্রেটারি নির্বাচন করা হয়েছিল, ফলে আমার দায়িত্ব তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই বেশি। একবার সি এম ও এইচ এর সঙ্গে দেখা করা, একবার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা, জেলা সভাধিপতির সঙ্গে দেখা করা, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটরের সঙ্গে দেখা করা এই সব কাজ করতে হতো। একবারেই দেখা হতো না বারবার যেতে হতো। অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমিটা কীভাবে ফরোয়ার্ড হয়ে যাচ্ছে। জীবনে একবারই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননীয় ভিসির রুমে যাওয়ার সুযোগ পাই সেও এই এন এস এস - এরই জন্য। ২০১১ – এর স্পেশাল ক্যাম্পে তৎকালীন সম্মাননীয় ভিসি ড. নন্দদুলাল পড়িয়া মহাশয়কে উদ্বোধক রূপে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। সেবার মাননীয় অধ্যক্ষ ড. প্রবীরকুমার চক্রবর্তী বলেছিলেন ভিসি স্যারকে অনেকবার কলেজে আমন্ত্রণ করেছি, কিন্তু ওঁর সময় নেই, আসবেন না। সবাইকে অবাক করে সম্মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলার ড. নন্দদুলাল পড়িয়া পুজোর ছুটির মধ্যে আয়োজিত ক্যাম্পে এসেছিলেন। 

ক্যাম্পে আগে রাত্রে থাকারও ব্যবস্থা ছিল কিন্তু আমাদের সময়কালে জঙ্গলমহল নানা কারণে  অশান্ত থাকতো, ফলে আমরা সন্ধের পর ভলান্টিয়ারদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। সকাল ছটা থেকে সন্ধে ছটা পর্যন্ত চলতো। সবাই খুবই নিয়মানুবর্তী ছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্লামে কাজ করতো। দুপুরে কলেজে ফিরে লাঞ্চ করে বিকেলে নানান সেমিনার ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নিত। দশদিন ধরে দুশো ভলান্টিয়ারের জন্য লাঞ্চের আয়োজন চাট্টিখানি কথা নয়। আমি মণিশ্রীদি গোলকুঁয়া চক থেকে স্বদেশদাকে রান্না করার জন্য অনুরোধ করে নিয়ে আসতাম। উনি বাজেট দিতেন। প্রতিদিন ফর্দ করে দিতেন। বাজার করতো ভলান্টিয়াররা নিজেরা। এক এক দিন এক একটা গ্রুপ দায়িত্ব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিত। বাজার করা, খাবার পরিবেশন করা, মাজাঘষা, গোছগাছ, অনুষ্ঠান পরিচালনা বিভিন্ন কাজ ভাগ করে নিত। আমার এন এস এস ভলান্টিয়াররা শিখে গেল জীবনের আসল উদ্দেশ্য। তাই এখন যখন দেখি আমার এন এস এস ভলান্টিয়ার রঞ্জিত, শ্যাম আরো অনেকে মানুষের বিপদে নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন নিজেকে সার্থক মনে হয়। ওদের কথা যখন কেউ আমাকে বলে, নতুন করে জানাতে চায়, মনে মনে হাসি আর ভাবি মায়ের কাছে মাসির গল্প করছে।

🍂

 একবার ক্যাম্পে স্লামে গিয়ে ক্লিনিং প্রোগ্রাম চলাকালীন আমার ছাত্র চিন্ময়ের চোখে শুঁয়োপোকার কাঁটা পড়ে যায়। মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা ওকে খুব দ্রুত দেখে দেন। ওদের এই সেবার কাজে আরো বেশি করে উৎসাহিত করেন। ক্যাম্প চলাকালীন একবার হাসপাতাল থেকে খবর এলো এক সদ্য প্রসূতির এক রেয়ার গ্রুপের রক্ত লাগবে, কোথাও না পেয়ে মেদিনীপুর কলেজের ক্যাম্পে বাড়ির লোককে পাঠিয়ে দেন তাঁরা। সেসময় ভলান্টিয়াররা সবে লাঞ্চে বসেছে। নাগমা নামে এক ভলান্টিয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল রক্ত দিতে। কেননা ওর ব্লাড গ্রুপের সঙ্গে মিলে গেছে। পরের দিন তাকে আমরা সংবর্ধনা দিই।

মজার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। আমার ইউনিটটি কাজ করতো গির্জা বস্তিতে। সারা বস্তিতে ব্লিচিং ছড়িয়ে, বাথরুমে বাথরুমে ফিনাইল দিয়ে যখন কাজ করছে, তখন একবার বুঝতে না পেরে বাথরুমে একজন থাকাকালীনই প্রায় তার গায়েই ফিনাইল দিয়ে ফেলছিল। অ্যাসিড দিয়ে আমি নিজে হাতে বস্তির অনেক বাথরুম পরিষ্কার করে দিয়েছি। আমি না দেখিয়ে দিলে ভলান্টিয়াররা উৎসাহ পাবে না। হয়তো রোজ আমরা এই কাজে যেতে পারবো না কিন্তু বাসিন্দাদের বোঝাতে পেরেছিলাম যে ইচ্ছে থাকলেই পরিচ্ছন্ন থাকা যায়।
২০০৯ - এর ৩০ ডিসেম্বরের "উপত্যকা"য়  প্রকাশিত জাতীয় সেবা প্রকল্প এর ক্যাম্পের সংবাদ।

কাগজে মুড়ে সি এম ও এইচ – এর দেওয়া ওষুধ সবার হাতে হাতে পৌঁছে দিত ওরা। ওদের সঙ্গে থাকতেই হতো সব সময়। ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া মানে একটা বড়ো দায়িত্ব। মিছিল করে ব্যানার সহযোগে যাওয়া হতো।

২০০৮,২০০৯ এবং ২০১১ এই তিনটি বছরের স্পেশাল ক্যাম্পে অনেক আলোচনাচক্রের আয়োজনও করেছিলাম। “রিলেশন বিটউইন লিটারেচার অ্যাণ্ড সোসাইটি”, “ চাইল্ড লেবার”, “ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট”, “নো এডস ফর নো এডস”, “ মাশরুম কালচার”, “লিগাল অ্যাওয়ারনেস”, “ভার্মি কম্পোজড”, “সাংবাদিকতার প্রথমপাঠ”, “ব্লাড ডোনেশান অ্যাণ্ড ব্লাড গ্রুপ টেস্ট”, “ হেল্থ অ্যাণ্ড হাইজিন”, “ ওম্যান অ্যাণ্ড এডুকেশন”, “ গ্লোবাল ওয়ার্মিং”, “রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট”, “ হিউম্যান রাইটস”, “মেডিসিনাল প্ল্যান্টস অ্যাণ্ড দেয়ার কনজার ভেশন” প্রভৃতি। কলেজের এবং কলেজের বাইরের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা এ বিষয়গুলিতে আলোকপাত করেন।

যে কোনো কাজেই ওরিয়েন্টেশন প্রয়োজন। এন এস এস – এর দশদিনের ওরিয়েন্টেশন কোর্সে যোগ দিই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন লোকশিক্ষা পরিষদে। আমি আর সোমদত্তা দুজনে সেবার যাই। এই প্রথম মেয়েকে ছাড়া বাইরে রাত কাটালাম। এজন্য আমার বাবা মা চলে এলেন মেদিনীপুরে।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments