বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫০
অর্জুন
ভাস্করব্রত পতি
অর্জুন একটি বৃহৎ বৃক্ষ জাতীয় গাছ। প্রায় ৫০ - ৬০ ফুট পর্যন্ত উচু হয়। পাতাগুলির আকারটা মানুষের জিহ্বার মতো, তবে সাইজে বড়। কিন্তু মাংসল নয়। পাতার প্রান্তভাগগুলি খুব সরু। দাঁতযুক্ত করাতের মত। বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে অর্জুন গাছে ফুল ফুটে এবং পৌষ থেকে ফাল্গুন মাসের মধ্যে ফল পাকে। এদের ফল আকারে অনেকটা করভাঙা ফলের মতো। কাঁচা ফল সবুজ রঙের হলেও এদের ফল শুকিয়ে গেলে বাদামি বর্ণ ধারণ করে। এবং খুব হালকা হয়। যা থেকে সহজেই চারাগাছ জন্মাতে পারে।
অর্জুনকে সংস্কৃতে কঙ্কভ, হিন্দিতে অর্জুন, তামিলে ভেল্লাইমরুদমারুম, জারমাদি, মারাঠিতে শাদুল, গুজরাটিতে সজদন বলে। অর্জুনের বিজ্ঞানসম্মত নাম Terminalia arjuna। এটি Combretaceae পরিবারের অন্তর্গত। ভারতের প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই এই গাছ জন্মায়। অর্জুন গাছের মধ্যে মেলে Crystalline compounds হিসেবে arjunine, arjunetin, Lactonic constituents, বিভিন্ন উপকারী তেল, ট্যানিন ইত্যাদি। খুব উপকারী বৃক্ষ এটি।
অর্জুন বৃক্ষের বৈদিক নাম 'ককুভ'। অথর্ববেদের ৫৬।৪।১১৮ সূক্তে এই গাছটির খোঁজ মেলে --
ককুভঃ শুম্মা ওষধীনাং গাবো গোষ্ঠাদি বেরতে।
ধনং সনিষ্যন্তী নামাত্মানং তব পুরুষঃ।
অর্থাৎ হে বৃক্ষরাট! ককুভ (অর্জুন), বিস্তীর্ণশাখ তুমি; বায়ুর প্রকাশ তোমাতে সর্বদা হয়, তোমার শরীর সর্ব শরীরের শ্রেষ্ঠ ধন যে বল, তাকেই দান করে। যেমন গরু, গোষ্ঠ থেকে বল সঞ্চয় ক'রে আবার অরণ্যে ফিরে যেতে পারে।
'অর্জুন' নামের তাৎপর্য--
'ককো বাতঃ, তস্য ককস্য বাতস্য।
কং ভূমিং ভাতি; অস্মাৎ বাতভূমি - প্রকাশকঃ অর্জ্জুনঃ'।
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন, "এই নামটির দ্বারা সে যে বাতভূমিতে (হৃদ্যন্ত্রে) বলদান করে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এখানে অর্জন নামের তাৎপর্য হ'লো অর্জ + উনন; এই অর্জ অর্থ বল; এই কথাটা বৈদিক শব্দাভিধানে আছে"।
ফল সহ গাছ
অর্জুন গাছের ছাল ভেষজ ব্যবহারে কাজে লাগে। যাঁদের বুক ধড়ফড় করে অথচ হাই ব্লাডপ্রেসার নেই, তাঁদের জন্য কাঁচা ছালের রস মহৌষধ। শ্বেত বা রক্তপ্রদর, রক্ত আমাশয়, রক্তপিত্ত, শুক্রমেহ (Spermatorrhoea), লো ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি নিরাময়ে অর্জুন গাছের ছাল ব্যবহার করেন বৈদ্যকরা। ফোঁড়া, হাঁপানি, হার্নিয়া রোগেও খুব উপকারী। হার্নিয়া নিরসনে কোমরে শুকনো অর্জুন ফল বেঁধে রাখার রেওয়াজ আছে। শুকনো অর্জুন ফল খুব ভালো জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আর এর কাঠ বিভিন্ন গেরস্থালি সামগ্রী বানাতে কাজে লাগে। 
অর্জুন ফল
'অর্জুন গাছটি সেই মাঠে একা দাঁড়িয়ে ছিল
একজন আর্য পুরুষ - অভিজাতদের স্তম্ভ
অন্য সব গাছ একে প্রণাম করেছিল
এটি ছিল নিছক গল্পের শুরু
কোথাও থেকে কৃষ্ণচূড়ার বীজ এসেছিল
কয়েক বছর পরে সে একজন যুবতী
একজন সাঁওতাল মেয়ে, তার চুলে লালচে রং নিয়ে
অর্জুন সাথে সাথে তাকে নিজের মত করে চেয়েছিল
সে এমন কোন মেয়ে ছিল না যে
বসন্তে সে সাজবে সে সাহায্য ছাড়াই, একা
সে আর্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি
সে কুঁড়ি ফোটাতে ব্যস্ত ছিল
গত রাতের ফুলগুলো তার চুল থেকে পড়ে
লহরী পাতায় তার অর্জুনের জন্য কাপড় বোনা ছিল-
সে একজন আর্য পুরুষ, যে ভেবেছিল
কেবল সে এত সুন্দর সৌন্দর্য দাবি করতে পারে
দূর থেকে অর্জুন গাছটি দেখতে পায়
কৃষ্ণচূড়ার নির্ঝর হৃদয়
সৌন্দর্যে বিমোহিত, তার বিভ্রান্ত চোখ
ভাবছিল কখন সে তার সন্ধান পাবে?
এর জন্য আমি এই গল্পটি দ্রুত শেষ করতে চাই
কৃষ্ণচূড়া অনেক বেশি অনড়তার অহংকার তাকে নিজেকে বিক্রি করতে দেবে না
সে বরং একজন প্রতিবেশী বা বন্ধু হতে চাইবে
গল্পটি খুব সহজ নয়
অর্জুন ছাল ছাল, তবু ঝরেছে
কিন্তু সাঁওতাল মেয়ে রক্ত ঝরাতে পারে
আর্য পুরুষ মেনে নেয় সে জিততে পারে না
অর্জুন বৃক্ষ হয়ে পুনর্জন্ম কর
কৃষ্ণচূড়াকে বন্ধু ভাবো
আমাকে অন্যের সাথে বিভ্রান্ত করো না,
খাড়া একজন
যখন আমি রক্তপাত করি,
তোমার ছাল ঝরিয়ে আমাকে ডাকো তারপর"।
-- 'অর্জুন এবং কৃষ্ণচূড়ার গল্প', মন্দাক্রান্তা সেন
🍂
0 Comments