বিবর্তনবাদ ও প্রাণের উৎপত্তিতে পুরাণের গ্রহণযোগ্যতা আদৌ কতটা?
শাশ্বত বোস
ভারতবর্ষ এক বৃহত্তর ধর্মযাপনের দেশ। কথাটা লিখলাম শুধু এটা বোঝাতে নয় যে এই দেশ এক সুবৃহৎ জনসংখ্যার ধারক হিসেবে বহু প্রাচীন কাল ধরে নানা ভাষা-জাতি-সভ্যতার মানুষের ভরসাযোগ্য যাপনচিত্র এঁকে চলেছে অগণিত নদীশাখার বহমান ধারায়, সেই সাথে আমি এই ধর্মাচরণ বা ধর্মযাপনের ব্যবহারিক ভিত্তির উপরও জোর দিতে চাইছি। ধর্মকে ঘিরে বহু জাগতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস গঠনতন্ত্র ও নির্দেশিকার প্রবহমান আত্মিকতার সুপ্ত একটি ধারা একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে ধ্বনিত হয়ে চলেছে গোটা দেশটার সুষুম্না তন্ত্রের ভেতর, সেই সভ্যতার প্রারম্ভিক সময়কাল থেকে। হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্মের আখ্যা দেওয়া হয়, এর প্রাচীনতার হিসেবেই শুধু নয় একই সাথে এর বিশালতা ও বিচিত্র ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে সময়বিশেষে এই ধর্মের যাপনের ভিন্নতাও এক্ষেত্রে সমানভাবে বিচার্য্য হয়ে থাকে। মহাকাব্য, বিজ্ঞান কিংবা অনুমান এই সব কিছুই এই ধর্মের সাথে মিলে মিশে গেছে প্রলম্বিত এক গুরুমন্ত্রের মত। মনে করা হয় মহাভারতের রচয়িতা ব্যসদেবই ভারতীয় পুরাণের সংকলক। তবে ইতিহাস অনুসারে পুরাণের সব থেকে প্রাচীন পাঠগুলো গুপ্ত সাম্রাজ্যের কালেই সংকলিত হয়েছিল। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিকদের মতে এই সময়কালের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। পুরাণ গ্রন্থগুলি ভারতের নানাস্থানে রচনা করা হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দে রচিত ছান্দোগ্য উপনিষদে পুরাণের একটি প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলে অভিহিত করে (ইতিহাসপুরানম্ পঞ্চম বেদম্)। অথর্ব বেদ এই ধারণাকে পুষ্টি দেয়।
ভারতীয় পুরাণ মোট পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত। যেমন সর্গ বা ব্রম্ভান্ড সৃষ্টির কাহিনী, প্রতিসর্গ: এর পরবর্তী যুগের বা প্রলয় পরবর্তী যুগের কথা বলে, বংশ: এতে দেবতা ও ঋষিদের বংশবৃত্তান্ত নিয়ে বলা আছে, মন্বন্তর: মনুর শাসনকাল যা তিরিশ কোটি চুরাশি লক্ষ আটচল্লিশ হাজার বছরের সমান এবং সেই সময়ের মনুষ্যজাতির সৃষ্টির বর্ণনা দেয় এবং বংশানুচরিতম: যেখানে রাজবংশের ইতিহাস বর্ণিত আছে। আরিয়ান রচিত ইন্ডিকায়, মেগাস্থিনিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে ভারতীয়রা শিব (ডায়োনিসাস) থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (সান্ড্রাকোটাস) পর্যন্ত "ছয় হাজার তেতাল্লিশ বছরে একশো তিপান্ন জন রাজা র কথা স্বীকার করে। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে রচিত বৃহদারণ্যক উপনিষদে গুরু-পরম্পরায় ৫৭টি যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ গুরু-পরম্পরা তারও ১৪০০ বছর আগে থেকে প্রচলিত ছিল। যদিও এই তালিকার যথার্থতা নিয়ে মতদ্বৈত রয়েছে। কহ্লন রচিত রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে বর্ণিত রাজাবলিতে খ্রিস্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজাদের তালিকা পাওয়া যায়।
🍂
এখন আসা যাক সৃষ্টির আদিকল্পের কথায়। আধুনিক বিজ্ঞানচর্চ্চা শুরু হবার আগেও মানুষের মনে নিজের উৎপত্তি সম্পর্কে কৌতূহল ছিল। এই অজানাকে দেখা, অচেনাকে চেনার স্পৃহাই কিন্তু একদিন জন্ম দিয়েছিল দর্শনবাদের, যা মানুষকে ধর্মীয় মাদকতার পাশাপাশি এক স্বাধীন যুক্তিসম্মত মনন গড়ে তোলার ভিত্তি যোগায়। সেই চিন্তনশীলতাকে আধুনিক ও প্রমাণসাপেক্ষ করে তোলে বিজ্ঞান। তবু আজ এই উত্তর আধুনিক যুগেও, পুরাণ, দর্শন ও বিজ্ঞানের সংঘাত থামেনি। যদি আমরা তুল্যমূল্য বিচারে আসি তাহলে কিন্তু দেখবো, খুব গভীর স্তরের যুক্তিগ্রাহ্য প্রামাণ্য নথি না দিতে পারলেও, সৃষ্টির আদিকালে এই ব্রম্ভান্ডের রূপ ঠিক কেমন ছিল সেই নিয়ে একটি আভাস কিন্তু আমরা আমাদের পুরাণের থেকে পাই। এই যেমন বিজ্ঞান বলছে, এই মহাবিশ্ব প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর পুরোনো। এ প্রসঙ্গে বলা যায় “বিগ ব্যাঙ” তত্ত্বই প্রাথমিক ভাবে আমাদের সৃষ্টির আদিকাল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটা দিয়েছিল। সে এক ভয়ানক বিস্ফোরণ, যা সাধারণ মানুষের কল্পনাশক্তিরও বাইরে, তাকে অনায়াসে পুরাণে বর্ণিত সৃষ্টির শুরুতে স্থিত মহাপ্রলয়ের সাথে তুলনা করা চলে। সেই সময় থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েছে ক্রমে, ব্রম্ভান্ডের তাপমাত্রাও কমেছে। এর কিছু পরে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস গঠিত হয়েছে। ক্রমশঃ মহাকর্ষের অধীনে গ্যাসগুলো ঘনীভূত হয়ে বর্তমান মহাবিশ্বের ছায়াপথ তৈরী হয়। সেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৌরজগতে ৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী তৈরী হয়। আদিমতম পৃথিবীতে কোন বায়ুমণ্ডল ছিল না। গলিত ভর থেকে নির্গত মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া ভূপৃষ্ঠকে ঢেকে দেয়। সূর্য্যের অতিবেগুনী রশ্মি জলকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত করে। অক্সিজেন এবং মিথেনের সাথে মিলিত হয়ে জল CO2 ও অন্যান্য যৌগ গঠন করে। ওজোন স্তর এই সময়েই তৈরী হয়েছিল। পৃথিবী শীতল হওয়ার সাথে সাথে জলীয় বাষ্প অঝোর ধারায় ঝরে পড়ে ও সাগর তৈরী করে। পৃথিবী সৃষ্টির ৫০০ বিলিয়ন বছর পর প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল। সূচনার স্তরে জীবনের প্রথম নন সেলুলার ফর্মগুলি ৩ বিলিয়ন বছর আগে উদ্ভুত হয়েছিল। এরাই হল দৈত্যাকার অণু (আর.এন.এ, প্রোটিন, পলিস্যাকারাইড) ইত্যাদি। এরাই তাদের অণুগুলিকে পুনরুৎপাদন করেছিল। জীবনের প্রথম সেলুলার ফর্মেশন সম্ভবত কোষ গঠনের মাধ্যমেই হয়েছিল। সমস্ত প্রাণের রূপই ছিল শুধুমাত্র জলের পরিবেশে।
এই সূত্রে আমরা বিষ্ণুর দশ অবতারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারি। মানুষ ও জীবজগতের উৎপত্তি ও বিবর্তনের প্রথম যুক্তিগ্রাহ্য ও বিজ্ঞানসম্মত ধারাটি আমরা ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত, চার্লস ডারউইনের দ্বারা লিখিত গ্রন্থ, ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিন্স অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ এর মাধ্যমে জানতে পারি। গ্রন্থটি প্রকাশের পর যা ডারউইনের মতালম্বীদের ভিতরে “ডারউইনবাদ” রূপে আখ্যায়িত হয়। যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে এই মতবাদটির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মনে করা হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও গবেষণার দৃষ্টান্তের বদলে এটি একটি আদর্শ মাত্র। ডারউইন মূলতঃ প্রাকৃতিক নির্বাচন ও অসংগঠিত বিন্যাসের উপর জোর দিয়েছিলেন তাঁর বক্তব্যে। এই তত্ত্ব মূলতঃ মিউটেশন ও নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির বিবর্তনীয় বৈচিত্র সম্পর্কে জৈবিক তত্ত্বের ধারণা দিতে গিয়ে, “সমষ্টির মধ্যে কিছু জীবের প্রাকৃতিক নির্বাচন”, এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ঠ হয়। জন্ম নেয় একই প্রজাতির অনেক জীব, সৃষ্টির খেয়ালে শুধুমাত্র কিছু কিছু জীবের মধ্যেই সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাদের অস্তিত্ত্বের সংগ্রামে সাহায্য করে। সেই বিশেষ কিছু জীবই পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এখন প্রশ্ন হল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার সময় ডারউইন সাহেব কোন কোন প্রকরণ নিরীক্ষণ করেছিলেন। শোনা যায় যাত্রাকালে চার্লস ডারউইন, গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জে যান। সেখানে তিনি জীবের এক আশ্চর্য্য বৈচিত্র লক্ষ্য করেন। সেখানে তিনি “ফিঞ্চস” নাম পরিচিত এক বিশেষ ধরণের ছোট কালো পাখি দেখেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে একই দ্বীপে অনেক জাতের ফিঞ্চ রয়েছে এবং প্রায় সব কটি জাত ওই দ্বীপেই বিবর্তিত হয়েছে। যাদের মূলতঃ বীজ খাওয়ার বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে পরিবর্তিত ঠোঁট সহ আরো অনেক রূপের উদ্ভব হয়েছিল।
এখন আবার আসা যাক পুরাণ প্রসঙ্গে। এই ডারউইনবাদকে অনেক দার্শনিক ও পুরাতত্ত্ববিদ বিষ্ণুর দশ অবতারের প্রাচীন ধারণার সাথে সমানুপাতিকভাবে চিহ্নিত করেন। অগ্নি, পদ্মা, গরুড়, লিঙ্গ, নারদ, স্কন্ধ ও বরাহ পুরাণে এই দশাবতার রূপের বর্ণনা আছে। বিষ্ণু বা নারায়ণ সৃষ্টির আদিকালে ছিলেন যোগনিদ্রায় মগ্ন। প্রলয়ের পরের অবস্থা হল, বিলুপ্তি ও পুরুষ প্রকৃতির মধ্যে বিভাজনের সময়কাল। বিভিন্ন পুরাণ বিশেষতঃ বিষ্ণু পুরাণে বর্ণিত আছে প্রলয়ের পরবর্তীকালে ব্যাপক বর্ষণের পর তৈরী হয়েছিল নিখিল সুরার সাগর। সেই সাগর থেকে উঠে আসেন বিষ্ণু স্বয়ং যোগনিদ্রায় মগ্ন হয়ে। সে নিদ্রা স্বপ্নহীন। তাঁর নাভিপদ্ম থেকে উঠে আসেন সৃষ্টি বিধাতা ব্রম্ভা। বিষ্ণুর এই নিদ্রার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন, তাঁর নয়নাশ্রিত অতুল তামসী শক্তি, বিশ্বেশরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতি সংহার কারিণী, ভগবতী যোগনিদ্রা দেবী। স্বয়ং শ্রী শ্রী সপ্তশতী চন্ডি বর্ণিত ব্রম্ভার স্তবে উল্লিখিত আছে,
“অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবজননী পরা ।।
ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা ।।”
অর্থাৎ তিনি অমৃতরূপা এবং অ-উ-ম ত্রিবিধ মাত্রারূপে অবস্থিত প্রণবরূপা। বিশেষরূপে যা অনুচার্যা, নির্গুণা বা তুরীয়া। তিনিই এই জগৎ ধারণ করেছেন। তিনি জগৎ সৃষ্টি করেন, পালন করেন আবার প্রলয়কালে তিনিই তা সংহার করেন।
বিষ্ণুর দশাবতার হলেন, যথাক্রমে মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ এবং কল্কি। এ প্রসঙ্গে গৌড়ের রাজা লক্ষণসেনের রাজসভার পঞ্চরতের অন্যতম এক অসামান্য প্রতিভাধধর কবি জয়দেবের নাম স্মরণ করতেই হয়। বর্তমান বীরভূম স্থিত কেন্দুলী যা সেই সময়ে কেন্দুবিল্ব নামে পরিচিত ছিল, সেই গ্রামেই এই ক্ষণজন্মা পুরুষের জন্ম হয়। ১২ শতকে তাঁর রচিত কাব্য “গীতগোবিন্দ” তে দশাবতার স্তোত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কাব্যের দশাবতার-স্তোত্রেই প্রথম গৌতম বুদ্ধকে 'যজ্ঞনিন্দাকারী' বিষ্ণুর অবতাররূপে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কাব্যের শেষে ভগবানরূপী কৃষ্ণ ভক্ত রাধার শ্রীচরণ নিজের মাথায় রাখার যাচ্ঞা জানিয়েছেন, "দেহি পদপল্লবমুদারম্"। ভগবান বিষ্ণু যুগে যুগে ধরিত্রীর চিরাচরিত প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখতে জগতের মঙ্গলের জন্য অবতাররূপে ধরাধামে নেমে আসেন। এই স্তোত্রে জয়দেব অবতাররূপী কেশবের দশরূপের বর্ণনা দিয়ে বন্দনাগানে লিপ্ত হয়েছেন। এই কাব্যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা, রাধার বিষাদ বর্ণনা, কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতা, উপালম্ভ বচন, কৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা, রাধার সখীদের দ্বারা রাধার বিরহ-সন্তাপের বর্ণনা গ্রন্থিত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করাই যায় দশাবতারের প্রাচীন ধারণার ক্রমটিকেও বহু ক্ষেত্রে আধুনিক ডারউইনীয় বিবর্তনের প্রতিফলন হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই ধারণাটিকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করার জন্য এখন যদি আবার আমরা বিজ্ঞানের আঙিনায় ফিরে যাই তাহলে দেখবো এই পৃথিবীতে প্রথম জীবিত রূপ হল প্রায় ৩.২২ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেওয়া নীল সবুজ শৈবাল, “সায়ানোব্যাক্টিরিয়া”। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৩৫০০ মিলিয়ন বছর পুরোনো পাথরে পাওয়া জীবাশ্ম দ্বারা এই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ত্ব প্রমাণিত হয়। এই সায়ানোব্যাকটিরিয়া কিন্তু সাধারণ শৈবাল নয়, এগুলি হল প্রোক্যারিওটিক জীবন রূপ এবং সেই কারণে কোষগুলিতে অর্গানেল ও স্বতন্ত্র নিউক্লিয়াস থাকে না।
দশাবতারের প্রথম শ্লোকে কবি জয়দেব বলছেন,
“প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং।
বিহিতরহিত্রচরিত্রমখেদম্।।
কেশব ধৃতমীনশরীর জয় জগদীশ হরে।।”
অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে অনন্ত জলরাশির তলায় জগৎ সংসার যখন নিমজ্জিত প্রায়, তখন সৃষ্টি রক্ষার্থে জীবের জন্মবীজ স্বরূপ জ্ঞানকেই তিনি নিমজ্জমনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন মৎসরূপী নৌকার ন্যায়। জ্ঞানের স্বরূপার্থে, সৃষ্টির প্রতিরূপার্থে বেদ বা জ্ঞানালোকের প্রতিবম্বই এখানে জীবন বা প্রাণের স্বরূপ। অর্থাৎ কিনা বিজ্ঞানের কত শত বছর আগে পুরাণ আমাদের ধারণা দেয় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল জলে।
দ্বিতীয় শ্লোকে তিনি বলেছেন,
“ক্ষিতিরতিবিপুলতরে তিষ্ঠতি তব পৃষ্ঠে
ধরণিধরণকিণচক্রগরিষ্ঠে।
কেশব ধৃতকূর্ম্মশরীর জয় জগদীশ হরে।।”
পুরাণ বলে বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার হলেন কূর্ম বা কচ্ছপ। সমুদ্রমন্থনকালে মন্থনদণ্ডরূপী মন্দার পর্বতকে পৃথিবীর কেন্দ্রে স্থির রাখার জন্য ভগবান পরিগ্রহ করেছিলেন ভীমকায় কচ্ছপের রূপ, নিজ পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন মন্দার পর্বতকে। সমুদ্র মন্থনের তাড়নায় পৃথিবীর ভারসাম্য যাতে হারিয়ে না যায় তাই পৃথিবীর ভরকেন্দ্রকেই নিজ পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন তিনি। তার সেই গুণবলে পৃথিবী আজও নিজ অক্ষে স্থির আছে। জয়দেব তার কবির অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলেন, পৃথিবীর ভার ধারণের ফলে ভগবানের কূর্মপৃষ্ঠে কিণাঙ্ক রেখা, আবার সেই রেখা তার ক্ষমতার প্রতীকও বটে। পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে ঘর্ষণের ফলে তাঁর পিঠে যে কিণাঙ্ক বা কড়া পড়েছে তা এক অর্থে তাঁর অঙ্গের শোভাও বটে। এবার যদি বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু চোখে এর ভেতর বিবর্তনবাদের ধারাটি খুঁজে দেখতে হয়, তাহলে দেখবো কচ্ছপ উভচর প্রাণী অর্থাৎ জল থেকে স্থলে প্রাণের আগমন হল সবে। কোথাও গিয়ে এই ধারণা বৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদের সাথে মিলে মিশে গেল না কি?
দশাবতার স্তোত্রের এর পরের শ্লোকে কবি বলেছেন,
“বসতি দশনশিখরে ধরণী তব লগ্না
শশিনি কলঙ্ককলেব নিমগ্না।
কেশব ধৃতশূকররূপ জয় জগদীশ হরে।।”
পুরাণ মতে সৃষ্টির অতিপ্রসবহেতু ধরণী যখন রসাতলে তলিয়ে গিয়েছিল, তখন শ্রী হরি একশৃঙ্গী বরাহরূপ ধারণ করে, আপন একদন্ড শীর্ষে পৃথিবীকে সমুদ্র তলদেশ থেকে উদ্ধার করে আনেন। আসলে বসুন্ধরা হরিপ্রিয়া। বরাহ অবতারে তাঁর যেমন রক্ষকের ভূমিকাটি স্পষ্ট তেমনি ব্যঞ্জিত তাঁর প্রেমিক রূপও। উদ্ধারকালে পরম পুরুষ তিনি, ধরণীকে একশৃঙ্গে কর্ষণ করে নবসৃষ্টির সূচনা করেছিলেন। কবি বলেছেন, হে কেশব, চন্দ্রের অবিচ্ছেদ্য রূপ কলংকের ন্যায় বরাহরূপধারী তোমার শুভ্র দশনশিখরে শ্যামলিমা ধরণী মগ্ন হয়ে আছেন। কবি এখানে শৃঙ্গাররসে বিষ্ণুর বরাহরূপকে উজ্জ্বল করে তোলেন। আবার এই বরাহ অবতাররূপেই যেমন পুরোপুরি স্থলভাগে প্রাণের সঞ্চারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি জনন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাণের পুনরোদ্গম ও বংশবৃদ্ধি ভাবনারও একটি স্বচ্ছ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তিনবার মনুষ্যেতর রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবার পর, চতুর্থবার কেশব ধারণ করলেন অর্ধ মানব-অর্ধ পশু, নৃসিংহ রূপ দুর্দমনীয় দানব হিরণ্যকশিপুর নৃশংস অত্যাচারের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার নিমিত্তে। এই হিরণ্যকশিপু স্বয়ং ব্রম্ভার কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে দেবতা মানব দানব তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না, এমনকি তিনি দিন বা রাতে হত হবেন না, এমনকি তাঁর মৃত্যু হবে না কোন অস্ত্রের আঘাতেও। বিবর্তনবাদ, বিজ্ঞান বলে “এপ” নামক এক বিশেষ বন মানুষের জিন মিউটেট ই জন্ম হয়েছে আধুনিক মানুষের। তারা লোমশ ছিল এবং গরিলা এবং শিম্পাঞ্জীর মত হাঁটত। ইথিওপিয়া ও তানজানিয়ায় মানুষের মত হাড়ের কিছু জীবাশ্ম পাওয়া গেছিল, যেগুলি প্রমাণ করে মানুষের পূর্বপুরুষের একটি প্রজাতি পূর্ব আফ্রিকায় ছিল। আবিষ্কৃত হাড়ের মধ্যে কিছু হাড় ভিন্ন প্রকৃতির ছিল, এই হাড়গুলিই ছিল প্রথম কোন মানব সদৃশ প্রাণীর, যাদের বলা হত “হোমো হ্যাবিলিস”। তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা ছিল ৬৫০ থেকে ৮০০ সিসি এর ভেতর এবং তারা সম্ভবত শাকাহারী ছিল। ১৮৯১ সালে জাভাতে আবিষ্কৃত জীবাশ্ম থেকে “হোমো ইরেক্টাস” নামক একটি মানব প্রজাতির কথা জানা যায়, যাদের ৯০০ সিসির মত মাথা ছিল এবং সম্ভবত এরা মাংসাশী ছিল। আজকের উন্ন্ত মানুষের সব থেকে কাছের প্রকরণ “হোমো সেপিয়েন্স” আফ্রিকায় উত্থিত হয়েছিল এবং মহাদেশ জুড়ে তারা স্থানান্তরিত হয়েছিল। জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৭৫ থেকে ১০ হাজার বছর আগে আধুনিক হোমো সেপিয়েন্সের আবির্ভাব হয়েছিল। অর্থাৎ মানুষের শরীরে আজও রয়ে গেছে বন্যতার জিন। সুযোগ পেলেই তাই আজও মানুষ ধরে পশুর রূপ। জীবজগৎ ধরাধাম কেঁপে ওঠে তার নৃশংসতায়। তবু মানবসৃষ্টির আদি পাঠ কিন্তু আমরা পাই, সেই আদি পুরাণেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের অনেক আগেই যার প্রচলন হয়েছিল।
0 Comments