জ্বলদর্চি

লিভ ইন /পুলক কান্তি কর

চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ

লিভ ইন  
পুলক কান্তি কর

একমনে খেলনাবাটী খেলছিল ঝুম্পি। কৃষ্ণার ডাক শুনে একছুটে এসে দাঁড়ালো তার ইজিচেয়ারের সামনে। ‘ডাকছ কেন মাসিমণি?’
-তোর চুলটা এত ছোট করে ছাঁটলো কেন রে তোর মা?
-তার আমি কী জানি। আমাকে বলল, আমিও পার্লারে গিয়ে তাই বললাম।
-বাঃ রে! তাই বলে একদম কদমছাঁট?
-আসলে মা বলছিল ন্যাড়া হতে। ওতে নাকি চুল ভালো হয়! তার উপর গরম পড়েছে তো! কিন্তু বাপি একেবারে ন্যাড়া হতে দিল না। 
-তোর বুঝি ন্যাড়া হওয়ার ইচ্ছে ছিল ঝুম্পি?
-তা নয়। তবে স্কুলে মুনমুনরা বড় চুল ধরে টানে! চুল না থাকলে লড়াই করতে গেলে আমি অ্যাডভান্টেজ পাবো মাসিমণি!
-দূর বোকা! অত সুন্দর চুল তোর! বড় হলে চুল কেটে ফেলিস না।
-তুমিও তো চুল ছোট করে ছাঁটো মাসিমণি? তোমার বুঝি চুল ভালো নয়।
-আমার কথা ছাড়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কৃষ্ণা। ওর বাবা ওর শখ করে নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণচূড়া। ওর বড় বেশী মেয়েলি লাগতো নামটা। তাই ছোট করে কৃষ্ণা করে নিয়েছে। ও যদিও খুবই ফর্সা, তবু এই নামটা রাখার পেছনে দ্রৌপদীর নামের ছোঁয়া পাওয়াটা তাকে উৎসাহিত করেছিল। তখনকার দিনের স্বাধীনচেতা নারী! পাঁচপাঁচটা স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হয়েও যে কারও কাছে বশীভূত হয়নি। সেই যুগেও যে আলাদা করে সখা হিসাবে কৃষ্ণকে বেছে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছিল! সেই যুগেও যে নিজের অসম্মানে নিজেকে সংকুচিত না করে বরং সারা ভারতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল! দ্রৌপদী তার জীবনে আদর্শ। আসলে ছোট থেকেই মনে মনে নারীবাদীত্ব  ওর মন এতখানি দখল করে নিয়েছিল যে সে কখনও ওর থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক মানুষের চোখে কিছু দেখা বা বিচার করাটাই ভুলে গিয়েছিল। ঘোর ভাঙল ঝুম্পির কথায় – ‘মাসিমণি, বাড়ীতে কে আসবে বলছিলে?’

🍂

-আসার তো কথা রে! দ্যাখ দেখি কটা বাজে?
-বড় কাঁটাটা টু এর ঘরে, আর ছোটটা ইলেভেন!
-ওরে বাবা! অনেকদেরী হয়ে গেল তো রে! তুই এখানে খেল। দেখিস, বেশী জায়গায় ছড়াস না খেলনা পাতি! আমি বরং ফোন করে দেখি।
  বলতে বলতেই ওর বাড়ীর সামনে একটা গাড়ী এসে থামলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন সুন্দর চেহারার পুরুষ। আজ সুন্দর একটা কচিকলাপাতা রঙের পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পরে এসেছে শান্তনু। মাথার চুল অনেকটাই ফাঁকা। পাতলা কাঁচাপাকা গোঁফ। হাতে বেশ বড়সড় একটা মিষ্টির হাঁড়ি। আজকাল এ চত্বরের সব মিষ্টি দোকানেই তো প্লাষ্টিকের ব্যবস্থা। মাটির হাঁড়িটা জোটালো কোত্থেকে কে জানে। আসলে মানুষজন প্রবাসী হলেই এইসব আবেগ বুঝি বেশী করে পেয়ে বসে! একটুবাদে শান্তনু এসে বলল, ‘কীরে পাঞ্চু, কেমন আছিস?’ দ্রৌপদীর পাঞ্চালী নামের অপভ্রংশ করেই ডাকতো সে এককালে। 
-ভালোই। তুই কেমন?
-আমিও ভালোই আছিরে। তুই আজ শাড়িটাড়ি পরে কেন বাবা! হঠাৎ নারী হয়ে গেলি নাকি? তুই তো শাড়ি দুচক্ষে সইতে পারতিস না! বলতিস, এটা একটা এক্সজিবিশনের পুরুষালি চাল! মহিলাদের জবুথবু করার সনাতন প্রচেষ্টা। সেই তুই রমণী বেশে, কেমন ঝটকা খেলাম যে রে! 
-তোর অনারে শান্তনু! তুই আবার এইসব পুরুষসুলভ প্যানপ্যানানি ভালোবাসতিস তো। তাই ভাবলাম এতদিন বিদেশে হটপ্যান্ট টিশার্টে ধিঙ্গি মেয়েদের দেখে দেখে চোখটা তোর আপসেট হয়ে গিয়ে থাকবে। এটা কিছুটা রিভার্স করার প্রচেষ্টা বলতে পারিস।
-তাও ভালো পাঞ্চু! তুই অ্যাটলিষ্ট আমার ভালোলাগার ব্যাপারটা মনে করেছিস এবং সেই মতো তোর আদর্শের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছিস - রিয়েলি অনার্ড!
-নে বোস এবার। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? 
-না রে, বসতে হবে এবার। কোমরটা ইদানীং দেখছি বিদ্রোহ করছে। মিনিট দশ পনেরো দাঁড়ালেই থাইগুলোতে একটু টান ধরে। তারপরে যে গাড়ীটায় এলাম - ওর গদিটদিগুলো বসে গেছে। নার্ভে আরও চাপ পড়ল মনে হয় ওতে!
-ডাক্তার দেখিয়েছিস?
-হ্যাঁ। ওদেশেই দেখিয়েছি। বলছে তো ডি.ডি.ডি।
-ওটা আবার কী?
-ওই সায়াটিকার মতো রোগ।
-সারবে না?
-ব্যায়াম ট্যায়াম দিয়েছে। এদেশে এলে তো নানান কাজে ঘোরাঘুরি। ঠিকঠাক ব্যায়াম করা হচ্ছে না। বাই দা বাই আমি তোর হাতে চা খাবো বলে ইনফ্যাক্ট সকাল থেকে কিছুই খাইনি।
-দেখেছিস!
-পাঞ্চু তুই আবার ভাবিস না যেন চা টা বানানো মেয়েদেরই কাজ ভেবে বলছি। ওদেশে আমিই চা বানিয়ে খেতাম।
-কেন তোর বউ - এরা?
-ওদেশের বউরা কি এদেশের মতো? সবাই পাঞ্চুর বাপ ঠাকুরদা। কাজের সব ভাগ-বাঁটোয়ারা আছে ওদেশে।
-বোস একটু। আমি চা করে আনি। তোর জন্য লুচি ভাজা হয়েছে। খাবি তো?
-আগে চা তো খাই।
কৃষ্ণা চলে যেতে শান্তনু ঘুরে ঘুরে দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখতে লাগলো। আগের ছবিগুলো নেই এখন। রিসেন্টলি লাগানো হয়েছে মনে হয়! খানিকবাদে কৃষ্ণা চা দিয়ে বলল, কী রে তোর বউকে নিয়ে এলিনা এবার ইন্ডিয়া!
-ও তো এখন সেপারেশনের নোটিশ দিয়েছে। ফালতু আর বয়ে নিয়ে কী করব? ইন্ডিয়া ট্যুর করাবো আমার টাকায়?
-সে কী রে? কেন?
-ওই! বনছিল না আর কী!
-বাচ্চাটা?
-ওটা তো ওর এক্স হাজব্যান্ডের! সুতরাং আমার কোনও বালাই নেই!
-অ্যালিমনি দিতে হবে নাকি? 
-না। ও চাকরী করে তো! আর ওসব ব্যাপারে তোর মতো নাক উঁচু। কয়েকদিন সাথে শোওয়ার বিনিময়ে বরের পয়সায় আনডিউ বেনিফিট নেওয়াকে ও কাইন্ড অফ প্রষ্টিটিউশন মনে করে। ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ ভালোই।
-তুই কেমন ভাবে কথা বলছিস শান্তনু! তোর ভাষা এরকম কাষ্টমাইজড হয়ে যাবে কখনো, ভাবতেই পারিনা রে! কেমন যেন ভোগবাদ! শরীর মন কাউকেই তো বাদ দিলি না!
-ভোগবাদের দেশেই তো থাকি রে পাঞ্চু! না মানতে পারলে টিকবো কী করে!
-নেক্সট গার্লফ্রেন্ড কী ঠিক করে এসেছিস?
শান্তনু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরে হেসে বলল, সেপারেশনের ওটাও একটা কারণ বলে সোফিয়া দাবী করছে – যদিও বিষয়টা আমার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়!
-মানে?
-মানে কিছুই নয়। নতুন একটা চাকরী জয়েন করেছি। সেখানকার আমার এক কলিগ ‘অ্যানা’ কে নিয়ে সোফিয়া এটা ওটা ভেবে ফেলছে।
-ওদেশের মেয়েরাও সন্দেহবাতিক হয় এখানকার মতো?
-আল্টিমেটলি মেয়ে তো!
-কী বলতে চাইছিস শান্তনু? কপট ধমক দিল কৃষ্ণা। 
-স্যরি বাবা। তবে এটা একটা ইন্টার-ন্যাশনাল জেলাসি। যুগে যুগে সব দেশে সব শ্রেনীর মানুষের মধ্যে এটা একটা কমন ফেনোমেনন।
-আহা হা! যেন পুরুষদের হয় না! বিলাসের সাথে আমি একদিন সিনেমা গিয়েছিলাম বলে তুই কি কম দিন মুখ ফুলিয়েছিলি? ব্যাপারটা অধিকারের, পুরুষ মহিলা জেনডারটা ম্যাটার করে না। 
-ইস্যুটা যে বিলাস কেন্দ্রিক ছিল না, তুই ভালো করেই জানিস পাঞ্চু। মিছিমিছি আজ সেসব কথা তুলে লাভ কি?
-তা ঠিক। তারপরও তো প্রায় কুড়িবছর কেটে গেল। বদলালো না কিছুই। 
-বদল কী করে হবে পাঞ্চু! তুই কি বদল কখনও চেয়েছিলি? সবসময় জানলা দরজায় বায়াসনেসের খিল লাগিয়ে রাখলে সত্যটা ঘরে ঢুকবে কী করে?
-সব দোষ ত্রুটি আমারই ছিল বল?
-একদম। একশভাগ তুইই রেসপন্সিবল ছিলি - এই সবকিছুর জন্য।
(২)
 শান্তনু চলে গেল কিছুক্ষণ আগেই। অনেকদিন পরে ওর সাথে পুরো দিনটা কাটিয়ে বেশ মিশ্র অনুভূতি হল কৃষ্ণার। একসময় শান্তনু ওর বিশেষ বন্ধু ছিল। শান্তনুর তরফ থেকে ব্যাপারটা বেশ গদগদ প্রেমই ছিল, কিন্তু কৃষ্ণা তার নিজস্ব কিছু নীতি নিয়মে এসব নিয়ে কোনও উৎসাহই দেখায়নি। তার কাছে বিবাহ শব্দটাই ‘বিশেষ করে জীবনে নির্বাহ’ বলে মনে হয়। তাই বলে যে শরীর নিয়ে তার কোনও প্রেজুডিস ছিল, তা নয়! ওর মনে পড়ল ওদের এম.এস.সি পড়া দিনগুলোর কথা। একবার ওদের বন্ধুরা সবাই মিলে দীঘা গেছিলো বেড়াতে। চারটে মেয়ে, চারটে ছেলে। সবাই মোটামুটি আধা কাপল। শুধু কৃষ্ণা আর শান্তনু - এই দুজনেই জানতো তাদের মধ্যে সেরকম কিছুই ঠিক নেই। হোটেলের চারটে ডাবল রুম ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। রাত হতেই মোটামুটি বাকী তিনটে জোড়া এক একটা ঘর দখল করে নিল। বিপিনের রুমমেট ছিল শান্তনু। বিপিন এসে অনুরোধ করলো - শান্তনু যদি কৃষ্ণার সাথে রাতটা কাটায় তবে ওদের সুবিধা হয়! আকাশ থেকে পড়ল শান্তনু। মানে? তাই আবার সম্ভব নাকি? 
-ন্যাকামি করিস না শান্তনু। তোদের রিলেশন সবাই জানে।
-ছাই জানিস তোরা। আর যদি থাকেও, তার জন্য বিয়ের আগে এভাবে থাকা সম্ভব নয়! নিজের মর‌্যালিটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!
-তুই মর‌্যালিটি ধুয়ে জল খাবি শান্তনু? আর তাছাড়া এতে অন্যায়টাই বা কী? দু-দিন বাদে তো ওকেই বিয়ে করবি।
-তুই অন্য ব্যবস্থা দেখ বিপিন। আমি সম্মত নই।
-আচ্ছা কেলো তো মাইরি! ঠিক আছে তুই লজ্জা পাচ্ছিস তো! আমি পর্ণাকে দিয়ে কৃষ্ণাকে বলাচ্ছি। 
বলতে বলতেই কৃষ্ণা এসে গিয়েছিল ওখানে। শান্তনুর থমথমে মুখ দেখে বলল, ‘কী বস? ভেবলে আছিস কেন?’ 
বিপিন ঠোঁটকাটা। সে আর পর্ণার জন্য অপেক্ষা না করেই বলল, ‘দ্যাখ না কৃষ্ণা, গাড়োলটাকে বলছি আজ তোর সাথে রাতটা কাটাতে, আমি তবে পর্ণার সঙ্গে থাকতে পারবো। এলাম এতদূরে তো এইজন্যেই মাইরি!’ শান্তনু গর্জে উঠলো, ‘তাই নাকি? তুই পর্ণার সাথে থাকবি বলেই এসেছিস?’ 
-তা নয় তো কি? সব শালার ব্যাটারা এই ধান্দাতে এসেছে। তুই এখন ন্যাকাবোকা সেজে নীতিবাগীশ সাজছিস। 
-দ্যাখ বিপিন, উল্টোপাল্টা বকিস না। 
হঠাৎ মাঝপথে কৃষ্ণা মাথা গলিয়ে বলল, ‘শান্তনু তুইই বা এত সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? ওরা একসাথে থাকতে চায় থাকতে দে না! দু-জন অ্যাডাল্ট মানুষ যদি একরাত সাথে কাটাতে চায়, সেটা ওদের ইস্যু।‘ 
-আমার তাতে আপত্তি নেই! কিন্তু তাহলে তুই আমি থাকবো কোথায়? বাকী চারজন তো একই ব্যবস্থা করেছে।
-আমরা চার নম্বর খালি ঘরটায় থাকবো। সমস্যা কি?
-মানে? তুই আর আমি একঘরে থাকবো? বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করল শান্তনু।
-হ্যাঁ। দৃঢ় গলায় বলল কৃষ্ণা। প্রায় ধমকের গলায় বলল, ‘সব ব্যাপার এত জেন্ডার স্পেশিফিক দেখিস কেন? আমি মেয়ে বলে? কী হবে তুই যদি আমার সাথে রাত কাটাস? তুই তো আমার বন্ধু!’
-সব ব্যাপারটাকে এত লঘু করে দেখিস না কৃষ্ণা। এই দেখবি এই বিপিনরাই রটাবে, তুই আমার সাথে হোটেলে একসাথে রাত কাটিয়েছিলি বলে!
-রটালে রটাবে! কী আসে যায়! মানুষ কল্পনা করবে আমাদের মধ্যে কিছু ইন্টিমেট রিলেশন হয়েছিল। ভেবে তারা যদি আনন্দ পায় পাক না, আমরা তো জানবো সত্যিটা কি! 
বিপিন চোখ টিপে শান্তনুর কানে কানে বলল, ‘দ্যাখনা একটা রাত কি কি জাদু দেখায়! ভগবান চান্স দিচ্ছেন, চান্স নে।
শান্তনু কড়া একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, বিপিন দৌড়ে পালালো। শান্তনু এবার কৃষ্ণার দিকে ফিরে বলল, ‘এসব ব্যাপারে একটু কম মাতব্বরী দেখালেই পারতিস পাঞ্চু। তুই তো একপ্রকার বুঝিয়েই দিয়েছিস বিয়ে থা তোর পছন্দের না, তবে মিছিমিছি...’ 
কথা শেষ করতে না দিয়েই বেশ আবেগ নিয়ে কৃষ্ণা বলল, ‘তাতে কী হল? বিয়ে না হয় আমার পছন্দের নয়, তাই বলে তুই আমার অপছন্দের, তা কি কখনও বলেছি?’ 
-মানেটা কী?
-‘মানেটা রাতে বোঝাবো।‘ মিষ্টি করে হেসেছিল কৃষ্ণা। ডাবল বেড - এমন নয় যে দুটো খাটের জোড়া। সারারাত কী কুণ্ঠা নিয়ে এককোণে সরে শুয়েছিল শান্তনু, ভেবেই এখন হাসি পেল কৃষ্ণার।
-আরে অতদূরে সরে আছিস কেন শান্তনু? আমি কি বাঘিনী নাকি? রাতে পড়ে টড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙবি তো!
-ও ঠিক আছে। তুই চিন্তা করিস না।
-চিন্তা না করি কী করে? আমার কথায় তুই এত বড় রিস্ক নিলি, সকালে হাত পা ভাঙলে লোকে বলবে নির্ঘাত রাতে কিছু অসভ্যতা করছিলি, তো আমি মেরে তোর হাত পা ভেঙে দিয়েছি।
-সেটা তুই পারিস বটে! আর লোকের কথা চিন্তা করিস না। লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই যা ভাবার ভাববে!
-বেশ তো! আমরাই বা অস্বাভাবিক আচরণ করবো কেন শান্তনু? বলেই পাশ ফিরে শান্তনুকে জাপটে ধরল কৃষ্ণা। অনেকক্ষণ ধরে হি হি করে হেসে বলল, ‘কী রে, কেমন লাগছে?’
-ছাড় কৃষ্ণা। তোর পাগলামি আছে, তা তো জানতাম না! অনেকরকম ফালতু ইডিওলজির মধ্যে থাকিস জানি, কিন্তু এ যেন কেমন, মাত্রাছাড়া!
-মাত্রাছাড়া কেন? ‘আজ দুজনে মন্দ হলে মন্দ কি’ গানটা শুনিস নি? বলেই কৃষ্ণা বিছানার উপর উঠে একটু অঙ্গভঙ্গি করে গানটার সাথে সাথে দু-লাইন নেচেও নিল। 
-আজ তোর কী হয়েছে পাঞ্চু? এরকম করছিস কেন?
-আরে আমার নাম পাঞ্চালী। পাঁচটা পুরুষ চাই আমার। তুই নামে অর্জুনের ঠাকুরদা হলে কী হবে, আমার কাছে তুই অর্জুনই!
-তার জন্য বিয়েটাতো করতে হবে!
-এত মেয়েদের মতো বিয়ে বিয়ে করিস কেন রে তুই! সবসময় একটা সিকিউরিটি মেন্টালিটি। বাবা, দেহটা দেব, বিয়ে করবে তো? কেটে পড়বে না তো? এই দেশীয় এসব ন্যাকামো আমি জাষ্ট নিতে পারি না। এই জন্য ফরেনাররা ভালো। ভালো লাগলে এনজয়, না লাগলে রনজয়!
-এটা আবার কী?
-ও বলিনি তোকে রনজয়ের কথা?
-না।
-আমার ছোট বেলার বন্ধু রে। একটু ইন্টু মিন্টু করতো। একদিন বাড়ীতে আমি একা ছিলাম। ও হঠাৎ কোত্থেকে এসে উদয় হল। আচ্ছা বাবা এলি এলি, বোস। না, প্রথমে প্যানপ্যানানি শুরু করলো, তারপর একটু সুযোগ বুঝে আমার বুকটা ছুঁয়ে দিল, দিলাম কষিয়ে পাছায় এক লাথি। তারপর আর এমুখো হয়নি।
-এতদিনের বন্ধুত্ব এভাবে কাটিয়ে দিলি?
-কী করব বল? এইসব মিটমিটানি আমার একদম ভালো লাগে না। ভালো লেগেছে পরিষ্কার করে বল! ইচ্ছে হচ্ছে, পরিষ্কার ভাষায় চা! তাতে আমি হয়ত দিলেও দিতে পারি। এই ইনিয়ে বিনিয়ে দেহ ভিক্ষা আমি সিম্পলি টলারেট করতে পারিনা। তুইও আগে আমার কাছে মিউমিউ করতিস। তবে আজ দেখলাম তুই অনেকটা সাবালক হয়েছিস। তাই আজ তোর সাথে আমার একটু অন্যকিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তোর ইচ্ছে হলে আমি আপত্তি করবো না শান্তনু। বলেই কৃষ্ণা খুব গাঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরল শান্তনুকে।
কৃষ্ণা দেখলো ওর মোবাইলটায় আলো জ্বলছে। দুপুরে সাইলেন্ট করেছিল, খুলতে ভুলে গেছে। উঠে গিয়ে দেখল শান্তনুর তিনটে মিসড কল। একটা মেসেজ পাঠিয়েছে অবশেষে। ঠিকঠাক পৌঁছে যাওয়ার মেসেজ। ওরা যখন সন্ধ্যায় অ্যাকাদেমী চত্বরে বসে গুলতানি মেরে বাড়ী ফিরত, তখন মোবাইলের চল ছিল না। অথচ শান্তনু রোজ ওকে দিয়ে কথা আদায় করে নিত ও যেন পৌঁছে ওদের মেসের ল্যান্ডলাইনে ফোন করে। কৃষ্ণা আপত্তি করে বলতো, ‘তোর এত উদ্বেগ কেন, আমি মেয়ে বলে? রাস্তায় আমার জন্য বাড়তি বিপদ?’ 
-ওঃ! সব কথায় এত নারীবাদ কেন বল দেখি! ঠিকঠাক তুই পৌঁছালি কিনা এটা জানতে চাওয়া কি দোষের? অন্য কেউ পুরুষ বন্ধু হলেও তো আমি তাকে এমন কথা বলতেই পারতাম।
-কই তোর পৌঁছানো নিয়ে আমার তো উদ্বেগ হয় না!
-এটা তোর গঠনের বাহাদুরি পাঞ্চু! সবাইকে এককাঠামোয় ফেললে চলবে কেন? 
অথচ আজ শান্তনুর যাওয়ার সময় কখন অজান্তে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘পৌঁছে একটা ফোন করিস’। শান্তনু কিছু না বলে তাকিয়েছিল এক মুহূর্ত, পরে বলেছিল, ‘আচ্ছা’। ইদানীং কি তবে কৃষ্ণা বদলে যাচ্ছে?
(৩)
ফোনটা রেখেই বাথরুমে স্নানে গেল শান্তনু। গরমকালে রাতের বেলা একটু স্যান্ডাল সাবানে স্নান করতে খুব ভালো লাগে তার। চন্দনের মৃদু গন্ধে মনটা প্রসন্ন হয়ে ওঠে। আজ অনেক বছর পরে কৃষ্ণার সাথে দেখা হওয়ার পর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। এককালে কৃষ্ণার প্রতি ওর অকৃপণ দুর্বলতা ছিল। পাগলের মতো ওর পথ চেয়ে থাকতো। অথচ দিনগুলো কেমন হয়ে গেল। অকারণ প্রতিটি বিষয় নারীপুরুষের ইঙ্গিতে বিচার করতো বলে মনের ভেতর কোথাও ওর প্রতি একটা প্রতিরোধ তৈরী হচ্ছিলই। নারীশরীরের গড়ন নিয়ে ওর আপত্তি! ওদের শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার নিয়েও খোদার উপর খোদকারি করতে চাইতো সে। শান্তনুর মনে পড়ে গেল এক শনিবারের কথা। তখন সে একটা অফিসে সরকারী চাকরী করত। কৃষ্ণা জয়েন করেছিল স্কুলে। হঠাৎ কৃষ্ণার ফোন, ‘বাড়ীতে আয়, কথা আছে!’
-তোর স্কুল নেই পাঞ্চু? 
-ছুটি নিয়েছি।
-কেন রে?
-আয়। এলেই বলব। এখুনি আয়।
পড়িমরি করে শান্তনু যখন এলো ওর বাড়ীতে, তখন কৃষ্ণা বাইরের জামাকাপড় পড়ে তৈরী। ওকে দেখেই বলল, ‘চল। বসিস না। একটা জায়গায় যাবো।‘
-কোথায়? 
-চলই না।
খানিকবাদে দেখা গেল একজন গাইনোকোলজিষ্টের চেম্বারে অ্যাপয়েনমেন্ট আছে কৃষ্ণার। ওর ওভারিয়ার সিষ্ট এর কিছু সমস্যা আছে শুনেছে শান্তনু। আজ ডাক্তারবাবুর কাছে তার অদ্ভুৎ দাবী। ‘ডাক্তারবাবু আমার হিষ্টেরেকটমি করে দিন’।
-আপনি জানেন হিষ্টেরেকটমি কাকে বলে?
-জানি। ইউটেরাস বাদ দেওয়ার নাম হিষ্টেরেকটমি।
-হঠাৎ করে ওই অপারেশনটা করবোই বা কেন?
-বারে! আজ দেড় বছর ধরে ওষুধ খাচ্ছি। সিষ্ট তো কমেই না! মাসে দেড়বার করে পিরিয়ডের এই ঝঞ্ঝাট আমি নিতে পারি না। মাসে সাত আটদিন শুধু এই কারণে নষ্ট।
-নষ্ট কেন? অন্য মানুষ কি এটা সইছে না?
-এই কষ্ট যদি ডাক্তারবাবু আপনার হত, তবে বুঝতেন। পুরুষ ডাক্তার, আপনি এর জ্বালা বুঝবেন কি! যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকে সে ব্যাটাও নির্ঘাত পুরুষ। নইলে এত কষ্ট কেউ দেয় মেয়েদের?
-শুনুন ম্যাডাম! ঈশ্বরের অবস্থান বা অভিপ্রায় নিয়ে আমার বাক্যখরচ করার মতো সময় নেই। আমি শুধু এটা জানি আপনার এই কন্ডিশনে অপারেশন করানোর কোনও ইন্ডিকেশন নেই। আমি করাতে পারবো না।
-পেশেন্ট এর কমফোর্ট বা ডিজায়ারের কি কোনও ভ্যালু নেই? রীতিগলা উত্তেজিত হয়ে গেল কৃষ্ণার গলা। ডাক্তারবাবুও অসহিষ্ণু গলায় কিছু বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। গলা নরম করে স্নেহের সুরে বললেন, ‘কত বয়স তোমার?’
-ছাব্বিশ!
-জীবনটা পড়ে আছে অনেক! বিয়ে থা করো, বাচ্চা টাচ্চা নাও। পরে সমস্যা বাড়লে ভাবা যাবে।
-আমি বিয়ে করবো না ডাক্তারবাবু, বাচ্চা নিয়েও আমার কোনও ফ্যাসিনেশন নেই। আমার বর্তমান জীবনটা এই কারণে জাষ্ট হেল হয়ে যাচ্ছে।
-ঠিক আছে এগুলো তোমার ব্যক্তিগত ডিসিশন। তোমার মা-বাবা এব্যাপারে তোমার সঙ্গে যুক্তিতর্ক লড়বেন। তুমি নেচারের ল অ্যান্ড অর্ডার মানতে চাও না –  তাও না হয় আমি তোমাকে এষ্টাব্লিশ করতে যাবো না। কিন্তু হিষ্টেরেকটমির আফটার এফেক্ট জানো কি? এখন যে জ্বালার কথা বলছ, তখনকার জ্বালা কিন্তু তার চেয়ে কম হবে না।
-শুনেছি তো হরমোন রিপ্লেসমেন্ট করালে সে সব সমস্যা চলে যায়! অনেক অল্প বয়সী মেয়েদের হিষ্টেরেকটমি করতেই হয়। তাদের যদি চলে, আমার চলবে না কেন?
-ওদের ক্ষেত্রে অপারেশনটা বাধ্যতা। না করলে তাদের প্রাণ সংশয় হতে পারে। কিন্ত তোমার তা নয়। সব সময় মনে রাখবে - নেচারেল রিসোর্সটা কখনও আর্টিফিসিয়াল রিপ্লেসমেন্ট দিয়ে মেকাপ করা যায় না। আর তাতে নানান ড্র-ব্যাক ও আছে। 
-মেনোপজাল ওমেনদের যে আপনারা এইচ.আর.টি দেন, তার বেলা? 
-আর্গু করো না আমার সাথে। ওই বয়সে মেয়েদের যে হর্মোন প্রয়োজন হয় সেটা তুলনায় কম। তখন লো ডোজে ব্যাপারটা মেকাপ করা যায়। এসব করো না। আমি কোনওভাবেই কনভিন্সড হবো না। এবার শান্তনুকে দেখিয়ে বললেন, ছেলেটি কে?
-ফ্রেন্ড।
-শুধু ফ্রেন্ড, নাকি স্পেশাল? সঙ্গে করে আমার কাছে এনেছো যখন ভালো বন্ধুই মনে হচ্ছে। শুনুন মিষ্টার...
-আমার নাম শান্তনু মুখার্জী। শান্তনু বলল।
-হ্যাঁ মিষ্টার মুখার্জী। আপনি ওনাকে বোঝান। এসব পাগলামি মাথা থেকে সরানো দরকার। সামনে অমূল্য জীবন পড়ে আছে। বাজারে অনেক ডাক্তার আছে - পয়সার লোভে করেও দিতে পারে। কিন্তু ও যেন সেই ডাক্তারদের কাছে না যায় - সে দায়িত্বটা আপনি নিন। 
 ডাক্তারবাবু আর সময় না দিয়ে অন্য পেশেন্ট এ মন দিলেন। ফেরার সময় শান্তনু বলল, ‘যাবার আগে একবার তো আমায় বলতে পারতিস।‘ 
-বললে কী হতো? তুইও একই কথা বলতিস। ওই সব ব্যাকডেটেড পুরুষালি চিন্তা।
-ঠিক আছে, তুই তোর মাকে বলেছিস?
-পাগল! আরে এতদিন মেয়েরা তো সব পুরুষের শেখানো বুলিই কপচেছে। তারা কখনও কখনও পুরুষের চেয়েও বড় প্রটাগনিস্ট। 
-তুই ই হলি আসল বোদ্ধা। সব বুঝিস! কেউ নিজের সুস্থ অঙ্গ কেটে বাদ দেয়?
-কেন? অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে ব্রেষ্টগুলো কেটে দিল না?
- কিসের জন্য? 
-যাতে ব্রেষ্ট ক্যানসারের অ্যাটাক না হয়!
-তাহলে তো আগাম সব অঙ্গ কেটে কবন্ধ হয়ে ঘুরতে হবে রে পাঞ্চু!
-দ্যাখ,  ব্রেষ্টের প্রয়োজন কী! বাচ্চাকে ফিডিং করানো। যখন ওর আর প্রয়োজন নেই, রেখে লাভ কী?
-ওটা পাগলামি! এসব যে গুরুত্ব দেয়, সেও পাগল।
-তাহলে যে ডাক্তার করালো তাকেও পাগল বলতে চাস শান্তনু! ওদেশের ডাক্তারদের এথিকস্‌ নেই? যত এথিক্স ইন্ডিয়ার ডাক্তারদের?
-অতশত জানিনা বাপু। আমি মনে করি প্রতিটি অঙ্গ একটা বিশেষ কাজ করে। ইউটেরাস তো শুধু বাচ্চা দেওয়ার জন্য নয়, এর অন্য ফাংশানও নিশ্চই আছে।
-তুই জানিস সেসব ফাংশান?
-জানিনা। জানতে কতক্ষণ! নেট খুললেই সব জানা যাবে।
-আমি জেনে শুনেই করতে রাজী হয়েছি শান্তনু। এতে কিচ্ছু অসুবিধা হবে না।
-তোর মতো পাগল আর একটাও দেখাতে পারবি এ ভারতে?
-কটা পাগল চাই? শয়ে শয়ে দেখাতে পারবো!
-মানে?
-তুই মহারাষ্ট্রের সে সব নিম্ন স্তরের মানুষেরা আখ কাটাকে কেন্দ্র করে জীবিকা পালন করে, তাদের কাহিনী জানিস?
-না।
-সেসব জানবি কেন? খবর কাগজ এতক্ষণ ধরে যে পড়িস, কী পড়িস? পেজ থ্রি?
-খবরটা বল, বাজে কথা রাখ।
-ওখানকার আখকাটার সিজিনে পুরুষ মহিলারা বিভিন্ন জায়গায় দালালের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ধরে। ছয়মাস সিজন, ছয়মাস বসে থাকা। ওরা এই সিজনে যাতে ম্যাক্সিমাম রোজগার করতে পারে - সেই চেষ্টাটা করে।
-রোজ কত?
-ওখানকার মালিকরা অনেক বেশী সেয়ানা। ওরা কন্ট্রাক্ট এ দেয়। তিনশ টন আখ কেটে প্যাকিং করতে হয়। সেই বুঝে টাকা। সুতরাং মেয়েরাও চায় ফালতু যেন সময় নষ্ট না হয়।
-এর সাথে আমাদের কনটেক্সটের মিলটা কোথায়? 
-একেবারে টিউবলাইট হয়ে যাচ্ছিস শান্তনু। ওখানকার মেয়েরা দলে দলে সবাই হিষ্টেরেকটমি করিয়ে নেয়।
-ডাক্তাররা রাজী হয় কেন?
-এটা ওদেরও বিজনেস। কিছু একটা বাহানা দেখিয়ে কেটে দেয়।
-লাভ কি এতে মেয়েদের?
-বা রে! মাসে মাসে যাদের নর্মাল পিরিয়ডও হয়, তাদের অন্তত চার পাঁচদিন তো ব্যথা কষ্ট সইতে হবে না। যাদের বেশী হয়, তাদের কথা ছেড়ে দে। ওরা মন দিয়ে এই সময় স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে।
-যারা শ্রমজীবি মহিলা, তারা কি পিরিয়ডের সময় বসে থাকে পাঞ্চু? তারা তো ওই নিয়েই কাজ করে।
-বিষয়টা শুধু এটুকুই নয় রে! ধর বাইরে গ্রামে গ্রামে ওরা সে সময় থাকে, তাঁবু করে বা অন্য কোনও উপায়ে যাযবরদের মতো। স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার পয়সা নেই। পুরোনো নোংরা কাপড়। সেসব ধুয়ে শোকাবে কোথায়? অবধারিতভাবে ওই সব আনহাইজিনিক ব্যাপার থেকে নানা গাইনোকোলজিক্যাল রোগ হয়। তখন আবার কাজের থেকে ছুটি, ডাক্তারের খরচ অধিকন্তু!
-এটা অত্যন্ত বর্বরোচিত, পাঞ্চু!
-আমি তো সবচেয়ে বড় কারণটা বলিইনি।
-আরও কারণ আছে নাকি?
-ধর দীর্ঘ ছমাস স্বামীর সাথে সহবাসে বাচ্চা পেটে আসার সম্ভাবনা! শুধু তো স্বামী নয়, দালাল, জোতদারদের দাবী দাওয়াও আছে....। এর থেকে বাবা বাঁশ ও নেই, বাঁশিও বাজবে না।
-আমি জাষ্ট নিতে পারছি না পাঞ্চু। এটা না হয় ওদের দুঃখের কাহিনী, অপরাগতা। তোর জন্য তো এগুলো কোনও কিছুই যুক্তি নয়!
হঠাৎ চোখটা টিপে গলা নরম করে কৃষ্ণা বলল, ‘তুই বাধা দিচ্ছিস কেন? এতে তো তোরই লাভ!’ 
কথাটা বুঝতে না পেরে শান্তনু বলল, ‘আমার লাভ? কীরকম?’ 
-আমি যদ্দুর জানি, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে তোর কোনও ফ্যাসিনেশন নেই! তুই যদি চাস আমি লিভ টুগেদারটা তোর সাথেই করবো। তখন তোর আর কোনও চাপ থাকবে না - যখন খুশী, যেমন খুশী...
শান্তনু রাগে উত্তেজিত হয়ে বলেছিল ‘তোর এসব বিলাসিতা বিলাসদের সাথে করিস কৃষ্ণা। আমার ক্ষমা কর।‘
                                                   (৪)
 শান্তনুর ইউ.এস.এ ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। পরশুদিনই ফ্লাইট। আজ ওরা ঠিক করেছে সারাদিন দুজনে মিলে শুধু ঘুরবে। কলেজ ইউনিভার্সিটির সময়ে যে সব জায়গায় গিয়ে বসতো, সব না হলেও দু-তিনটে জায়গায় তো যাবেই। দুপুরে বারবিকিউ তে বাফেতে খেয়ে দেয়ে সোজা নন্দন চত্বর। সেখান থেকে বাগবাজার অথবা প্রিন্সেপ ঘাট। তারপর বাড়ীতে ফিরে বাড়ীতেই ডিনার। আবার কবে শান্তনু ফিরবে কে জানে?
  আজ একটা নীল রঙের জিন্স এর উপর হলুদ একটা টপ পরেছে কৃষ্ণা। ওকে দেখে শান্তনু বলল, ‘যাক তোকে স্ববেশে দেখেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম। ভাবছিলাম আজও বুঝি শাড়ী পরে আসবি।‘
-রিস্ক নিলাম না রে। ভাবলাম প্রিন্সেপ ঘাট যদি যাই, আর তুই নৌকো চড়ার ফিকির তুলিস – শাড়ীটা হয়তো সামলাতে পারবো না।
-ভালোই করেছিস। চল নন্দনে না গিয়ে এখন বরং দক্ষিণেশ্বর যাই। সেখান থেকে নৌকো চড়ে বেলুড় যাবো। 
-এখন বোধ হয় নৌকো ভাড়া করে যাওয়া যায় না রে শান্তনু। যাবি চল। তবে লঞ্চে যেতে হবে।
-ঠিক আছে, আগে তো খাওয়া দাওয়া সারি।
  সারাদিন ঘুরে টুরে ওরা বাড়ী ফিরে এল তখন সন্ধ্যে সাতটা। টুকটাক রান্না সকালবেলা কাজের মাসীই করে গেছে। কৃষ্ণা এসে চা টা বসিয়েই বাথরুমে ঢুকে গেল। স্নান সেরে বেরোল হাল্কা একটা ছাপা শাড়ী পরে। শান্তনু বলল, এ শাড়ীটায় তোকে বেশ দারুন লাগছে রে! আয়াম অনারড!
-এই ছেচল্লিশ বছর বয়সেও তোর ভালো লাগছে এটাই অনেক। যখন বয়স কম ছিল, তখন তো কই বলতিস না?
-সে সব কথা কি তখন বলার জো ছিল রে পাঞ্চু! বললেই বলতিস যারা রূপের প্রশংসা করে তারা দেহবাদী। তাদের কামুক মন! এরকম আরও কত কী!
-তখন যদি তোর এই বোধ ছিল তো আজকে নেই কেন? আজকেও তো আমি একইরকম ভাবতে পারি!
-তা পারিস। তবে এখন আর এসব কিছু ম্যাটার করে না। তখন তোকে তুষ্ট করাটা দরকার ছিল।
-এতই যদি দরকার ছিল, তবে আমাকে না বলে বিদেশ চলে গেলি কেন?
-‘না বলে’ ব্যাপারটা ঠিক নয়! বিদেশ যাওয়াটা তো শিডিউলডই ছিল। শুধু আমি অ্যাভয়েড করছিলাম তোর কী সিদ্ধান্ত হয় সেসব ভেবে। যেদিন শুনলাম তুই অপারেশনটা করিয়েই নিয়েছিস, সেদিনই চলে যাওয়ার ডিসিশন নিলাম। তুই তখন বড় বেশী একগুঁয়ে আর কট্টর ছিলিস পাঞ্চু!
-জানিস শান্তনু, তখন আমার প্রতিটি স্ত্রী অঙ্গের জন্য আমার নিজের উপর ঘেন্না করতো। আমার মনে হত সবগুলো কেটে বাদ দিয়ে দিই। 
-কেন? এত বিরাগের কারণ কী? 
একটু চুপ করে রইল কৃষ্ণা। তারপর বেশ উদাস গলায় বলল, ‘জানিস তো আমার ছোটবেলায় একটা ঘটনা ঘটেছিল তোদের কাউকে বলা হয়নি। আমার মা  চাকরি করতো! পুরো দুপুর আমি একা বাড়ীতে থাকতাম। আমার একজন প্রাইভেট টিউটর ছিলেন। বছর দুয়েক পড়ানোর পর খেয়াল করলাম, হঠাৎ হঠাৎ করে দুপুরে উনি আসতে শুরু করেছেন। ওনাকে আমার এমনিতেই ভালো লাগতো। সুন্দর, সুপুরুষ। সর্বোপরি এত সুন্দর পড়াতেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতাম। হঠাৎ একদিন দুপুর বেলায় এসে একথা সেকথা বলতে বলতে আমাকে বললেন, চলো একটা বিশেষ খেলা খেলব। খেলবে?
আমি বললাম ‘হ্যাঁ।‘
উনি বললেন, খেলাটা গোপন কিন্তু, কাউকে বলা যাবে না – এটাই শর্ত।
আমি বললাম ‘বেশ’।
তারপর একদিন আমার বেষ্টফ্রেন্ডকে বিষয়টা বলতে সে বললো, ‘সর্বনাশ। এখুনি মাকে বল।’ 
মা সব শুনে ঠাটিয়ে আমার গালে কয়েকটা চড় আর পিঠে রুলের বাড়ি দিয়ে বললেন –  ‘একথা পৃথিবীর আর দ্বিতীয় কোনওজন যেন না জানে!’ সেই টিচারকে তিনি কিছু বললেন না। উনি সেই বছরটা পুরো আমাকে পড়াতে এলেন। শুধু দুপুরে একজন পার্মানেন্ট আয়া ঠিক করা হল বাড়ীতে।
-তুই তখন কোন ক্লাশ?
-সিক্সে পড়ি তখন।
-তোর বাবা জানতেন না?
-জানতে পারতো না। কিন্তু হঠাৎ আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল। বমি হতো খুব। মা ভাবলো হয়তো অন্য কোনও বড় সমস্যা। গাইনোকোলজিষ্ট দেখাতে হবে। অগ্যতা... জানিস শান্তনু, সেই স্মৃতি আমাকে এখনও তাড়া করে।
-কিন্তু পাঞ্চু, এই ধরনের ঘটনা তো আনকমন নয়। প্রচুর ঘটে। তাই বলে কি সব মেয়ে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়? সবাই কি ব্রেষ্ট, ইউটেরাস কাটতে চায়? এই মানসিকতা কি তুই এখন বয়ে বেড়াস?
কৃষ্ণা চুপ করে রইল।
শান্তনু বলল, ‘বুদ্ধদেব বসুর ওই লাইনটা মনে আছে তোর? ওই যে ‘সজ্ঞানে সকৃত কর্ম!’ তুই জেনেশুনেই করেছিস বলে এখনও সেই দায় মাথায় রেখে ‘যা করেছি বেশ করেছি’ মার্কা উত্তর যদি দিস তাহলে বলবো ভুল করছিস।
-জীবনটা কেমন হয়ে গেল রে শান্তনু। বিয়ে করবো না ভেবেইছিলাম, কিন্তু তুই চলে যেতে মনে মনে বড় নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। 
-আমি থাকলেই বা কী হত?
-লিভটুগেদার করতাম। তুই তো বিদেশে গিয়ে খালি বিয়ে আর ডিভোর্স করতেই থাকলি। হাসলো কৃষ্ণা।
-তুই বা সেই চেষ্টা করলি না কেন?
-বাঙালী পুরুষ, কে আর সব জেনেশুনে ওসব করতো বল! আর যারা লিভটুগেদারে রাজী হ’ত, তারা সব দু’দিনের খদ্দের। দেহটা ভোগ হলেই কেটে পড়তো!
-আবার সেই বায়াসড কথাবার্তা! তাহলে আমার সাথেই বা থাকতিস কোন ভরসায়?
-লিভটুগেদার করার জন্য একটা রিলেশন লাগে শান্তনু। সেটাই আর হয়নি কখনো।
-তুই রান্নাবাড়ী কিছু করার থাকলে কর পাঞ্চু! রাত হয়ে গেল তো! বাড়ী যাবো না?
-নাই বা গেলি আজ! থেকে যা না! সেই দীঘার রাতের কথা মনে পড়ে? আমার খুব সেই রাতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে শান্তনু। থাকবি আজ?
শান্তনু উঠে গিয়ে জাপটে জড়িয়ে ধরলো কৃষ্ণাকে। কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে আটকে রাখতে পারবি তো?’

Post a Comment

0 Comments