জ্বলদর্চি

ন্যালাখ্যাপা /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

ন্যালাখ্যাপা

পুলককান্তি কর 

 দিন দিন নিজের উপর ঘেন্না ধরে যাচ্ছে বদ্রীপ্রসাদের। এই মাছের কাঁটার লোকজন সবাই তাকে মান্যগণ্য করে। সবাই মনে করে এমন সজ্জন ব্যবসায়ী এই সারা কালীনগর বাজারে আর কেউ নেই। এক কথার মানুষ সে। লোকজনকে ঠকানো তার ধাতে নেই। বরং মানুষের বিপদে আপদে তার মতো কেউ এগিয়ে আসে না। টাকা পয়সা নিয়ে তাদের জাতি তুলে বাঙালীরা যতই ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করুক না কেন, বদ্রীপ্রসাদ কিন্তু যথেষ্ঠ হাত খোলা। এটা ঠিক যে সে পিতৃবাক্য অবজ্ঞা করে না। ওর বাপুজী বলে গেছিলেন ‘বেটা আনেবালা লছমী কো কভি নেহি পুছনা, লেকিন যানে বালী লছমীজী কো ‘শ’ বার পুছনা’। তাই বলে কঞ্জুসী সে করে না। মানুষজনের অভাব অভিযোগে লছমীজীকে ঘর থেকে বার করা তার কাছে ‘জায়জ’ই মনে হয়। 

  সমস্যাটা হচ্ছে কাজলকে নিয়ে। আজকাল কাজলকে দেখলেই বুকের রক্তটা তার ছলকে উঠতে চাইছে। শিরার গতিকে কিছুতেই মনে মনে জব্দ করতে পারছে না সে। আড়ত থেকে ওদের বাড়ীটা কাছেই। এমনি সকালে দুবার, বিকেলে একবার কার্ত্তিককে দিয়ে চা-বিষ্কুট পাঠিয়ে দেয় কাজল, তবু দিনে কোনও একবার ওর দেখাটা না পেলে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কথায় কথায় ওর বাড়ী যাওয়াটাও ভালো দেখায় না সে জানে, তবু কী আর করা! ওর বর কার্ত্তিক সাদা সিদে মানুষ! সে কি আর বোঝে, কত্তাবাবুর মনে কী চলছে! সে না বুঝেই বলে, চলেন কত্তাবাবু আমাদের বাড়ীতে আজ একটু পায়ের ধূলো দিয়ে আসেন!

-রোজ রোজ আর কী পায়ের ধূলো দেবো কার্ত্তিক? আজ নয়, আরেকদিন যাবো।

-চলেন না কত্তাবাবু। আজ আপনার বৌমাকে বলেছি আপনার জন্যে ভালো করে পকোড়ি ভাজতে!

বদ্রীপ্রসাদের জন্য এর থেকে ভালো মওকা আর কী হতে পারে। সে তার ক্যাশবাক্স থেকে একশ টাকা বের করে বলে ‘নিয়ে যা। বেসন তেল কিনে  ঘরে নিয়ে যাস’।

বদ্রীপ্রসাদের বাংলা একেবারেই পরিষ্কার। প্রায় পাঁচপুরুষের বাস ওদের এই বাংলায়। এখানেই লেখা পড়া, বেড়ে ওঠা। ওরা বসিরহাট শহরেই বাড়ী করে আছে। মাছের আড়ৎ করে সে সকাল বেলা। তারপর চিংড়ি আর কাঁকড়ার ব্যবসা চলে দিনভর। এগুলোর খুচরো বা পাইকারী বিক্রি নিয়ে ওরা এত মাথা ঘামায় না। মূলতই এক্সপোর্ট হয়। সেই নিয়েই সারাদিন মাথা ব্যাথা থাকে। ট্রাকে লোডিং, এয়ারপোর্টের ব্রোকারদের সাথে কথাবার্তা চালানো, ব্যাঙ্ক ট্যাঙ্কের কাজ – সব নিয়েই সারাদিনের ব্যস্ততা।

  কার্ত্তিক টাকাটা নিতে দোনামোনা করছে দেখে বদ্রীপ্রসাদ বলল, ‘আরে ধর, নিয়ে যা’।

-কেন মিছিমিছি দিচ্ছেন কত্তাবাবু। আপনার আশীর্বাদে এটুকু আছে আমার। অতিথি থেকে কেউ পয়সা নেয়, বলেন?

-অতিথি বলে ভাবছিস কেন? ঘরের লোকই ভাব না, তাহলে সমস্যা থাকে না। নে ধর।

কার্ত্তিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও টাকাটা নিয়ে বলল, ’কত্তাবাবু বউ জানতে পারলে বকবে!’

-জানানোর দরকার কি? 

-ও তো আমাকে এগুলো কিনতে বলেনি! আমি নিজে থেকে নিয়ে উপস্থিত হলে জিজ্ঞাসা তো করবেই! আমার তো অত বুদ্ধি নেই!

-ঠিক আছে, তুই নিয়ে গিয়ে বলিস, কত্তাবাবু নিজে থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাহলে আর তোকে কিছু বলবে না।


🍂

-তাই বলব গিয়ে!

-তুই এবার একটু চালাক চতুর হ’ কাত্তিক। নইলে তুই  এই সংসারে টিকে থাকবি কী করে?

-চাইলেই কী চালাক হওয়া যায় কত্তাবাবু? আমার বউও একথা প্রায়ই বলে! তবে ভগবান আমাকে যখন একটু বুদ্ধু বানিয়েই পাঠিয়েছেন, আমি আর খোদকারী করি কী করে?

-এটা ঠিক কথা বলেছিস তুই। তবে কিনা একটু চোখ কান খোলা রাখ। দেখিস লোকে যেন তোকে ঠকাতে না পারে।

-কত্তাবাবু, আপনিই তো বলেন, যে ঠকায় সে নিজে ঠকে! আমাকে ঠকিয়ে আর কার কী লাভ!

  বদ্রীপ্রসাদ আর এই বেকার বাক্যব্যয়ে মন না দিয়ে মোবাইলটা তুলে কথা বলতে শুরু করল। কার্ত্তিকের ঘরের বাজার হাট সব কাজলই করে। কিন্তু গত দু-দিন ওকে বাজার চত্বরে না দেখে বদ্রীপ্রসাদের মনটা এমনিতেই ছটফট করছিল। কিছু কি হয়েছে? ইদানীং বাজারে এলে কাজল কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওর দোকানে আসে। এটা ওটা কথা বলে যায় ওর সাথে। কার্ত্তিকের জন্য কিছু নির্দেশও থাকে। কাজল নিজে কি কিছু বুঝতে পারছে ওর দুর্বলতার কথা? খারাপ লাগে! চিন্তাও হয় নিজের ভাবমূর্তির কথা ভেবে। তারই কর্মচারীর স্ত্রী মানে একঅর্থে তারই আশ্রিতা। তার প্রতি কোনও প্রকার কুনজর দেওয়া মানে সাঙ্ঘাতিক কু-কার্য! তবে কিনা বদ্রীপ্রসাদ নিজেকে কোনওভাবেই আটকাতে পারছে না। ওর কোষ্ঠীতে আছে - এই বয়সে নাকি কোন গ্রহের সাথে কোন গ্রহের ফেরে মনে সাঙ্ঘাতিক চঞ্চলতা আসবে। তার প্রতিকারের জন্য মুক্তো টুক্তো পরার বিধানও দিয়েছে এক জ্যোতিষ। কদিন ধরেই সে ভাবছে, একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নিয়ে একটা মুক্তো ধারণই করে ফেলবে সে। একদিন এক ডাক্তারকেও কথাচ্ছলে বলেছিল কথাটা। উনি বলেছিলেন, বয়স কত আপনার?

-চুয়ান্ন।

-একটা ইউ.এস.জি করিয়ে নিন। অনেক সময় পৌরুষ গ্রন্থি বাড়লে এইধরনের কামোন্মাদনা বাড়ে!

-পৌরুষ গ্রন্থি কী, ডাক্তারবাবু?

-প্রোটেষ্ট এর নাম শুনেছেন?

-আজ্ঞে হ্যাঁ।

-ওটাই। এনলার্জড প্রষ্টেট হয়েছে কিনা দেখুন। 

ইউ.এস.জি তে এরকম কোনও সমস্যা নেই তার। একটু সুগার আর কোলেষ্টেরল তার বাড়া আছে ঠিকই, তবে কিনা এদুটো ওদের খানদানি বিমারি। সঙ্গে আছে, সঙ্গেই যাবে। টুকটাক নিয়ম টিয়ম আর দু-দফায় চারটি ওষুধ খেতে হয় তাকে। সামনের সপ্তাহে কলকাতা যাওয়া আছে। এবার নিশ্চিত মুক্তোটা পরে নেবে সে! এগারো রতি ধারণ করতে বলেছিল জ্যোতিষ! আচ্ছা মানসিক চাঞ্চল্য কমে গেলে কাজল কি আর আকর্ষণ করবে না তাকে? সে কি এমন ব্যাকূল হয়ে সারদিন অন্তত একবার ওকে দেখার জন্য আর মুখিয়ে থাকবে না? তেমন দিনের কথা ভাবতেও মনের ভেতর একটা শূন্যতা টের পেল সে! বাজার থেকে ফেরার পথে সে তিনটি কাঠি আইসক্রীম কিনলো। কাজল কাঠি আইসক্রীম খেতে খুব ভালোবাসে। দোকানদারকে বলল, ‘রঘুয়া, একটা ছোট আইসপ্যাকে দিয়ে দে আইসক্রীম গুলোয়। একটু বাদে কার্ত্তিক এসে তোর বাক্স ফিরিয়ে দেবে।‘ 

  ওকে দরজার সামনে দেখে কাজল বলল, ‘আসুন দাদা, ভেতরে আসুন।‘

বদ্রীপ্রসাদ হাতের আইসক্রীমগুলো কাজলের হাতে দিয়ে বলল, ‘এখন চা চড়িও না, আগে এগুলোর সদগতি কর।‘

-তিনটে এনেছেন কেন?

-আমাকে বাদ দিচ্ছ নাকি? 

-না, না, আপনি আর আমি দুজন তো! 

-আমি ভাবলাম, আমার সুগার বলে আমাকে বাদ দিচ্ছ। তিন নম্বরটা কার্ত্তিকের।

-ও তো দোকানে। আসেনি তো! 

-ওঃ হো। একেবারে ভুলে গেছি। ঠিক আছে ওটা তুমি বাক্সে তুলে রেখে দাও। ঠিক থাকবে। আমি ফিরে গিয়েই ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। 

-ও তো আজ আপনার জন্য পকোড়া ভাজতে বলে গেছিল। আমি পেঁয়াজ টেঁয়াজ কেটে সব রেডী করে রেখেছি। আপনি আগে কি ওটা খাবেন? গরম ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!

-না। আগে আইসক্রীমটাই দাও। একটু পরে পকোড়া খাওয়া যাবে।

-ভাজতে টাইম তো একটু লাগবে। আপনার সময় আছে তো?

-হ্যাঁ। চিন্তা করো না। ঘন্টাখানেক থাকতে পারবো তোমার এখানে। 

কাজল ঘরের ভেতর চলে গেল। কত বয়স হবে কাজলের? পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের বেশী তো মনে হয়না। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ। মুখখানি টলটলে, বেশ মায়াদার। কার্ত্তিকের বউ বলে মানায় না। এর লেখাপড়াও কার্ত্তিকের চেয়ে বেশী। পাস গ্র্যাজুয়েট। কার্ত্তিক তো হায়ার সেকেন্ডারী পাশ। আজকাল কাজল টুকটুক করে নিজের গল্প বলে। যতটুকু বোঝা যায় ওদের বাড়ীর অবস্থা ভালো ছিল না। কার্ত্তিকদের বাড়ীর অবস্থা তুলনায় ভালো। পড়াশুনো বিশেষ করেনি ঠিক, কিন্তু পৈতৃক জায়গা জমি অনেক আছে। কিছু একটা কাজে না থাকলে কেমন লাগে, তাই বদ্রীপ্রসাদের দোকানে ম্যানেজার টাইপের কাজ করে। নির্দিষ্ট কোনও কাজ নয়! হিসেব পত্র লেখা, ব্যাঙ্কে যাওয়া, টাকা পয়সার লেজার মেলানো এইসব। একটু ও বোকাসোকা বলে লোকে ওর পেছনে লাগে। কিন্তু ছেলেটা খারাপ নয়। সৎ। খানিকক্ষণ পরে একটা প্লেটে আইসক্রীমটা নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো কাজল। ‘আপনি তো কেশর পিস্তা আনতেন! আজ কুলফী ফ্লেভার আনলেন যে!’

-খাও না! সেদিন আমি টেষ্ট করে দেখলাম। বেশ ভালো করেছে খেতে।

-আপনি কি প্রায় আইসক্রীম সাঁটিয়ে দিচ্ছেন নাকি?

-না, না।

-আপনি কি ভুলে গেছেন, গত বছর এইরকম সময়ে আপনার সুগার বেড়ে গিয়ে আপনি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন? আপনাকে হসপিটালে ভর্ত্তি করতে হয়েছিল।

-আজকাল নিয়মে থাকি কাজল। নিয়ম করে ওষুধ খাই। মাঝে মাঝেই রক্তপরীক্ষা করাই। তুমি চিন্তা করো  না।

বদ্রীপ্রসাদের মনে খুশীর একটা হাওয়া বয়ে গেল। কাজল ওর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করে তাহলে! মন থেকেই তো বললো মনে হল। বানানো, ফর্মালিটির কথা নয়।

 কিছুক্ষণ পরে বদ্রীপ্রসাদ বলল, ‘কার্ত্তিক আগামী সপ্তাহে একবার কলকাতা গিয়ে ডাক্তার দেখাবে বলছিল। ওর তো দেখি তেমন কিছু সমস্যা নেই! তবে কি তোমার কোন সমস্যা...

  কাজলের হঠাৎ চোখমুখটা লাল হয়ে গেল। মাথা নীচু করে বললো, ‘ছাড়ুন ওর কথা!’

-না, না, ছাড়বো কেন? তোমার কি কোনও কিছু অসুখ করেছে?

লাজুক হেসে মাথা নাড়লো কাজল। বদ্রীপ্রসাদ বুঝলো হয়তো গোপন কোনও স্ত্রীরোগ; কাজল বলতে সংকোচ করছে। বলল, ‘ঠিক আছে, তোমায় বলতে হবে না। তোমার এই নিয়ে সংকোচ করারও দরকার নেই। তবে এক কাজ করতে পারো। আগামী সপ্তাহে আমারও কলকাতা যাওয়া দরকার। তেমন হলে একদিনেই যাওয়া যেতে পারে। এই গরমে তোমাদের আর এতখানি কষ্ট করতে হবে না। আমার গাড়ীতেই চলে যেও।‘ 

এইবার বেশ স্পষ্ট গলায় কাজল বলল, ‘আমি যাবো না।‘

-কেন? ডাক্তার দেখাবে, এতে অসুবিধা কি?

-ওর কথা ছাড়ুন তো দাদা। অন্যের কথা শুনে লাফায়!

-এতে লাফানোর কী হল কাজল! সমস্যা কিছু হলে ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়াটাই তো ভালো!

-সমস্যা আর কি? ইদানীং মাথার পোকা নড়েছে! বাচ্চা চাই!

-তাতে অন্যায় কি? দেখিয়ে এসো।

-ও গিয়েও কিছু লাভ নেই দাদা। আমি জানি সমস্যাটা কোথায়!

-বেশ তো! সেটাও তো দূর করার দরকার।

-তার জন্য আমার উজিয়ে যাবার তো কিছু নেই। ও যাক না।

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস আসতে চাইল বদ্রীপ্রসাদের। অনেক কষ্টে সে হালকা করল তাকে। বিবাহিত দম্পতি যখন, সবকিছু তো তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। আজকে আর কাজলের সাথে গল্প করার ইচ্ছে হচ্ছে না তার। পকোড়া খেয়েই উঠে পড়ল সে।

(২) 

  বেশ কয়েকদিন আর কার্ত্তিকের বাড়ীর পথ মাড়ালো না বদ্রীপ্রসাদ। অবশ্য কাজল রুটিন করে সকালে আর বিকেলের চা পাঠিয়ে দিয়েছে। বাজার আসার পথে দু-একবার ঢুঁ ও মেরে গেছে সে। বদ্রীপ্রসাদ নিজেকে জোর করে কাজলের কথা ভাবা থেকে নিরস্ত করার জন্য বিভিন্ন কাজে মন দেবার চেষ্টা করছে। আজ সকাল থেকে আড়তে খুব ভিড় ছিল। কার্ত্তিকও আজ নেই, আগে থেকেই বলে রেখেছিল; আজ ওর কলকাতায় যাবার কথা। অনেকক্ষণ থেকে মনটা চা-চা করছিল, ভাবছিল ছোটুকে বাজারে চা আনতে পাঠাবে কিনা, এমন সময় দেখল কাজল আসছে। ওর সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফ্লাষ্কটা রেখে চা ঢালতে ঢালতে সে একবার আলতো করে দেখে নিল বদ্রীপ্রসাদকে। বলল, ‘আজ একটু আসতে দেরী হয়ে গেল দাদা, আসলে সকালে উঠে ওর জন্য সব গুছিয়ে টুছিয়ে দিতে হল, খাবার বানালাম!’ 

-তা তুমি গেলে না?

-আমি যাবো না, একথা তো আগেই বলেছিলাম!

-ওঃ। আমি ভাবছিলাম তুমিও গেছো বুঝি!

  কাজল চুপ করে রইল। বদ্রীপ্রসাদের চা খাওয়া হয়ে যেতে বলল, ‘এবার আমি যাই?’

-যাও।

-বিকেলে কি আমি চা নিয়ে আসবো? নাকি আপনি যাবেন?

-তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না কাজল। আজ আমি এখানেই চা খেয়ে নেবো।

-আমাদের বাড়ীর বেলগাছ থেকে আজ সকালেই ক’টা পাকা বেল কুড়িয়েছি। আপনি আসুন, বেলপানা করে রাখবো।

  বদ্রীপ্রসাদের মনে আর কোনও দ্বিধা রইল না। কাজল আন্তরিক ভাবে ডাকছে যখন, ওকে কি না বলা যায়! সর্বোপরি ওর যাওয়ার ইচ্ছা তো ষোল আনা। বিশেষ করে আজ কাজল কলকাতা না যাওয়ায় কোনও এক অজানা কারণে তার মনের মেঘ কেটে গেল হঠাৎ ই! এক ঝলক খুশির রোদ এসে ওর এতদিনের মনখারাপকে যেন এক নিমেষে মুছে দিল। ও বলল, তাহলে একটু তাড়াতাড়ি যাবো কাজল! বেলটেল খেয়ে তো সঙ্গে সঙ্গে চা খাওয়া যায় না! কিন্তু বেলের চক্করে তোমার হাতের চা আমি মিস করতে চাইনা একবেলা।

-বেশ তো আসুন। আমি তো দুপুরে শুই না।

-না, না, এত দুপুরেও যাবো না। চারটে নাগাদ যাবো।

  আজ পুরো দিনটা যেন হাওয়ায় উড়তে লাগলো বদ্রীপ্রসাদ। কোথাও কি কাজলের মনেও ওর প্রতি প্রশয়ের আভাস পাওয়া গেল? থাকগে, এত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খুশীর বারোটা বাজিয়ে লাভ নেই। আপাতত বর্তমানেই বাঁচা যাক! ঠিক চারটেতে বদ্রীপ্রসাদ এসে হাজির হল ওদের বাড়ীতে। এই গরমের দুপুরে তেমন কাজ থাকে না। আজকের যতটা আপলোডিং ছিল, সব দুটো আড়াইটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। দোকানে ছোটু আছে। টুকটাক কিছু ও সামলে নিতে পারবে। একটু পরেই বেলের সরবৎ হাতে করে ওর পাশে এসে বসল কাজল। এতক্ষণ জল ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। হাতের আঙুল আর কব্জিতে বিন্দু বিন্দু জল ঠিক যেন পদ্মপাতার উপর জলের মত টলটল করছে। কাজল শাড়ীর আঁচলটায় হাত টা মুছতে যেতেই বদ্রীপ্রসাদের নজরে পড়লো, কাজলের ঠিক মনিবন্ধের উপর একটা ফোস্কার দাগ। আঙুলগুলো দেখে অনেকক্ষণই বদ্রীপ্রসাদের মনটা টাট্টুঘোড়ার মতো লাফাচ্ছিল, এটা দেখে সে একটা বাহানা পেয়ে গেল। নিজের তর্জনীটা ফোষ্কার উপর আলতো করে ছুঁয়ে বলল, এটা কী করে হল?

-সকালে তাড়াহুড়োয় মাছের তেল ছিটকে গেছে!

-বার্ণল লাগাওনি?

-বার্ণল ছিল না ঘরে। কোলগেট পেষ্ট লাগিয়ে দিয়েছিলাম তখন।

-খুব জ্বালা করছে বুঝি?

-ওঃ কিছু না দাদা। এ প্রায়ই হয়। মেয়েদের এসব গা সওয়া!

-কেন? সাবধানে থাকো না বুঝি?

-এত কি আর সাবধানে থাকা যায় দাদা! এ তো এক সেকেন্ডের ভুল! ভাগ্যিস বেশী দিন এর দাম চোকাতে হয় না।

বদ্রীপ্রসাদ কথাটার কী অর্থ করল, বোঝা গেল না। কাজল তাড়া দিল, ‘খেয়ে নিন দাদা! গরম হয়ে যাবে তো!’

খেয়ে গ্লাসটা এমনভাবে বাড়ালো বদ্রীপ্রসাদ যাতে কাজলের আঙ্গুলের সাথে ওর ছোঁয়া লাগে! বলল, ‘খুবই ভালো হয়েছে কাজল! সত্যি তুমি কত গুণী! সঠিক জায়গায় থাকলে আর ভালো সুযোগ পেলে তোমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো!

-কী আর এমন গুণ দেখলেন আমার!

-গুণ তো অনেক! কোনটা ধরি আর কোনটা ছাড়ি!

-তাও বলুন দু-একটা। শুনে তো দেখি, সত্যি সত্যি সেগুলো গুণ কিনা!

-এই ধরো, ‘চা’। তুমি এমন চা বানাও, মনে হয় যেন শিল্প!

-দাদা এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। চা বানানোটাকে আজ পর্যন্ত কেউ গুণের তালিকায় ঢুকিয়েছে বলে আমার শোনা নেই।  

-এগুলো তো ছোটোখাটো। তোমার অভিনয় প্রতিভার কথাটা তো বলাই হয়নি!

-আমি বুঝি লোকজনের সাথে ভালো অভিনয় করি, দাদা?

-অভিনয় শিল্পের কথা বলছি কাজল! এমনিতে তুমি খুব ভালো মনের মানুষ।

কাজল কিছু না বলে হাসলো। বদ্রীপ্রসাদ উৎসাহ পেয়ে বলল, আমি তো নিজের মনে মনে সবসময় বলি – কাজল, তোমার মতো ভালো মনের মেয়ে হয় না!

-আপনি তার পরিচয় পেলেন কী করে দাদা?

-ফুল কি তার সুগন্ধ লুকিয়ে রাখতে পারে কাজল? আর অভিনয়টা তুমি সত্যি বড় ভালো করো। গতবারেই কি তুমি প্রথম অভিনয়টা করলে?

-না। কলেজে থাকতে আমি দুবার নাটক করেছি। প্রথমটা ছিল শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’। ওটা সফল হল বলে  পরের বছর আমাকে দিয়ে স্যার ম্যাডামরা রক্তকরবীও তুলিয়েছিলেন। সবাই খুব প্রশংসাও করেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কাজল।

  বদ্রীপ্রসাদ মনে মনে বলল, এই অভিনয়টাই তো যতকিছুর মূল! প্রতিবছর ওদের বাজার কমিটি থেকে কালীপূজর পরের রাতে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। গত তিনবছর ধরে ওরা নিজেরা সেখানে যাত্রা-নাটক করে। বদ্রীপ্রসাদ বড় ব্যবসায়ী, সুতরাং তার একটা প্রধান রোল বাঁধাই থাকে। গতবছরে কাজল ছিল প্রধান অভিনেত্রী। যাত্রাপালার নাম ছিল ‘বিকেলে ভোরের ফুল’। এটা উত্তমকুমার-সুমিত্রা মুখার্জীর ফিল্মটার গল্প নিয়ে নয়। এক অকাল বিধবার জীবনের নানান দুর্বিসহ অবস্থা থেকে উত্তরণের গল্প। কাজল ছিল ওই বিধবার রোলে। বদ্রীপ্রসাদ সেজেছিল কলকাতার এক মান্যগণ্য প্রৌঢ় ব্যবসায়ী। পাকে চক্রে ওই বিধবা এসে আশ্রয় পেয়েছিল ঐ প্রৌঢ় ব্যবসায়ীর ঘরে। সে অবিবাহিত ছিল। রান্না করা, বাসন মাজা থেকে কী করে ধীরে ধীরে সে ওই ব্যবসায়ীর মনের মানুষ হয়ে উঠেছিল – গল্পটা এই নিয়ে। শেষ দৃশ্যে যখন ওই ব্যবসায়ী হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, তখন মেয়েটি যেভাবে এসে ওর বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে - তা অনেককে ওথেলো ডেসডিমোনার গল্পকে মনে করিয়েছিল। রিহার্সালে একটু বাধো বাধো ছিল, কিন্তু আসল দিনে মঞ্চের উপর কাজল এমনভাবে বদ্রীপ্রসাদের বুকে লুটিয়ে পড়েছিল –  সেদিন থেকেই যত বিপত্তি! স্ত্রী দেহ এত নরম! এত তুলতুলে দেহলতা! তার মনে হল, এ অভিনয় নয়! এ সত্যি সত্যি হয়তো জন্মান্তরের গল্প। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস এসে বাসা বাঁধল, কাজলের সাথে তার সম্পর্ক এক জীবনের নয়! সেই থেকে তার শান্তি নেই। সে সেই নরম তুলোর আশায় দিন শুরু করে এখন প্রতিদিন। বদ্রীপ্রসাদ বলল, ‘অভিনয় শিখবে?’

-কোথায়? 

-কলকাতায়! পেপারে বিজ্ঞাপন দেখি তো, বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয়ের তালিম দেন; পরে বিভিন্ন জায়গায় সুযোগ দেওয়ার কথাও লেখা থাকে তাতে!

-সে সম্ভব নয় দাদা!

-কেন সম্ভব নয়? কার্ত্তিক ভালো ছেলে - ও বাধা দেবে বলে তো মনে হয় না!

-থাক না দাদা। যে স্বপ্ন নিজে দেখতে সাহস পাইনা, তাকে আর উসকে লাভ কী? এই জীবনও তো নাটকের ষ্টেজ! ঠিকঠাক মতো চালিয়ে তো যাচ্ছি!

  বদ্রীপ্রসাদ চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ কেউই কথা বলছে না দেখে কাজলই আবার বলল, ‘এবার আর যাত্রা হবে না দাদা?’ 

-হবার তো কথা! এখন তো সবে মে মাস। সেপ্টেম্বর আসতে দাও, তখনই সবার হোলদোল শুরু হবে।

-ওই রিহার্সালের দিনগুলোই বড় সুন্দর। যেন মনে হয় জীবনে কিছু একটা করা গেল। বাকী সব দিন তো - থোড় বড়ি খাড়া...

বদ্রীপ্রসাদ মুখে বলতে পারলো না, সেও কীরকম উদগ্রভাবে চেয়ে আছে সেই দিনগুলোর আশায়! এবারও যদি এমন একটা রোম্যান্টিক নাটক ঠিক করা যায়, বেশ হয়! ঈশ্বর করুন যেন এবারও কাজলকেই কাষ্টিং করা হয়। নইলে সাধ হবে সব মিছে!

  বদ্রীপ্রসাদ নরম গলায় একটু যেন বেশী সাহস দেখিয়ে বলল, ‘আজকাল তোমার কথা খুব মনে হয় কাজল’!

-কী মনে হয়!

-এই তুমি অন্য কোথাও বিয়ে হলে বেশী সুখি হতে পারতে। তোয়ার ইচ্ছেগুলো পূর্ণ হতে পারতো! কার্ত্তিক তো ন্যালাখ্যাপা, ও কি তোমার ঠিকঠাক মূল্য দিতে পারে!

-অত ভাববেন না দাদা।

-ভাবনা এলে কী করি বলতো! ভাবতে চাইনা, তবুও আজকাল তোমার কথা খুব মনে হয়।

-একটা বিয়ে করলেন না কেন দাদা? সংসারে বউ বাচ্চার ঠেলা থাকলে বুঝতেন, বেকার ভাবনাগুলো কখন দৌড়ে পালাতো!

-তাই?

-হ্যাঁ। এমন কিছু বয়স নয় আপনার। তিপান্ন চুয়ান্ন বছরের পয়সা ওয়ালা লোক; মেয়ের অভাব হবে না। অবশ্য আপনাদের মারোয়াড়ী মেয়েরা এতদিন বিয়ে না করে বসে থাকে কিনা জানিনা!

-বসে থাকে না কেউ!

-তবে বাঙালী বিয়ে করে নিন। আপনার চাল চলন সবই বাঙালীদের মতো। বাংলা যাত্রা দলে পাঠ করে দিচ্ছেন, আর আপনার মারোয়াড়িত্ব কী বেঁচে আছে?

-সে জন্য নয়। যদিও আমাদের পরিবার গোঁড়া,তবু আমি বিয়ে করতে রাজী আছি শুনলে মনে হয় মা এখন আর বাঙালিতে আপত্তি করবে না।

-তাহলে রাজী হয়ে যান। আমরা মেয়ে দেখি।

-অত কষ্ট আর তোমাদের করতে হবে না কাজল! বিয়ে আমি করবো না।

-কেন? মনে হয় না একজন আপনার নিজের লোক থাকবে, সে আপনার কথা ভেবে সারাদিন পথ চেয়ে বসে থাকবে, আপনার বাচ্চা হবে, আপনার উত্তরাধিকার...

-এসব আমি ভাবি না কাজল। আমি আমার ভাবনায় মুক্ত থাকতে চাই। আমি যখন খুশী যাকে খুশী ভাবার স্বাধীনতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইনা।

-এমন কাকে আপনি ভাবেন দাদা যে বিয়ে করলে আপনার সে স্বাধীনতা চলে যাবে?

-ও আছে! তুমি বুঝবে না! সব থেকে বড় কথা, কেউ থাকুক বা না থাকুক – আমি সবার জন্য উন্মুক্ত, এই ভাবনাটা আমাকে খুশী দেয়।

-এলিজিবল ব্যাচেলার! ফোড়ন কাটলো কাজল।

-ঠিক বলেছো।

-জানেন দাদা, যারা এমনটা ভাবে - তাদের কিন্তু কোথাও নারী সম্পর্কিত মোহ আছে। ওরা ঠিক সন্ন্যাসী টাইপের নয়।

-সে কথা তো আমি অস্বীকার করছি না কাজল! সে মোহ আমার নিশ্চিত ভাবেই আছে। কিন্তু সেটা অন্য কিছুর বিনিময়ে নয়।

-বিয়ের একটা সুবিধাও আছে। আপনি নিজের সন্তান তৈরী করে যেতে পারেন ওতে। সে আপনারই রক্ত এবং সংস্কার নিয়ে এগিয়ে যাবে আগামী বছরগুলোয়। এটা তো মানুষের স্বাভাবিক একটা ইচ্ছে। স্বয়ং ঈশ্বরও তো এক থেকে বহু হওয়ার বাসনায় এই পৃথিবী গড়েছেন।

বদ্রীপ্রসাদ বুঝলো, কাজলের মধ্যে থেকে এক মাতৃসত্ত্বা এই কথা বলছে। ও বলল, বিশ্বাস করো, আমার ওসব একদমই মনে হয় না। বরং উল্টোটাই মনে হয়।

-উল্টো টা কি?

-উটকো ঝামেলা।

-জানেন দাদা, বহু মানুষ বলেন বিবাহ নাকি মানুষকে পূর্ণতা দেয়। এটা একটা অ্যাঙ্গেলে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া।

-তুমি নিজে কি এই তত্ত্ব বিশ্বাস করো, কাজল?

কাজল চুপ করে রইল। বদ্রীপ্রসাদ বললো, ‘দ্যাখো কেন কিজন্য বিয়ে করিনি তা আজ আমার কাছে তেমন করে ম্যাটার করে না। বরাবরই এটাকে আমি ঝামেলা ভেবে এড়িয়ে গেছি। কখনও যে নারীসঙ্গ পাওয়ার জন্য আমি প্রচুর উৎসুক ছিলাম সেটাও নয়। তবে তোমাকে তো অনেক কথা বলি কাজল, গতবছরের ঐ যাত্রাটা করার পর থেকে আমার জীবনের অনেক কিছু বদলে গেছে।

কাজল মিষ্টি হেসে বলল, কেন, ‘এখন কি বিয়ে করতে মন চাচ্ছে?’

-না না। বিয়ে করতে নয়। তোমার হয়ত খারাপ লাগবে শুনে, আমার কাউকে খুব নিবিড় করে পেতে ইচ্ছে করছে।

-আপনার ইচ্ছে যদি জেনুইন হয় এবং যাকে পেতে ইচ্ছে করছে সে যদি রাজী হয়, চেষ্টা তো করে দেখতেই পারেন! জীবন তো থেমে নেই। কখন ইচ্ছে বদলে যাবে, কেউ জানে?

বদ্রীপ্রসাদ মনে মনে যথেষ্ট লজ্জিত হয়েই ভাবলো, কাজল কি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছে? সেও কি তার সম্মতির আভাস পাঠাচ্ছে? নাকি এটা একটা সাধারণ উপদেশ? সে কুণ্ঠা নিয়ে বলল, বলতে সংকোচ হয় যে!

-সংকোচ বা লজ্জা যদি বড় হয়, তবে সে সম্পর্কে তালা মেরে দিন। কেন না বুক ফাটবে আর মুখ ফুটবে না - এমনটা তো পুরোনো কালের গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের শোভা পেত, আজকের পুরুষ-মানুষ তেমন ভাবলে কপালে দুঃখই লেখা থাকবে দাদা।

বদ্রীপ্রসাদ চুপ করে রইল। ওর থেকে হাত দুয়েক দূরেই একটা টুলের উপর কাজল বসে। একটা শস্তা ছাপা শাড়ী ওর পরনে। বুকের উপর থেকে অল্প একটুখানি আঁচলটা সরে আছে। ওর খুব ইচ্ছে হল কাজলকে একবার বুকে টেনে নেওয়ার। কাজল মাথা নীচু করে নিজের আঙুল খুঁটছে। ও ওর একটা হাত দিয়ে কাজলের ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে একটা আর্জি আছে কাজল’।

কাজল ক্ষিপ্র হরিণীর মতো ঘাড় তুলে বলল, ‘বলুন’।

-তোমায় একবার বুকে পেতে চাই! আসবে?

কাজল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। বদ্রীপ্রসাদ বলল, ‘বাইরের ছিটকিনিটা লাগানো আছে?’

কাজল ধীর পায়ে গিয়ে সদর দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে এসে দাঁড়ালো বদ্রীপ্রসাদের পাশে। বদ্রীপ্রসাদ তড়াক করে উঠে এক ঝটকায় কাজলকে টেনে আনলো নিজের বুকে। ওর ঘাড়ের কাছে মুখটা নিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ ওর কার্ত্তিকের মুখটা মনে পড়ল। ও যেন বলছে, ‘ছিঃ ছিঃ কত্তাবাবু! আপনিও আমাকে ঠকালেন।’ হঠাৎ করে ও কাজলকে ছেড়ে এসে বসল আগের চেয়ারটায়। কাজল বলল, ‘কী হল? চলে গেলেন যে!’

-থাক কাজল! কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

-আপনি যদি অন্য কারোর কথা ভেবে নিজেকে নিবৃত্ত করেন, সেটা আপনার দায়। আমার কিন্তু কোনও পাপবোধ বা খারাপ লাগা নেই।

-কেন নেই কাজল? থাকা তো উচিৎ!

-আমার দেহ এবং মনের অধিকার - সম্পূর্ণভাবেই আমার প্রসাদদা। এটা আমি কাকে দেবো না দেবো এটা একান্তভাবেই আমার বিষয়। এর জন্য খারাপ লাগা বা না লাগাটা তাই কোনও শর্তাধীন নয়! আপনি চাইলে এইমুহূর্তে আমার সবটুকু পেতে পারেন। এই বলে আলতো করে বদ্রীপ্রসাদের হাত ধরে টান দিল কাজল। বদ্রীপ্রসাদ মৃদুভাবে তা ফিরিয়ে দিল। বলল, ‘আমি জানি, তোমায় চাইলে এইমুহূর্তে তোমাকে পুরোটাই পেতে পারি, তাই না চাওয়ার দায়িত্বটা আমার উপরই বর্ত্তায়, কাজল!’

-বেশ তো! বসুন ওখানে। আমি দরজাটা খুলে দিয়ে আসি।

-আমি আজ যাই কাজল। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও আমার অসংগত ব্যবহারের জন্য।

-প্রথম কথা, আপনি এখন বসুন। চা খেয়ে যাবেন। আর দ্বিতীয় কথা, এই নিয়ে কোনও গ্লানি মনে পুষে রাখবেন না। যদি মনে করে থাকেন এটা আপনার সাময়িক একটা ভুল হয়ে গেছে তবে ওকে সাময়িক করেই রাখুন। নইলে সারাজীবন এটা আপনার পিছু ছাড়বে না।

-তবু! তুমি কিছু মনে করোনি তো?

-ধরুন মনেই করেছি! তাতে কি? আমার মনে করাটাও সাময়িকই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা আপনাকে আমি বিচার করি না, সুতরাং এই মনে করা করি নিয়ে আপনার আগামী দিনে কোনও সমস্যা হবে না। আমি রোজ দুবেলাই আপনার জন্য চা পাঠাবো। আপনিও মাঝে মাঝে আসবেন। এবার পূজোয় আমাকে কাষ্ট করলে আপনার বিপরীতে অভিনয়ও করবো। চাপ নেবেন না। বসুন, চা করে আনি।

 চা বানাতে রান্নাঘরের দিকে উঠে গেল কাজল। বদ্রীপ্রসাদ মাথটা নীচু করে চুপ করে বসে রইল। নিজেকে এই মুহূর্তে কার্ত্তিকের মতোই ন্যালাখ্যাপা মনে হল তার। ঠিক এখন তার কী করা উচিৎ সেই উপদেশটুকু যদি দিয়ে যেত কাজল, বড় খুশী হত সে।    

Post a Comment

1 Comments

  1. ভাস্কর সেনDecember 22, 2024

    শেষ অংশে অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স এসেছে বলে গল্পটি অধিকাংশ পাঠকের কাছে আদৃত হবে বলে মনে হয়। সুলিখিত গল্প।

    ReplyDelete