পঞ্চাশ তম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
দেখতে দেখতে অগ্রহায়ণ এসেই গেল। বাতাসে হিমেল টান, ভোরের বেলা পুরু কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে থাকে গাছপালা, দিন ছোট হয়ে আসছে,রোদ উঠতে না উঠতেই দুপুর,দুপুরটিও দ্রুত ঢলে পড়ে সন্ধ্যার কোলে।
এতোদিনকার জীবনে বছরের এই সময়টায় পড়ার চাপ থাকতো খুব, পরীক্ষা…
এখনও ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই সেকথা মনে পড়ে।তবে এখন জীবন বদলেছে অহনার। টুকটাক সাংসারিক কাজকর্ম, মাত্রই দেড় বছরের শিশু সন্তানটির দেখভাল, মেধাবী বড়ো ভাসুরের ছেলেটিকে পড়াশোনায় সাহায্য করা, ইত্যাদি ইত্যাদি নৈমিত্তিক দায়বদ্ধতায় কাটে তার দিন।
ইদানিং পিসিমার শরীরটা খানিক ভালো হয়েছে। চেতনা ফিরেছে,খানিক হাঁটাচলা করতে পারেন। নিজের কাজ নিজেই করেন। তার বাচ্চাটাকেও কাছে নিয়ে গল্প শোনান। ডাক্তার বলেছেন,ওনার সুস্থতার জন্য পারিবারিক আসঙ্গ খুব জরুরী। ওদেরও সবসময়ের চেষ্টা থাকে তাঁকে আবার প্রিয় সংসারে জড়িয়ে নেওয়ার।
এই তো সেদিন ভোরে উঠে ওরা দুই বৌ দেখে,খিড়কি দুয়ার খোলা,চমকে দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখে,কাঁপতে কাঁপতে পিসিমা রান্নাশালের দিকে চলেছেন।
দিদিভাই বলে উঠলো,
-’ও পিসিমা! কোথায় যাচ্ছেন!’
-’তোমাদের তো মা কোন দিকেই আজকাল কোন খেয়াল থাকছে না।আজ যে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার।আজ যে বড়ির বিয়ে…
এতো বেলা হয়ে গেল,তার জোগাড় কই!’
যদিও সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল না,বড়ির বিয়ের আয়োজনও করা হয়নি,তবু স্মৃতিভ্রষ্ট পিসিমাকে একটুও বিরক্ত না করে অহনা জানতে চেয়েছিল,তার আয়োজন উপচার। সুযোগ পেয়ে মহাসমারোহে বৃদ্ধা খুলেছিলেন তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি।
🍂
এমন সব হিমেল সকালে,বাড়ির বৌয়েরা সকাল সকাল স্নান সেরে আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা নতুন বিউলীর ডাল বেটে,ফেটিয়ে তারের জাল বা পরিস্কার কাপড়ে পরপর বড়ি দেয় হাতের বিশেষ কৌশলে।মাঝে থাকে দুটি বড়ো আকারের বড়ি, তাদের মাথায় থাকে ধান দূর্বার টোপর,একটিতে শ্বেত চন্দন,অন্যটিতে লাল চন্দন ও সিঁদুর,মন্ত্র পড়ে পুজো হয়।ঘরে ঘরে শাঁখ বাজে এবং অগ্রহায়ণের পয়মন্ত সকাল আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লক্ষ্মীশ্রী কল্যাণে,যখন পুজো শেষে বাড়ির মেয়েদের, ছেলেদের নয় কিন্তু,খালা ভরে ফল-মিষ্টি, মালপোয়া-নাড়ু-চিঁড়ে বিতরণ করা হয়।শুনতে শুনতে অহনার মনে হয়েছিল,কতো সাধারণ জীবনাচরনেও গ্রামীন সমাজ তাদের কন্যাশিশুদের সুরক্ষার কথা মনে রাখতো,ইতু,টুসু্ ইত্যাদি লৌকিক পরবে ও গানেও তো তার রেশ মেলে বেশ।
হঠাৎ কি মনে হতে সে জানতে চেয়েছিল,
-’ আচ্ছা পিসিমা, আমাদেরও ঐরকম জাল আছে,তারের!আপনিও তো দিতেন বড়ি;গয়নাবড়ি,তাইনা?’
-’আছে বইকি!দিতাম তো বড়ি।ভোর থেকে উঠে স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড় ও আচারে বড়ি দিতে হয়। শুধু কি দেওয়া!তারপরে,সারাদিন রোদের পিছনে পিছনে ছোটা…সন্ধ্যের রান্না শেষে উনুনে তারজালি সেঁকে বড়ি ছাড়িয়ে কুলোয় মেলে বেশ কয়েকদিন রোদ খাইয়ে নতুন হাঁড়িতে সম্বচ্ছরের জন্য তুলে রাখা…প্রতিবার বড়ির পালা শেষ হলে ধুয়ে মুছে তেল মাখিয়ে কাপড় জড়িয়ে ঐ তারের জালি তুলে রাখতাম।এমনি করেই তো আমচুর, তেঁতুলও রাখতাম।
এখন তোমরা এসেছ, আমার দায় শেষ।বুঝে নাও সব।’
বলতে বলতে উদাস হয়ে যান বৃদ্ধা; দুই প্রজন্মের দুই নারীর মনশ্চক্ষে একসঙ্গে ভাসতে থাকে হৈমন্তী প্রভাতের হিম উজিয়ে শ্বেতাম্বরার ব্যস্ততা…ডাল বাটা,ফেটানো,জলে ফেলে দুধসাদা গোনলাটির ভেসে ওঠা দেখে তারজালিতে তেল মাখিয়ে বড়ি দেওয়া, একটু বেলার দিকে,সোনারং কাঁসার থালায় রোদ লাগলে তাতে পোস্ত ছড়িয়ে গয়না বড়ি দেওয়া।বড়ো শৈল্পিক সেই সব ক্রিয়াকর্ম। তিনি করতেন।মনে পড়ছে,মনে পড়ছে সব।
তাঁকে খানিক ব্যক্তিগত সময় দেওয়ার ছলে, ততক্ষণে সরে আসেন নবীনা, তাছাড়া তাড়াও থাকে তাঁর,এসময়; রান্নাবান্না, ঘরকন্না…
সেদিনটাও ছিল তেমনই এক নির্বিশেষ দিন। সকাল থেকেই অফিস-স্কুলের তাড়া। রান্নাবান্না শেষে আঁশ হেঁসেল নিকিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়েছিল বাড়ির নতুন বৌটি। প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও এখন পুকুরে নামতে ভয় পায়না সে,এমন কি স্নান করতেও।জলে রোদ পড়লে কেমন একটা স্বচ্ছতা আসে তায়,জলের তলা পর্যন্ত দেখা যায়।নীচের পাঁকমাটি,ঝিনুকের খোলা,নুড়ি,ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলা তেচোখো মাছের দল…কাজ ভুলে সে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ।হারিয়ে যায় কোন যেন রূপকথার রাজ্যে…
তো সেদিন হোলো কি, তেমনই বেখেয়ালে বসেছিল অহনা ঘাটের পৈঠায়। পিসিমার কাছে ছেলেকে খেলতে বসিয়ে এসেছে, খানিক নিশ্চিন্তে।হঠাৎ পেছনে কার যেন উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ ফেরালে,
-’কেমন মেয়ে গো তুমি!ছেলে ছেড়ে নাইতে এসেছ তো এসেছ!কোন সাড়া নেই! অদ্ভুত তো!’
-’কে আপনি?’
চমকে তাকিয়ে দেখে ,সুন্দরী এক মধ্যবয়সিনী রমণী,গায়ে দামী শাড়ি,গয়না। আচরণে বেশভূষায় আভিজাত্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ;তার ছেলেকে কোলে করে দাঁড়িয়ে আছেন উপর পৈঠায়…
-’তুমি নতুন বৌ!’
-’হ্যাঁ। কিন্তু…’’
-’আমি তোমার পিসিমার সই,দূরে থাকি। দেখা করতে এসেছি অনেকদিন পরে। আর এসে অবধি তোমার কথা এতো শুনছি যে নিজেই দেখতে চলে এলাম তোমায়…’
ভীষন লজ্জায় মাথায় কাপড় তুলে, তড়িঘড়ি উঠে এসেছিল সে।পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি,
-’ছি ছি!করো কি!করো কি! আমি যে কায়েতের ঝি!’
ততক্ষণে পিসিমা, দিদিভাই সবাই এসে পৌঁছেছে। তাদের গল্পে শুনেছিলেন ইনিই সেইজন,যার সঙ্গে পিসিমার দেখা হয়েছিল সেই চারধাম তীর্থ যাত্রায়।
-’পিসেমশাই কোথায়?’
-’কেন রে মেয়ে! আমার সঙ্গে আলাপই হোলনা,তার আগেই পিসেমশাই!
হ্যাঁ লো সই!কি বলেছিস একে তাঁর নামে!’
অতঃপর ছদ্ম কলহ,গ্রাম্য রসিকতা,শুকিয়ে আসা কুঞ্চিত গালে নওল কিশোরী টোল…
রান্নাশালায় দুই বধূর ব্যস্ততা, অগ্রহায়ণ দুপুরের মিঠে রোদে ফুলকারী আসন পেতে কাঁসার থালায় হঠাৎ আসা অতিথির জন্য স্বল্প উপচারেও আন্তরিকতা মিশিয়ে সাজিয়ে দেওয়া মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন…শেষ বিকেলের আলোয় গলা জড়াজড়ি বিদায়;বেশ কেটেছিল দিনটি।
অগ্রহায়ণের পড়তি রোদ তখন মাঠময় কাটা ধানের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে, কাঠবেড়ালি, মেঠো ইঁদুরের দল পড়ে থাকা ধানের গুচ্ছ সংগ্রহে তৎপর,সই-পিসিমার আপন হাত থেকে খুলে তার হাতে পরিয়ে দেওয়া উপহারী বালাদুটির দিকে তাকিয়ে অহনার মনে পড়লো, শিক্ষক বাবার লেখা কয়েকটি চরণ,
রাত পেরোনো দ্বিধান্বয়ী সন্ন্যাসী যে আলো
হেঁটে বেড়ায় মায়াবিধুর ছায়াপথের ধারে
নাথবৎ এ জীবনজোড়া অনাথবৎ কালো
কেমন করে ধন্য করে মহতী নিরাকারে!...
0 Comments