চিত্র - শুভম দাস
বাতিঘর
পুলককান্তি কর
মামের কোনও ফেসবুক ফ্রেণ্ড সুন্দর একটা ছড়া পাঠিয়েছে গ্রুপে। ‘আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে সূয্যি নামে পাটে/ খুকু গেল জল আনতে পদ্মদীঘির ঘাটে’-কী সুন্দর পদ্মপুকুর। খাটো একটা শাড়ী পরে একটা কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজেই একটা পদ্ম হয়ে। কী সুন্দর লেখা! তেমনি ছবি। নিজের মনে কোথাও যেন হারিয়ে যায় লিসা। এই শিকাগো শহরের এই অঞ্চলটায় তেমন জনবসতি নেই। ধূ ধূ প্রান্তর, গাছপালা পুকুর সবই আছে, কিন্তু এই দৃশ্যটি যেন বড় মায়াময় এক জগৎ থেকে ভেসে আসা এক টুকরো সঞ্জীবনী। লিসার বাবা-মা এখানকার ‘বঙ্গ চেতনা’ ক্লাবের ফাউণ্ডার মেম্বার। মেয়ের বাংলা শেখার ক্ষেত্রে কোনও আপোষ তাঁরা করেননি। এখানকার পাশ্চাত্যের পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে মেয়ে যাতে ভালো মতো বাংলা লিখতে পড়তে পারে, সেজন্য তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট। লিসা যে বাংলা সাহিত্য খুব ভালোবাসে তা নয়, তবু পড়ার অভ্যেসটা বজায় রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র হলে দাঁত কামড়ায়, কিন্তু সুনীল, শীর্ষেন্দুতে সে সাবলীল। ওর এখন উনিশ বছর চলছে, কিন্তু হঠাৎ এই ছেলে ভুলানো ছড়ার লাইন ক’টা যেন ওর চোখের সামনে একটা দৃশ্যপট তৈরী করে দিল। এখানে ওদের বাড়ীর সামনেই দুটো ম্যাপল গাছ আছে; তার ভেতর দিয়ে যখন সূর্যাস্ত আসে, বেশ ভালোই লাগে তার। কিন্তু আজকের এই দৃশ্যপট যেন তার মনোজগতের বহুকালের চেনা। লিসা বলল, ‘মাম এই দ্যাখো, অজিনা মাসী তোমাকে এই পোষ্ট শেয়ার করেছে, লেখাটি কার বলতে পারো?
না রে, এতো সেই ছোটবেলার ছড়ার বইতে পড়েছি। চেনা কারোর লেখা নয় বোধহয়। প্রচলিত।
দ্যাখো মা, বাচ্চাটা কেমন ছোট্ট করে শাড়ী পরেছে? তোমারা ছোটবেলায় এভাবে পুকুরে গেছ কখনও?
না রে! আমরা শুধু সরস্বতী পূজোর দিনে শাড়ী পরতাম! তাও মায়ের পুরোনো শাড়ী ভাঁজ করে!
গ্রামদেশের মেয়েরা কি এরকম শাড়ী সবসময় পরে? আমার এইরকম গ্রাম দেখতে খুব ইচ্ছে করে। এবার ইণ্ডিয়া গেলে আর দিল্লিটিল্লি বেড়াতে যাবো না। বাপিকে বলো কোনও গ্রামে যাবো। এরকম পদ্মপুকুরে নেমে কলসী করে জল তুলবো।
অবন্তিকা হেসে বলল, তোর ফ্যান্টাসী ভালো লিসা। তবে এসব সিন কেবল ছবিতেই দেখতে পাওয়া যাবে। আজকাল আর গ্রামের মেয়েরা শাড়ী পরে না। সবাই দেখবি বারমুডা আর টপ পরে বসে আছে।
যাঃ। তোমার আবার বাড়াবাড়ি। বাপি বলছিল, কেউ নিজেদের ট্রাডিশন সহজে ছাড়তে পারে না। কোথাও না কোথাও সেটা থেকে যায়।
অবন্তিকা কথা বাড়ালো না। বলল, ‘অনেকক্ষণ মোবাইল ঘাঁটাঘাটি হয়েছে, এবার পড়তে বসো’।
মাম! ডোন্ট ইউ রিমেম্বার দ্যাট অ্যায়াম নাইনটিন? ইউ শুড’ন্ট্ ইন্টারফেয়ার ইন মাই শিডিউল!
আই মাস্ট! ইউ ডোন্ট ফরগেট দ্যাট ইওয়র বাপি ইজ বিয়ারিং ইয়োর কস্ট টিল নাউ। ইউ আর নট লাইক আদার অ্যামেরিকান নাইনটিনস!
মা মেয়ের খুনসুঁটি খানিকক্ষণ চলছিলই, অরিত্র এসে ঘোষণা করল, ‘অবন্তিকা পূজোর সময় টিকিটটা কনফার্ম করলাম। পঞ্চমীর দিন আমরা কলকাতা পৌঁছব। সেই বুঝে প্যাকিং করো।‘
অবন্তিকা বলল, ‘এখনও পাক্কা দুমাস। ডোন্ট ওরি। কিন্তু আমাদের এখানের পূজোটা কবে হবে?’
ওই তো দু’সপ্তাহ আগের এক সানডে শিডিউলড হয়ে গেছে। ওসব মিটিয়েই টিকিট করেছি। চিন্তা নেই।
লিসা বলল, ‘বাপি, এবার কিন্তু আমি কোনও গ্রামে যাবো। সেই বুঝে তুমি শিডিউল ফিক্স ক’রো।‘
তোর মামার বাড়ীই তো গ্রামে! অরিত্র এই কথা বললেই অবন্তিকা রি-অ্যাক্ট করে। অরিত্র উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ীর ছেলে, অবন্তিকার বাড়ী বর্ধমানে। অবন্তিকা কিছুতেই নিজেকে গ্রামের মেয়ে মানতে রাজী নয়। সে বলল, বর্ধমান, কতদিনের শহর জানো? সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে এটা যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু ছিল। আর তোমার কলকাতা?
লিসা বলল, তোমরা এই নিয়ে শুরু হয়ে গেলে? তেমন নয় বাপি, আমি আক্ষরিক অর্থে এমন গ্রামে যেতে চাই যেখানে এখনও ইলেকট্রিক আসেনি। হ্যারিকেনের আলোয় যেখানে সন্ধ্যেবেলা কাটে!
তেমন গ্রাম ভুলে যা সোনাই। এখন সারা বাংলায় তেমন গ্রাম নেই বলেই মনে হয়!
তুমি তোমার বন্ধু-বান্ধবদের ফোন করে দেখো না!
আচ্ছা।
লিসা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাম, আমি একটু বেরোচ্ছি।‘
এখন কোথায় চললি?
লিসা হাসলে, বললো ‘দেখা যাক’।
আধ ঘন্টা ড্রাইভ করে লিসা এসে পৌঁছেলো একটা বেশ ক্যাসলের মতো বাড়ীর সামনে। বাড়ীটা দীপাঞ্জন পাল এর। বয়স পঞ্চাশের আশাপাশে। বাড়ীর সামনে দুটো লতানো গাছকে এমন খেলিয়ে উপরে তুলেছেন ভদ্রলোক, মনে হয় যেন অরণ্যের মধ্যে লুকানো এক প্রাসাদ। বাড়ীর সামনে ঝোপের মতো কয়েকটা গাছ, কতগুলো গুঁড়ি আর সিমেন্ট দিয়ে বানানো ভাস্কর্য। ভদ্রলোকের নিজের বানানো সব। কেমিষ্ট্রির অধ্যাপনা করতে এদেশে এসেছিলেন। কিন্তু এখন পাশাপাশি তাঁর আঁকা এবং স্থাপত্য এই মুলুকে বেশ নাম করেছে। লিসাকে দেখে খুব খুশী হয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ এত খুশী খুশী’?
মন ভালো আছে পল!
কেন হে?
ইণ্ডিয়া যাবো! জানেন, এবার আমরা ইণ্ডিয়ার একটা ভিলেজে যাবো মনস্থ করেছি।
হঠাৎ?
লিসা মোবাইল থেকে সেইভ করা পোষ্টটা বের করে দেখালো। পল ছবিটা কেমন?
ছবি হিসাবে এখনকার অ্যাসপেক্টে তেমন কিছু নয় লিসা। এগুলো সিম্পল পোট্রেট, ন্যাচারাল ভিউজ, এর এখন প্রসপেক্ট নেই!
প্রসপেক্টের কথা হচ্ছে না। আপনি এমন ছবি এঁকেছেন কখনও?
না লিসা! ইনফ্যাক্ট এগুলো বাচ্চাদের জন্য একটা ফ্যান্টাসী। ছবির সমঝদাররা না তো একে জাতে তুলবে, না তো দাম দেবে!
আপনি কি ছবি সবসময় বাজারদরের অ্যাসপেক্টে বিচার করেন পল?
দীপাঞ্জন একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘নট অলওয়েজ’!
আপনি আমার জন্য এই ছবিটা এঁকে দিতে পারবেন? এরকম একটা পন্ড ফুল অফ লোটাস্, আ লিট্ল্ গার্ল ইন সারি…
তোমার জন্য আমি সব করতে পারি লিসা। কিন্তু একটা কথা, আমি জানি না ছবিটা তোমার ভালো লাগবে কিনা। বিকজ আই হ্যাভ নো সাচ ফ্যান্টাসী ইন মি জাস্ট নাউ! যেটা হৃদয় থেকে অনুভব না করি, সেটা আঁকতে গেলে কপি করাই হবে লিসা।
এটা যদি খুব সিম্পল একটা ছবি হয়, আঁকতে পারবেন না কেন?
অনেক সময় সিম্পল জিনিসটাই বড্ড কঠিন হয়ে যায় লিসা। দ্যাখো সঙ্গের যে কবিতাটা ওটা অত্যন্ত সাদা-মাটা একটা ছড়া। ‘পদ্ম দীঘির কালো জলে হরেক রকম ফুল/ হাঁটুর নীচে দুলছে খুকুর গোছা ভরা চুল’। কিন্তু আজকের কোনও প্রতিষ্ঠিত কবিকে দাও, এমনটা কেউ লিখতে পারবে না। এমনটা নয় যে তাদের এবিলিটি নেই; কিন্তু সহজ জিনিসকে সহজ করে বলতে পারাটা সহজ কথা নয়। এখন চিন্তাভাবনাটাই বড় জটিল হয়ে গেছে লিসা! সব থেকে বড় কথা পাঠকেরা, - পুরোনো কবিদের লেখা এই ছড়া পড়বে, আজকের কেউ লিখলে হেসে উড়িয়ে দেবে।
আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন পল। যদি ছবি দেখে আমার আজকের মতো ফিলিংস হয়, তবে পূজোর আগে আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ!
কী সারপ্রাইজ!
বলে দিলে আর সারপ্রাইজ কী?
আমার মনোস্কামনা পূরণ করবে বুঝি!
দেখা যাবে! হাসলো লিসা। দীপাঞ্জন বললো, ‘তাস তো তোমার হাতেই রইল লিসা। তুমি তো বলতেই পারো, তোমার পছন্দ হয়নি।‘
আপনি কি আমাকে চেনেন না পল? আমি এই ব্যাপারে অত্যন্ত অনেষ্ট। আপনি ভাবছেন কেন? আপনি রঙের জগতের এতবড় জায়েন্ট, আপনি নিশ্চই পারবেন।
সে হয়তো পারবো। কিন্তু লিসা, তুমি হঠাৎ এই ছবিটা নিয়ে পড়লে কেন?
সে বলতে পারবো না পল। ছবিটা দেখে আমার ভেতরটা যেন কেমন করছে! আমি জায়গাটা মনে মনে দেখতে পাচ্ছি।
তুমি নিজেই আঁকছো না কেন লিসা? তুমি তো এখন অনেকখানি আঁকতে শিখেছ। সঙ্গে ভালোবাসা আছে যখন, আঁকাটা দাঁড়িয়ে যাবে।
না পল। আমি যে স্বপ্নকে অনুভব করতে চাই, তাকে অধিকার করতে চাই না। আমি নিজে যদি আঁকার চেষ্টা করি, ওই কল্পনাটা আমার অধিকারের আওতায় আসবে। আমি ওটা চাইনা পল। দীপাঞ্জন লিসার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি, তুমি একদিন বড় হবে লিসা। কিন্তু আমি তোমার জন্য উপযুক্ত ট্রেনার নই। আমি হয়তো তোমাকে রঙ-তুলি, ছেনি হাতুড়ির ব্যবহার শেখাতে পারবো; কিন্তু তোমার কল্পনাকে বুনে দেওয়ার বাঁধুনিটা আমার জানা নেই।
আপনি কিভাবে শিখছেন পল?
আমি তেমন গুরু পেয়েছিলাম লিসা। আমি আসলে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র। তুমি জানো এর নাম?
সেটা কোথায়?
ওয়েষ্ট বেঙ্গল এ। তোমার বাড়ীর কাছে পিঠে। বাবাকে বলো এবার ঘুরিয়ে আনবে। বিরাট মিশনারী স্কুল। রেসিডেন্সিয়াল। ওখানে ছেলেদের পড়াশুনোর পাশাপাশি ওদের হবি’জগুলো নারচার করা হত। ওখানে পল্লব মহারাজ আমাকে রঙের সাম্রাজ্য শিখিয়েছিলেন।
এখন উনি বেঁচে আছেন? আমি গেলে ওঁকে দেখতে পাবো?
না বোধহয়। জানো তো, উনি ফিজিক্সে এম.এস.সি., এম.টেক.!
মাই গড! ফিজিক্সের লোক এতখানি আর্ট এর সমঝদার?
উনি অনেক কিছুই ভালো পারতেন লিসা! উনি ভালো গানও জানতেন! এইসব গন্ধর্ববিদ্যাগুলো আমদের ব্রেনের মধ্যে খুব কাছাকাছি থাকে, জানো তো!
গন্ধর্ববিদ্যা কী জিনিস?
দ্যা সাবজেক্ট ডিলিং উইথ অ্যাবষ্ট্রাক্টস্ লাইক পেইন্টিং, লিটারেচার, ড্যান্সিং, সিঙ্গিং, রিসাইটেশন এটসেটরা।
হোয়াই নট ফিলোজফি? ইট অলসো ডিলস উইদ অ্যাবষ্ট্রাক্ট থটস্।
ইউ আর রাইট, বাট আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট পারফর্মিং আটস্!
ওক্কে! আপনার লাস্ট পেইন্টিংটা কই? অকসানে দিয়ে দিলেন নাকি?
না না তুমি দেখে সার্টিফাই কর, তবে না অকসানে যাবে!
আমাকে এতখানি কেন অনার দেন পল? আমি কি সত্যি সত্যি এতখানি সম্মানের যোগ্য?
সম্মান কাউকে এমনি এমনি দেওয়া যায় না লিসা, যদি না সে সেটা ক্যারি করে! আই বিলিভ, ইউ হ্যাভ দ্যাট সেন্স!
থ্যাঙ্ক য়্যু পল!
তোমাকে যে কাজটা করতে বলেছিলাম করেছ?
হয়েছে। কালারটা নিয়ে একটু ডাইলেমায় আছি। মনের মধ্যে ব্যাপারটা ফিল করছি, কিন্তু প্রাকটিক্যালি ব্লেন্ডিং করতে পারছি না।
বেশ তো। আবিষ্কার করো। ততক্ষণ আমরা বরং বিভিন্ন বিখ্যাত আর্টিষ্টদের কালার কালচার নিয়ে কথা বলি?
(২)
ফ্লাইটের উইনডো দিয়ে মেঘের ঘরবাড়ী দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে গেল লিসার। গত পরশু থেকেই মনটা একটু বিগড়ে রয়েছে তার। পরশু সারাটা দিনই ষ্টুয়ার্টের সাথে ডেটে গিয়েছিল সে। বাইশ তেইশ বছরের ছেলে, ও চলে আসবে বলে ওর দুহাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খেতে খেতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলবে, ভাবতেও পারেনি লিসা। এদেশের ছেলেরা এত সফট মাইন্ডের হয় না জেনারেলি। লিসা নিজেও ঠিক ছেলেদের এত ছোটখাটো ব্যাপারে চোখের জল ফেলাটাকে মেনে নিতে পারেনা। ছেলেটা বছর তিনেক ওর পেছনে পড়ে আছে, ওকে আকৃষ্ট করার কতরকম চেষ্টা করেছে, তবু লিসার মন পায় নি। আসলে লিসা বোধহয় নিজেও ঠিকমতো জানে না সে ঠিক কী চায়? কাকে চায়? জীবনের প্রয়োজনে যদি কখনো বিয়ে করতে হয় - এরকম কেউ যদি তার জীবনে জোটে যার গভীরতা নেই, যার নিজের মধ্যে গোটা একটা পৃথিবী নেই, তবে বোধহয় তার নিজের দম বন্ধ হয়ে যাবে। সে চায় এমন কাউকে যার পায়ের তলায় বসে নিজেকে চেনা যাবে, যার হাত মাথায় থাকলে মনে হবে বনস্পতির ছায়া, তেমন লোকের কাছেই তো সে মরতে চায়! ষ্টুয়ার্টকে একদিন লিসা বলেছিল, ‘তুমি যে ঝ্যাং ঝ্যাং করে গীটার বাজাও, সুরকে দেখতে পাও?’ ষ্টুয়ার্ট এমন অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল - যেন এমন আশ্চর্য কথা সে জীবনে শোনেনি। খুব সিরিয়াস গলায় সে জিজ্ঞাসা করেছিল - এমনটা কি সত্যিই সম্ভব? লিসা চুপ করে ছিল সেদিন। ও নিজেও জানেনা - সত্যি এমনটা সম্ভব কিনা! ওর জীবনে অদ্ভূত একটা অনুভূতি হল কিছুদিন আগে। পূজো উপলক্ষ্যে বাপিদের ক্লাবে তিন রাত বিরাট সঙ্গীতানুষ্ঠানের অয়োজন করা হয়েছিল। বেঙ্গল এবং সাউথ ইণ্ডিয়া থেকে অনেক শিল্পী এসেছিলেন। সাউথ থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন বি. কুমার নামে। ভায়োলিন বাজিয়েছিলেন ভদ্রলোক। ও ক্লাসিক্যাল কিছুই বোঝেনা, কিন্তু ওই সুরের মূর্চ্ছনা ওকে এমন বিহ্বল করে দিয়েছিল দু-তিনদিন, ও কোনও কিছু বোঝার স্তরে ছিলনা। ভদ্রলোক ওদের বাড়ীতে একদিন ছিলেন। ওকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিছু পিছু ঘুরতে দেখে উনি বলেছিলেন, কী গো বেহালা বাজানো শিখবে?
ইচ্ছে তো হয়! কিন্তু পারবো কি?
না পারার কী আছে লিসা? পৃথিবীতে অসম্ভব কিছু নেই।
কী ভাবে শিখবো? আপনি তো ইণ্ডিয়া ফিরে যাবেন!
আমার ক্যালিফোর্নিয়াতে ইনস্টিটিউট আছে। এখানকার চার্জে আছে আমারই এক ছাত্র ম্যাক। তুমি ওখানে গিয়ে শিখতে পারো।
শিখলে আপনার কাছেই শিখবো। সেটা তো সম্ভব নয়!
আজকাল পৃথিবীতে অসম্ভব কিছু নয় লিসা। তুমি বেসিক ব্যাপারগুলো ম্যাকের কাছে শেখো; আমি মাঝে মাঝে দেখে নেবো।
আচ্ছা পণ্ডিতজী, আপনি যেসব পিস বাজান, ওদের দেখতে পান? আই মিন ক্যান ইউ সি দেম?
দিস আর অ্যাবস্ট্রাক্টস্, লিসা! ইউ ওনলি ক্যান ফিল দেম। দোজ্ আর বিওন্ড ইয়োর ফাইভ সেন্স অরগ্যান্স্; ওনলি ফেল্ট বাই ইয়োর ইনার সেন্স, দ্যাট ইজ মাইণ্ড! ট্রাই টু মেডিটেট ডেইলি সো দ্যাট ইউ ক্যান ফিল ইয়োর মাইণ্ড! কোথাও যেন ধাক্কা খেল লিসা। ওর ভেতরে এই উত্তরটা প্রত্যাশিত ছিল না। সে মনে করে, যে কোনও জিনিষ তখনই সম্পূর্ণ অধিগত হয় - যাকে দেখা যায় ভেতরের চোখ দিয়ে। বাপি অবশ্য শুনে বললো, ভদ্রলোক তো ঠিকই বলেছেন সোনাই! ভারতীয় দর্শন তো নিরাকার বিশ্বাস করে। যার আকার নেই তুমি তাকে দেখবে কী করে?
কল্পনার চোখ দিয়ে দেখবো!
বেশ। চেষ্টা করে দেখো তো বায়ুকে দেখতে পাও কিনা! বায়ুর অস্তিত্ব আছে ঠিক কথা, কিন্তু তাকে স্পর্শ ছাড়া কোনওভাবে তুমি ফিল করতে পারবে কি? কোনও কল্পনার চোখ কি তোমাকে সেটা দেখতে সাহায্য করবে?
লিসার কথাটা বাস্তবোচিত মনে হল বটে, কিন্তু সে কুমার সাহেবের কাছে শেখার ব্যাপারে আর উৎসাহ দেখালো না। ওর ওটাই দোষ! মনে কারোও প্রতি যদি বিন্দুমাত্র কোনও নেগেটিভ সিগনাল আসে, সে সেই সম্পর্কে টিকতে পারে না। ষ্টুয়ার্ট শুধু অধ্যবসায়ের গুণে এতদিন টিকে আছে। যদিও একতরফা, তবু লিসার থেকে সামান্য প্রশ্রয় না পেলে কি এতদিন এত মুগ্ধতা দেখাতে পারতো! ষ্টুয়ার্টের কথা মনে পড়ায় হালকা হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটের কোণে। লিসা আবার মেঘেদের ঘরবাড়ী দেখায় মন দিল।
(৩)
বাপি কথা রেখেছে। লিসার মামাদের শ্বশুরবাড়ীর সূত্রে একটা গ্রাম পাওয়া গেছে যেখানে এগারো বারো বছর আগেও কারেন্ট ছিল না, ইদানীং এসেছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে ট্রান্সফর্মার বার্স্ট করার জন্য দিন পনেরো হল ওখানে কারেন্ট নেই। আর থাকলেই বা কী! গ্রামে তো আর শহরের মতো পথে ঘাটে স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো থাকে না। রাস্তায় বেরিয়ে গেলে দিব্যি প্রকৃতির শোভা উপভোগ করা যাবে। গ্রামটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দৌলতপুর গ্রাম। কাঁথি শহরে নেমে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দক্ষিণে যেতে হয়। অবন্তিকা এই অন্ধকারে আসতে রাজী হয়নি। ফ্যান লাইট ছাড়া চারদিন কাটানো তার পক্ষে সিম্পলি অসম্ভব। অরিত্র লিসাকে শুধু পৌঁছে দিতে এসেছে। বিকেলে ফিরে যাবে। অবশ্য ফেরার দিন নিতে আসবে আবার। শহর থেকে একটু বেরিয়ে যেতেই চোখটা জুড়িয়ে গেল লিসার। চারপাশে শুধু বাদাম গাছের সারি। গাছগুলোর মাঝে মাঝে কী সুন্দর খোপ খোপ মত জায়গা, লিসার ইচ্ছে করছে নেমে নেমে ওদের ভেতর লুকোচুরি খেলে। মাঝে মাঝে মস্ত বড় বড় নিমগাছ, অশ্বত্থ গাছ। আশেপাশে অসংখ্য পুকুর- তাতে কত লোক নেমে স্নান করছে। এমন দৃশ্য সে আগে কখনও দেখেনি। এর আগেও সে ইণ্ডিয়া কয়েকবার এসেছে, কিন্তু সবসময় শহরকেন্দ্রিক ঘোরাফেরা ছিল তাদের। পুরুষরা বেশীর ভাগই লুঙ্গি না হলে বারমুডা পরা। যে সব মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করছে, তাদের অধিকাংশই প্যান্টশার্ট। ক্কচিৎ কখনও ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বয়স্ক মানুষ। মহিলাদের মধ্যে শাড়ী এবং চুড়িদার প্রায় সমান সমান। যারা বিবাহিত তারাই শাড়ী পরে, তবে তাদের পরার ধরনটা অদ্ভুত। আটপৌরে টাইপের, কিন্তু ছবির মেয়েটির মতো নয়।
যে বাড়ীতে ওরা এল, সেটি দোতলা মাটির বাড়ী। উপরে খড়ের চালা। বাড়ীর সামনে অসংখ্য গাছপালা। সব কটা গাছ লিসা চেনে না। পরে জানলো, ওদের মধ্যে প্রধান হল শিউলি - এই সময়টা প্রচুর ফুল ফোটে, চাঁপা গাছ, গামার গাছ আর সেগুন গাছ। সেগুন গাছের মস্ত বড় পাতা দেখে অবাক হয়ে গেল সে। মানুষের মতো গাছেদেরও কত বৈচিত্র্য, কত ধরনের রকম ফের। ওদের শিকাগোর বাড়ীর সামনেটায়ও অনেক গাছ আছে - তবে ওরা যেন বড় নির্জন, বড় বেশী ফাঁকা ফাঁকা। আর এখানকার গাছগুলো যেন পরস্পরের সাথে পরিবার তৈরী করে আছে - ঘন ঘন, জোটবদ্ধ। দুপুরে খাবার খেতে গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হল। বাড়ীর কর্তা প্রবীরবাবু একটা হাইস্কুলে জিওগ্রাফি পড়ান। ওনার স্ত্রী মল্লিকাও এম.এ. পাশ- বেঙ্গলি সাবজেক্টে; তবে চাকরীটাকরী করেন না। ওনাদের একছেলে একমেয়ে। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে আই.টি. সেক্টরে চাকরী করে, মেয়ে লণ্ডনে থাকে। লিসার এখানে আসার কারণ শুনে প্রবীরবাবু একটু রসিকতা করলেন; মল্লিকা বললেন, ‘ভালোই করেছ মা। গ্রাম বাংলাকে না চিনলে নিজেকে চিনবে কী করে?’
অরিত্র দুপুর দুপুরই ফিরে গেল কলকাতা। মল্লিকা বললেন, ‘চলো, গ্রামটা দেখিয়ে আনি, এই গ্রামটি ভারী সুন্দর’।
কী কী দেখার মতো জিনিস আছে এখানে মাসিমা?
গ্রামে কী আর তোমাদের শহরের মতো বিশেষ দ্রষ্টব্য থাকে? এখানে সব কিছুই খুব সাধারণ। যদি অনুভব করতে পারো, তবে সবই তোমার অসাধারণ মনে হবে!
আমার তো একটা ঘাস বা ফড়িং দেখেও ভালো লাগে মাসিমা। মনে হচ্ছে এমনটা আগে কখনও দেখিনি।
মল্লিকা হাসলেন। বললেন, চলো আজ তোমাকে গ্রামের মধ্যে একটা লাইট হাউস আছে দেখিয়ে আনি। তুমি আগে কখনও লাইট হাউস দেখেছ?
দেখেছি। নর্থ ক্যারোলিনায় বোডি আইল্যাণ্ডটা বেশ সুন্দর।
চলো, আমার বিশ্বাস আমাদের এই লাইট হাউসটা তোমার জীবনের এক অসাধারণ অনুভূতি হয়ে থাকবে।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই লাইট হাউসে পৌঁছে যাওয়া গেল। ব্রিটিশ আমলে তৈরী এই লাইট হাউস। দীর্ঘ কাল ধরে সমুদ্রের মধ্যে পথ খোঁজা নাবিককে তীরের সন্ধান জানিয়ে আসছে এই বাতিস্তম্ভটি। মল্লিকা বললেন, লিসা জানো কি, লাইট হাউসের বাংলা মানে?
না।
এর অর্থ হল ‘বাতিঘর’। কী সুন্দর না শব্দটা?
লিসা চোখ বন্ধ করে যেন শব্দটা অনুভব করল মনে মনে। বলল, ‘সত্যি চমৎকার! মনের মধ্যে একটা দৃশ্যকল্প তৈরী করে শব্দটা!’
আমার ধারণা তুমি আমাদের এই লাইট হাউসটা দেখে গেলে, পৃথিবীর যে কোনও লাইট হাউস দেখে তোমার মনে এই ‘বাতিঘরের’ প্রতি তুলনা আসবে।
আপনি কি অন্য কোনও লাইট হাউস দেখেছেন মাসিমা!
না। তবে তোমার কথার স্পিরিটটা বুঝতে পারছি। আমি অন্য কিছু না দেখে এটাকে এতখানি ভালোত্বের তকমা কেন দিচ্ছি – তাই বলতে চাইছো কি?
লিসা একটু লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।
মল্লিকা বললেন, পৃথিবীর প্রতিটা ভালো জিনিসই তার মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। অন্য লাইট হাউসও হয়তো তার স্থান পাত্র বুঝে ভালো। কিন্তু এই স্তম্ভটিও এতখানি তোমার মনকে ছেয়ে থাকবে যে, তুমি একেও কোনওদিন ভুলতে পারবে না।
লাইট হাউসের উপরে ওঠা যায়। ছোট ছোট ঘোরানো সিঁড়ি। মল্লিকা হাঁটুর ব্যথার কারণে উপরে ওঠার সাহস করলেন না। লিসা একাই উপরে উঠলো। ছোট একটা মেশিন ঘর, ওর লাগোয়া বারান্দাটুকুতে দাঁড়িয়ে পাশাপাশি গ্রামগুলোর ছবি দেখা যায়। চারপাশে শুধু সবুজ গাছ। দূরে সমুদ্রের মোহানা। মাঝে মাঝে রাস্তা এবং পুকুরগুলোর রেখা দেখে মনে হচ্ছে – তারা যেন এত সবুজের মধ্যে পথ চিরে বেরোবার জন্য আকুলি বিকুলি করছে। পুরো দৃশ্যটাকে কেমন যেন চিত্রকল্প মনে হল তার। যে নৈর্ব্যক্তিক গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাতিঘরটি, যে অনুদ্বিগ্ন প্রজ্ঞা নিয়ে সে দেখে যাচ্ছে কালের অনুবর্ত্তন – তার স্থৈর্যকে শুধু মনে মনে অনুভব করতে হয়।
মল্লিকা বললেন, ‘তুমি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর নাম শুনেছ মা?
শুনেছি।
ওঁর লেখা কপালকুণ্ডলা পড়েছ?
না মাসিমা। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা একবার পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু এত কঠিন বাংলা – আমি ধৈর্য রাখতে পারিনি।
বেশ তো, এবার গিয়ে পড়ো। এবার পড়তে তুমি বাড়তি উৎসাহ পাবে এই কারণে যে উপন্যাসটা এই জায়গায় বসে লেখা হয়েছিল। তোমাকে আজকে দেখাবো কোন ঘরটায় বসে বঙ্কিমচন্দ্র লিখতেন।
ওনার বাড়ি কি এখানে ছিল না কি?
না, না। ওনার বাড়ি হল কলকাতার নৈহাটীর কাঁঠালপাড়া গ্রামে। উনি ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকরী করতেন তো। ঘুরে ঘুরে চাকরি করতে হত।
গল্পের প্লটটাও কি এই জায়গাকে কেন্দ্র করে?
কিছুটা। এই অঞ্চলটা তখন জঙ্গল ছিল। গল্পের নায়ক নবকুমার যেখান থেকে সাগরসঙ্গমে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা আমি কালকে দেখাবো।
সাগরসঙ্গম মানে?
মোহনা। এখানে রসুলপুর নদী এসে বে অফ বেঙ্গল মানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আগে লোকে সাগর মেলায় যেত এই রুট ধরে। সাগর মেলার নাম শুনেছে?
হ্যাঁ। গতবার এসে একদিনের জন্য আমরা গঙ্গাসাগর গিয়েছিলাম।
ওই গল্পে এক কালিঠাকুরের বর্ণনা আছে – যার নাম কপালকুণ্ডলা - সেই ঠাকুরের মন্দির অবশ্য এখানে নেই। তোমরা আসার সময় কাঁথি হয়েই তো এসেছ! কাঁথিতে ওই মন্দির আছে। হয়তো তখন এইদিকটায় রাস্তাঘাট ছিল না। ওই মন্দির হয়েই হয়তো জঙ্গলের রাস্তা ধরে এদিকে আসতে হতো। তুমি এবার আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটা পড়ো। বাড়তি মজা পাবে।
চেষ্টা করবো মাসিমা।
রাতে শোওয়ার ব্যবস্থা হল মাসিমার সাথে এক খাটে।
লিসা বলল, ‘ওমা মেসোমশাই কোথায় শোবেন?’
উনি তাঁর ঘরে শোবেন! মল্লিকা উত্তর দিলেন।
ওমা, না, না, ছিঃ ছিঃ। উনি আলাদা কেন শোবেন?
উনি তো আলাদাই শোন ওঁর ঘরে। তোমার যদি আমার সঙ্গে শুতে আপত্তি থাকে তবে অবশ্য আলাদা কথা!
লিসা ছোটবেলা থেকে একা শুতে অভ্যস্ত। একটা অস্বস্তি তার হচ্ছিলই, তবু ভদ্রতার খাতিরে মুখ ফুটে কিছু বললো না সে। বরং অবাক হল, এই দেশে স্বামী-স্ত্রী আলাদা খাটে শোয় দেখে। ও দেশে আলাদা বিছানা মানে বুঝে নিতে হবে – সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে, ডিভোর্স অবশ্যম্ভাবী। মাথার কাছে টর্চ নিয়ে শোওয়া, যদি রাতে বাথরুমে উঠতে হয়। একটা হ্যারিকেন মৃদু করে ঘরের এককোণে জ্বালিইয়ে রাখা। লিসা আগে কোনওদিন এত অন্ধকার দেখে নি। হ্যারিকেনও না। ওর মনে হল হ্যারিকেনের ওইটুকু ছোট আলোর বৃত্তে যেন সারা ঘরের চাপচাপ অন্ধকার জমাট বেঁধে রইল। বাইরে কত কিছুর ডাক যে আবহ সঙ্গীতের মতো বেজে চলল সারারাত, তার ইয়ত্তা নেই। এমন পরিবেশে লিসার ঘুম এল না অনেকক্ষণ। কিছুটা সারাদিনের ধকলের জন্য, কিছুটা উত্তেজনায়! বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখার পর লিসা ধীরে ধীরে চোখ খুলে রাখল। ক্রমশ অন্ধকারও যেন ধরা দিতে লাগলো ওর চোখে। রড কোষ, কোন কোষের কথা তার পড়া ছিল বটে, তবে অন্ধকারকেও যে এভাবে অনুভব করা যায়, সে ধারণা তার ছিল না। মল্লিকা বললেন, ‘কী মা ঘুম আসছে না?’
না।
আসলে নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ তো! তুমি তো আগে কখনও এমন জায়গায় রাত কাটাওনি! তবে ভয় পেয়ো না। আমি তোমার পাশেই আছি। ভদ্রমহিলা ওর মাথায় হাত রাখলেন। লিসার মনে হল আস্ত একটা আশ্বাস যেন ওর মাথা স্পর্শ করল। মল্লিকা মৃদুভাবে ওর চুলে হাত বুলিতে দিতে লাগলেন। লিসা বলল, মাসিমা আপনার মেয়ে জামাই কবে আসবে?
ওরা তো বেশী আসে না। ছোট বাচ্চা তো! এখানে এই অন্ধকার আর মশায় ওদের ভারী কষ্ট হয়!
ওঃ স্যরি!
না, না, স্যরি বলার কিছু নেই। ওদের প্রব্লেমটা জেনুইন! আমি বুঝি!
আপনি লণ্ডনে গেছেন?
না। মেয়ে বলেছিল অবশ্য যেতে। যাওয়া হয় নি।
মাসিমা, আপনার এই গ্রাম্য জীবন ভালো লাগে?
জানো তো মা, মানুষের এইসব মানসিক আবেগগুলো অনেকটাই প্রাপ্তব্য বিষয়গুলোর সম্ভাব্যতার উপর নির্ভর করে।
এত কঠিন বাংলা আমি ঠিক বুঝতে পারি না মাসিমা।
মানে হল অ্যাভেলেবিলিটি। ধরো তুমি একটা বাস বা ট্রেনে উঠেছ। যদি ওই রুটটায় বাসে-ট্রেনে ভিড় হয়, তবে তুমি কোনও একটা বসার জায়গা – তা যত খারাপই হোক না কেন, পেলেই খুশী! কিন্তু টার্মিনাসে যদি তুমি বাসে উঠে দেখ সব জায়গাগুলোই খালি – তুমি দেখবে পাজ্ল্ড হয়ে যাবে কোন জায়গায় বসবে এই ভেবে। আমাদের সুখের চাহিদাটা এরকমই।
কথাটা আপনি ভালোই বললেন মাসিমা। পুরোটা যে ভালো বুঝলাম তা নয়, তবে কতকটা আন্দাজ করলাম। আপনার জীবনে শহুরে জীবনের কি কোনও সম্ভাবনা ছিল না?
মল্লিকা হাসলেন। বললেন ‘শহুরে জীবন যে দেখিনি তা তো নয় মা! কলকাতা শহরে এম.এ. করেছি। দু-বছর পাক্কা ছিলাম ওখানে।‘
ওই দিকেই বিয়ে-থা করে সেটলড হতে পারতেন! গ্রামে বিয়ে করলেন কেন? মেসোমশাইয়ের সাথে কি আপনার লাভ ম্যারেজ?
অন্ধকারে লিসা বেশ বুঝতে পারলো ভদ্রমহিলা মনে মনে হাসছেন। একটুক্ষণ চুপ করে লিসা বলল, হাসছেন কেন?
মল্লিকা লিসার গালটায় টোকা দিয়ে বললেন, ‘যার সাথে লাভ ছিল, সে এখন তোমাদের আমেরিকায়!
কী করেন ভদ্রলোক?
পড়ায় ওখানে কোনও কলেজে!
যোগাযোগ আছে?
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস যেন পড়ল, মনে হল লিসার।
মল্লিকা বললেন, ‘না’।
কেন? ঝগড়া?
না, না। আমাদের সম্পর্ক সব ঝগড়া মালিন্যের উর্দ্ধে।
মানে?
তোমরা আজকালকার মেয়েরা ওসব বুঝবে না লিসা।
তবে বিয়ে করলেন না কেন?
কাষ্ট-এর সমস্যা ছিল। কারও বাড়িতে মানতো না।
কাষ্ট মানে?
জাতি। যেমন তোমরা ব্রাহ্মণ, আমরা কায়স্থ।
ইন্টার কাস্ট বিয়ে হয় না বুঝি?
আজকাল হয়; আগে হত না!
মেসোমশাই জানেন?
না। আমার যে লুকোবার মতো কিছু ছিল, তা কিন্তু নয় লিসা। কিন্তু আমি ওনাকে যতটুকু চিনি, ওনার এই কথা হজম করার মতো দৃঢ়তা ছিল না। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি লিসা - মেয়েদের হৃদয়ের সমুদ্রে অনেক ঢেউ! এক ঢেউ এর খবর দিয়ে আরেক ঢেউকে ছোঁয়ার চেষ্টা তুমি কখনও করো না জীবনে!
আপনি তো টাইটানিক ফিল্মের রোজ এর মতো কথা বললেন!
আমি তো ফিল্মটা দেখিনি লিসা! আমার অনুভবটাই বললাম শুধু!
লিসা হঠাৎ পাশে ফিরে জড়িয়ে ধরল মল্লিকাকে। মল্লিকা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম যত্নে। দুই ভিন্ন বয়সী নারীর মধ্যে হৃদয়ের তরঙ্গ আনাগোনা হতে লাগল নিঃশব্দে, নিভৃত গোপনে।
(৪)
হাঁটতে হাঁটতে একাই রসুলপুর নদীর মোহনায় চলে এসেছে লিসা। মল্লিকার আজ হাঁটুর ব্যথাটা খুব বেড়েছে। ওঁর বাড়ী থেকে প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার হাঁটা পথ। লিসা অভয় দিয়ে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না মাসিমা, রাস্তাটা তো চিনে নিয়েছি; কোনও অসুবিধা হবে না।
আসলে মোবাইলগুলোয় চার্জ নেই। তোমার মেসোমশাই পরশু শহর থেকে চার্জ করিয়ে এনেছিলেন, ফুরিয়ে গেছে। তুমি চাইলেও তো যোগাযোগ করতে পারবে না মা!
ভাবছেন না কেন মাসিমা, যখন এসব ছিলনা তখন মানুষ কী করত! আমি তো সেই ফিলিংসটা পাবো বলেই এখানে এসেছি!
মোহনার কাছটা বড় চমৎকার। নদীর ক্লান্ত শান্ত তরঙ্গদের কাছে সমুদ্রের রুদ্ররূপের নতজানু হওয়াটাও অনুভব করার মতো ঘটনা। লিসা একমনে সেই দৃশ্য দেখছিল। সূর্য আস্তে আস্তে দিগন্তে ঢলে পড়ার প্রস্ততি নিতে শুরু করে দিয়েছে বহুক্ষণ। নদীর ওপারে হিজলি। পারাপারের জন্য একটাই নৌকো। অনেক লোক এপারে দাঁড়িয়ে আছে। নৌকোটা সবে তীরে এসে লেগেছে। নদীর ওপারে কয়েকটা গরু এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে ওদের মালিক কে জানে! মল্লিকা বলছিলেন ওপারে নাকি একটা জাগ্রত পীরের মাজার আছে। তবে ওপারে যেতে হলে সকাল সকাল বেরোতে হত। দেখা যাক কাল একবার চেষ্টা করে। পরশু সকালেই অরিত্র এসে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে লিসাকে। হঠাৎ শুনতে পেল একটা সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে নদীর দিকে চেয়ে একমনে গান গেয়ে চলেছে - “নয়ন তোমায় পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে”। লিসা জানে এটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। কিন্তু গানটি যে এত সুন্দর করে কেটে কেটে গাওয়া যায়, তেমন ধারনা ছিল না তার। গানের প্রতিটি শব্দ, অক্ষর যেন পাগলের মতো ধেয়ে আসছে তার মর্মে, তার সমস্ত অস্তিত্বকে ছিন্ন করে দিয়ে যেন পৌঁছে যাচ্ছে ভেতরের কোনও অজানা জায়গায়। লিসা সেই জায়গাটাকে চিনতে পারছে না, কিন্তু কথাগুলোকে স্পষ্ট চলে যেতে দেখছে। ও আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালো ছেলেটির সামনে, ছেলেটি ওকে দেখতে পাচ্ছে না, চোখ বুজে গান করছে। পাজামা পাঞ্জাবী পরা, মুখে একমুখ দাঁড়ি গোঁফ। খানিকক্ষণ পরে চোখ খুলে লিসাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘আমাকে কিছু বলবেন?’
হ্যাঁ।
বলুন না।
আপনার গানটা শুনছিলাম। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আপনি আমাকে গানটা শিখিয়ে দেবেন?
আপনি কে? এ অঞ্চলে তো আপনাকে দেখিনি কোনদিন! বেড়াতে এসেছেন বুঝি?
আমার নাম লিসা। আমি প্রবীরবাবুদের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
তাঁদের আমি চিনি। আপনি ওদের আত্মীয় বুঝি?
না, না। পরিচয়ের সূত্র ধরে আসা। আসলে আমি ইলেক্ট্রিক নেই এমন একটা গ্রাম দেখবার আব্দার করেছিলাম বাপির কাছে। সেইজন্যই এখানে আসা।
আপনি বুঝি এদেশের মেয়ে নন?
আমি শিকাগোয় থাকি।
ওঃ। বাংলা তো ভালোই জানেন দেখছি।
মোটামুটি। বাড়িতে মা-বাপি আমার বাংলা শেখার জন্য অনেক যত্ন করেছে। আপনি আমাকে গানটা শেখাবেন?
আগে আপনি বসুন। লিসা বসতে, ছেলেটি বলল, ‘গান তো আমি নিজে শিখিনি কখনও। কিভাবে শেখাতে হয় জানি না।
আপনি গান শেখেন নি?
না।
না শিখে কী করে এত ভালো গান করলেন?
ভালোমন্দ তো জানি না! গানটা যেমন করে অনুভব করেছি, তেমনি করে প্রকাশ করেছি মাত্র! আপনিও ভালো করে গানটা পড়ুন, বুঝুন, আপনিও গাইতে পারবেন!
আমিও এভাবে গাইতে পারবো? অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল লিসা।
নিশ্চই পারবেন। আপনার গানটা ভালো লাগার কারণ এই যে, আপনি আমার মতো করেই গানটা অনুভব করেছেন। গলায় যদি সুরের বোধটা থাকে, তবে দেখবেন আপনি যেমনটা গানকে দেখছেন, ওরা তেমন করেই আপনার থেকে অন্যের কাছে যাবে।
আপনি বলছেন গানকে দেখা যায়?
নিশ্চিত যায়। আমার বিশ্বাস একটু আগে আপনিও দেখতে পেয়েছেন। যদি না পেয়ে থাকেন, তবে পাবেন।
আমি গানটা ভালো করে শিখতে চাই, মিস্টার--- এই যাঃ! আমি তো আপনার নাম জানি না।
আমার নাম রবীন্দ্রনাথ মাইতি।
রবীন্দ্রনাথ!
নাম শুনে চমকে লাভ নেই। এটা রবিঠাকুরের দুর্ভাগ্য - তাঁর নাম নিয়ে অনেক অধমের নাম হয়। আমার বাবা-মা আদৌ রবিঠাকুরের কোনও সুবাস কোনওদিন পেয়েছেন কিনা টের পাইনি, তবে আমার নামটা রাখার সময় সে কথা খেয়াল করেন নি।
আপনি কী করেন?
আমি? হাহা করে হেসে উঠল রবীন্দ্রনাথ। বলল, ‘খাইদাই ডুগডুগি বাজাই!’
মানে?
কোনটার মানে? ডুগডুগি?
হ্যাঁ।
ওটা একটা বেকারদের জন্য কল্পিত বাদ্যযন্ত্র!
গান তো করেন শুনলামই। এইরকম আর কোনও গন্ধর্ব বিদ্যা?
গন্ধর্ব বিদ্যার মানে জানেন?
শুনেছি।
বাঙালী বেকাররা অনেক ধরণের গন্ধর্ব বিদ্যা জানে ম্যাডাম।
যেমন?
ধরুন কবিতা লেখা, গল্প লেখা …..
আপনি লেখেন? আমি এরকম লোককে মনে মনে আমাদের থেকে ভিন্ন জগতের লোক মনে করি!
ভিন্ন জগতের বলতে কি গন্ধর্ব?
বলতে পারেন! আমি ভাগ্যবান - এরকম একজনকে আজ সামনে দেখতে পেলাম। আপনার লেখা শোনাবেন?
দেখুন ম্যাডাম, নেমশেক এ কিছু হয় না। যদি সত্যি কিছু পড়তে হয় আসল রবীন্দ্রনাথকে পড়ুন। ওঁকে চিনুন।
আমার সবসময় মনে হয়, আমি যদি এমন কাউকে পেতাম যিনি আমাকে এসব চিনতে সাহায্য করবেন, ধরিয়ে দেবেন আমাকে সমস্ত অলীক সুর, অচেনা সমস্ত রঙ, অধরা সব কিছু …..
কী হ’ত তাতে?
আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে প্রাণপণে সব কিছু আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম।
ওভাবে কিছু লাভ হবে না ম্যাডাম!
আপনি আমায় লিসা বলে ডাকতে পারেন। আমাকে ‘তুমি’ বলে যদি কাজ চালান আরও ভালো লাগবে।
‘লিসা’টা বলা যেতেই পারে, তবে ‘তুমি’তে নামতে যতখানি সময় লাগবে ততক্ষণে আপনি নাগালের বাইরে চলে যাবেন, ফলে সে চেষ্টা করে লাভ নেই। যাই হোক, যে কথা বলছিলাম ….
আপনি বলছিলেন - আমার কিছু লাভ হবে না।
হ্যাঁ লিসা। আপনি পৃথিবীতে এতজন গুণী মানুষের একজীবনে সান্নিধ্য পাবেন না। আর সব কিছু যে নিজেকেই শিখতে হবে এমন ভাবনাটাও একটা অতিইচ্ছা। রবিঠাকুরের একটা গান আছে এই নিয়ে, ‘অতিইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচাও মোরে’। শুনাছেন?
কোন গানে আছে?
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই ....। সব বিদ্যা একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ের ভালোবাসা দিয়ে ছুঁয়ে দেখুন। একটা পারলেই দেখবেন অন্যান্য অনুভূতিগুলো আপনি আসবে।
মানে আমি যদি ভালো রঙ চিনি, সুরের বোধও আমার আপনি আসবে?
নিশ্চিত। সুরটাও তো একটা রঙ। এরা সবাই বেশ লতায় পাতায় বসত করে লিসা, একটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করুন, বাকীগুলোর ঠিকানাও পেয়ে যাবেন। নিজেকেই নিজের মনের মধ্যে থেকে খুঁজে নিতে হবে তাদের।
কিন্তু কেউ সাহায্য করলে খুঁজতে সুবিধে হয়। এই যেমন আপনি আমাকে অনেকখানি সাহায্য করলেন।
রবীন্দ্রনাথ হাসলো। বলল, ‘বেশ তো, এইবার নিজেই পথ চিনে চলতে শুরু করুন।‘
একা চলবো ভাবলে অসহায় লাগে।
এই পথটা একা একা চলারই, লিসা। তবে হ্যাঁ, সাহায্য পেতে চাইলে আপনি আসল রবীন্দ্রনাথে ভরসা করতে পারেন। তিনি একাধারে গন্ধর্ব, একাধারে ঋষি। তিনি আপনার সব চাহিদা পূর্ণ করে দিতে পারেন একা।
লিসা মুগ্ধ চোখে রবীন্দ্রনাথের দিকে চাইল। যৌবনের রবিঠাকুরের ছবির সাথে একটা সচেতন মিল কি নেই? ওই রকম দাড়ি, ওইরকম চুলের ধরণ! লিসা বলল, ‘আপনার ফোন নম্বরটা দেবেন’?
দিতে কোনও অসুবিধা নেই, তবে আমার মনে হয় আপনার না নেওয়াই ভালো।
কেন? মাঝে মাঝে যোগাযোগ করতে পারতাম তবে।
কিছু কিছু সম্পর্ক ক্ষণিক, একে দীর্ঘায়িত করতে চাইলে বিড়ম্বনা বাড়ে। বিশেষ করে মুঠোর মধ্যে যে সব সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের ভারী কষ্ট। তারা মুঠোর চাপে ছট্ফট্ করে, মুঠো খুললে উড়তে পারে না। ওরা হল গিয়ে ওই অতিরিক্তটুকু - যেগুলো না বইতে পারলে ভারী লাগে আর বইতেও সবসময় মন চায় না!
লিসা একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি পরশু দিন এখান থেকে চলে যাবো। কাল একবার দেখা হতে পারে কি?
তার দরকার নেই লিসা।
আপনি কি আমায় মনে রাখবেন?
হাসলো রবীন্দ্রনাথ। বলল, ‘অন্ধকার নেমে গেছে। নতুন জায়গা, আপনার ফিরতে অসুবিধা হবে’।
লিসা তাকিয়ে দেখল, চারপাশে ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছে। নদীর ওপারে খেয়াটা ছাড়লো। হয়তো এটাই শেষ, আজকের মতো। গ্রামাঞ্চলে সন্ধে যেন ঝুপ করে নামে। বলতে বলতেই অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। আবছা অবয়ব ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা নির্দিষ্ট সময় বাদ দিয়ে দিয়ে বাতিঘরের আলোর তীব্র স্তম্ভ সারা আকাশকে সতর্ক করে দিয়ে যাচ্ছে, কালের গতি থেমে নেই। লিসার শিকাগোর বাড়ীর সামনের ম্যাপেল গাছ দুটোর কথা মনে এল। ওরা যদি এরকম অন্ধকার পেত!
রবীন্দ্রনাথ বলল, ‘উঠুন। আমি বরং কিছুটা রাস্তা আপনাকে এগিয়ে দিই। একটা তিনমাথা রাস্তা আছে, ওখানটায় ছেড়ে দেব; তবে আর পথ ভুল হবে না’।
ওরা নিঃস্তব্ধে হাঁটতে শুরু করল। লিসা বলল, ‘আপনার হাতটা ধরে হাঁটলে কি আপনার অসুবিধে হবে’?
রবীন্দ্রনাথ কিছু না বলে ওর হাতটা আলতো করে ধরল। লিসার একটু আগে শোনা গানটার শেষ দু-লাইন মনে পড়ল ‘জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর / লোক লোকান্তরে যুগ যুগান্তর / তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই / কোনও বাধা নাই ভূবনে ….
রবীন্দ্রনাথ হাতটায় একটু চাপ দিয়ে বলল, ওই ডানদিকের রাস্তাটা ধরে চলে যান, আর অসুবিধা হবে না।
লিসা ওর হাত দুটো দিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতটা চেপে ধরলো। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তেমন কিছু করলো না। সে জানে, যে মুঠো খুলে যাবে একটু পরে, তাকে দৃঢভাবে চেপে ধরতে নেই।
1 Comments
অনবদ্য লেখা।কোথায় যেন নিজেকে খুঁজে পাওয়া।
ReplyDeleteআপনার আগের লেখাগুলোর থেকে একদম অন্যরকম একটি লেখা।
এইধরনের আরো লেখার আপেক্ষায় থাকলাম। শুভেচ্ছা ও প্রণাম নেবেন।