বার্লিনের ডায়েরি (৬০পর্ব )
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(সিস্টিন চ্যাপেলর পরবর্তী অংশ )
( মাইকেলেঞ্জেলো )
সিস্টিন চ্যাপেলের মিউজিয়ামের এই ভবন টি অভ্যন্তরীন সাজসজ্জার বিবেচনায় পৃথিবীর অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্কন শিল্পের সৌন্দর্য নিকেতন। পশ্চিমী দুনিয়ায় চিত্র শিল্পের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান এই সিস্টিন চ্যাপেল। রঙ তুলি দিয়ে তিনি এঁকেছেন ধর্মগ্রন্থের মতে অবিশ্বাসীদের পরকালের শাস্তিপূর্ণ জীবনের করুণ ছবি। শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর অসাধারণ শৈল্পিক চেতনা দিয়ে গড়ে তোলা অনবদ্য শিল্পকর্ম ! যে সৃষ্টি এতকাল পরে ও শিল্পীর অন্যতম সেরা সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হয়। তাঁর অনুপম সৃষ্টির সাগরে অবগাহন করে ঢেউয়ের দোলায় ভেসে চলেছে শ্রী। ও নির্বাক হয়ে ভাবছিল সেইকবে যাঁর নামের সাথে পরিচয় হয়েছিল ইউরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁ যুগের অন্যতম নায়ক রূপ। আজ কী সৌভাগ্য তারই অনুপম সৃষ্টির বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সমগ্র ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে অনুভূতিতে তার স্পর্শ সুখ উপলব্ধি করছে।
কানে হেডফোনে বাজছে ছবির পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ। এই গীর্জার দেওয়ালে ও ছাদে মূল যে নয়টি দৃশ্য অঙ্কিত আছে তা প্রাচীন হিব্রু ও বাইবেলের চিত্র রূপ।এবং তাঁর এই অসাধারণ সৃষ্টি ফ্রেস্কোগুলো মাত্র সাড়ে চার বছরে আঁকা হয়েছিল। এর অন্যতম কাহিনী সূর্য চন্দ্র এবং আদম ও ইভ এর পৃথিবীর সৃষ্টি ও তাঁদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ন। দি ক্রিয়েশন অফ আদাম এবং দ্য লাস্ট জাজমেন্ট। যে ফ্রেস্কো দুটি -- মূল বিষয় সিস্টিন চ্যাপেলটির সিলিং এবংবেদীতে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ও সেখানে রয়েছে নূহের মহাপ্লাবন ও পরবর্তী কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী। বিশেষতঃ সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের মাঝের অংশটিকে মাইকেলেঞ্জেলোর সৃষ্টি তত্ত্ব বিষয়ক যে নয় টি চিত্র রয়েছে তার প্রথম তিন অধ্যায় (১)ব্রম্মান্ডের উৎপত্তি , (২)মানুষের জন্ম ও (৩)অশুভের আগমন।রঙ তুলির অপরূপ সমন্বয়ে এত নিখুঁত সব দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় বেশীর ভাগ গল্প গাঁথা ভাষা ও ভাবনা যেন আমাদের প্রাত্যহিক পরিচিত জীবনে বোধের সাথে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে আছে। অসংখ্য গল্প বাইবেলীয় জগৎ ও পৌরাণিক কাহিনী মালার থেকে নির্বাচিত অংশ কে অত্যন্ত মর্ম স্পর্শী রূপ দিয়ে শিল্পী চিত্রায়ন করেছেন।
শ্রী ও অদ্রিজা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রথম চিত্রটিতে দেখেছিল ঈশ্বর পৃথিবীর আকাশ থেকে আলো সরিয়ে দিলেন ,এলো তমসাবৃত ঘোর অন্ধকার। এবং ধীরে ধীরে আলো ও আঁধারের পৃথকী করণ ঘটলো। দ্বিতীয় চিত্র তে-- ঈশ্বর তাঁর দুই বাহু প্রসারিত করে সৃষ্টি করলেন সূর্য ও চন্দ্রের। বিশাল ব্রম্মান্ডের বুক জুড়ে আকাশ আলো করে দেখা দিল জ্যোতিষ্ক মন্ডল এবং অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্র রাজি নিয়ে সৌরজগৎ । তৃতীয় চিত্র--টিতে শ্রী দেখেছিল পৃথিবী জল এবং স্থল --এই দুই অংশে বিভক্ত। সৃষ্টি কর্তা ঈশ্বর এই চিত্র টিতে মানবের রূপ ধারণ করেছেন জগতের কল্যানে। তিনি মানবের সাথে একাকার হয়ে মিলে গিয়েছেন। ঈশ্বর সচেষ্ট হয়েছেন আকাশ আলো স্থলে জলে ময় পরিপূর্ন সবুজ শ্যামল পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার করতে।
সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ। সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের চিত্র।
চতুর্থ চিত্র টি তে দেখা গেল সদ্য সৃষ্ট মানব পুরুষের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাহেন্দ্রক্ষণ। মানব জীবন সৃষ্টির বিকাশ তত্ত্বের চিত্রায়নের জন্য " দ্য ক্রিয়েশন অব আদম (the creation of Adam )" --এই অপরূপ শিল্প কর্মটি বারবার দেখেও দেখার আশ মেটে না ,অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে ওরা। পাশে দাঁড়িয়ে শ্রী লক্ষ্য করে ঋষভের মনের অব্যক্ত কথার রাশি চোখের ভাষায় প্রাণময় হয়ে উঠেছিল। .
🍂
শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর (১৫১১ থেকে ১৫১২খ্রীষ্টাব্দ ) আঁকা সেরা ছবির তালিকাতে জগদ্বিখ্যাত একটি অনবদ্য কাজের সামনে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটি ছিল মূলত প্লাস্টার করা কাঁচা দেওয়ালের ওপর গুড়ো রঙ জলে গুলে আঁকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে করুণাময় ঈশ্বরের আদম কে সৃষ্টি করছেন শুধু মাত্র আদমের আঙুলের স্পর্শের মাধ্যমে। শ্রীর মনে পড়ে মিউজিয়াম হল থেকে বাইরে বেরিয়ে ঋষভ বলেছিল ,মাইকেলেঞ্জেলোর জীবনীকার জর্জিও ভাসারির লেখায় পড়েছিলাম ,"মাইকেলেঞ্জেলো যে শৈল্পিক এবং জীবন দর্শনের সূচনা করেছিলেন তা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে প্রবহমান ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্পের জন্মহয় চেতনার অন্তর্লোকে। প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।" তাঁর আঁকা ফ্রেস্কো প্যানেলের নয় টি ছবির তালিকায় এই ছবিটি অবশ্য চার নম্বর ছিল। যেখানে স্রষ্টা তাঁর নিজের মত করেই মানুষ কে গড়েছেন।
শ্রী র মনে পড়ে এই ফ্রেস্কো চিত্রে ও দেখেছিল জন্মেই ঈশ্বর সৃষ্ট আদম এক সুপুরুষ বলিষ্ঠ চেহারার অধিকারী। ঈশ্বর কে দেখানো হয়েছে লম্বা চুল দাড়িতে মন্ডিত মানুষের চেহারাতে। তিনি ডান হাত টি বাড়িয়েছেন আদমের দিকে আর নগ্ন আদম ঠিক একই ভাবে ঈশ্বরের দিকে প্রসারিত করেছেন তাঁর বাম হাত টি। হল থেকে বাইরে বেরিয়ে ঋষভ কে উদ্দেশ্য করে শ্রী বলে ,আমার মনে হয় , শিল্পী যেন বলতে চাইছেন '' দু জনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের একই ভাবের চিত্রটিতে পরস্পর আঙ্গুল স্পর্শ না করার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের দ্বারা অন্তহীন প্রাণের বিকাশ তীর্থে যাত্রার স্পন্দন সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। এবং আদমের গ্রহণ করার দৃশ্যটি সৃষ্টি তত্ত্বের এক অপরূপ অনিন্দ্য সুন্দর প্রকাশ। '' ঋষভ সম্মতি জানিয়ে বলে দেখতে ছবিটির অপরূপ নিবেদনে আমার মনে ও ঠিক এই ধারণা হয়েছিল ।
পঞ্চম ছবিটিতে মমতাময় ঈশ্বরের প্রসারিত অভয় দানের হাত টির দিকে ঈভ কে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখাগেল। আদমের পর আদি মানবী ঈভের সৃষ্টি ,'দ্য ক্রিয়েশন অফ ঈভ।' শিল্পী তাঁর সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে প্রাণশক্তি উজাড় করে ঘুমন্ত আদমের পাশ থেকে ঈভ কে আঁকলেন- - ,(the creation of Eve ) .ঈভ সৃষ্টিকর্তার সামনে করজোড়ে আনত নয়ানে।
আদম এর জন্ম
অদ্রিজা সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ঘাড় হেলিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে একের পর এক ছবি দেখে চলতে চলতে বলে ঘাড় ব্যথা হয়ে গিয়েছে,তবুও আমি সব ছবি পর্যবেক্ষণ করে দেখবো এবং বিশ্লেষণ ও শুনবো।ও নিবিষ্ট চিত্তে একটি ছবিতেই তাকিয়ে থাকে। ঋষভ ইশারায় শ্রী কে ষষ্ঠ তম ছবিটি দেখতে বলে -- "দ্য ফল অফ ম্যান আন্ড দ্য এক্সপ্যালসন ফ্রম প্যারাডাইস। " একই ছবির ডানদিকে আদম ও ঈভের নিষিদ্ধ ফল সেবন। বামদিকে তাদের স্বর্গ থেকে বিদায় দিয়ে মর্তে নির্বাসন মানব মানবী রূপে। সৃষ্টি কর্তা আদম ও ঈভকে স্বর্গোদ্যানের সর্বত্র গমনের ছাড়পত্র দিলেও জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার অনুমতি দেন নি। এই ফ্রেস্কো চিত্রে একসাথে দুটো ঘটনা দেখানো হয়েছে। চিত্রের কেন্দ্রস্থলে জ্ঞানবৃক্ষ রোপিত রয়েছে এবং তাতে আশ্রিত সর্পরূপী শয়তানের বাস। তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে আদম ও ঈভের নিষিদ্ধ জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়া অর্থাৎ নিষ্পাপ চরিত্রে পাপের প্রবেশের কারণে শাস্তি স্বরূপ দেবদূতেরা তাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলেন। শ্রী ডায়েরিতে নোট করেছিল এ যেন ঠিক আমাদের প্রচলিত পৌরানিক উপাখ্যানে গাঁথা কাহিনীর মত।
সপ্তম চিত্র টি তে ছিল নোয়াহের আত্মোৎসর্গ । এখানে নোয়াহো তাঁর পত্নী ,ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসব শেষে মেষ বলি দিতে চলেছেন। ছবিতে পিছনের দিকে খোঁয়াড়ে মেষ মহিষ ও ঘোড়ার সব গৃহপালিত প্রাণী দের সমাবেশের চিত্র আঁকা রয়েছে। ছবিটিতে কেউ বা চুল্লির আগুন ফুঁ দিয়ে বর্দ্ধিত করছে কেউ বা আগুনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের জোগার করতে ব্যস্ত কেউ বা অগ্নিতে প্রদানের জন্য মাংস সংগ্রহে উৎসাহী। দুই পাশে দুই ক্রীড়া বিদ তাদের হাতে লাল ফিতেয় বাঁধা পদক ঝুলছে। বেশ একটি চলমান জন জীবনের সামাজিক চিত্র। যেন সেকালের নিপুন এক গার্হস্থ্য উৎসবের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে ।
এরপর অষ্টম চিত্র "দ্য গ্রেট ফ্লাড" --প্রকৃতির খেয়ালে বানভাসি মানুষের জীবনের দুর্বিষহ পরিণতি। ভয়ঙ্কর প্লাবনে সৃষ্টি ও প্রলয়ের সম্মুখীন হয়ে জীবনে বেঁচে থাকার অদম্য সংগ্রাম। ডুবন্ত মানুষ লড়াই করছে সামান্য সম্বল টুকু আঁকড়ে ধরে। মাকে জাপ্টে ধরে শিশুটির ভেসে থাকছে জলের ওপর। প্রতিকূল অবস্থায় প্লাবিত অঞ্চলে ভেসে মা শিশুর প্রাণপণ বাঁচার লড়াই। যুবকের পিঠে তার অসমর্থ পিতা। কেউ ডুবে যাচ্ছেন , কেউ বা হেলে পড়া গাছের ডালে আশ্রয় নিয়েছেন কেউবা অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে। জল ক্রমশ বর্ধিত হয়ে বিপদ সীমা ছাড়িয়ে উত্তাল বেগে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মৃত্যুভয়ে ভীত আতঙ্ক গ্রস্থ মানুষের বাঁচার লড়াই। এই বিপর্যয়ের বাস্তব চিত্রটি আজকের আধুনিক পৃথিবীতে ও অত্যন্ত এক পরিচিত দৃশ্য।
আরেকটি দৃশ্যে ছিল মেডিটেরিয়ান সাগরের জল বহুগর্জনে অসহায় ক্ষুদ্র দ্বীপ গুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। মাইকেলেঞ্জেলো এঁকেছেন তাঁর নায়ক নোওয়ার নৌকা শান্ত জলে একপাশে দাঁড়িয়ে ত্রাণের আশায় অপেক্ষমান। বন্যা প্রাকৃতিক দূর্যোগ এরপর শান্ত হয়ে গেলে আবার জীবন জেগে উঠেছে । কিন্তু সমস্যা জর্জড়িত পৃথিবী তে শান্তি কোথায় ? সিরিজের শেষ ছবির কাছে শ্রী এসেছে--' ড্রাঙ্কেননেস অফ নোওয়া'। প্লাবন থেমে গিয়েছে নোওয়া এবার চাষের কাজে কঠিন পরিশ্রমে রত। গভীর মনোযোগ দিয়েছেন আঙ্গুরের ক্ষেতে ফসল ফলনে। এরপর সেই আঙুরের মদিরা সেবনের ফলে নেশাগ্রস্থ সুরা পাত্রের পাশে নোওয়াকে বিবস্ত্র অবস্থায় আবিষ্কার করেছেন তারই পুত্ররা। সে এখন পুত্র দের নিকট উপহাসের পাত্র অসম্মানিত। সাময়িক ভাবে মত্ততার কারণে ঈশ্বর কে বিস্মৃত হলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্ত ব্যক্তি ও সকলের চোখে উপহাসের যোগ্য অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠে। রঙ তুলিতে আঁকা ছবি--- তার অনুপম তুলির টানে হাতের কুশলী জাদুতে ফুটিয়ে তুলেছেন অসংখ্য গল্প অনুভূতি আর ঘটনার প্রবাহ।
মাইকেলেঞ্জেলোর বেশীর ভাগ ছবিতে দেখা যায় প্রচলিত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এক যুগান্তকারী শিল্পের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। মানবআত্মার পুনরুত্থান তাঁদের কৃতকর্মের ফল ভোগের দৃশ্য নিখুঁত পরিকল্পিত ভাবে এঁকেছেন উপাসনা মঞ্চের পিছনে বিরাট দেওয়ালটি প্রায় ৫০০০ স্কোয়্যার ফুট জোড়া এই ফ্রেস্কো টিতে --মাইকেলেন্জেলোর বিখ্যাত বিতর্কিত সৃষ্টি "দ্য লাস্ট জাজমেন্ট"। শ্রীময়ী এবারে ছাদের দিক থেকে ঘাড় মাথা নামিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকায়। এই ফ্রেস্কোটির উচ্চতায় ৪৫ ফিট ও প্রস্থ প্রায় ৪০ ফিট, শোনাযায় এই কাজটি শেষ করতে তাঁর নয় বছর সময় লেগেছিল। সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের ছবি আঁকা শেষ করার ২৫ বছর পর তিনি এই দেওয়াল চিত্র আঁকায় মননিবেশ করেছিলেন।
(ক্রমশ)
0 Comments