জ্বলদর্চি

সাগরে অগ্নি/শেষ পর্ব /সুদেব কুমার ঘোষ

  
সাগরে অগ্নি          
শেষ পর্ব         
সুদেব কুমার ঘোষ

                       
রামজয় বিদ্যাভূষণ বীরসিংহ গ্রামে ফিরে এলে সংসারের সকল বৃত্তান্ত জানতে পারলেন। তিনি পুত্র ঠাকুরদাসের খোঁজে কোলকাতায় গমন করলেন। ঠাকুরদাসের কষ্টের বিষয় অবগত হলেন। সেই স্থানে পুত্রকে আর রাখা ঠিক হবে না বিবেচনা করলেন। বড়বাজারের নিকট দয়েহাটায় ভাগবত চরণ সিংহ নামে রামজয় তর্কভূষণের এক পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি খুব দয়ালু প্রকৃতির ব্যক্তি। তিনি রাম জয় তর্কভূষণের মুখে যাবতীয় বিবরণ শুনে ঠাকুর দাসকে নিজ তত্বাবধানে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরে ঠাকুরদাসকে মাসিক আট টাকা বেতনে অন্য জায়গায় কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। এতে দুর্গা দেবীর সংসারে অনেকটাই দুঃখ ঘুচল। এদিকে ঠাকুরদাসের বয়স তেইশ বৎসর হল। বিয়ে দেবার প্রয়োজন। গোঘাট নিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতী দেবীর সাথে ঠাকুরদাসের বিবাহ সম্পন্ন হল। এখানে ভগবতী দেবী ও তাঁর পিতৃ ও মাতুল কুল সমন্ধে সম্যক ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ভগবতী দেবীর প্রভাব বিদ্যাসাগরের উপর অনেকটাই প্রতিভাত হয়েছিল। আরামবাগ মহকুমার খানাকুল ব্লকের অন্তর্গত পাতুল গ্রামে পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশ নামে এক পণ্ডিত ব্যক্তি বাস করতেন। তাঁর চার পুত্র ও দুই কন্যা। চার পুত্রের নাম রাধামোহন, রামধন, গুরুপ্রসাদ ও বিশ্বেশ্বর। দুই কন্যার নাম গঙ্গা ও তারা। বিদ্যাবাগীশ মহাশয় নিজ গৃহে চতুষ্পাঠীতে স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপনা করতেন। তিনি নিজ গ্রামে ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে মাননীয় ও শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর জৈষঠা কন্যা গঙ্গা দেবীর সাথে গোঘাট নিবাসী রামকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে বিয়ে দিলেন। রামকান্ত মহাশয় ব্যাকরণ ও স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপনা করতেন। তাঁরও এলাকায় যথেষ্ঠ সুনাম ছিল। গঙ্গাদেবীর গর্ভে দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করল। জৈষ্ঠ্য কন্যা লক্ষী ও কনিষ্ঠার নাম ভগবতী। কালক্রমে রামকান্ত মহাশয় অধ্যাপনায় মনোনিবেশ না করে তান্ত্রিক সাধনায় জীবন উৎসর্গ করতে লাগলেন। ফলে ছাত্র সংখ্যা কমতে লাগল। অবশেষে অধ্যাপনা ছেড়ে পুরোপুরি তান্ত্রিক সাধনায় ব্যাপৃত হলেন। শব সাধনা এবং শ্বশানে জপ - তপ তাঁকে ধীরে -  ধীরে উন্মাদের পর্যায়ে নিয়ে গেল। অবশেষে গঙ্গা দেবী পিতার স্মরনাপন্ন হলেন। পিতা উদার প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কন্যা , জামাতা ও দুই নাতনিকে নিজ গৃহে প্রতিপালন করতে লাগলেন। পঞ্চানন মহাশয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রগণ পিতার ন্যায় যথাযথ দায় - দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। পিতার অবর্তমানে রধামোহন  সংসারের হাল ধরলেন। অপর তিন ভ্রাতা দাদার হাতে সংসারের যাবতীয় দায় - দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। দাদা , রাধামোহন এমনভাবে দক্ষতার সাথে  সংসার পরিচালনা করতে লাগলেন অন্য ভায়েরা কোনো প্রশ্নই তুলতে পারলেন না। ভাইদের মধ্যে কখনো মতান্তর এবং মনান্তর দেখা দিলনা। পিতার মতো রাধামোহনেরও সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর মন ছিল দয়ালু। কেউ বিপদে পড়লে ফিরিয়ে দিতেন না। তাঁর লাঘব মোচন করার চেষ্টা করতেন।

🍂

পাশাপাশি গ্রামের লোক রাধামোহন বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন। তিনি অর্থ সঞ্জয়  করে রাখতেন না। গরীবদের অন্নদান ও সাহায্যদানে খরচ করতেন। তিনি ছিলেন অমায়িক , পরপোকারী , ও ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তি। সংসারের অন্যান্য সদস্যদের ন্যায় বোন, ভগ্নিপতি এবং ভাগ্নী - ভাগ্নেয়দের  সমভিব্যাহারে প্রতিপালন করতেন। এমনকি ভাগ্নী দের পুত্র - কন্যাদের প্রতিও কোনোরূপ বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বীকার করেছেন এই পরিবারের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ ও ঋণী।

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যখন পাঁচ বৎসর বয়স হল তখন বীরসিংহ গ্রামের বিখ্যাত শিক্ষক কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি হলেন। কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শিক্ষক হিসাবে খুব নিপুণ ও যত্ন বান ছিলেন। গুরুমহাশয় হিসাবে তিনি আদর্শস্বরূপ ছিলেন। তথায় এক বৎসর শিক্ষার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় কঠিন জ্বর ও প্লীহা রোগে আক্রান্ত হলেন। ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রোগ সারল না বরং রোগ উত্তরোত্তর বেড়েই যেতে লাগল। অতঃপর ভগবতী দেবীর মাতুল রাধামোহন মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রোগের কথা শুনে নিজ গৃহে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার করানোর ভার নিলেন। ইতিমধ্যে রাধা মোহন মহাশয়ের কাহিনী সমন্ধে পাঠককুল অবহিত হয়েছেন। পাতুল গ্রামের কাছে কোটরী বলে একটি গ্রাম আছে। সেখানকার বৈদ্যজাতীয় উত্তম চিকিৎসক ছিলেন। তাঁদের সুনিপুণ চিকিৎসার ফলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরীর ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করতে লাগল। তিন মাস চিকিৎসার পর বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে উঠলেন। পুনরায় তিনি বীরসিংহ গ্রামে ফিরে এসে আবার কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় পড়াশোনা আরম্ভ করলেন। তথায় আট বৎসর বয়স পর্যন্ত শিক্ষালাভ করলেন। তারপর তাঁর মেধার পরিচয় পেয়ে ১২৩৫ সালের কার্তিক মাসের শেষে তাঁকে কোলকাতায় শিক্ষা লাভের জন্য আনা হোল। পিতা  ঠাকুরদাস মহাশয় যেখানে ছিলেন সেই জগদ্দুর্লভ বাবুর বাড়িতে বিদ্যাসাগর মহাশয় আশ্রয় নিলেন। তাঁর বাড়িতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী , তাঁর  জৈষ্ঠা ভগিনী , তাঁর স্বামী ও দুই পুত্র , কনিষ্ঠা ভগিনী ও তাঁর এক পুত্র বাস করিতেন। কনিষ্ঠা ভগিনীর নাম রাইমণি । বিদ্যাসাগর মহাশয় রাইমণিকে দিদি বলতেন। তাঁর ছেলের নাম গোপাল। রাইমণি গোপালকে যেমন ভাবে প্রতিপালন করতেন বিদ্যাসাগর মহাশয়কেও ঠিক তেমনি ভাবে প্রতিপালন করতেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যেভাবে মানুষ করেছিলেন এবং তাঁর ব্যবহার এমন ছিল তা দেখে বিদ্যাসাগর মহাশয় মন্তব্য করেছিলেন " এই দয়াময়ীর সৌম্য মূর্ত্তি, আমার হৃদয়মন্দিরে , দেবীমূর্ত্তির ন্যায় , প্রতিষ্ঠিত হইয়া , বিরাজমান রহিয়াছে। " অনেকেই বিদ্যাসাগর মহাশয়কে নারী জাতির পক্ষপাতী বলে আখ্যা দিতেন। এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় মন্তব্য করেছেন " যে ব্যক্তি রাইমণির স্নেহ , দয়া ,সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে  এবং ঐ সমস্ত সদগুনের ফলাভোগী হইয়াছে , সে যদি স্ত্রীজাতীর পক্ষপাতী না হয় , তাহা হইলে, তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমণ্ডলে নাই।" বিদ্যাসাগর মহাশয় ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসতেন। কোলকাতায় যাবার পর ঠাকুমার জন্য তাঁর খুব মন খারাপ করত। মাঝে - মধ্যে কেঁদে ফেলতেন। কিন্তু রাইমণির স্নেহ - যত্ন তাঁর সেই উৎকণ্ঠা অনেকটা নিবারণ হয়েছিল।
  জগদ্দুর্লভবাবুর বাড়ির কাছে শিবচরণ মল্লিক নামে এক সুবর্ণবণিকের বাড়িতে একটি পাঠশালা ছিল। সেখানে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ভর্তি করা হল। সেই পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন স্বরূপচন্দ্র দাস। কিন্তু তথায় অগ্রহায়ন , পৌষ ও মাঘ --- এই তিন মাস পড়ার পর আবার তিনি রোগে আক্রান্ত হলেন। কোলকাতায় চিকিৎসা করানো হল। কিন্তু রোগ সারল না। পরে তাঁর ঠাকুমা কোলকাতায় গিয়ে তাঁকে বীরসিংহ গ্রামে নিয়ে এলেন। সেখানে বিনা চিকিৎসায় রোগ সেরে গেল। আবার তাঁকে ১২৩৬ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে কোলকাতায় আনা হোল। আবার তাঁকে স্বরুপচন্দ্র দাসের পাঠশালায় ভর্তি করা হোল। সেখানে পাঠ শেষ হলে পরবর্তী পাঠ কী এবং কোথায় হবে এ নিয়ে ঠাকুরদাস এবং তাঁর আত্বীয় - স্বজন আলোচনা করতে লাগলেন। পুত্রের স্মৃতিশক্তি প্রসঙ্গে ঠাকুরদাস মাইল স্টোন দেখে কীভাবে ইংরেজী সংখ্যা মালা শিখেছিলেন সেই কথা উল্লেখ করলেন। সেই উপাখ্যান শুনে পরামর্শ দাতাগন বিদ্যাসাগরের ইংরেজী পড়ার জন্য হের সাহেবের স্কুল ও পরে হিন্দু কলেজে ভর্তি করার উপদেশ দিলেন। উভয় প্রতিষ্ঠান অবৈতনিক। কেবল তাই নয় ইংরেজী পড়লে চাকরী পাওয়া সহজ হবে এরূপ পরামর্শও দিলেন। কিন্তু ঠাকুরদাসের ইচ্ছা ছিল বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত শাস্ত্র নিয়ে কৃতবিদ্যা করাবেন। ভগবতী দেবীর মামার এক আত্বীয় মধুসূদন বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করতেন। তাঁর পরামর্শে ঠাকুরদাস পুত্রকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করলেন। সেই কলেজে পড়ে তিনি কীভাবে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত হলেন এবং তাঁর চাকুরী জীবনের কাহিনী আমাদের সকলের কম - বেশী জানা আছে। সে বিষয়ে আমি এখানে আলোকপাত করব না। এই আলোচনা থেকে আমার মনে হয় বিদ্যাসাগর তাঁর পূর্বপুরুষ এবং আত্বীয় - স্বজনদের নিকট থেকে বংশগতির সূত্রানুযায়ী গুণাবলী অর্জন করেছিলেন। তারপর তিনি যে পরিবেশের মধ্যে শিক্ষালাভ করেছিলেন সেই পরিবেশও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর  পিতৃকুল , মাতৃকুল, ঠাকুমার পিতৃকুল মায়ের মাতুলকুল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রায় সকলেই সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন। ঠাকুরদাসেরও ইচ্ছা ছিল সংস্কৃত নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা। কিন্তু দারিদ্রের কারণে তাঁর স্বপ্ন সফল হয়নি। পুত্রের মধ্য দিয়ে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর লোকগাথায় দয়ার সাগরও হয়ে উঠে। তিনি যা অর্থ উপার্জন করতেন তার প্রায় সবটাই গরিবদের জন্য কিংবা দরীদ্র ছেলেদের পড়াশোনার জন্য খরচ করতেন।  তাঁর কাছ থেকে ঋণী ব্যক্তি লজ্জায় পড়ে যেতে পারে এই ভাবনায় তিনি তাঁর সম্মুখীন হতেন না । রাস্তার পাশে বা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়তেন। এরূপ ব্যক্তি পৃথিবীতে আছে বলে মনে হয়না। এই দয়ার গুণও তিনি তাঁর আত্বীয় - স্বজনদের মধ্যে থেকেই অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর মায়ের মাতুলকুলের প্রায় সবাই খুব দয়ালু ছিলেন। পিতার মুখ থেকে কোলকাতায় তাঁর আশ্রয় ও চাকরীর দেওয়ার কাহিনী শুনে তাঁরও মন পরোপকারী হয়ে উঠেছিল। তিনি নারীজাতির প্রতি বিশেষ দয়ালু ছিলেন। মহিলা দোকানদার যেভাবে পিতা  ঠাকুরদাসের প্রতি খাবার পরিবেশন করতেন সেই কাহিনী শুনেও তিনি প্রভাবিত হয়ে ছিলেন। তারপর রাইমণির স্নেহ - যত্ন তো তাঁকে নারীজাতির প্রতি আর ও শ্রদ্ধা - ভক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল। সাগরে জল থাকে একথা সবাই আমরা জানি। কখনোই আগুন থাকেনা। কিন্তু বিদ্যাসাগর ও দয়ারসাগরের সাগরে জল নয় সত্যিই আগুন ছিল। আর এই আগুন লক্ষ্য করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন।

Post a Comment

0 Comments